হঠাৎ হাওয়া, পর্ব:৭+৮

0
889

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০৭

রিকশা চলছে ধীরগতিতে। ফারহান আর নিরু বিভিন্ন কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে আছে দুজনেরই। আর দূর থেকে একজন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তার রাগ ওদের প্রতি নয় বরং নিজের প্রতি।

ওরা চোখের আড়াল হতেই ব্যক্তিটিও সেখান থেকে সরে গেল।

দশ মিনিট বাদেই নিরু আর ফারহান বাসায় ফিরে এল। ফ্রেশ হয়ে দুজনেই মায়ের সাথে বসে লাঞ্চ করে নিল। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ফারহান অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। আর নিরু রুমে বসে আছে। ওর শাশুড়ি ঘুমিয়েছেন।

ফারহান বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনো রিকশা না পেয়ে হাঁটতে লাগলো। দুপুরবেলা তাই রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। দু’মিনিট হাঁটতেই একটা মেয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। ফারহানের মেয়েটাকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না।

মেয়েটা একটু হেসে বললো, “কেমন আছেন?”

ফারহান কপাল কুচকে বললো, “আপনি?”

“ওহ, চিনতে পারলেন না? অবশ্য মনে রাখার মতোই কেউ নই আমি। যাইহোক পরিচয়টাই না-হয় আগে দিয়ে নিই। আমি শ্রাবণী।”

ফারহান এবার বুঝতে পারলো মেয়েটা কে। এই তো সেই শ্রাবণী যার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তখন দু-এক বার দেখা হয়েছিল তাই চেহারাটা তেমন মনে নেই। নামও তো ঠিকভাবে মনে ছিল না। এখন শুনে মনে পড়েছে।

ফারহান সৌজন্যমূলক হেসে বললো, “জ্বি, চিনতে পেরেছি।”

“কেমন আছেন বললেন না কিন্তু।”

“এইতো বেশ ভালো। আপনি?”

“ভালো। আসলে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”

ফারহান অবাক হয়ে বললো, “ক্ষমা! কিন্তু কেন?”

মেয়েটা মুখে কাচুমাচু ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো, “আসলে আমার তখন তেমনটা করা উচিত হয়নি। আসলে আবেগের বশে কী করেছিলাম ততোটা ভেবে করিনি। আমার আপনাদের সম্মানের কথা ভাবা উচিত ছিল।”

“সেসব আমি অনেক আগেই ভুলে গেছি। আর এতদিন পর এসব কথা তুলে তো কোনো লাভ নেই তাই না? আর এভাবে কথা বলাটা ভালো দেখাচ্ছে না। আমি অফিসে যাচ্ছি। হাতে সময় বেশি নেই। আসছি। ভালো থাকবেন।”

ফারহান যাওয়ার আগেই শ্রাবণী বললো, “শুনলাম বিয়ে করেছেন।”

ফারহান হাসিমুখে বললো, “হ্যাঁ, এইতো সপ্তাহখানেক হলো।”

“ওহ, আচ্ছা। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে। যান।”

“হুম।” বলেই ফারহান হাঁটতে শুরু করলো। শ্রাবণীর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার নেই এখন।

ফারহান চলে যেতেই শ্রাবণী রাগে ফেটে পড়লো। রাগে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। মনে মনে বলছে, “সব হয়েছে আমার দোষে। সব ভেবে চিন্তে পালানো উচিত ছিল। আজকে ওই মেয়েটা যে পরিমাণ সুখে আছে সেরকমই সুখে থাকতে পারতাম আমি। অভাবের মধ্যে থাকতে হতো না ওই ছোটলোকটার কাছে। যে আমার চাহিদা পূরণ করতে পারে না তার সাথে কি-না পালিয়ে গিয়েছিলাম। আবারো সব ঠিক করার একটা উপায় তো বের করতেই হবে। এই সংসার আমার করে নেব আমি। যেকোনো মূল্যেই হোক।” একটা শয়তানি হাসি দিয়েই সেখান থেকে চলে গেল সে।

__________________

সন্ধ্যার পরপরই পড়ার টেবিলে বসে ফারহানের কথা ভাবছে নিরু। সারাক্ষণ শুধু তার চিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ফারহানের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ছে নিরুর।

সেদিন যখন ফারহানরা তাকে দেখতে গিয়েছিল সেদিন তো নিরু একদম জড়সড় হয়েই ছিল। প্রচন্ড নার্ভাস ছিল। ফারহানের দিকে তো প্রথমে ভালোভাবে তাকায়ই নি। কিন্তু যখন তাদের একটু আলাদা করে কথা বলতে দেওয়া হয় তখন দেখেছিল। ফারহান মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। আর নিরু মাথাটা নিচু করে ছিল। একবার দেখাতেও তার মুখটাই শুধু চোখের সামনে ভাসছিল। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ তবুও যেন চোখ ফেরানো দায়। নিরুও যে একদম আহামরি ফর্সা এমনটা কিন্তু নয়। তবে চেহারার গঠন মাশা আল্লাহ।

“নিরু?”

ফারহানের ডাকে নিরু ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। এতক্ষণ আনমনা হয়ে ভাবছিল তাই খেয়ালই করেনি যে ফারহান এসেছে।

ফারহান টাই খুলতে খুলতে বললো, “কী এত ভাবছিলে?”

“আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা। ওহ না। আপনি তো আমাকে আগেই দেখেছিলেন। আমি যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি সেই দিনটার কথা ভাবছিলাম।”

“এত ভাবছো আমাকে নিয়ে! আবার প্রেমে টেমে পড়ে যাও নি তো?”

“আপনি যান আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। শুধুশুধুই কীসব কথা বলছেন।”

ফারহান ভ্রু উঁচিয়ে বললো, “শুধুশুধু বললাম না-কি? আমার তো তাই মনে হলো। না-হয় তো তুমি সোজাসুজিই না বলে দিতে তাইনা?”

নিরু রুমের বাইরে যেতে যেতে বললো, “আমি চা নিয়ে আসছি আপনার জন্য।”

ফারহান একটু জোড়েই ডাকলো, “নিরু?”

নিরু পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো, “কী?”

“এখন আর চা এনো না। আসার সময় পাশের দোকান থেকে চা খেয়ে এসেছি।”

“ওহ, আচ্ছা। তাহলে আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। ঘেমে গেছেন। ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই?”

“উঁহু, সেরকম কিছু নয়। অভ্যাস হয়ে গেছে। তোমার পড়া থাকলে পড়তে বসো।”

“না কোনো পড়া নেই। আজকেই তো ফার্স্ট ক্লাস ছিল। আমি বারান্দায় যাচ্ছি। ভালোই হাওয়া দিচ্ছে।”

“হুম, যাও। আসছি।”

ফারহান ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে নিরুর পাশে দাঁড়ালো। সে মনে মনে ভাবছে, “আজকে শ্রাবণীর সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টা কী নিরুকে জানানো উচিত? ও যদি বিষয়টা অন্যভাবে নেয়? আর কেমন ভাবেই বা নিবে? উনার সাথে তো আর আমার এতদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না। বলেই ফেলি। কিচ্ছু লুকাবো না।”

ফারহান সোজাসুজি বলে দিল, “আজকে রাস্তায় শ্রাবণীর সাথে দেখা হয়েছিল।”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কোন শ্রাবণী?”

“যার সাথে প্রথমে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার নাম শ্রাবণী। কাল নামটা ঠিকভাবে মনে ছিল না তাই বলতে পারিনি।”

“ওহ। কী বললো?”

ফারহান শুরু থেকে সবটা নিরুকে বললো।

সব শুনে নিরু বললো, “ওহ, তাহলে উনি উনার ভুলটা বুজতে পেরেছে এতদিনে?”

ফারহান মেকি হেসে বললো, “তার ভুলটা এখন আমার কাছে ঠিকই মনে হয়। পালিয়ে গিয়ে ঠিকই করেছিল। পালিয়ে গেল বলেই তো তোমাকে বিয়ে করতে পারলাম। না পালালে কী আর এই সুযোগটা আসতো?”

নিরু কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলো।

__________________

পরেরদিন শুক্রবার। নিরু আর ফারহান আজ বাড়িতেই আছে। তবে ফারহানের মা-বাবা আজ গ্রামের বাড়িতে যাবেন। ওনাদের ইচ্ছা ছিল ছেলের বিয়ের পর ক’টাদিন গিয়ে থেকে আসবেন নিজেদের আপন ঠিকানায়। বহুদিন ধরে শহরে থাকলেও মাটির টান কী আর ভোলা যায়? তাইতো সকালে উঠেই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে নিরুর শাশুড়ি। নিরুও তাকে হাতেহাতে সাহায্য করছে। গোছগাছ প্রায় শেষের দিকেই। ফারহান গেছে একটা সিএনজি ডাকতে।

সকাল এগারোটার দিকে রওনা হলেন তারা। যাওয়ার সময় নিরুর শাশুড়ি ওকে বলে গেছে, “তোমাকে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। সংসার তো এখন তোমারই। আমরা আর ক’দিনই বা বাঁচবো। সংসার এখন থেকে তোমাকেই সামলাতে হবে। নিজের আর আমার ছেলের খেয়াল রেখো। আমরা কিছুদিন পরেই ফিরে আসবো। ভালো থেকো।”

নিরুও হাসিমুখে জানিয়েছে, “সবকিছুরই খেয়াল রাখবো মা। আপনারা দেখে শুনে যাবেন আর পৌঁছানোর পর একটু কল করে জানিয়ে দিয়েন।”

_________________

বিকালে ড্রয়িংরুমে বসে নিরু আর ফারহান সিনেমা দেখছে। পুরো বাড়িতে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। ফারহান টিভির দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিরুর দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে আছে। এই একবার হাত ধরছে তো আবার চুল ধরে এলোমেলো করে দিচ্ছে।

ফারহান আবারো চুলে হাত দিতেই নিরু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আপনি কী করছেন বলুন তো?”

ফারহান সোজাসাপ্টা ভাবে উত্তর দিল, “আমি আমার বউয়ের চুল ধরছি।”

“আবার এলোমেলো করছেন কেন?”

“একটু এলোমেলো করলে কিচ্ছু হবে না। এক মিনিট। তুমি বসো। আমি তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেবো।”

“তেল দিতে ভালো লাগে না আমার।”

“ভালো না লাগলেও দিতে হবে। আমি দিয়ে দেবো। নাহলে দেখবে চুল পড়ে পড়ে মাথা টাক হয়ে যাবে।”

“হবে না।”

ফারহান নিরুর আর কোনো কথা না শুনেই তেল আনতে রুমে চলে গেল। তেল এনে নিরুর মাথায় লাগিয়ে দিয়ে একটি বিনুনি করে দিল।

বিনুনিটা দেখে নিরু অবাক স্বরে বললো, “আপনি আবার বিনুনিও করতে পারেন?”

ফারহান একটু ভাব নিয়ে বললো, “অবশ্যই পারি।”

“শিখলেন কীভাবে? মানে ছেলেরা তো সচরাচর বিনুনি করতে পারে না।”

“মাকে দুই-তিন বার করে দিয়েছিলাম তাই মনে আছে।”

“ওহ।”

“হুম, চলো ছাদে যাই। বসে বসে আর ভালো লাগছে না।”

“আচ্ছা চলুন।”

নিরু আর ফারহান ছাদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো৷ দুজনের দৃষ্টিই নিচের দিকে। তবে কেউ কোনো কথা বলছে না।

হঠাৎ নিরু নিচের রাস্তায় থাকা গাছের আড়াল থেকে একজনকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অতিদ্রুত ফারহানকে বললো, “দেখুন, ওখানে কে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।”

ফারহান নিরুর কথা মতো সেদিকে তাকানোর আগই সেই লোকটা উধাও হয়ে গেল।

ফারহান কাউকে দেখতে না পেয়ে বললো, “কই? কেউ নেই তো। তুমি হয়তো ভুল দেখেছো।”

নিরুর স্পষ্ট মনে আছে সে কাউকে দেখেছিল তবে পরেরবার আর না দেখতে পেয়ে তেমন কিছু ভাবলো না। রাস্তায় কত মানুষই তো দাঁড়াতে পারে।

নিরু সেই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বললো, “আচ্ছা ছাদে কোনো ফুলগাছ নেই কেন?”

“পরিচর্যা করার মানুষ নেই তাই ফুলগাছ লাগানো হয়নি। তুমি চাইলে এনে দিতে পারি।”

নিরু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “আচ্ছা, তাহলে এরপরের দিন অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসবেন।”

ফারহানও মৃদু হেসে সায় জানালো।

সন্ধ্যার খানিকক্ষণ আগেই ওরা নিচে নেমে এলো। আর ছাদে থাকতে ভালো লাগছিল না। কেমন যেন গুমোট ভাব চারদিকে। হয়তো রাতে বৃষ্টি হতে পারে।

ফারহান একটু বাইরে গেছে। বলেছে সন্ধ্যার একটু পরেই ফিরে আসবে। তাই নিরু রান্নাঘরে গেছে রাতের খাবার রান্না করতে। হঠাৎ ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসায় চেয়ারের উপরেই রেখে দিল ফোনটা। এভাবে বারবার কল আসায় একবার রিসিভই করে ফেললো।

নিরুকে কিছু বলতে না দিয়েই ওপাশ থেকে একজন পুরুষালী কণ্ঠে বললো, “ফোন ধরতে এত লেট করছিলে কেন সোনা?”

নিরু রেগে গিয়ে বললো, “কে আপনি? এইসব কী ধরনের কথা বলছেন?”

ওপাশ থেকে মৃদু হাসির স্বর ভেসে এলো। “আমাকে চিনতে পারছো না তুমি? তাহলে তো খুব শীঘ্রই চেনানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”

সাথেসাথেই ওপাশ থেকে কল কেটে গেল।

নিরু চিন্তিত হয়ে রইলো। কে কল করেছিল? লোকটা কে? আর এমন সব কথাই বা বলছিল কেন?

#চলবে__??

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০৮

নিরু চিন্তার মাঝেই রান্না শেষ করলো। মনে মনে ভাবছে, “উনাকে বিষয়টা জানানো উচিত। না-হয় এরপরে যদি আবার কল আসে তাহলে উনি আমাকে ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু এখনো আসছে না কেন? আটটা বাজতে চললো। সময় ঠিকই পেরিয়ে গেছে কিন্তু উনার আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। না জানি আবার কখন লোকটা কল দিয়ে বসে।”

নিরু চিন্তিত হয়েই সোফায় বসে রইলো।

সাড়ে আটটা নাগাদ ফারহান বাসায় ফিরলো। নিরুকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে বললো, “সরি বউ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে দেরি হয়ে গেল। তুমি কী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”

নিরু প্রথমেই সবটা বলে দিল।

ফারহান কিছু না বলে চুপ করে রইলো। কিছু ভাবছে সে।

নিরু ফারহানকে এমন চুপ থাকতে দেখে ভয়ে ভয়ে বললো, “আপনি কী আমায় ভুল বুঝছেন?”

“উঁহু। কখনোই নয়। এরপরে কল এলে আমাকে দিও।”

নিরু একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সায় জানালো।

ফারহান একটু হেসে বললো, “ওই বিষয় মাথা থেকে বাদ। এখন খেতে দাও। ভীষণ খিদে পেয়েছে।”

নিরুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, “আপনি বসুন। আমি সার্ভ করছি।”

“তুমিও বসো আসার সাথে।”

নিরু ফারহানকে সার্ভ করে দিয়ে নিজেও খেতে বসে গেল। এবার একটু শান্তি লাগছে ওর। এতক্ষণ ভয় ছিল যে ফারহান ওকে ভুল বুঝবে না তো? ওর থেকে দূরে সরে যাবে না তো? কিন্তু ফারহান ওর চিন্তাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছে। নিরুর অশান্ত মন শান্ত করেছে।

_____________

রাত বারোটা বেজে তেইশ মিনিট৷ নিরু আর ফারহান শুয়ে আছে তবে ঘুমায়নি। নিরুর ফোনে আবারো একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এল। নিরু প্রথসে রিসিভ করতে না চাইলেও পরে ফারহানের জোরাজুরিতে রিসিভ করলো। তবে ওপাশ থেকে কোনো শব্দ শোনা গেল না।

নিরু ফোন লাউডস্পিকারে দিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, “হ্যা…হ্যালো?”

ওপাশ থেকে আবারো সেই পুরুষালী কণ্ঠ শোনা গেল, “বাহ, প্রথমবারেই কল রিসিভ করে ফেললে। তা তোমার স্বামী কী ঘুমিয়েছে?”

নিরু কোনো উত্তর না দিয়ে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান ফোনটা ওর হাতে থেকে নিয়ে বললো, “না ঘুমায়নি। তোর কলের জন্য অপেক্ষা করছিল।”

অপরপাশের ব্যক্তিটি কোনো উত্তর না দেয়ায় ফারহান আবারো বললো, “কী হলো? কথা অফ হয়ে গেল কেন? কী ভেবেছিস কল করে এসব আজেবাজে কথা বললেই আমরা আলাদা হয়ে যাবো? আমার বউ কোনোদিন কারো সাথে প্রেম করেছে না-কি, কারো সাথে ঘুরতে গিয়েছে না-কি, অতীতে কাউকে ভালোবাসতো না-কি এসব বিষয়ে আমার জানা আছে। তাই এসব ভুল ভাল কথা-বার্তায় আমাদের সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে না। আর যদি এই নাম্বারে কল করেছিস তাহলে… থাক না-ই বললাম। পরেরটা পরে দেখা যাবে।” কথা শেষ করেই ফারহান কল কেটে দিল।

ফারহান এভাবে কল কেটে দেওয়ায় অপর পাশে থাকা ব্যক্তিটি ফোনটা ছুড়ে মারলো ফ্লোরে। রাগে গজগজ করতে করতে বিশ্রীভাবে হেসে বললো, “ফারহান শাহরিয়ার, খুব তো নিজের বউয়ের খবর নিয়েছো। সে কাউকে ভালোবাসে কি-না এই খবর নিয়েছো কিন্তু তাকে কেউ ভালোবাসে কি-না সে খবর কী রেখেছো? তাকে কেউ পেতে চায় কি-না সে খবর কী রেখেছো? কল করবো না আর। এরপর যা হবে সব সামনা-সামনি হবে। তবে কিছু সময় দরকার৷ শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা।”

ফারহান ফোনটা বালিশের পাশে রেখে বললো, “মনে হয় না আর কল করবে। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে।”

নিরু ফারহানের দিকে ফিরে শুয়ে বললো, “লোকটা কে ছিল? আর এমনি বা করছে কেন?”

ফারহান নিরুকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো, “সেটা তো আমিও বলতে পারছি না। এখন এত টেনশন করো না তো। আমি আছি তো। তুমি ঘুমাও।”

নিরুও লক্ষ্মী মেয়ের মতো ফারহানের বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলো। এই আশ্রয়টা বড্ড নিরাপদ মনে হয় তার। বড্ড বেশিই। খানিকক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো নিরু। ফারহান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।

____________________

সকালবেলায় দুজনে একসাথেই বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ফারহান নিরুকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেল। তবে বলে গেছে, অফিসের কাজ বেশি হলে নিতে আসতে পারবে না। তাহলে নিরু যেন একাই চলে যায়।

নিরুও সায় জানিয়ে ভেতরে চলে গেছে।রাস্তা তো বেশি নয় একাই চলে যাবে সে। তাছাড়া তার এক বান্ধবীর বাড়িও ওদিকেই। দুজনে একসাথেই না-হয় যাওয়া যাবে।

দুপুরবেলায় নিরু ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ফারহানকে না দেখে আগে ফোন চেক করলো। ফারহান কোনো মেসেজ বা কল করেছে না-কি দেখার জন্য। ফারহান মেসেজ করে রেখেছে, “কাজের চাপে আছি। এখন যেতে পারছি না। এখন গেলে রাতে ফিরতে দেরি হবে। এখন তুমি একাই চলে যাও। আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবো।”

নিরু ফোনটা ব্যাগে রেখে তার বান্ধবী দৃষ্টির সাথেই বাড়ির পথে রওনা হলো।

বাড়িতে এসে বিরক্তি লাগছে নিরুর। পুরো বাড়িতে ও একা। আর কেউ নেই। একা একা কী করবে তাই বুঝতে পারছে না। এতক্ষণে মা, শাশুড়ি মা সবার সাথেই ফোনে কথা বলে নিয়েছে। কিন্তু সময়ই যাচ্ছে না। ফারহানকেও কল করছে না কারণ সে ব্যস্ত আছে।

একসময় ঘুমিয়ে পড়লো নিরু। আপাতত এটাই সবচেয়ে ভালো কাজ। বিরক্তিও লাগবে না সাথে সময়ও কেটে যাবে।

সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঘুম ভাঙলো নিরুর। ফ্রেশ হয়ে এসে এক চাপ চা করে আনলো রান্নাঘর থেকে। বারান্দায় বসে বসে বাইরের প্রকৃতি দেখবে আর কিছুক্ষণ পরপর চায়ের কাপে চুমুক দেবে।

নিরু বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে আকাশটা বেশ ঘোলাটে হয়ে গেল। দমকা হাওয়া আসছে। এখনকার প্রকৃতিটাই এরকম। হঠাৎ করেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যায় আবার হঠাৎ করেই সব ঠিকঠাক। বৃষ্টি আসবে মনে হয় কিন্তু একটু দমকা হাওয়াতেই সব মেঘ উড়ে যায়।

তবে এখন তেমনটা হলো না। হঠাৎ করেই হাওয়া থেমে গিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। থেকে থেকে বাজ পড়ারও আওয়াজ হচ্ছে। নিরু রুমের সব জানালা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় বসে রইলো। ভিজতে ইচ্ছা করছে খুব কিন্তু এই অসময়ে ভিজলে জ্বর আসতে পারে ভেবেই ভিজছে না। নিরুর কাছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে, আর মুষলধারে বৃষ্টি এলে ভিজতে ভালো লাগে। কিন্তু এখন কোনোটারই উপায় নেই। তাই বই নিয়ে বসলো। বইয়ের পাতায় ডুবে থাকলে বাইরের চিন্তা মাথায় আসবে না।

______________________

রাত আটটায় বাসায় ফিরলো ফারহান। এসেই নিরুকে জিজ্ঞেস করলো, “ওই লোকটা কী আর ফোন করেছিল?”

নিরু না সূচক মাথা নাড়াতেই সে ফ্রেশ হতে চলে গেল। নিরু বিছানায় বসে রইলো। ফারহান ফ্রেশ হয়ে এসে বললো, “চলো আজ রাতের শহর ঘুরবো।”

নিরু অবাক হয়ে বললো, “আপনি সবেমাত্র বাসায় এলেন। এখনি আবার বাইরে যাব? ক্লান্ত লাগছে না আপনার? এসময়ে ঘুরতে যেতে হবে না।”

ফারহান মুচকি হেসে বললো, “কেন যেতে হবে না? তোমার তো রাতের শহর ঘুরতে ভীষণ ভালো লাগে। আর আমার এখন একদম ক্লান্ত লাগছে না। ফ্রেশ হওয়ার সাথেসাথে সব ক্লান্তিও চলে গেছে। এখন চলো। যেভাবে আছো সেভাবে গেলেও চলবে। তৈরি হতে হবে না। আমরা তো হেঁটে হেঁটেই ঘুরবো। রাতের বেলা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে হাঁটতে বেশ লাগে।”

“খাবেন না?”

“ঘুরতে যখন যাবো তখন বাইরেই খেয়ে নেব।”

নিরু মাথায় ভালোভাবে ওড়না জড়িয়ে বললো, “আচ্ছা, চলুন।”

ফারহান আর নিরু মেইন গেটে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাস্তার কিনারা ঘেঁষে হাঁটছে তারা। লোকজন কমে আসতে শুরু করেছে ক্রমশ। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে রাস্তাটা বেশ আলোকিত হয়ে আছে।

সন্ধ্যাবেলায় বৃষ্টি হওয়ায় মাঝেমাঝে একটু পানিও জমে আছে, কাঁদা হয়েছে। তবে ওরা তা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টাই করছে। নাহয় একবার পড়ে গেলে আর রক্ষা থাকবে না। হাত-পা মচকে যেতে পারে।

নিরু হাঁটছে আর মনে মনে ভাবছে, “লোকটা আমার সব ভালোলাগা জেনে বসে আছে। এতকিছু জানলো কী করে? জিজ্ঞেস করলেও বলতে চায় না। ভারী অদ্ভুত।”

নিরুকে আনমনে হাঁটতে দেখে ফারহান ওর হাতটা একটু শক্ত করে ধরে বললো, “কী এত ভাবছো বলতো? দেখে হাঁটো নাহলে পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে।”

আরো কিছুক্ষণ হেঁটে ফারহান একটা রিকশা ডাক দিয়ে উঠে পড়লো।

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “আপনি না বললেন হেঁটে হেঁটে ঘুরবো। তাহলে আবার রিকশায় উঠলেন কেন?”

ফারহান সাইড হয়ে বসে বললো, “এতক্ষণ হেঁটে নিশ্চয়ই তোমার পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে। এখন কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ো। একটু দূরেই একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে সেখানে যাবো।”

নিরুও কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লো। আসলেই তার পায়ে ব্যথা করছে।

রেস্টুরেন্টে খাওয়া শেষে ওরা এবার হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরছে। দুজনের হাতেই দুটো আইসক্রিম। আসার সময় নিরু-ই বায়না ধরেছিল যে আইসক্রিম খাবে।

দুজনে আইসক্রিম খেতে খেতে নিরিবিলিতে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে দু-একজন পথচারীদের দেখা যাচ্ছে। তবে কেউ কারোর দিকে তাকানোর মনোভাব দেখাচ্ছে না। সবাই যার যার মতো।

নিরু হঠাৎ চলতে চলতে ফুটপাতের উপর বসে পড়লো। ফারহান তার পাশে বসে বললো, “হঠাৎ এখানে বসলে যে?”

নিরু মুচকি হেসে বললো, “মানুষজন না থাকলে ফুটপাতে বসে থাকতে বেশ লাগে। এখানে কিছুক্ষণ বসবো তারপরে বাসায় যাবো।”

ফারহান সায় জানাতেই নিরু বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে শুরু করে দিল। ফারহান শুনছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। মাঝেমাঝে বিভিন্ন কথার উত্তরও দিচ্ছে।

___________________

কেটে গেছে বেশ কয়েকটি দিন। এরমধ্যে আর নিরুর ফোনে কোনো অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসেনি। নিরুও সেটা কারোর ফাজলামি ভেবেই ভুলে গেছে। আগামীকাল নিরুর শ্বশুর-শাশুড়ি আসবে। এ নিয়ে তার আনন্দের শেষ নেই। আর বাড়িতে একা একা থাকতে হবে না। বাড়িতে একা থাকতে থাকতে বিরক্তি এসে গেছে নিরুর। তাছাড়া তাদেরও মিস করছে। বাড়িটা একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ফারহানও অফিসে চলে গেছে। আজকে নিরুর ক্লাস নেই তাই বাড়িতেই আছে।

#চলবে__??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here