#হঠাৎ_বসন্তে
#লেখনীতে:সারা মেহেক
#পর্ব:২
নির্ভয় রুহির পিছু পিছু ছুটে গেলো। রুহির অনেকটা কাছে আসতেই সে রুহির অজান্তে সেই শাড়ীর আঁচলের এক কোনা মাটি থেকে তুলে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।
এদিকে রুহি আনমনে হেঁটে চলছে, ওদিকে নির্ভয় রুহির পিছু পিছু শাড়ীর আঁচল তুলে হেঁটে চলছে। এ যেনো কোনো সিনেমার দৃশ্য! নির্ভয় নিজের এমন কাজে হালকা হেসে মিনমিন করে রুহির উদ্দেশ্যে বলল,
” এই যে মিস, আপনার শাড়ীর আঁচল আবারো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।।”
অল্প পরিচিত, চেনাজানা এক কণ্ঠস্বর শুনে রুহি চট করে পিছনে ফিরে তাকালো। নির্ভয়কে দেখে সে বিস্মিত হলো। তবে তার বিস্ময়ের মাত্রাটা আরো বেড়ে গেলো নির্ভয়ের হাতে নিজের শাড়ীর আঁচল দেখে। সে আঁচলের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। এরপর চট করে নির্ভয়ের হাত থেকে আঁচল নিয়ে খানিকটা ধমকের সুরে বলল,
” আপনার সাহস তো কম না! আপনি আমার শাড়ীর আঁচল ধরেছেন!”
নির্ভয় কিছু বলতে যাবে, কিন্তু এর আগেই তাদের পাশ দিয়ে একজন অপরিচিত যুবক যেতে যেতে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে উঠলো,
” কিপ গোয়িং ভাই। আস্ত একটা রোমান্টিক মুভির সিন ছিলো। ভাবী তো সেই লাকি।” এই বলে সে হাসতে হাসতে চলে গেলো। ছেলেটির কথা শুনে রুহি বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। সে গরম চোখে নির্ভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনার মতলবটা কি, বলুন তো। এক শাড়ীর আঁচলের পিছনে আপনি পরে আছেন কেনো? কি মতলবে আমার কাছে এসেছেন বলুন৷ তবে হ্যাঁ, যে-ই মতলবে আসুন না কেনো, আপনার মতলব আমি পূরণ হতে দিবো না। আমাকে অবলা নারী ভেবে থাকলে ভুল করছেন মিস্টার।”
রুহির কথাবার্তায় নির্ভয় বেশ ভড়কে গেলো। সে বুঝতে পেরেছে, রুহির কথাবার্তা কোন পথে যাচ্ছে৷ তবে সে সেটা রুহিকে বুঝতে না দিয়ে সে হালকা হেসে বলল,
” আমার কোনো মতলব নেই মিস। আমি যাস্ট আপনার শাড়ীর রঙের প্রেমে পরেছি। এই স্নিগ্ধ আঁচলটা এতো ধুলোবালি সহ্য করছে, সেটা ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছে। এজন্য তাকে বাঁচাতে আমি ছুটে চলে এসেছি।”
রুহি চোখ বড় বড় করে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি বললেন আপনি! আপনার সাহস তো কম না। এভাবে চেনা নেই, জানা নেই, এমন একটা মেয়েকে এ কথা বললেন কি করে! আপনি তো মানুষটা সুবিধার নন। নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করছিলেন আগে থেকে। আর আজ সুযোগ বুঝে……” এই বলেই রুহি ভেঙচি কেটে চট করে মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। নির্ভয়ের কথাবার্তা তার মনে এখন অজানা এক শঙ্কা ঢুকিয়ে দিয়েছে। নির্ভয়ের এমন আচরণ তার কাছে বেশ সন্দেহজনক ঠেকছে। এমন মানুষের সাথে আর কথা বাড়ানো উচিত নয় ভেবেই সে হাঁটা শুরু করলো। এদিকে নির্ভয়ও কম নয়। সে আবারো রুহির পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলো। কয়েক কদম হাঁটার পর সে রুহির পাশে এসে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে লাগলো।
নির্ভয়কে নিজের পাশাপাশি হাঁটতে দেখে রুহি ভেতরে ভেতরে বেশ ভয় পেলো। কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ না করে পা চালিয়ে যেতে যেতেই দৃঢ়চিত্তে বললো,
” আমাকে বাধ্য করবেন না মানুষ জড়ো করতে। ”
রুহির কথায় নির্ভয় বিচলিত হলো না। বরং চোখেমুখে হাসির ছটা নিয়ে সে বললো,
” পুরো দুনিয়াকে এভাবে অবিশ্বাস করলে কিভাবে চলবেন? সবার উপরই একটু না একটু আস্থা রেখে চলতে হয়। আমি বলছি না যে, অন্ধবিশ্বাস করুন। কিন্তু এমনভাবে বিশ্বাস করুন যাতে মানুষটি আপনাকে ঠকালেও আপনার আফসোস না হয়।”
রুহি সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলো,
” আপনি কি বলতে চাইছেন?”
নির্ভয় আবারো হাসলো। বললো,
” আপনি নিঃসন্দেহে আমার উপর বিশ্বাস করতে পারেন। আমার দ্বারা কোনো ক্ষতি হবে না আপনার। অবশ্য এতো ভিড়ভাট্টার মধ্যে ক্ষতি করা সম্ভব না কারোর পক্ষে। করলেও গণধোলাই হতে সে নিস্তার পাবে না৷ আমার নিজের জানপ্রাণ নিয়ে মায়া আছে। আমি এসব চাই না।” এই বলে সে সশব্দে হেসে উঠলো। সাথে হেসে উঠলো রুহিও। তবে নিঃশব্দে।
রুহির এ হাসিই নির্ভয়কে চিন্তামুক্ত হতে ইশারা করলো। সে বুঝতে পেরেছে, রুহির মনে আপাতত তার জন্য সেই সন্দেহটা নেই৷ এতে সে মনে মনে বেশ খুশি হলো।
খানিক বাদে, নির্ভয়, রুহিকে জিজ্ঞাস করলো,
” আপনার কোনো তাড়া আছে?”
রুহি বুঝতে না পেরে বললো,
” ঠিক বুঝলাম না৷ কিসের তাড়ার কথা বলছেন?”
” এই যে বাসায় যাওয়ার….”
” বাসায় না, হোস্টেল। আপাতত তাড়া নেই। সময়মতো পৌঁছাতে পারলেই হলো।”
এবার নির্ভয় খানিকটা ইতস্ততভাবে জিজ্ঞাস করলো,
” আমাকে আপনার মূল্যবান কিছু সময় দেওয়া যাবে?”
রুহি নির্ভয়কে সন্দেহ করলো না ঠিক। তবে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাস করলো,
” কি করবেন আমার সময় নিয়ে?”
নির্ভয় বোকাসোকা হাসি দিয়ে মাথার পিছনের চুলগুলো হালকা হাতে নেড়েচেড়ে বললো,
” এই তো ঘুরবো একটু। ”
রুহি নির্ভয়ের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” যদি আপনার প্রস্তাবে রাজি না হই তবে?”
নির্ভয় খানিকটা হতাশ হলো। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” আজকের বিকেলটাই বৃথা যাবে আমার। মনে হাজারো কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরে যেতে হবে।”
নির্ভয়ের কথাবার্তার ধরন দেখে রুহি ফিক করে হেসে ফেললো। বললো,
” আপনার বিকেলটা বৃথা হতে দেই কি করে, বলুন…। আরেকটু সামনে গিয়ে বসি চলুন।”
নির্ভয় বেশ খুশি হলো। চোখেমুখে হাসিখুশি এবং উৎফুল্ল ভাব এনে বললো,
” আচ্ছা চলুন।”
নির্ভয় এবং রুহি ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার ধারের ঘাসের উপর বসে পরলো। আশেপাশে অনেক মানুষজনই রয়েছে। অধিকাংশই প্রেমিকযুগল। ব্যতিক্রম হিসেবে কয়েকজন বন্ধু বান্ধবীসহ এসেছে।
রুহি এবং নির্ভয় একধ্যানে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। কারোর মধ্যে কোনোরূপ কথাবার্তা চলছে না। অনেকক্ষণ যাবতই দুজন চুপচাপ। খুব বেশিক্ষণ নিরবতার এ দেয়াল সইতে না পেরে নির্ভয় শেষমেশ কথা বলেই ফেললো। রুহিকে সে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি মনে হয়, সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় এখানে এসেছেন, ঠিক না?”
নির্ভয়ের প্রশ্নে রুহির মনোযোগ ছেদ পরলো। সে তো বেশ যত্নে লেকের পানি দেখে চলছিলো। কি সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ খেলা করছে পুরো লেক জুড়ে! এ সামান্য দৃশ্যই তার নিকট অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন লাগছে। এজন্য এ দৃশ্য অবলোকনে নির্ভয়ের ব্যাঘাত ঘটানোয় খানিকটা বিরক্ত বোধ করলো সে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে সে বললো,
” জি। আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় এবং আমার বান্ধবী দুটোর সম্পূর্ণ ইচ্ছায় এখানে আসা হয়েছে। ওরা এতো জোর না করলে আসতাম না। অবশ্য আমি তো জানতাম না যে, ওরা আমাকে এভাবে একা রেখে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে চলে যাবে।”
নির্ভয় এর প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। তবে রুহি তাকে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি একা একাই ঘুরতে এসেছেন এখানে?”
নির্ভয় স্মিত হাসলো। লেকের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
” এর জবাব হ্যাঁ আবার না-ও।”
রুহি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
” ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।”
” আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে এসেছিলাম। সে আপাতত তার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বিজি। অবশ্য সে আগে থেকেই আমাকে বলে রেখেছিলো এটা। আবার ও না আসলেও আমি আসতাম ঠিকই। এমন উৎসব উদযাপন করতে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঠিকই ঘুরে বেড়াতাম আমি। অফিসের কাজের চাপে এমন ছোটখাটো উৎসব উদযাপন করার মধ্যে আলাদা এক ধরনের মজা আছে। এজন্য আমি সুযোগ পেলেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এমন উৎসবে ঘুরে বেড়াই। তো…প্রথম ক্ষেত্রের জবাব হলো ‘না’ এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রের জবাব হলো ‘হ্যাঁ’।”
এরপর আবারো দুজনের মাঝে নিরবতার দেখা মিললো। খানিক বাদে রুহি বলে উঠলো,
” সূর্যাস্ত হতে আর সম্ভবত দু ঘণ্টা বাকি আছে। আমাকে সময়মতো হোস্টেলে পৌঁছাতে হবে।”
নির্ভয় এবার ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
” প্যাডেল বোটে উঠবেন?”
®সারা মেহেক
#চলবে