#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ১২
বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে নিরু-ফারহান আর নিধি-সিয়াম। আজ সকাল থেকে চিন্তা করে তেমন কোনো জায়গার কথা মাথায় না আসায় রেস্টুরেন্টে আসার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল ওরা।
চারজনে এক টেবিলে বসে আসে। নিরুর একপাশে ফারহান, আরেকপাশে নিধি আর সামনে বরাবর সিয়াম। নিধি আর নিরু দুজনেই শাড়ি পড়েছে। আর ফারহান, সিয়াম পাঞ্জাবী।
নিরু বেশ অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। কেমন যেন উশখুশ করছে। কারণটা হলো সামনে বসে থাকা সিয়াম। সে লোলুপ দৃষ্টিতে নিরুর দিকে ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে আবার ফারহানের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। মনে হচ্ছে যেন তার চেয়ে ভালো ছেলে আর দুটো নেই।
কিছুক্ষণ যেতেই ফারহান ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তবে কিছু বলতে পারছে না। নিরুকে নিজের পেছনের দিকে আড়াল করে বসিয়ে নিজে একটু সামনে এগিয়ে বসলো। এখন যদি সিয়ামকে কিছু বলে তাহলে তাদের নিজেরই সম্মান যাবে। শুক্রবার হওয়ায় মানুষজনে গিজগিজ করছে রেস্টুরেন্ট। তাছাড়া এখন নিধির সামনে যদি সিয়ামকে কিছু বলা হয় তাহলে স্বভাবতই তার খারাপ লাগার কথা। আর যাইহোক নিজের স্বামীকে যদি কেউ খারাপ বলে তাহলে সব স্ত্রীরই খারাপই লাগবে। সাথে অপমানিত-ও হবে। তারচেয়ে পরে একা পেলে উপযুক্ত জবাব দেয়া যাবে।
ফারহানের আচরণে নিরু মুচকি হাসলো। সবদিক বিবেচনা করে যে ও কোনো সিনক্রিয়েট করেনি এতেই ভালো লাগছে তার। তাছাড়া ওই নোংরা লোকের সাথে এখানে ঝামেলা করা মানেই নিধির বিপদ। এটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে নিরু।
ফারহান হাসি-খুশি ভাবে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে। এই অসভ্য লোকটা তার নিরুপাখির দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিল এটা ভাবতেই রাগ হচ্ছে প্রচুর। তবুও নিজেকে সামলে নিচ্ছে।
খাবার আসতেই নিরু আবার আগের মতো বসলো। তাছাড়া তো আর কোনো উপায় ও নেই। অস্বস্তি নিয়েই খাওয়া শেষ করলো। একটু নিচুস্বরে ফারহানকে বললো, “বাসায় যাব।”
ফারহান নিরুর হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বললো, “হুম। এখনি যাবো। আমি বিল দিয়ে আসছি।”
ফারহান বিল দেয়া শেষ হতেই সবাই বেরিয়ে পড়লো।
রাস্তায় এসে ফারহান নিধি আর নিরুকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তোমরা যেতে থাকো। আমরা পেছনে আসছি।”
নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”
ফারহান হেসে বললো, “থাকে না ছেলেদের মধ্যে কিছু প্রাইভেট কথা। ওসব শুনে তোমাদের কাজ নেই। তাইতো সিয়াম ভাই?”
সিয়াম কিছু না বুঝলেও মাথা নাড়ালো। নিরু আর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিধির সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগলো। গোধুলির সময়। এখন হেঁটে যেতেই ইচ্ছা করছে। আবছা আলোয় কাছের কোনো মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতিটাই অন্যরকম। চারদিক আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ বাতিগুলো একটা একটা করে জ্বলে উঠছে। আবার কোনো কোনোটা নষ্ট হয়ে আছে। পাখিরা ইতিমধ্যেই নীড়ে ফিরে গেছে।শুক্রবার হওয়ায় কর্মজীবী মানুষদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়া দেখা যাচ্ছে না। তবে রাস্তার পাশ ঘেঁষে, চলমান রিকশায় কয়েকজোড়া কপোত-কপোতীর দেখা মিলছে।
নিরুরা সামনে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ফারহানের চেহারায় কাঠিন্যতা ফুটে উঠলো।
ফারহান কিছু বলার আগেই সিয়াম বললো, “আপনি ওদের আগে পাঠিয়ে দিলেন যে? কি প্রাইভেট কথা?”
ফারহান যথাসম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে বললো, “আমার জানামতে আপনার একটা বউ আছে তাই-না?”
সিয়াম ভ্রু খানিকটা কুঞ্চিত করে বললো, “হ্যাঁ।”
ফারহান এবার চোয়াল শক্ত করে বললো, “তাহলে অন্যের বউয়ের দিকে নজর যায় কেন?”
সিয়াম কিছু বলার আগেই ফারহান আবারো রাগী কিন্তু নামানো স্বরে বললো, “নিজের বউ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করুন। অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিতে যাবেন না। পরে দেখবেন যে চোখ দিয়ে নজর দেবেন সে চোখই আর আস্ত রইলো না। তখন ব্যাপারটা কেমন হবে?”
সিয়াম রাগে গজগজ করতে করতে বললো, “আমাকে চিনিস তুই? এসব কথা বলার সাহস পাচ্ছিস কোথা থেকে?”
ফারহান দ্বিগুণ রেগে বললো, “তুই যে গুন্ডা সেটা আমার আগে থেকেই জানা আছে। তবে আমিও কিন্তু অবলা কোনো মানুষ নই। স্টুডেন্ট লাইফে মারামারি কম করিনি। তবে সেটা শুধুমাত্র তোদের মতোই কিছু লম্পট মানুষদের সাথে। মানুষ হওয়ারও যোগ্য না তোরা। বয়সে বড় ভেবে একটু সম্মান দিয়েই কথা বলছিলাম তবে সেটা ডিজার্বই করিস না তুই। যাইহোক যা বললাম সেটা যেন মাথায় থাকে। নাহলে নিজের বউকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় সেটা কিন্তু আমার জানা আছে। তোর বউয়ের অপমানিত হওয়ার কথা চিন্তা করে তখন কিছু বলিনি। নাহলে ঝামেলা একটা হয়েই যেত।” বলেই ফারহান হনহন করে ছুটে চললো সামনের দিকে। এখানে আর একমুহূর্ত দাঁড়ানোর ইচ্ছা তার নেই।
সিয়াম রাগে পাশের দেয়ালে একটা বাড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল।
নিরুরা কিছুদূর এগিয়ে ফারহানদের দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে ওরাও দাঁড়িয়ে আছে। কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
ফারহান ওদের কাছে যাওয়ার আগেই মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিল।
নিরু ফারহানকে দেখে বললো, “কী এত কথা বলছিলেন? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”
ফারহান একটু হেসে বললো, “তেমন কিছু না। চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ওদের কথা বলার মাঝে সিয়ামও এসে দাঁড়িয়েছে। সে ওদের সাথে না গিয়ে বললে, “নিধির হয়তো পা ব্যথা করছে। তোমরা যাও। আমি ওকে নিয়ে রিকশা করে আসছি।” বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিধির হাত ধরে পাশে দাঁড় করানো রিকশায় উঠে পড়লো।
নিধি রিকশায় ভালোভাবে বসে বললো, “এভাবে নিয়ে এলে কেন? আর এত ভালোবাসা কবে হলো আমার প্রতি যে পা ব্যথা না হতেই এত চিন্তা।”
সিয়াম রাগান্বিত স্বরে বললো, “তোর সাথে এখন কথা বলার মুড নেই আমার। চুপচাপ বসে থাক না-হয় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেব। আর ভালোবাসার কথা বলছিস? সেটা তোর প্রতি কোনোকালেই ছিল না আমার।”
নিধি কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। কান্নাও এখন আর আসে না। এর চেয়ে আরো কত খারাপ ব্যবহার করে সে। এটুকুতে কী-বা যায় আসে।
এদিকে সিয়াম চলে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো নিরু। ফারহানের একহাত জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো আপন মনে। কোনোদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। শুধুমাত্র মনের শান্তি আছে। আর ফারহানের দৃষ্টি তো নিরুতেই সীমাবদ্ধ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে পাশে থাকা নারীটির দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নিরুর খোপা থেকে খুলে আসা সামনের ছোট চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল। নিরু মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকালো।
ফারহান শীতল স্বরে বললো, “তুমি এত সুন্দর কেন নিরু?”
নিরু লজ্জামিশ্রিত হেসে বললো, “আপনার দেখার দৃষ্টি সুন্দর। তাই আপনার চোখে আমাকে সুন্দর লাগে।”
নিরু একটু থেমে আবারো বললো, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই আমাকে সুন্দর লাগে। ভালোবাসার মানুষের সবই তো সুন্দর তাই-না?”
ফারহান মাথা নাড়িয়ে নিরুর মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো, “এবার একদম বউ বউ লাগছে। আমার বউ।”
নিরু লজ্জায় মাথা কিছুটা নোয়ালো।
ফারহান ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে নিরুর মাথাটা উপরে তুলে বললো, “তুমি এখনো এত লজ্জা পাও কেন বলো তো।”
নিরু আশেপাশে তাকিয়ে বললো, “আপনি রাস্তায় কী শুরু করেছেন বলুন তো?”
“বেশি মানুষজন তো নেই আর কী এমন করলাম? জাস্ট ঘোমটা দিয়ে দিলাম।”
“হয়েছে চলুন।”
নিশ্চুপ হয়ে ওরা দুজন সামনের দিকে চলতে লাগলো। হঠাৎ করে নিরু বললো, “শুনুন।”
“হুম, বলো।”
“আমি কালই ওই বাসায় ফিরে যেতে চাই।”
“তুমি না কালই বললে দুদিন পরে যাবে।”
“আমার আর ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। এখানে থাকলে নিধির কাছে যেতে ইচ্ছা করবে। আর ওই লোকটার মুখোমুখি হতে হবে। তার দৃষ্টি আমার মোটেও সুবিধার লাগছে না। কেমন যেন একটা। থাকতে চাই না আমি এখানে। কালই ফিরে যাব।”
“আচ্ছা, তাহলে কাল সকালে তোমাকে বাড়িতে দিয়ে তারপরে আমি অফিসে চলে যাবো।”
“আচ্ছা।”
আরো বিভিন্ন কথা বলতে বলতে ওরা বাড়িতে পৌঁছে গেল। রাস্তা কখন ফুরিয়ে গেছে টেরই পায়নি।
ফারহান রুমে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিরু ভ্রু কুঁচকে বললো, “এই আপনি ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়লেন কেন? তাড়াতাড়ি উঠুন। ফ্রেশ হবেন আগে।”
ফারহান না উঠে নিরুর হাত ধরে টান দিল। নিরু টাল সামলাতে না পেরে সোজা এসে ফারহানের বুকের উপর পড়লো। নিরু মাথা তুলে উঠতে চাওয়ার আগেই ফারহান ওর মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, “চুপচাপ শুয়ে থাকো। নড়বে না। শান্তি লাগছে।”
নিরু আর কিছু না বলে চুপটি করে রইলো। তার নিজেরও উঠতে ইচ্ছা করছে না।
___________________
সিয়াম বাড়িতে এসেই একের পর এক সিগারেট খেয়েই চলেছে। আর নিধি বিছানায় বসে আছে। দিন দিন জীবনটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে তার। এভাবে চলতে থাকলে কবেই না জানি মানসিক অত্যাচারের জেরে মৃত্যু হয় তার। সিয়ামের কাছ থেকে এর জবাব চাইতে খুব করে ইচ্ছা করে কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পরে না। তার ভুলের কারণেই তো তার জীবন এখানে এসে পৌঁছেছে। সে তো নিজেই সিয়ামকে প্রপোজ করেছিল। ভালোবাসার কথা চেপে না রেখে বলে দিয়েছিল। সিয়ামও রাজি হয়ে গিয়েছিল। ভালোই চলছিল সম্পর্ক। সম্পর্কের বয়স যদিও খুব কম ছিল। মাত্র ছয় মাস। তবুও সিয়াম শুরুতে ভালোবাসা দেখিয়েছে প্রচুর। তাই তো নিধি আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ওর সাথে। তবে কেন এখন নিরুকে চায় সে? কেন ওর জীবনটা এভাবে নষ্ট করছে?
নিধি সিয়ামের সামনে গিয়ে আজ সাহস করে বলেই ফেললো, “কেন আমার জীবনটা নষ্ট করছো তুমি? কী ক্ষতি করেছি আমি তোমার?”
#চলবে__??