স্বর্ণলতা part 48

0
531

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৪৮
_____________
স্বর্ণলতা এক হাতে চাবুক আর রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে এগিয়ে গেলো জাফরের কাছে।জাফরের পাশেই আশু সর্দার বাঁধা।
এবার জাফরকে আরও কয়েকবার চাবুক দিয়ে আঘাত করার পর আশু সর্দার এর দিকে পা বাড়ালো।আশু সর্দার ভয়ে গুটিসুটি হয়ে গেলো।নীরব সমানে আর্তনাদ করে যাচ্ছে।এ আর্তনাদে আশু সর্দারের আত্মা কেঁপে উঠছে।
স্বর্ণলতা এবার বললো-
—”লজ্বা করেনা! কবে থেকে করছিস এসব?তোকে তো ভালো করে চিনিও না আমি।সেই তুই কিনা আমাকে একবার দেখে আমার সাথে রাত্রিযাপনের ইচ্ছে পোষণ করিস?তোর মেয়ের বয়স ও তো না আমি।তোর নাতনির বয়সের হবো।আসলে পৃথিবীতে পাপ মানুষ কে এতোটা নিকৃষ্ট করে, এতো টা নিচে নামায় যে তখন সে আর মানুষ থাকেনা।মানুষ রূপী জানোয়ারে পরিনত হয়।
তোদের পাপের স্রামাজ্যে হাজারো নারীর কান্না মিশে আছে।তোরা হাজারো মায়ের বুক খালি করেছিস।আসলেই পাপের আরেক নাম শাস্তি।তোরা শান্তি তে থাকতে পারবি না।তাই আজ তোরা শাস্তি পাচ্ছিস।এ শাস্তি ওপর থেকে নির্ধারিত।একদিনের কর্মফলে তোদের আজ এ দশা না।হাজারো মায়ের হাজারো নারীর বুকফাঁটা কান্নার প্রতিটি অশ্রুকণা আজ তোদের শরীরে অভিশাপ হয়ে ঝড়ছে।চাবুকের প্রত্যেকটা আঘাত তাদের অভিশাপের ফল।”

স্নেহা কে উদ্দেশ্য করে স্বর্ণলতা বললো-
—”আপু,কয়েকটা বিষপিঁপড়া এর শরীরেও ঢুকিয়ে দাও।এদের শরীরের জ্বালা আজকে বিষপিঁপড়া কামড়ে মেটাক।বিষে বিষে এদের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যাক -তারপর উচ্চস্বরে বলুক-”হ্যাঁ আমি শাস্তি পাচ্ছি।আমি অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছি।অন্যায়ের শাস্তি এতোটাই নির্মম।এতোটাই ভয়াবহ।”

আশু সর্দার পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছিলো।পায়ের নখ দিয়ে মাটি খামচে ধরছিলো বারংবার।বিষপিঁপড়া তার দেহের অভ্যান্তরে খুবলে খাচ্ছে।এমতাবস্থায় রণক আশু সর্দারের মুখ খুলে দিলো।
আশু সর্দার ভাঙা ও অসহায়ত্ব ভঙ্গিতে বললো-
—”আম্মা! আপনে আমার আম্মা।কসম খোদার আমি এগুলা কিছু জানিনা।আপনের লগে আমি কিছু করতে চাইনাই।জাফর সব জানে।আমারে বাঁচান আম্মা।আমার হাতের বাঁধন খুইলা দেন আম্মা।আমার খুব বিষ হইতাছে আম্মা।আম্মা আমারে খেমা দেন আম্মা।ও আম্মা।”

জাফর কোন কথা না বলে নিশ্চুপ হয়ে রইলো।তার ভেতর অজানা আশঙ্কা-
‘বিষপিঁপড়ার বিষময় শাস্তি তার ওপর প্রয়োগ হবে না তো!ভাবতে ভাবতেই সৈকত তার ভেতরেও বিষপিঁপড়া ছেড়ে দিলো।
তাদের একি আর্তনাদ।আম্মা,মা,আম্মাজান কিছুই ডাকা বাদ নেই।জাফর তো গলা কাটা মুরগীর মতো ছটপট করতে লাগলো।
আর বলতে লাগলো-
—”স্বর্ণলতা! তোমার কাছে আমি জান ভিক্ষা চামুনা।আমারে তুমি মারতে চাওনা?মাইরা ফেলাও।আমারে মরণ দাও।আল্লাহ্ এই যন্ত্রণা আমি সইবার পারতাছি না।আমারে মরণ দাও।ও স্বর্ণলতা! ও আল্লাহ আমারে বাঁচাও আল্লাহ্।”

স্বর্ণলতা বিকট শব্দে হেসে উঠলো আর বললো-
—”যেদিন আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিলি, যেদিন আমাকে স্টোর রুমে বন্দী করে রেখেছিলো।যেদিন আমার মুখে তোর পা এনে পিষে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে সেদিন তোকে একটা কথা বলেছিলাম-
‘আমাকে যদি বাঁচিয়ে রাখিস তাহলে তোর এমন হাল করবো যেখানে তুই নিজেই তোর মৃত্যু কামনা করবি”।

—-”হ মা কইছিলা।তুমি জিতছো।আমরা হারছি আমগো এই যন্ত্রণা থিকা মুক্ত করো মা।”

স্বর্ণলতা রণক কে উদ্দেশ্য করে বললো-
–”পানি প্রস্তুত তো?”

—”হ্যাঁ প্রস্তুত”।

—”নিয়ে এসে এদের গায়ে ঢেলে দিন।”

রণক আর সৈকত মিলে সারারাত ধরে ৪ বালতি বরফ দ্বারা পরিপূর্ণ বালতি নিয়ে আসলো।যেগুলো সারারাত ধরে তারা বরফ থেকে পানিতে রূপান্তরিত করেছিলো।পানি একটু গরম হলে সেখানে আবারও বরফ দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হতো।
তখনো শীত যায়নি।কনকনে হাড় কাঁপানো শীত।আর তাদের সবার গায়ে বরফ গলা পানি সজোরে ঢেলে দেওয়া হলো।পানির ঠান্ডা স্রোতে সবাই আল্লাহ,মাগো মা বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
বিষপিঁপড়া গুলো এতোক্ষণে শরীর ছেড়ে বেয়ে নিচে নেমে এসেছে।ঠান্ডা পানির জন্য তাদের সর্বাঙ্গে কম্পণ সৃষ্টি হয়েছে।
এতোক্ষণ বিষপিঁপড়া ছিড়ে খাচ্ছিলো আর এখন এতো ঠান্ডা পানিতে একদম নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
নীরব,জাফর আশু সর্দারের ঠোঁট দুটো নীলাভ বর্ণ ধারন করেছে।চোখ লাল হয়ে আছে।মুখটা সাদা ফ্যাকাশে রক্তশূণ্যের ন্যায় মুখমন্ডলের গঠন তৈরী হয়েছে।মনে হচ্ছে ১ জন্মের পাপের ফল তারা কিছুক্ষণ আগে ভোগ করছিলো।মনে হচ্ছিলো নরকের যন্ত্রণা ও বোধহয় এর চেয়ে কম কষ্টের।কিন্তু তাদের শাস্তি তো এখনো শেষ হয়নি।

স্বর্ণলতা পিঠে আবার চাবুক মারা শুরু করলো।এবার নীরব,শোভা,রূপকের মা,আশু,জাফর সবার গায়ে আঘাত করতে লাগলো।আর বলতে লাগলো।
—”তোরা শিরকের মতো জঘন্য অপরাধ করেছিস।মানুষ কখনো অমর হতে পারেনা।শিরক করেছিস তোরা।তোদের কঠিন শাস্তি হবে।
আল্লাহর অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব গোনাহ মাফ করলেও তার সঙ্গে শিরক তথা অংশীদার স্থাপন করার গোনাহ কখনো মাফ করবেন না। আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে অংশীদার স্থাপন করবে তাদের শাস্তিও মারাত্মক। কুরআনে শিরকের যে গোনাহ ও শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তাহলো-

>> নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরিক তথা অংশীদার সাব্যস্ত করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক অংশীদার সাব্যস্ত করল আল্লাহর সাথে, সে যেন আল্লাহকে অপবাদ দিলো।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৪৮)

>> আহলে-কিতাব ও মুশরেকদের মধ্যে যারা আল্লাহকে অস্বীকারকারী, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। সৃষ্টির মধ্যে তারাই নিকৃষ্ট।’ (সুরা বাইয়্যেনাহ : আয়াত ৬)

শিরক মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। হাদিসে পাকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে ৭টি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে থাকতে বলেছেন। আর তা হলো-

>> হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা ৭টি ধ্বংসকারী বস্তু থেকে বেঁচে থাকো। ‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক তথা অংশীদার স্থাপন করা।’জাদু করা, কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, আল্লাহ যা হারাম করেছেন, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের মাল খাওয়া, জেহাদ থেকে পলায়ন করা, সতি নারীর প্রতি অপবাদ দেয়া।’ (বুখারি)

তোরা হত্যা করেছিস।তোরা নারীকে অপবাদ দিয়েছিস তোরা জাদুটোনায় লিপ্ত ছিলি”।

স্বর্ণলতা চাবুক দিয়ে আঘাত করছিলো আর প্রত্যেকটা কথা অনাবরত বলে যাচ্ছিলো।একটা সময় তাদের ক্ষতস্থানে লবন,মরিচ লাগানো হয়।এতে তাদের মাটি কাপাঁনো চিৎকার আর্তনাদ কারও মন গলেনা।কারন এরচেয়ে বহুগুন মানসিক যন্ত্রনা তারা সহ্য করেছে।স্নেহা তার অনাগত সন্তান হারিয়েছে। স্বর্ণলতা হারিয়েছে নারীছেড়া ধন।
এভাবে আনুমানিক ২ ঘন্টা অতিক্রম করার পর পুলিশ বাড়িতে পৌঁছে গেলো।বিশাল ফোর্স নিয়ে পুলিশ বাড়িটাকে ঘিরে ধরলো।
জাফর শুষ্ক ঠোঁটে মৃদু হাসি হাসলো।আর চিৎকার করে বলতে লাগলো-
—”দারোগা সাহেব দেহেন দেহেন আমগো ক্যামনে অত্যাচার করতাছে।দেহেন দারোগা সাহেব।”
পুলিশ ইন্সপেক্টর রাহাত দেখলো একেকজন একেকভাবে পড়ে আছে।কারও আবার হাতের পায়ের নখে মাটি আটকে গিয়েছে।ঠান্ডাতে থরথর করে কাঁপছে।ক্ষতস্থানে লবণ মরিচ লাগানো আবার ছেলেগুলোর চোখ লাল টকটকা। ঠোঁট নিলাভ বর্ণ ধারন করেছে।সবার অবস্থা শোচনীয় ছিলো।এরপর স্বর্ণলতা বললো-
—”ইন্সপেক্টর সাহেব আপনাকে যে কল করেছিলো সে এইযে ইনি,মি.জাফর।আপনাকে সে নিজেই এড্রেস দিয়েছে।”
এবার উপস্থিত সবাই চোখ কপালে উঠে গেলো।নীরব রীতিমতো গালি গালাজ শুরু করে দিলো।
–”কিহ! তুই নিজে পুলিশ ডেকেছিস?শয়তান কোথাকার। তোর মনে কি ছিলো?এদের সাথে হাত মেলানো!”

—”মুখ সামলে কথা বল।দারোগা সাহেব আমি কিছু করিনাই।এরা দোষী।আমি অসহায়।আমি বাঁচার জন্য আপনারে কল দিছিলাম।”

এবার রণক চুপ না থেকে বলে উঠলো-
—”নীরব তুই ঠিক ধরেছিস।মামা এতোদিন সবার সাথে গেইম খেলেছে।নিজে বাঁচার জন্য এখন মিথ্যা বলছে।তোদের উচিত তার সব অপকর্ম ফাঁস করে দেওয়া।এই দেখ আমি তোদের প্রমান দিচ্ছি।”
রণক তার হাতের ফোন থেকে একটা রেকর্ড অন করলো-
—-”স্বর্ণলতাকে তোর সাথে বিয়ে দিমু।এরপর যখন তোদের বাচ্চা হবে তখন বাচ্চা নিয়ে আমাদের কাজ হাসিল করে একে একে সবাইরে খুন করমু।স্নেহা,শোভা,তোর মা,নীরব কেউ ই বাঁচবো না।সবাই রে নির্মম মৃত্যু দিমু আমি।এরপর তোর আর আমার রাজত্ব!”

মামা চমকে উঠলো।সে মনে মনে ভাবলো এই কথা তো আজ রণক কে বলেছে।তবে এর আগে পেছনে অনেক কথা ছিলো।যদি রণকের কথা সত্যি হয় তবে সে করবে।আর না হলে রণক কে খু/ন করবে।কিন্তু ও আগের পেছনের কথা বাদ দিয়ে এইকথা টা রেকর্ড করলো!”

মামার রেকর্ড শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো উপস্থিত সবাই।নীরব বলে উঠলো-
—”ওহ্ এই পরিকল্পনা ছিলো?এখন নিজের পিঠ বাঁচাতে সাধু সাজবি?”

—”নীরবের মা,রূপকের মা আশু সর্দার উত্তেজিত হয়ে জাফর এবং তাদের করা সমস্ত পাপের ভান্ডার খুলে দিলো।একমনে গড়গড় করে তাদের পাপের কাহিনী বলতে লাগলো।স্বর্ণলতার বাবা,মা কে খু*ন,বাচ্চাকে খু*ন সহ আরও সব খু*নের কথা স্বীকার করলো।তাদের মাথায় ঘুরছিলো জাফর নামক বিশ্বাসঘাতকতার মুখোশ ছিড়ে ফেলা।তারা উত্তেজনায় তাদের করা পাপ-ই যে সব উগড়ে ফেললো এটা তাদের মাথায় আসলো না।”

এবার রণক বললো-
—”ইন্সপেক্টর এরা সবাই নিজের দোষ নিজের মুখে স্বীকার করলো এদের এখন শাস্তি দিন।এদের গ্রেফতার করুন।এরপর নীরবের দিকে তাকিয়ে বললো-
মাথামোটার দল। নে শোন পুরো রেকর্ড শোন।”

পুরো রেকর্ড শুনে সবার মাথায় হাত।এ কি করলো! উত্তেজনার বশে তাদের করা পাপ স্বীকার করে নিলো।একে এতো মার খেয়েছে আবার ঠান্ডা পানি পাশাপাশি লবণ মরিচের ঝাল।ভালো মন্দ চিন্তা করবার জন্য মস্তিষ্কই তাদের কাজ করছিলো না।জাফর বরাবরের মতো নীরব থাকলো।এরপর বলে উঠলো-
—”আমরা পাপ করছি।তয় স্বর্ণলতা আর রণক নিজেই পাপী।স্বর্ণলতা খু*ন করছে মন্টুরে।মন্টুর মা নিজেই স্বাক্ষী দিবো।আর রণক সব পাপ কাজে জড়িত আছিলো।এগুলা সবাইরে জিগান সবাই কইবো।আমরা তো পাপ স্বীকার করছি-ই।অহন তো আর মিছা কইয়া লাভ নাই।”

পাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসলো-
—”চাচাজান! আপনে কি আমার কথা কইতাছেন?স্বর্ণবুবুজান আমারে মারছে হেইডা কইবার চান?তাইলে আমি কেডা?”
কন্ঠটার দিক সবার চোখ গেলো।মন্টুর তার মাকে ধরে ধরে তাদের দিকে আসছিলো।জাফর মনে মনে বললো-
—”মন্টু বাইচাঁ আছে!ক্যামনে!!!!!”
এরপর স্বর্ণলতা বললো-
—”আর কাকে রণক বলছেন মামা?কাকে পাপের ভাগীদার করছেন?ও কি সত্যি রণক!”
জাফর ভূত দেখার মতো সবাইকে দেখছিলো।একে মন্টু এখন আবার বলছে রণক না!
—”পরিষ্কার করে বলছি।মামা যখন আমি বাঁধন ছেড়ে উঠলাম তখন স্বর্ণকে স্বর্ণলতা বলিনি।বলেছিলাম স্বর্ণ।আমি রূপক।তোমরা যেমন রণক কে দিয়ে ওকে ঠকিয়েছো ঠিক তেমনি তোমাদের আমরা ঠকালাম।”
রূপকের মা বলে উঠলো-
—”তুই এখানে আসলি কিভাবে?আর রণক কোথায় তাহলে?”
চলবে………..
Sharmin sumi-শারমিন সুমি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here