#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ১১
মাথায় ভালোভাবে ওড়না টেনে নিরু নিধিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। মাকে বলাতে প্রথমে মানা করলেও নিরুর জেদের কাছে হার মেনে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন। তিনি প্রথমে যেতে দিতে চাননি এই ভাবে যে যদি উনারা তার মেয়েকে কোনো কটু কথা শোনায় তখন তো মেয়েটা মন খারাপ করবে। সাধারণত কোনো মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেলে মেয়েটার বান্ধবীকেই দোষী করা হয়। তাদের সে বিষয়ে কেন জানালো না এসব বিষয় নিয়ে রাগারাগি হয়। নিরুও সেই ভয়েই এতদিন ওবাড়িতে যায়নি।
দু’মিনিটও লাগলো না নিধিদের বাসায় আসতে। তবে নিরু কলিংবেল চাপবে না-কি চাপবে না এ নিয়ে দ্বিধায় আছে। জড়তাও কাজ করছে। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেলে চাপ দিয়েই দিলো নিরু।
মিনিট পেরোনোর আগেই দরজা খুলে দিল নিধির মা। তার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা গেল তিনি নিরুকে দেখে খুব একটা খুশি হননি।
নিরু শুকনো ঢোক গিলে সৌজন্যসূচক হেসে বললো, “কেমন আছো কাকিমা?”
রাশেদা বেগম বিনিময়ে হাসলেন একটু।
“আল্লাহ ভালোই রেখেছে। তুই কেমন আছিস? শ্বশুরবাড়িতে দিনকাল কেমন কাটছে?”
“এইতো ভালোই।”
রাশেদা বেগম দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আয়, ভেতরে আয়। আজ এতদিন পরে এলি যে?”
নিরু একটু কাচুমাচু করে বললো, “এমনি দেখতে এলাম তোমাদের। অনেকদিন হলো আসা হয় না। তোমরা আমার উপর রাগ করে আছো তাই-না?”
রাশেদা বেগম শান্তস্বরে বললেন, “সেটাই কী স্বাভাবিক নয়?”
নিরু কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “নিধির সাথে তোমাদের আর যোগাযোগ হয়েছিল?”
নিধির কথা উঠতেই ছলছলে দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। যতই রাগ থাকুক, মেয়ে হয় তো তার। কতটা দিন হয়ে গেল মেয়েটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে তা-ও জানেন না।” উনি মাথা না সূচক মাথা নাড়িয়ে চোখ মুছে নিলেন।
নিরু অপরাধী ভঙ্গিতে বললো, “আমার উচিত ছিল তোমাদের ব্যাপারটা জানানো। কিন্তু নিধি আমাকে ওয়াদা করিয়েছিল যাতে কাউকে কিছু না বলি। পরীক্ষার পরে ও নিজেই তোমাদের জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। রাগ করে থেকো না প্লিজ।”
এতক্ষণ মনের মাঝে রাগ থাকলেও আর সেটা ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। মনে মনে আওড়ালেন, “এখন নিরুর উপর রাগ করে থাকলেই তো আমার মেয়েটা ফিরে আসবে না। শুধু শুধু এই মেয়েটার মনে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?”
রাশেদা বেগম নিরুকে আশ্বস্ত করে বললেন, “তোর উপর আর রাগ নেই আমার। আমার মেয়েটা কী আর ফিরে আসবে না রে? কতদিন হলো ওকে দেখি না। কোথায় আছে ও? তোর সাথে ওর কথা হয়েছিল নিরু?”
নিরু মন খারাপ করে বললো, “না। সেদিনের পর থেকে আর ওর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।”
নিরু আর রাশেদা বেগমের কথার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠলো। রাশেদা বেগম উঠে যাওয়ার আগেই নিরু উঠে বললো, “তুমি বসো কাকিমা, আমি দেখছি।”
নিরু দরজা খুলে দিতেই দেখলো অপরপাশে নিধি দাঁড়িয়ে। তার মুখটা মলিন। নিরুকে দেখেই শক্তহাতে জড়িয়ে ধরলো।
নিরু প্রথমে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও পরমুহূর্তে সে-ও জড়িয়ে ধরলো নিধিকে। নিধির শরীরের কাঁপুনি অনুভব করতে পেরে অস্থির হয়ে বললো, “এই নিধি, নিধি, কাঁদছিস কেন তুই?”
নিধি কিছু না বলে কাঁদতে লাগলো। মনে মনে শতবার ক্ষমা চেয়ে নিল নিরুর কাছে। অস্ফুটস্বরে বললো, “ক্ষমা করে দিস আমাকে নিরু। তোর জীবনটা বাঁচানোর কোনো উপায় আমার জানা নেই। আমার জীনটা তো নষ্ট হয়েই যাচ্ছে। তোর না জানি কী হয় এখন।”
অস্ফুট হওয়ায় কিছুই বুঝতে পারলো না নিরু। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কী বলছিস তুই?”
নিধি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কারো ডাক শুনতে পেল। ডাকটা আর আরো নয় তার স্বামী সিয়ামের। লোকটাকে স্বামী বলতেও ঘৃণা হয় তার।
ততক্ষণে নিধির মা-ও এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। মেয়েকে একদৃষ্টিতে দেখছে সে। কতদিন পরে দেখলো।
নিধি নিজেকে সামলে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা, ক্ষমা করে দাও আমায়। ক্ষমা করে দাও।”
নিধির মা কিছু না বলে মেয়েকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিলেন। এখন কীভাবে রাগ দেখাবেন তিনি? রাগের চেয়ে মমতাটাই তো বেশি প্রকাশিত হচ্ছে।
সিয়াম এসে সালাম করলো তার শাশুড়িকে। মৃদু হেসে নিরুকে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো?”
নিরু জোরপূর্বক হেসে উত্তর দিল, “জ্বি, ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
লোকটা কেমন করে যেন হেসে বললো, “অনেক ভালো।”
নিরু নিধির থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এল। বলে গেছে বিকালে আবার যাবে। এখন ওরা একটু ব্যক্তিগত সময় পার করুক।
নিরু চলে যেতেই সিয়াম নিধিকে নিয়ে ওর রুমে চলে এল। দরজাটা আটকে দিয়ে শক্তহাতে নিধির চুলের মুঠি ধরে রাগী স্বরে বললো, “কী বলছিলি তখন নিরুকে? হ্যাঁ? খুব সাহস বেড়ে গেছে তাই-না?”
নিধি ব্যথা পেয়ে কুকিয়ে উঠে বললো, “সিয়াম, ছাড়ো। লাগছে আমার।”
“লাগুক। কী বলতে চেয়েছিলি তখন?”
নিধি মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললো, “কিছু না, কিছু বলিনি। ছাড়ো প্লিজ।”
সিয়াম না ছেড়ে উল্টো আরো জোরে ধরে বললো, “একে-তো তোর জন্যই আসতে এত দেরি হয়েছে। এখন এর মধ্যে যদি ঝামেলা বাঁধাস তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”
“তোর চেয়ে খারাপ আর কেউ আছে না-কি? আমি বলেছিলাম আমাকে অত্যাচার করতে যে আমার জন্য দেরি হয়েছে? তোকে মারলেও হয়তো আমার শান্তি হবে না।” মনে মনে আওড়ালো নিধি। মুখে বলতে পারলো না। সে সাহস যে তার নেই। এসব কথা যদি সিয়ামের সামনে বলে তাহলে হয়তো এখনি ওকে খুন করে দেবে।
__________________
আধভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরু। হালকা বাতাসে থেকে থেকে উড়ছে চুলগুলো। সেদিকে নিরুর খেয়াল নেই। সে আনমনা হয়ে সন্ধ্যার ধূসর-লাল আকাশ দেখতে ব্যস্ত। গোসলের পর ভেজা চুল বেঁধেই নিধিদের বাসায় গিয়েছিল সে তাই এখনো চুল ভেজাই আছে। কিছুক্ষণ আগে এসেই চুলগুলো ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। পাখিরা ডানা ঝাপটে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। সূর্য তার সোনালী আভা ত্যাগ করে তলিয়ে গেছে কিছুক্ষণ হলো।
ফারহান রুমে নিরুকে না দেখে বারান্দায় যেতেই দেখলো তার প্রিয়তমা খোলা চুলে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। ফারহান তাকে পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, “মন খারাপ না-কি আমার নিরুপাখির?”
নিরু দৃষ্টি সামনে রেখেই বললো, “এত তাড়াতাড়ি এলেন যে আজ?”
“অফিসে রংয়ের কাজ চলছে তাই দুপুর পর্যন্ত অফিস টাইম ছিল আজ। তাই তাড়াতাড়িই চলে এলাম৷ কাল তোমাকে নিয়ে একেবারে যাবো। আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পেলাম না।”
“কী?”
“মন খারাপ তোমার?”
“না। জানেন আজ নিধি এসেছে।”
“তাহলে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা। এমন মুখ ভার করে রেখেছো কেন?”
“ওর কথা-বার্তা কেমন যেন লাগছিলো। তাছাড়া ও এসেই কেমন করে কাঁদছিলো।”
ফারহান মৃদু হেসে বললো, “আরে অনেকদিন পর দোখা হয়েছে তাই হয়তো কেঁদেছে। এতে এত ভাবার কী আছে? ওর বরও সাথে এসেছে।”
“হ্যাঁ।”
“ওহ, আচ্ছা।”
“একটা কথা বলি?”
“হুম, বলো। এত অনুমতি নেয়ার কী আছে?”
নিরু আবদারের সুরে বললো, “আমি আরো দুটো দিন থাকি? নিধি তো সবেমাত্র আজই এসেছে। ওর সাথে তো তেমন সময় কাটানোই হয়নি। আমরা কাল চলে গেলে ও কবে চলে যাবে টেরই পাবো না। আর দেখা না-ও হতে পারে।”
ফারহান নিরুর দিকটা ভেবে বললো, “আচ্ছা, তবে আর দুই দিনই কিন্তু।”
নিরু খুশি হয়ে ফারহানকে জড়িয়ে ধরে বললো, “থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনি এত্ত এত্ত ভালো।”
ফারহান আলতো স্বরে হেসে নিরুকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিল। ছোট ছোট আবদার পূরণ করাতেও কত খুশি মেয়েটা। এরকম হাসিমুখ দেখতে পেলে তো শত-শত আবদারও পূরণ করতে রাজি ফারহান। তার নিরুপাখিকে হাসতে দেখার আনন্দ যে অনেক।
এতক্ষণ একটু মন খারাপ থাকলেও এখন ভীষণ ভালো লাগছে নিরুর। মনে মনে ফারহানকে ধন্যবাদ জানালো। সাথে অভিযোগও ছিল অবশ্য- সে আরেকটু আগে আসলে মন তাড়াতাড়ি ভালো হতো। আগে না এসে অপরাধ করেছে বটে।
ফারহান নিরুকে ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। তারপর গেল নাহিদের সাথে আড্ডা দিতে। তারা বাড়ির সামনেই একটা চায়ের দোকানে যাবে। এ কয়দিনে দুজনের মাঝে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বয়সে দুজন প্রায় কাছাকাছি তাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই তাদের ক্ষেত্রে বেশি মানানসই। নিরু তো তাদের এই মিল দেখে ভীষণ খুশি। তার ভাই যে ফারহানকে মন থেকে মেনে নিয়েছে এর চেয়ে বেশি খুশি আপাতত আর নেই। দুজনে কী সুন্দর আড্ডা দেয়, ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় দুই বন্ধু একসাথে আছে।
নিরু এমনি এমনি বসে থেকে বিরক্ত হওয়ায় সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার ঘরে চলে গেল। আস্তে করে দরজাটা খুলতেই মাকড়সার জাল পড়লো সামনে। অনেকদিন হলো ঘরটা খোলা হয় না। ছোটবেলার কত-শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঘরে।
নিরু মাকড়সার জাল একহাতে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ছোটবেলার অধিকাংশ সময় এই ঘরেই কেটেছে নিরুর। সারাক্ষণ এখানে বসে বসে পুতুল খেলেছে। কখনো কখনো তো রাতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়তো। তখন অবশ্য সাধারণ রুমের মতোই ছিল কিন্তু এখন কিছু পুরনো জিনিসপত্র দিয়ে ভরে আছে। তাই দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে।
নিরু হাত দিয়ে ছোট ছোট খেলনাগুলো স্পর্শ করে দেখছে। মনে মনে ভাবছে, “আবার যদি ফিরে যাওয়া যেত সেই সময়টায়! কতই না রঙিন ছিল চারিপাশ! সবকিছুই রঙিন লাগতো। মাথার মধ্যে কোনো চিন্তা, ঝুটঝামেলা কিচ্ছু ছিল না। আলাদা এক জগৎ ছিল।”
কিন্তু শত চাইলেও যে সে জগতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। সময় সে তো পেরিয়েই গেছে। তাকে কী আর পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া যায়? কখনোই সম্ভব নয়।
ভাবতে ভাবতেই তীক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরু। সবকিছু দেখে ঘরটায় আবার তালা দিয়ে বেরিয়ে এল। এখানে বসার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই নাহলে কিছুক্ষণ বসে থেকে কাটানো যেত।
নিরু রুমে এসে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। বেশ ধুলাবালির মধ্যে ছিল। কিছুক্ষণ পরেই ফারহান ফিরে এল। নিরু তখন ফারহানের জামা-কাপড় গোছাচ্ছিল।
ফারহান বিছানায় বসে বললো, “তুমি ভার্সিটি বাদ দিচ্ছো কেন বলো তো?”
নিরু কাজ করতে করতেই বললো, “এখান থেকে ভার্সিটি অনেক দূরে না সেজন্য। যাওয়ার সময় না-হয় আপনি নিয়ে গেলেন কিন্তু আসার সময় একা একা এতটা পথ আমি আসতে পারবো না। এক সপ্তাহেরই তো ব্যাপার। এই কয়দিন না গেলে তেমন কিছু হবে না।”
“অনেক কিছু হবে। কতগুলো ক্লাস মিস গেল তোমার।”
“আমি দৃষ্টির থেকে সব নোটস নিয়ে নেব। আচ্ছা একটা কথা শুনুন।”
“হুম বলো।”
“কাল তো শুক্রবার তাই-না?”
“হুম।”
“কাল আমরা ঘুরতে যাবো। নিয়ে যাবেন তো? আমি, আপনি, নিধি আর ওর বর। না করবেন না প্লিজ।”
ফারহান মৃদু হেসে বললো, “আচ্ছা, যাবো। কোথায় যাবে?”
নিরু খুশি হয়ে বললো, “সেটা কালকে আমি আর নিধি ঠিক করে নেবো।”
#চলবে__??
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।]