স্বর্ণলতা part 49

0
547

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৪৯
_____________
উপস্থিত সবার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এ রূপক! তাহলে রণক কোথায়! কবে থেকে রূপক এখানে!
একে একে সব রহস্য জাল ছিড়ে বেড়িয়ে আসছে।সূর্যিমামা পশ্চিমে ডুব দিয়েছে।চারদিক অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু সত্যের আলোয় গোটা ধরনী আলোকিত হচ্ছে।
সব লাইট গুলো একসাথে জ্বলে উঠলো।সৈকত লাইট গুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।আলোমাখা স্নিগ্ধ এই স্বর্নালী সন্ধ্যায় পাপমোচন হবে।সকল পাপের বুক চিরে সত্যি বেড়িয়ে আসবে।এখন আলোতে সবাই সবার মুখ দেখে নিক।ক’দিন পরই তো গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।একে অন্যের মুখে চেয়ে নিক।তাদের পাপের হিসেব কষে নিক।

দৌড়াতে দৌড়াতে একজন কে দ্রুত বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে দেখা গেলো।সে আর কেউ না।সেই হলো রণক।পেছনে ছিলো মেহুল।রণক দৌড়াতে দৌড়াতে স্বর্ণলতার কাছে গেলো।রণক স্বর্ণলতায় এতোটাই মগ্ন ছিলো যে আশেপাশের ভয়ংকর পরিস্থিতি তার নজর এড়িয়ে গেলো।
ভেজা কন্ঠে স্বর্ণলতাকে বললো-
—”স্বর্ণলতা!আমার শিউলি ফুল! তুমি ঠিক আছো তো!জানো?মেহুল বললো মামা তোমাকে নাকি মেরে ফেলেছে।আমার দুনিয়া ওলট পালট হয়ে গিয়েছিলো!কত দ্রুত আমি ছুঁটে এসেছি তা শুধু আমি জানি”।

—”বাহ্! বড় ভাইয়ের বউয়ের জন্য এতো প্রেম!”তাচ্ছিল্যের স্বরে রূপক কথাটি বলে উঠলো।
রণক রূপক কে দেখে থমকে গেলো!একি! হুবহু তার মতো দেখতে আরেকজন!একি তাহলে তার ভাই রূপক!”

বিস্ময় ভরা দুচোখ নিয়ে এগিয়ে গেলো রূপকের দিকে।
হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো।তাকে ছুঁতেই গাল বেয়ে নোনাস্রোত ভেসে গেলো রণকের।রূপকের শরীরেও ঠান্ডা শিহরন জাগিয়ে তুললো!
—“তুমি আমার ভাই! হ্যাঁ তুমিই তো আমার ভাই।আমি শুনেছি তোমার কথা।তোমাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।আজকে তোমাকে দেখে বুকের ভেতর এতো যন্ত্রণা হচ্ছে কেনো!”

তখন রূপকের ও দু গাল বেয়ে নোনাজলে মাখামাখি। ছেলেরাও কাঁদতে পারে!ছেলেরা নাকি আবেগ লুকাতে ভালোবাসে।আজকে কেনো তাহলে এতো আবেগে আসক্ত দুজন!চোখের ভেতর নোনাপানির অতল সমুদ্র আজ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই?কেনোই বা নিয়মের ব্যাঘাত ঘটিয়ে অনিয়ম হয়ে ঝড়ে পড়ছে! ছেলেরা কাঁদে না! এই নিয়ম কি অশ্রুরা জানেনা!

রূপক রণককে এক ঝটকায় বুকে টেনে নিলো।তারা হয়তো মেয়েদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে পারলো না।তবে এতো বছরের রক্তের টান ঠিকি তাদের হৃদয়কুঠুরে কান্নার স্রোত ভাসিয়ে দিলো।বুকে জড়িয়ে শান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললো দুজনে।ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক কি এতো মধুর!ক্ষনিকের জন্য ভুলিয়ে দিলো তারা দুজন শত্রুপক্ষ।এতো কান্ড ঘটে গেছে রণকের তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।তার মতো একজন কে দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।কখনো কি তারা ভেবেছিলো,দুজনের হঠাৎ দেখায় তাদের ভেতরে মায়া বাড়িয়ে দিবে শতগুন।এভাবে আবেগের মহাশূন্যে ভাসবে তারা!মনে হচ্ছে কত যুগের চেনা।দুজনের সাথে দেখা হওয়ার কতই না ইচ্ছে ছিলো।কিন্তু বাস্তবে তারা তো ভিন্ন উদ্দেশ্যে আলাদা হয়েছিলো।

রূপক চোখ মুছে রণক এর দিকে তাকালো।
রণক গড়গড় করে বলতে শুরু করলো-
—”পৃথিবীতে বহু পাপ করেছি।পাপের টাকায় আয়েশ করেছি।কিন্তু আজকের মতো শান্তি কোনদিন ও পাইনি।তোমাকে বুকে নিয়ে আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে ভাইজান।”

ততক্ষণে উপস্থিত সবার চোখ টলমল করছে।ইনস্পেক্টর রাহাত উল্টোপাশে চোখের পানি মুছে নিলো।তার ভাইয়ের সাথে তার কাটানো স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো।মাস দুয়েক আগে তার ভাই এক্সিডেন্টে মারা যায়।এবং ঠিক এভাবে মৃত্যু পর তার ভাইকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো সে।

রূপক ভেজা কন্ঠে বলতে লাগলো-
—”আমার এই ভাই টাকেও তোমাদের পাপের স্রামাজ্যে টেনে নিয়ে এসেছো।ওর তো একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হতে পারতো।”
এতোক্ষণে রণক আশেপাশের পরিস্থিতিতে দৃষ্টিগোচর করলো।নীরব,আশু,জাফরের অবস্থা দেখার মতো ছিলো না।
রণকের বুঝতে বাকী রইলো না সব পাপের অবসান আজ হতে চলেছে।
ইন্সপেক্টর রাহাত বললো-
–”মিস স্বর্ণলতা,এদের মুখের স্বীকারোক্তি শুনে যা বুঝলাম তাতে মনে হলো এই কয়েকটা দিন আপনি ভীষণ রকম মানসিক,শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেছিলেন।এদের হাত থেকে আপনি বাঁচার পথ পেলেন কিভাবে?”

স্বর্ণলতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো-
—”যখন আমি সব জানতে পারি তখন আমি শপথ করি, আমার বাবা,মা আমার সন্তানের খু*নীদের ভয়নাক শাস্তি দিবো।কিন্তু পথ আমার জানা ছিলো না।যেদিন রণক মামাকে মিথ্যা বলে ঢাকায় পাঠায় সেদিন ওর সাথে আমি চাঁদ দেখতে যাই।অনেকটা অনিচ্ছাসত্বেও আমি গিয়েছিলাম।আমি তখন ওনার পরিচয় জানতাম।রণক,মনে আছে সেদিন কিছুক্ষণের জন্য আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম?আসলে সেদিন আমি কাকতালীয় ভাবে মন্টুদের বাসায় পৌঁছে যাই।এরপর মন্টুকে পাতাল ঘরে আটকে রেখে অত্যাচারের কাহিনী শুনতে পাই।এবং সেদিন ই ওনাকে কথা দেই আমি মন্টুকে যেভাবে হোক উদ্ধার করবো।

এরপর রণকের সাথে বাসায় এসে জানতে পারি স্নেহা আপু রূপককে সবকিছু বলে দিয়েছে।যখন রণক মিথ্যা কথা বলে মামাকে ঢাকায় পাঠায় তখন আপু নিশ্চিত হওয়ার জন্য রূপককে কল করে।তার বেশ কিছুক্ষণ পর মামা ও রূপককে কল করে।কল করে বলে তারা ঢাকা পৌঁছে গিয়েছে রূপক কখন আসবে।এ কথায় রূপক বিস্মিত হয়।রূপকের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে।দুজনেই একি কথা বলছে কেনো!এরপর আবার আপুকে কল করে।আসলে রণক যে মিথ্যা বলেছিলো সেটা মামা সত্যি ভেবেই রূপককে বলে। রূপক সব সম্পত্তি আম্মার নামে করে দিবে এবং সে নাকি কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসেছে এই কথাতেই রূপকের সন্দেহ হয়। তখন রূপক আপুকে কল করে।এক পর্যায়ে আপু সবকিছু বলে দেয়।”

এরপর স্বর্ণলতা কে থামিয়ে রূপক বলতে শুরু করলো-
—”যখন আমি শুনেছিলাম স্বর্ণ আর নেই।তখন থেকেই আমি বেঁচে থেকেও যেনো মরে গিয়েছিলাম।কানাডাতে আমার বেডরুমের আনাচে কানাচে স্বর্ণের ছবি থাকতো।আমি সারারাতা স্বর্ণের ছবির সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিতাম।কষ্টে সিগারেট টানতাম।আর স্বর্ণের ছবিকে বলতাম-
”দেখো স্বর্ণ,আমি স্মোক করছি।আমাকে বাঁধা দিবেনা?আমার বদঅভ্যাস ছাড়ানোর জন্য হলেও ফিরে এসো।”আমার ফ্ল্যাটে আমার বন্ধু জ্যাক থাকতো।ও আমার কষ্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেয় আমার অজান্তে স্বর্ণের সব ছবি সে উঠিয়ে নিবে।কারন সে চাচ্ছিলো আমি মুভ অন করি।স্বর্ণের ছবি দেখে আমি আরও ভেঙে পড়ছিলাম।আমি জানতে পেরেছিলাম সে এমন কাজ করবে।সেদিন যখন আমি বেলকুনিতে দীর্ঘক্ষণ কথা বলছিলাম।আপুর থেকে সবকিছু শুনছিলাম এই সুযোগে সে ছবি গুলো উঠিয়ে গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিচে নেমে এসেছিলো।বেলকুনি থেকে তাকে দেখে-উল্লাসিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলেছিলাম-
—”Jack! Hey! Jack.Stop.Stop.Don’t go.My wife is Alive.Now i’m the most happiest person in the World.Come on Jack.Give me a hug!”

কথা গুলো বলতে বলতে দুচোখ আবারও ভিজে উঠলো রূপকের।এরপর আবারও স্বর্ণলতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো-
—”যখন শুনেছিলাম আমার স্বর্ণ বেঁচে আছে।আমার তখন মনে হচ্ছিলো আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি।সেদিন আপুর ফোন দিয়ে স্বর্ণের সাথে আমি মাত্র ৪ মিনিট কথা হয়েছে।এর মধ্যে ৩ মিনিট ৩২ সেকেন্ড আমরা শুধু কেঁদেছি।তাকে লাস্ট কথাটা বলেছিলাম-
—”আমার পূর্নিমার চাঁদ।আমার চোখের মনি স্বর্ণ!আমি আসছি।তোমাকে আমার বুকে নিয়ে আমি ফিরবো।”

রাহাত সাহবের চোখমুখ উজ্বল হয়ে উঠলো।এতো প্রেম দেখেছে সে।প্রেম যে এতো স্নিগ্ধ হয়।তার এটা জানা ছিলোনা।
স্বর্ণলতাকে হাতের একপাশ দিয়ে আগলে ধরে রূপক।এরপর বলে-
—”বাকীটা তুমি বলো।”
স্বর্ণলতা আবারও বলা শুরু করে-
—”যখন জানতে পারলাম রূপক আসছে।তখন সমস্ত পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলাম।প্রথমে স্নেহা আপুকে দিয়ে রণক কে বলালাম আমি সবকিছু জানি।এবং আমি রনকের সাথে থাকতে চাই।এতে করে আমি রণকের পুরো আর্কষণ আমার দিকে আনলাম।যাতে তার মস্তিষ্কে শুধু আমি ঘুরি।আমার কথায় তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করলাম।এরপর নিয়ে গেলাম আশু সর্দারের বাড়িতে।সেদিন আশুর বাড়িতে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম।এরপর রণক আর মেহুল কে নিয়ে আমি চলে যাই মন্টুর বাসায়।মন্টুর মা আগে থেকেই আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।সেদিন ও আকাশে হালকা চাঁদ ছিলো।আমি রণক কে বললাম…………….
____________
অতীত-
”আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”

—”হ্যাঁ বলো।”

—”এখানে না।চলুন সেদিনের মতো সেই দিঘির পাড়ে যাই।যেখানে আপনি আমাকে গান শুনিয়েছিলেন।”

রণক স্নেহাকে যেতে বলে মেহুল আর স্বর্ণলতাকে নিয়ে চলে যায়।রণক চাচ্ছিলো স্বর্ণলতাকে একা নিয়ে যেতে কিন্তু স্বর্ণলতার কথায় মেহুল ও সাথে যায়।
এরপর তাদের গন্তব্যে পৌঁছালে স্বর্ণলতা মেহুলকে একটু দূরে দাড় করিয়ে রাখে।এরপর রণক হাত স্পর্শ করে তার মুখের সম্মুখে তুলে ধরে।এরপর হাতে চুমু দেয়।এতোক্ষণে রণক নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো।সে সুখের সাগরে ভাসছিলো।
স্মিত হেসে মধুর কন্ঠে স্বর্ণলতা বললো-
—”দেখুন!আমি জানি আপনি রূপক না।কিন্তু আপনার আমার প্রতি ভালোবাসায় আমি বিমোহিত।আমি আপনার চোখে আমার জন্য এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা দেখেছি।আজকে রাত যদি আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত হয় আপনি কি তা নষ্ট হতে দেবেন?”

—”মানে!”

—”আমি চাই আপনাকে এই মূহুর্তে বিয়ে করতে।আর আমাদের আজকের ভালোবাসায় নতুন এক প্রান জন্ম দিতে।”

—”এখন!এখানে কিভাবে বিয়ে করবো আমরা?”

—”আসুন।ঐ যে দেখুন আপনার মকবুল চাচার বাড়ি।তার পাশেই একটা বাড়ি আছে।স্নেহা আপু আর সৈকত ভাইয়া সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।মেহুল স্বাক্ষী থাকবে।করবেন আজকে আমাকে বিয়ে?আপনার শিউলি ফুল কে আপনার মাঝে সারাজীবন যন্তে রাখবেন?”

রণক কোন কথা না বলে স্বর্ণলতার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।এরপর সেখানে উপস্থিত মন্টুর মা মেহুল এবং স্নেহা আর সৈকত কে নিয়ে বসে পড়লো তার শিউলি ফুলকে আপন করে পাবার আশায়।স্নেহা বাড়িতে যায়নি।বাড়িতে না গিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে আগেই উপস্থিত ছিলো।
এরপর সবাইকে গ্লাসে শরবত খেতে দেওয়া হয়।আর রনকের গ্লাসে মেশানো থাকে ঘুমের ঔষধ।যা খেয়ে সেকেন্ডের মধ্যেই রণক তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।রণক কে পাহারা দেওয়ার জন্য মেহুল থাকে।আর একটা নির্ধারিত সময় উল্লেখ করে দেয়।এই সময় হলেই রণক কে যাতে উঠিয়ে দেওয়া হয়।আর বলা হয় মামা স্বর্ণলতাকে জোর করে নিয়ে গেছে।এমনকি এখন তাকে মেরে ফেলা হবে।নির্দিষ্ট সময়ের আগে রণক যাতে না উঠতে পারে সেইভাবেই তাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়।এবং নির্দিষ্ট সময় পর ও নিজে না উঠলে মেহুল ওকে উঠিয়ে দিবে এমন পরিকল্পনা করা হয়।মেহুল রণক কে উঠিয়ে দেয় আর স্বর্ণলতার কথা শুনেই রণক দৌড়ে আসে বাড়ির দিকে।”

______________
বর্তমান-
স্বর্ণলতা যখন ঘটনা টা সবাইকে শোনাচ্ছিলো তখন রণক মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ছিলো।তার কিছুই বলার নেই।মিথ্যা মরিচিকার পেছনে এতোদিন দৌঁড়িয়েছে সে।যে তার হবার নয়,তার পানে হাত বাড়িয়েছে সে।
এদিকে পাতাল ঘরে মন্টুর কাহিনী শোনার পর সেদিন-ই মন্টুকে উদ্ধার করা হয়।নীরব শোভাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানোর ফলে তারা কিছু বুঝতে পারেনা।
এরপর যখন মামা আসে তখন পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ শুরু হয়।তারা নিশ্চিত ছিলো মামা আজই আসবে।
চলবে………….
Sharmin sumi- শারমিন সুমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here