#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৪২
_____________
স্নেহা রণক কে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে।এদিকে রণক বাড়ির বাইরে পদ্মদিঘিতে।স্বর্ণলতার জন্য পদ্মফুল তুলছে।
স্নেহা খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির বাইরে গেলো।আর রণক কে দিঘীর নিচে পেলে।স্নেহা কিছুটা চিৎকার করে ডাকলো-
—”র-ণ-ক……….তু-ই নি-চে কে-নো?????????
রণক নিচে থেকে তাড়াহুড়ো করে উঠে স্নেহার মুখ চেপে ধরলো।
চুপ…..কি করছিস তুই?রণক নামে ডাকছিস কেনো আপু?স্বর্ণলতা বাসায় না?”
—”ছাড়! তোর এতো সাহস হলো কবে থেকে?”
—”কেনো কি করেছি আমি?”
—”মামা কে রূপক সেজে মিথ্যা বলেছিস কেনো?”
রণক স্নেহার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো।সে মামা কে মিথ্যা বলেছে এটা তো শুধু স্বর্ণলতা জানে।তাহলে স্নেহা জানলো কি করে!সবচেয়ে বড় কথা, কি মিথ্যা বলেছে সেটা তো স্বর্ণলতা জানেনা।তাহলে স্নেহা জানলো কিভাবে রূপক সেজে মিথ্যা বলেছে।”
রণক উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
—”মামাকে রূপক সেজে মিথ্যা বলেছি এ কথা কে বলেছে তোমাকে?”
স্নেহা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো-
–”রূপক সেজে মিথ্যা বলেছিস কেনো?”
—”মানে! কে বলেছে তোমাকে?”
—”মেহুল।”
রণক বিস্মিত হয়ে বললো-
—”কেডায়?ঐ বাইট্টা ছেড়ি ডা?”
—“চুপ বাইট্টা বলোস কেনো?”
—”না লম্বা ছেমরি।ওতো অনেক লম্বা।”
—”ফাইজলামি করবি নাতো।ভয় ডর নেই?ও যদি কাউকে বলে দিতো?”
—”আপু! যখন আমি ঢাকাতে প্রথম রূপক সেজে গিয়েছিলাম তখন হলে আমি একটু ভয় পেতাম।কিন্তু এখন?
নাহ্ বিন্দুমাত্র না।কারন ও তো জানেই আমি কে।তখন তো আর জানতো না।তখন ভাবতো আমি রূপক।ওকে আমি দেখেছি দিঘীর নিচে।ওকে দেখতে গিয়েই তো সুন্দর সুন্দর পদ্মফুল গুলো নজরে আসলো।
—”তুই পদ্ম তুলছিলি?”
-”তাহলে তোমার কি মনে হয় দিঘির পানি মাপছিলাম?
—”রণক!বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।তুই পদ্মফুল কিসের জন্য তুলছিলি?”
—”স্বর্ণলতা কে উপহার দেওয়ার জন্য।”
—”ছিঃ রণক! তোর এতো অধঃপতন! একে ও আমাদের শত্রু।অন্যদিকে সম্পর্কে ও তোর ভাবী।”
—”পৃথিবীতে কোথাও লেখা আছে ভাবীকে ভালোবাসা যাবেনা?উল্টো ভাই মারা গেলে ভাবীর সাথে দেবরের বিয়ে পরিবার দেয়না?”
—”রূপক তো বেঁচে আছে।”
—”কিন্তু স্বর্ণলতার কাছে মৃত।”
—”রণক! তুই এমন করছিস কেনো?মৃত্যু ডেকে আনবি?এত বড় একটা মিথ্যা বলেছিস মামাকে।কেনো মিথ্যা বললি?মামা বাড়ি ফিরে তোকে আস্ত রাখবে?”
—”স্বর্ণলতাকে নিয়ে আজ চাঁদ দেখবো।আজ পূর্নিমা।তাই মামাকে সরানো আমার খুব গুরত্বপূর্ন কাজের মধ্যে একটি ছিলো।আজকে নিশ্চিন্তে স্বর্ণলতাকে নিয়ে বের হবো।ও আকাশের পানে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইবে।আর আমি চেয়ে রইবো ওর পানে।ওর চাঁদ আকাশে।আর আমার চাঁদ মাটিতে আমার পাশে।”
—”কিসের মোহে ডুবেছিস তুই?পরিনাম কি হবে ভেবে দেখেছিস?”
—”প্রেমের মোহে মোহিত আমি।আমি আরও ভয়ানক কাজ করেছি।তুমি জানো আর কি করেছি?”
দাঁতে দাঁত চেপে স্নেহা জিজ্ঞেস করলো-
—”কিরে,তুই আর কি কি করেছিস?”
—”বড় আপুর সামনে প্রেমের কথা বলতে লজ্বা লাগছে তাও বলি।স্বর্ণলতা কে আমি খুব ভালোবাসি।আমি ওকে চাই আপু।ওর কষ্ট হোক এমন কোন কাজ আমি করতে চাইনা।কারন ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না।আমি তো জানতাম ই ও যেই বাচ্চা নিয়ে স্বপ্ন দেখতো সেই বাচ্চাকে একদিন মেরে ফেলা হবে।উল্টো রূপকের নামেও মিথ্যা সংবাদ দেওয়া হবে।মেয়েটা তখন বড্ড একা হয়ে যাবে।তাই মেহুল কে দিয়ে একটা চিরকুট দিয়েছিলাম।বলেছিলাম ওর বাচ্চা হওয়ার পরই যাতে দেয়।আগে যাতে কোনমতোই না দেয়।”
”চিরকুট!
—”কি লিখেছিলি চিরকুটে?”
হালকা কেঁশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলো রণক।
আর বললো-
বোনু! কবিতা লিখেছিলাম রে।-
”স্নিগ্ধ শীতল পরশমনি
ও আমার নিল নয়নী
তোমায় দেখে তৃষ্ণা আমার না জুড়ায়।
তুমি কিন্তু বেঁচে থাকবে আমার মায়ায়।
তোমার মধ্যে আমাকে রেখো।
পৃথিবী জুড়ে স্বপ্ন এঁকো।
তুমি কিন্তু পুষে রেখো,তোমার অন্তরের ঠিক পাশে।
আমাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো তোমার হৃদয় মাঝে।
কাজল মাখা মায়াবী চোখে বৃষ্টি যাতে না আসে।
আমি কিন্তু থাকবো তোমার ঠিক আশেপাশে।
তোমার মাঝেই হবে আমার বাস।
তুমি,আমি আর আমাদের কল্পকথা বিন্যাস।”
স্নেহা একটু অবাক হলো।আর বললো-
—”এই চিরকুট কি স্বর্ণলতা পেয়েছিলো?”
—”মেহুল কে জিজ্ঞেস করিনি।কিন্তু মনে হয় ও দিয়েছে।মেহুল এতো বড় ভুল কাজ নিশ্চয়ই করবে না।”
—“সর্বনাশ!!এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রূপক অর্থাৎ তুই মৃত্যুর কথা আগে থেকে জানতি।
স্বর্ণলতা যখন পড়ছিলো তখন তো ও জানতো রূপক মৃত।মৃত্যুর সংবাদ তো গর্ভবতী অবস্থায় ই ও পেয়েছিলো।তাহলে ও তো ভাবতেই পারে রূপক মৃত্যুর কথা আগে থেকে জানতো।কিংবা এ মৃত্যু সাজানো মৃত্যু।কারন এখন তো তুই ফিরে এসেছিস।ও জানে রূপক ফিরেছে।তাহলে তার অবর্তমানে সামলে নেওয়ার কথা রূপক কেনো লিখবে?নিশ্চয়ই সে জানতো তার মৃত্যুর সাজানো।এটা তো ভাবতে বাধ্য স্বর্ণ।আর এক্সিডেন্টে মৃত্যুর কথা ও কি বিশ্বাস করবে?ও তো বুঝতে পারবে তুই ও জড়িত।মানে রূপক ও জড়িত।কারন তুই তো রূপক সেজে আছিস।”
স্মিত হেসে রণক বললো-
—”ও বুঝতে পারে রূপক জড়িত।”
—”তুই কিভাবে বুঝলি?”
—”ওটা আমাদের গোপন কথা।তোমার জেনে কাজ নেই।
আর আমি ওকে ইচ্ছে করেই বলেছি এক্সিডেন্টের কথা।তোমার কি আমাকে এতো বোকা মনে হয়?মামা আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় আমার বুদ্ধিমত্তার জন্য।মামার ৯০% পরিকল্পনার সূত্রপাত আমার মস্তিষ্ক থেকে।”
—”তুই তাহলে ওকে সন্দেহ করার রাস্তা দেখালি কেনো?”
—”আমি চাই ও আমাকে সন্দেহ করুক।আমি ওকে এক পৃথিবীর সমান ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবো।একদিন ও আমাকে মন থেকে ভালোবাসবে।আমার কাছে ছুটে আসবে।সেদিন ওর সব সন্দেহের অবসান ঘটাবো।আমি বলে দিবো আমি কে।”
স্নেহার দুচোখ ভরা বিস্ময়।রণক কে তারা যতটুকু পাগল ভেবেছিলো তার চেয়ে হাজার গুনে বেশি পাগল রণক।মামা তার পিঠ বাঁচাতে হয়তো ঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এরপর স্নেহা আবার জিজ্ঞেস করলো-
—”আর মামাকে যে কথা দিয়েছিস তুই রূপক সেজে থাকবি।তাহলে স্বর্ণলতাকে তোর আসল পরিচয় বলে দিবি কেনো?”
—”ততক্ষণ রূপক থাকবো যতক্ষণ এই জাল থেকে মুক্ত না হবো।এ শর্তে রাজি না হলে মামা স্বর্ণলতাকে লম্পট টার হাতে তুলে দিতো।আমার কাছে দ্বিতীয় রাস্তা ছিলো না।সময় সুযোগ বুঝে সব কাজ করবো।”
—-”রণক! তোর কি মামার সাথে ডাবল গেইমিং করার কোনো পরিকল্পনা আছে নাকি?স্বর্ণলতা কে ভালোবেসে সব কিছু বলে দিবি না তো? কিংবা পুলিশ ডেকে মামাকে বাচ্চার মারার শাস্তি দিবি ?”
—”সত্যি কথা বলতে আমি কখনো এসব করবো না।আমি স্বর্ণলতা কে ততটুকুই বলবো যতটুকু ও জানে।আমি কিন্তু অনেক নোংরা অতীত জানি আপু।এইযে নীরব একে আমি কেনো দেখতে পারিনা?এসব খবর আমি জানি।মামা যেমন নীরব ও ঠিক তেমন।বাপ কা বেটা।আর আমি এটাও জানি এই নোংরা পাপ তুমি আর মা জানো।আর কেউ জানেনা।
আমি স্বর্ণলতাকে কোনো অতীত বলবো না।স্বর্ণলতাকে ভালোবাসি।হ্যাঁ অনেক ভালোবাসি।এক পৃথিবী সমান ভালোবাসি।তবুও ওকে সবকিছু বলবো না।
কারন এ পাপের জগতে আমিও পাপী।আমি সবকিছু বলে পুলিশের কাছে যাবো?মামাদের শাস্তির জন্য?তাহলে আমার শাস্তি হবেনা?আমার কিছু হলে স্বর্ণলতা কে দেখবে?ও তো তখন রূপকের হয়ে যাবে।এই কাজ কোনদিন ও করবো না।ও শুধু জানবে রূপক মৃত।মামা মেরে ফেলেছে রূপক কে।আর আমি জীবিত।”
—-”তোর পরিচয় জানার পর স্বর্ণযদি তোকে গ্রহন না করে ছুড়ে ফেলে দেয়?”
—”ফেলে দিক।আমি ওর ছায়া হয়েই থাকবো।যতদিন না ও আমাকে ভালোবাসে ততদিন আমি ওর পদস্থলে পিষ্ট হবো।”
—”বাবারে ভালোবাসা! এতো ভালোবাসা তোর দুলা ভাই ও আমাকে বাসেনা।”
—”অনেক ভালোবাসি অনেক।আর তোমাকে এতো কিছু বলার কারন আমি তোমাকে প্রচন্ড বিশ্বাস করি আপু।”
_____________________
রণক মেহুল কে দিয়ে নীরব আর তার মায়ের রাতের খাবারে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিলো।
সন্ধ্যা হলো রাত নামলো।আকাশে ইয়া বড় এক রূপালী চাঁদ উঠলো।
পূর্নিমার আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠলো।রাতের খাবার সবাই দ্রুত শেষ করলো।
রাতের খাবার শেষ করতে না করতেই নীরব আর শোভা গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো।
স্বর্ণলতা তার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলো।তখন রণক তার ঘরে ঢুকে স্বর্ণলতা কে বললো-
—”শুভ্রশিউলি! দ্রুত তৈরী হয়ে নাও।আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হবো।”
বলেই স্নেহার ঘরের দিক হাঁটা শুরু করলো।
স্বর্লতা পরনের শাড়ি বদলে খুব সুন্দর একটা নীল শাড়ি পড়লো।চুলগুলো পরিপাটি করে নিলো।চোখ ভর্তি কাজল দিলো।এতো সুন্দর করে সাজার পেছনে বিশাল কারন আছে।যা স্বর্ণলতার পরিকল্পনার ই একটা অংশ।সে চায় রণক তার মাঝে আরও মুগ্ধ থাকুক।
স্নেহাকে বিদায় দিয়ে রণক স্বর্ণলতার ঘরে আবার এসে থমকে গেলো-
স্বর্ণলতাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারছিলো না।স্বর্গের হুরপরীর মতো সুন্দর লাগছে তাকে।কাজল ভরা চোখে নীল শাড়িতে সদ্য ফোটাঁ নীলপদ্মের মতো লাগছিলো।
স্বর্ণলতার কাছে যেতে যেতে রণক বললো-
”তুমি আমার শিউলি ফুল,
আমার অবাধ্য মনের না করা ভুল।
সাদা রঙা ছোট্ট মুক্তার ন্যায়,
এ মন শুধু তোমাকে আগলে রাখতে চায়।”
স্বর্ণলতা স্মিত হাসলো।আর তাদের চাঁদ দেখার অভিযানে বেড়িয়ে পড়লো।
চলবে………
Sharmin Sumi-শারমিন সুমি