#হঠাৎ_বসন্তে
#লেখনীতে:সারা মেহেক
#পর্ব:৪(শেষ)
“প্রিয় অপরিচিতা,
এ সম্বোধনটি আমার বেশ প্রিয়। ভার্সিটি জীবনের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের ‘অপরিচিতা’ গল্পটি পড়ার সময় নামটি আমার মনে ধরেছিলো। কোনো এক কারণে তৎক্ষনাৎ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই যে, কোনো একদিন কোনো এক রমনীকে এ নামে ডাকবো আমি। তবে সে রমনীকে এ নামে ডাকবার উপযুক্ত কোনো কারন খুঁজে পায়নি আমি। সেসময় নিজের কাছেই নিজে বোকা বনে গেলাম। ভাবলাম, একুশ শতকের এ যুগে এসে আমি কোনো রমনীকে বিনা কারনে এমন নামে সম্বোধন করবো, আর সে আমাকে জুতার বাড়ি দিবে না, এমনটা হতেই পারে না। এ কারনেই আমি সেই সুপ্ত ইচ্ছাটাকে মনের এক কোনে মাটিচাপা দিয়ে দেই। এই সুপ্ত ইচ্ছা যে হঠাৎ বসন্তে আবারো এভাবে জাগ্রত হয়ে যাবে তা কখনো ভাবিনি আমি।
রবীন্দ্রনাথের গল্পে অনুপমের কাছে কল্যাণী যেমন অপরিচিতা রয়ে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের গল্পে আপনি আমার কাছে অপরিচিতা রয়ে গেলেন। পার্থক্য শুধু একটাই। গল্পে অনুপম, কল্যাণীর নামটা জানতো, কিন্তু এক্ষেত্রে আমি আপনার নামটা জানি না৷ জানার সুযোগটাও নেই হয়তো। মস্ত বড় ঢাকা শহরে এতো কোটি মানুষের মধ্যে সেই অপরিচিতাকে খুঁজে পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? তবে জানেন কি? এ অসম্ভব কাজটিকে আমি সম্ভব করতে চাই। অন্তত চেষ্টাটা করা যেতে পারে। সে চেষ্টার ফল পাবো কি না সেটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম।
জানেন অপরিচিতা? আজকের দিনটি আমার কাছে সারাজীবনের জন্য স্মরনীয় হয়ে থাকবে। অদ্ভুতভাবে আজকের দিনটি আমার মনের দুয়ারে কোনো এক সংবাদ নিয়ে এসেছে। আমি ভেবেচিন্তে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি, সে সংবাদটা কি। কিন্তু এই আন্দাজের উপর ভিত্তি করে সবটা তো বলে দেওয়া যায় না৷ এজন্য আমি অপেক্ষা করবো, সেই দিনটির জন্য যে দিন আমি মনের দুয়ারে কড়া নেড়ে যাওয়া সেই সংবাদটি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হবো। ততদিন থাকুক না সে অনুভূতিগুলো মনের এক কোনে। বিস্তৃতি হতে থাকুক পুরোটা মন মস্তিষ্ক জুড়ে।
ইতি,
নামহীন এক যুবক।”
এটুকু লিখে নিজস্ব ডায়েরি হতে পাতাটা ছিড়ে ফেললো নির্ভয়। এরপর অতি যত্নে ভাঁজ করে তা রেখে দিলো মানিব্যাগের মধ্যে। এখানে রাখার উদ্দেশ্য একটাই, কোনো এক প্রহরে, কোনো এক মূহুর্তে সেই অপরিচিতা হঠাৎ তার সামনে চলে আসবে এবং সে ছোট্ট এই চিঠিটি এগিয়ে দিয়ে বলবে,
” জনাব নির্ভয় আপনার জন্য একটি চিঠি নিয়ে এসেছে তার হৃদয়ের ডাকঘর হতে। অনুগ্রহপূর্বক চিঠিটা গ্রহন করে আমাকে বাধিত করুন।” এই ভাবতে ভাবতে নির্ভয় হেসে ফেললো। সে যে সত্যিই কিছু একটা খোয়াচ্ছে তা দিব্যি বুঝতে পারছে সে। আফসোস, এ জানার পরও সে নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না। সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার!
নির্ভয় মানিব্যাগটা রেখে আবারো ডায়েরির পাতায় কলম ঘুরালো,
” আজ বসন্তে প্রতিটি পত্রপল্লব যেমন নতুন সাজে সজ্জিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি আমার মনটা নতুন কোনো অনুভূতিতে সজ্জিত হচ্ছে। আমি নিজের এ কাণ্ডে বেশ অবাক হয়েছি বটে। কয়েক ঘন্টার পরিচয়ে এমন কিছু টান, কিছু অনুভূতির সাথে পরিচিত হবো, তা ভাবতেও পারিনি। মেয়েটির সাথে পরিচিয় কয়েক ঘণ্টার। অথচ সে আমার মনে এমন তোলপাড় তুলে দিয়ে যাবে তা ঘুনাক্ষরেও ধারনা করতে পারিনি আমি।
অদ্ভুতভাবে মেয়েটির পরনের শাড়ী সর্বপ্রথম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধানমন্ডি লেকের শত শত মানুষের মাঝে আমার চোখ আটকে যায় তার পরনের শাড়ীর আঁচলে। হলদে, কমলা, লালসহ আরো দু একটা রঙের সংমিশ্রণে তৈরী সে শাড়ীর আঁচলটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর ছিলো। একদম নজরকাড়া, অতুলনীয় সুন্দর যাকে বলে। কিন্তু এ সৌন্দর্যের কোনো কদরই ছিলো না সেই অপরিচিতার কাছে। স্নিগ্ধ সে আঁচলটা দিব্যি রাস্তার ধুলোবালি, ময়লাগুলো নিজের মাঝে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ অপরিচিতার কোনো হেলদোলই নেই এতে। আমি যখন তাকে বললাম এ ব্যাপারে, সে কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। পর মূহুর্তেই অবশ্য সে তার সম্পূর্ণ ধ্যানমগ্ন বিলিয়ে দেয় তার শাড়ীর আঁচলের উপর।
এ শাড়ীর আঁচল নিয়ে বেশ লম্বা, উহু, ছোটোখাটো একটা কাহিনি আছে। তবে এখন তা লিখতে মন চাইছে না। অন্য কোনোদিন না হয় সে ঘটনা স্মৃতিচারণা হিসেবে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখবো। আজ লিখবো তার সাথে ঘণ্টা দুয়েক কাটানো সময়ের কথা।
প্রথমে তাকে যখন অনুরোধ করলাম আমার সাথে সময় কাটানোর সে হয়তো মনে মনে বেশ অবাক হয়েছিলো। আমি এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম যে, সে আদৌ আমাকে সময় দিবে কি না। আমার এ সন্দেহকে সে বেশ ভদ্রভাবে দূরে ঠেলে দিয়েই আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো। এরপর আর আমার খুশি দেখে কে। মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বাইরে সবটাই স্বাভাবিক দেখিয়েছি।
অপরিচিতার সাথে প্যাডেল বোটে উঠা, ফুচকা খাওয়া, এ দুটোতেই সময় চলে গিয়েছে। মন চাইছিলো আরো কিছু সময় কাটিয়ে দেই৷ কিন্তু ভাগ্যে তা ছিলো না৷ তবে সে ক্ষুদ্র সময়কেই আমি আমার মনের গভীরতা দিয়ে খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পেরেছিলাম। এতে কোনো সন্দেহ ছিলো না যে, আজকের দিনটা আমার অনেক অনেক স্পেশাল কেটেছে। এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলো কাউকে বলবার মত নয়। আবার বলবার মত হলেও, শুনবার মত মানুষটা নেই।এজন্যই তো ডায়েরির পাতায় লিখে মনের শান্তি মিটিয়ে চলছি। ”
এটুকু লিখে নির্ভয় ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ডায়েরি হতে মুখ তুলে সামনের জানালার দিকে তাকালো। চারপাশের পরিবেশ কালো রঙে সম্পূর্ণভাবে আবৃত করে নিয়েছে নিজেকে। রঙবেরঙের দালান-কোঠাও নিজেদের শরীরে কালো রঙ মেখে রাতের আঁধারের সাথে হারিয়ে যেতে চাইছে। তবে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে বাঁধা দিচ্ছে প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বলন্ত বাতিগুলো। নির্ভয় খানিক সময় চোখজোড়া বন্ধ করে চারপাশের নিস্তব্ধতাকে গভীরভাবে অনুভব করলো। সে উপলব্ধি করতে পারছে, আঁধারের এ নিস্তব্ধতা তাকে কিছু প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছে। যার কোনোটিরও উত্তর তার জানা নেই। বলা বাহুল্য, সবগুলো প্রশ্নই সেই অপরিচিতাকে ঘিরে জেগে উঠছে। ‘সেই অপরিচিতার জন্য কি অপেক্ষা করবে তুমি?’, ‘অপেক্ষাই বা করবে কেনো?’, ‘কি আশায়? কি মনে করে?’, ‘ অপরিচিতার সাথে দেখা হলে কি করবে তুমি?’, ‘যদি অপরিচিতা অন্য কারোর হয়ে থাকে, তবে তো এ অপেক্ষা বৃথা যাবে। মানতে পারবে তুমি?’। এতক্ষণ যাবত সব প্রশ্ন মাথায় ঠিকঠাক ঘুরপাক খেলেও শেষের প্রশ্নটি তার পুরো শরীরে ঝিম ধরিয়ে দিলো। চট করে চোখ মেলে সামনের দিকে তাকালো সে। লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস ফেলে ডায়েরি এবং কলম তাদের নিজস্ব স্থানে রেখে দিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পরলো সে। এসব ব্যাপারে আর ভাবতে পারছে না সে। কেমন যেনো সব শূন্য হয়ে আসছে। ভাবনা শক্তিও যেনো লোপ পেয়ে বসেছে। আপাতত এসব নিয়ে না ভেবে ঘুমিয়ে যাওয়াই সমীচীন হবে বলে চোখ বুজে রইলো নির্ভয়। তবে ঘুম তার চোখে পুরোপুরি ধরা দিলে তো….. চোখ বন্ধ অবস্থাতেও বারংবার সেই অপরিচিতার চেহারা ভেসে উঠছে তার আঁখিজুগলের সামনে। কি স্নিগ্ধ, মায়াবী সে মুখখানা! কি মিষ্টি সেই হাসি! কি দারুণভাবে শাড়ীর সাথে মানিয়েছে তাকে!
.
পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র মন বসছে না রুহির। মনটা বারবার ছুটে চলে যাচ্ছে ধানমন্ডি লেকে। বড্ড দুষ্টু এ মনটা। মোটেও সামলে রাখা যায় না তাকে।
রুহির মন মস্তিষ্ক জুড়ে এখন শুধুমাত্রই সেই নামহীন যুবকটি বিরাজ করছে। যার ছোট্ট ছোট্ট ভদ্রতাজনক ব্যবহার যে কাউকেই তার উপর মুগ্ধ করে দিতে বাধ্য করবে। রুহির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ সেও তো অচেনা সেই যুবকটির উপর মুগ্ধ হয়েছে। না চাইতেও৷ অদ্ভুতভাবে তার মনটা সেই যুবককে চিনতে চাইছে, জানতে চাইছে, খুব কাছ হতে অনুভব করতে চাইছে। কিন্তু…….এসবের সুযোগ কোথায়? সে না জানে যুবকের নাম, না জানে ঠিকানা, জানে শুধু তার চেহারার গঠন। তা জেনে কি লাভ? মস্ত বড় ঢাকা শহরে একজনের চেহারার গঠন থেকে কি করে তাকে বের করা সম্ভব? মোটেও সম্ভব নয়। অবাস্তব হয়ে যায় সবটা। কিন্তু তার যে মন চাইছে সে যুবটিকে আরেকবার দেখার, তার সাথে আরো কিছু সময় কাটানোর। কি করবে সে? মনের মধ্যে বড্ড অস্থিরতা অনুভব করছে সে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার ভেতরটা। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হওয়ার আশায় তার মনটা অপেক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু এ অপেক্ষার কারণ কি? অর্থ কি? সেই অচেনা যুবকটির মতই কি তবে নামহীন এ অপেক্ষা?
আর ভাবতে পারছে না রুহি। দু-হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে খানিক সময় চেয়ারে বসে রইলো সে। কিছুক্ষণ বাদে এলোমেলো পায়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ চাঁদকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো সে। তার সকল অস্থিরতা, সকল ব্যাকুলতা এই রূপালী চাঁদটিই দূর করতে পারে।
.
.
‘সময় ও স্রোত কারোর জন্য থেমে থাকে না’ এ উক্তিটি সবার ক্ষেত্রে হয়তো প্রযোজ্য নয়। উদাহরণ হিসেবে রুহি এবং নির্ভয়ের নাম নেওয়া যায়। তাদের দুজনের গত চারটা মাস থমকে থাকার মত কেটেছে। তাদের সময়টা কাটেনি, বরং সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই যেনো থমকে আছে। অনুভূতি, অপেক্ষা সবটাই থমকে আছে সেই ফেব্রুয়ারিতে।
সেদিনের পর থেকে নির্ভয় যত উপায়ে তার অপরিচিতার খোঁজ করতে পারা যায়, ঠিক তত উপায়ে খোঁজ করেছে৷ কিন্তু বিধি বাম। সেই অপরিচিতার কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি৷ কিভাবে পায়নি সে জানে না। সে শুধু জানে, নিজেসহ কয়েকজন পরিচিত কয়েকজনের সাহায্য নিয়েও সে অপরিচিতাকে খুঁজে পায়নি।
রোজ রোজ নির্ভয়ের চোখজোড়া অপরিচিতাকে খুঁজে বেড়ায়। তার মন বলে, এই হঠাৎ করেই অপরিচিতা সেই শাড়ীটি পরে তার সামনে এসে তাকে চমকে দিয়ে বলবে,
” আজ থেকে আর লুকোচুরি নয়। চলুন, দুজন এ ব্যস্ততাময় কোলাহলপূর্ণ শহর হতে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই।”
কিন্তু এমন কিছুই হয় না৷ উল্টো দিন দিন অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে। এতোদিনেও সে এ অপেক্ষা করার কোনো উপযুক্ত কারন বের করতে পারেনি। পারেনি বললে ভুল হবে। সে ইচ্ছা করেই এর কারণ বের করেনি। কারন সে ভয়ে থাকে, এর কারন খুঁজতে গিয়ে যদি অবাস্তব, অযৌক্তিক কিছু কারন বেড়িয়ে আসে তখন কি হবে? এর চেয়ে বরং না খোঁজাই শ্রেয়। অপেক্ষা করুক না সে….যদি ভাগ্যের ফেরে এ অপেক্ষার ফল হিসেবে মিষ্টি কিছু পায় সে। তবে ক্ষতি কি তা তে?
আজ পহেলা আষাঢ়। প্রকৃতি তা মেনেই পূর্ণ উদ্যোমে বৃষ্টি বর্ষণ করার পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে৷ সকাল হতেই দূর আসমানে দেখা মিলছে ধূসর কালো মেঘের ঘনঘটা। যেকোনো সময়ই যে ঝমাঝম বৃষ্টি নেমে পরবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ রুহি জরুরি কিছু জিনিস কেনাকাটা করার জন্য একাই বেড়িয়েছে আজকে। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখে সে ছাতা নিয়েও বেড়িয়েছে। কিন্তু আকাশের মেঘেদের দলকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা এ ছাতার সামনে হার মানবে না। তবে রুহিও কম নয়৷ সময়মত হোস্টেলে পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করেই সে বেড়িয়েছে। অবশ্য এর মাঝে বৃষ্টি এলে অন্য কথা।
রুহি কেনাকাটা শেষ করে বাসস্টপে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। তার দাঁড়ানোর এক মিনিটের মাথায়ই ঝমাঝম বৃষ্টি শুরু হলো। যে বাসস্টপ কিছুক্ষণ আগেও খালি ছিলো, সে বাসস্টপ এখন আশেপাশের লোকজনে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। যাদের সবাই নিজেদেরকে কনকনে ঠান্ডা পানির বৃষ্টি হতে রক্ষা করতে চাইছে। এতো ভীড়ের মাঝে বেশ অস্বস্তি লাগছে রুহির। সে না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে। অগত্যাই চোখমুখ কুঁচকে চেহারায় বিরক্তির একটা ভাব এনে বাসস্টপের ছাউনির কোনার দিকটায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার দৃষ্টি ঘুরাঘুরি করছে বাহিরের বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে। তার মন চাইছে, বৃষ্টির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। কিন্তু এ ইচ্ছাটা এখানে অপূর্ণই রাখতে হবে।
হঠাৎ রুহির চোখ আটকে গেলো অদূর হতে আসা এক যুবকের উপর। কালো রঙয়ের একটা ছাতা সহিত যে যুবকটি আসছে সে যুবকটি তার পরিচিত মনে হচ্ছে। চেহারাটা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তুমুল বর্ষনের জন্য যুবকের চেহারা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। তবে তার মন বলছে, এই যুবকই সে, যাকে তার আঁখিজুগল এতোদিন যাবত খুঁজছে। আসলেই কি সে?
ধীরেধীরে যুবকটি এগিয়ে আসছে। ক্রমশ তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে আসছে। হ্যাঁ, এবার চেনা যাচ্ছে তাকে।
যুবকটি রুহির কয়েক হাত সামনে আসতেই রুহির বুক ধক করে উঠলো। পুরো শরীরে ঝিম ধরে গেলো। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে এলো। এই সেই অচেনা যুবক যাকে দেখার আশায় চারটা মাস কাটিয়েছে সে। রাস্তায় বের হলে তার ক্লান্ত, অতৃপ্ত, পিপাসু দৃষ্টিজোড়া খুঁজেছে যাকে, এই সেই যুবক। তাহলে কি এতোদিনে সে অজানা অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো?
এদিকে নির্ভয় বিস্মিত এবং নিষ্পলক চাহনিতে রুহিকে দেখে চলছে। তার বিস্ফোরিত নয়নজোড়া কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না যে, চার মাসের অপেক্ষার পর সে তার অপরিচিতাকে খুঁজে পেয়েছে। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝামাঝি ঝুলে আছে সে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার মাঝে, যা বর্ণনা করার মত নয়।
রুহির মন বলছে, সামনের দিকে এগিয়ে যাও। কিন্তু তার পা জোড়া সায় দিচ্ছে না এতে। অতি খুশিতে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আজ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। না বলা কিছু কথা বলতে হবে সেই যুবককে। তাকে শোনাতে হবে নিজের অপেক্ষার প্রহরগুলির কথা।জানতে হবে যুবকটির মনের কথা। এসব ভেবে বেশ কষ্টেসৃষ্টে পা এগিয়ে ভীড়ের মাঝ হতে বেড়িয়ে এলো রুহি। নির্ভয় বাসস্টপ হতে অল্প কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রুহি যতই নির্ভয়ের দিকে এগুচ্ছে ততই তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ বেড়ে চলছে।
এক সময় ছোট ছোট পা ফেলে রুহি নির্ভয়ের অনেকটাই কাছে চলে এলো। যদিও দুজনের আলাদা আলাদা ছাতার জন্য দুজন দুজন হতে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এ দূরত্ব দুজনের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠা তৃপ্তিময় হাসির কাছে কিছুই না৷
এতোটা লম্বা প্রহর পর অচেনা মানব মানবী দুটো বাকশূন্য হয়ে পরেছে। আগ বাড়িয়ে কিছু বলার মত সাহস পাচ্ছে না তারা। শুধু অনুভব করতে পারছে মনের মাঝে বয়ে যাওয়া তোলপাড়ের শব্দকে। হঠাৎ নির্ভয় হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। কিন্তু এ শব্দ রুহির কান অব্দি পৌঁছালো না। তার কান অব্দি শুধু পৌছাচ্ছে নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ এবং প্রকৃতিকে সতেজ করে তোলা তুমুল বারিপাতের শব্দ।
রুহি দৃষ্টিজোড়া নিচে নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ভয় তা দেখে হালকা হাসলো। এরপর আবারো গলা পরিষ্কার করে রুহির দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
” আমি নির্ভয়৷ আপনি? ”
রুহি চট করে মাথা তুলে তাকালো। অচেনা এ যুবকটির নাম তাহলে নির্ভয়। নামটা শুনে কেমন এক শীতল অনুভূতি বয়ে গেলো শরীর জুড়ে। এবার তো তার নাম বলার পালা। বলবে কি? সাহসে তো কুলাচ্ছে না৷ কিন্তু বলতে তো হবে।
অতঃপর রুহি এক মিনিট সময় নিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে তার দিকে এগিয়ে রাখা নির্ভয়ের হাতটা আলতো স্পর্শ করলো। মূহুর্তেই পুরো শরীরে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হাতজোড়াও অনুভূতি শূন্য হয়ে এলো। তবুও বেশ কষ্টেসৃষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে লাজুক হাসি দিয়ে সে বলল,
” আমার নাম রুহি। ”
নির্ভয় মুচকি হাসলো। রুহিকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলল,
” আপনার নাম বরং অপরিচিতা হলে মন্দ হয় না৷”
রুহি, নির্ভয়ের কথা বুঝতে পারলো না। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নির্ভয়ের দিকে তাকাতেই নির্ভয় তার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্যান্টের পকেট হতে মানিব্যাগটা বের করলো। অপর হাতে থাকা ছাতাটা কাঁধের সাথে আটকে দু হাত দিয়ে মানিব্যাগ হতে সেই চিঠিটা বের করলো। এই সেই চিঠি, যে চিঠিটা গত চার মাস অপরিচিতার অপেক্ষা করতে করতে কখনো বৃষ্টির পানিতে ভিজে, তো কখনো সময়ের স্রোতে ভেসে নিজেদের মাঝেই কালিতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। ফলস্বরূপ গুটিকয়েক লেখাও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটা নির্ভয় জানতো। সে চাইলেই চিঠির কাগজ পরিবর্তন করতে পারতো। কিন্তু সে করেনি। কারণটা খুবই সাধারণ তবে গভীর। সে চেয়েছিলো, তার অপরিচিতা তার এ চিঠির অবস্থা দেখে তার কষ্টের অপেক্ষার প্রহর সম্পর্কে ধারনা করবে৷ নিজেকে ওয়াদা করবে যে, নির্ভয় নামক এ যুবককে আর কখনো অপেক্ষা করাবে না সে।
নির্ভয় হাসি হাসি মুখে রুহির দিকে চিঠিটা এগিয়ে দিলো। চিঠি হাতে পেয়ে রুহি তৎক্ষনাৎ তা খুলে দেখলো। শুরুতেই ‘ অপরিচিতা’ সম্বোধন দেখে চমকে উঠলো সে। সাথে সাথে গর্জে উঠলো মেঘেদের এক দল।
চিঠিটা পড়া শেষ হতেই রুহি লাজুক চাহনিতে নির্ভয়ের দিকে তাকালো। নির্ভয়ও বিনা বাক্যব্যয়ে তার অপরিচিতাকে কিছু বললো। যা শুধু তার অপরিচিতাই শুনতে পাচ্ছে। বাইরের মানুষজন নয়। তারা তো শুনতে পাচ্ছে বৃষ্টির প্রতিধ্বনি। যা আগলে রাখছে দুজন যুবক যুবতির কিছু না বলা অনুভূতির কথা।
অবশেষে হঠাৎ বসন্তে শুরু হওয়া সে কাহিনি পূর্ণতা পেলো হঠাৎ বর্ষায় এসে।
———-সমাপ্ত————–
(আসসলামু আলাইকুম। সবাই সালামের জবাব দিবেন।
ছোট্ট এ গল্পটি পড়ে কেমন লেগেছে তা জানাতে ভুলবেন না কেউ৷ ধারাবাহিক গল্প আগামী মাসে শুরু করার ইচ্ছা আছে। তবে একটু দেরিতে। ততদিনে এমন ছোট গল্প, অনুগল্প চলতে থাকবে। এরপর হয়তো #সারিশ_জুটির_প্রেমময়_প্রহর দিব। ততদিন ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন আমার জন্য। আল্লাহ হাফেজ। ❤️)