স্বর্ণলতা part 38

0
348

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৩৮
_____________
মেহুল দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে ঢুকলো।একটু শ্বাস নিয়ে বললো-
—”আপা,মামা আইতাছে এইদিক।আপনে কোনো জায়গায় লুকাইয়া যান।”

—”মেহুল ঠিক বলেছে স্বর্ণলতা।মামা তোমাকে এ ঘরে আমার সাথে দেখলে সন্দেহ করতে পারে।তুমি বরং এই আলমারির ভেতর লুকিয়ে যাও।”

স্বর্ণলতা তারাতারি করে আলমারীর ভেতর ঢুকে গেলো।কিছু সময় পরেই মামা ঘরে ঢুকলো।মামার মুখটা মলিন দেখাচ্ছে।
স্নেহাকে বললো-
—”বিয়া তো হইবো না।হুদা হুদি আমার কতগুলা টাকা খরচা হইলো।”
স্নেহা বিস্মিত হওয়ার ভান করলো।আর বললো-
—”কেনো মামা!!সব আয়োজন তো শেষ-ই তাহলে বিয়ে কেনো হবেনা?”

—”তোর অর্কমার ঢেকি ভাই আছেনা!!হে থাকতে আর শত্রু লাগে?”

—”কে?রণক না রূপক?”

—”রণক!রূপক আইবো কই থিকা।হারামজাদারে এতোডা বছর আমার লগে রাখছি।পালছি সব শিখাইছি আর অহন পিরিত ব্যারামে ধরছে তার”।

সৈকত খিকখিক করে হেসে উঠলো।যেনো মামার হারে তার খুব ভালো লাগছে।
মামা একটু কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
—”কি হইলো ডা কি! তোমার আবার হাসি পায় বুঝি?”

—”ইয়ে,না মানে।মামা হয়েছে কি শোনেন।রণক তো আমাদের দলেরই।ওর কি এসব করা সাজে!আর যাইহোক স্বর্ণলতা তো ওর ভাবী।”

—”মাথায় তো আমারো খেলে না।এই স্বর্ণলতার জন্য কি যে বিপদ হইলো।এতো সুন্দর কোনো মানুষ হয়!!আর সবগুলা যদি ওরেই চায় আমি কয়ডারে দিমু?”

—”সবগুলো চায় মানে?আর কে কে চায় মামা?”

—”সেইদিন পাকনামি কইরা রণক রে লইয়া জঙ্গলে গেছিলো না?ঐ হানে তো রণক আর স্বর্ণলতারে আমগো দলের কিছু লোক দেখছে।তো ঐহানে আশু সর্দার আছিলো।আশু সর্দার হইলো গিয়া আমার গুরু।হের স্বর্ণরে একদিনের জন্য হইলেও লাগবো।এইদিকে রণক ওরে ছাড়বো না।আবার নীরব হারামজাদাডার ও নাকি লাগবো।এইডা আবার যদি রণক কোনভাবে জানবার পারে বুঝ তাইলে কি হইবো।আমি পড়ছি উভয় সংকটে।ক আমি কোন দিক যামু?”

এবার স্নেহা রসিকতা করে বলেই বসলো-
—”মামা শোনো।স্বর্ণরে কেটে কয়েক ভাগ করে সবার মাঝে দিয়ে দাও।”
মামা স্নেহার রসিকতায় মজা পেলো না।সে কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলো।হঠাৎ আবার দরজা থেকে ঘুরে এসে স্নেহাকে জিজ্ঞেস করলো-
—”আচ্ছা তোরা যাবি কবে?”

—”ওমা! আমরা এখানে কি তোমার কোন অসুবিধা করছি?”

—”না হেইডা না।”

সৈকত বলে উঠলো-
—”মামা,আপনাদের তো বলেইছি।স্নেহার দুই দুই বার মিসক্যারেজ হওয়ার জন্য ও খুব ড্রিপেশনে চলে গিয়েছিলো।তাই ওকে আম্মার কাছে নিয়ে এসেছি।মায়ের কাছে থাকলে ভালো লাগবে।আর আমিও অফিসে বেশ কিছুদিন ছুটি ও পেয়েছি।কিছুদিন থাকুক।আমি ছুটি শেষ হলে নিয়ে যাবো।”

—”আরে না না জামাই।ওর যতদিন মন চায় থাকুক।তোমার ছুটি শ্যাষ হইলে তুমি যাইও গা।আইচ্ছা আমি যাই তাইলে।বাইরের ভোজ গুলান সবাইরে খাওয়াইয়া দেই।”
মামা বিলাপ করতে চলে গেলো-
‘আহারে!এমনি উপরি ইনকাম নাই।অহন আমার কতডি টাকা জলে গেলোরে!’

মামা চলে যাওয়ার পর স্বর্ণলতা বের হলো।
—”আপু এখানে আর থাকা যাবেনা।আমি আমার ঘরে যাই।আজ রাতে তুমি সবার সাথে বৈঠক করবে।এবং তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইবে।তারা এখন রণক কে নিয়ে কি ভাবছে।তাদের পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে উল্টো গুটি আমি সাজাবো।

সম্মতি সূচক কন্ঠে স্নেহা বললো-
—”আজকে অবশ্যই কিছু না কিছু কথা তো উঠবেই।তুমি বরং ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো”।
স্বর্ণলতা যাওয়ার আগে স্নেহা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আর বলে গেলো-
”আমার একটাই লক্ষ্য আপু।আমি শত্রুদের শাস্তি দিয়ে আমার স্বামীর কাছে ফিরতে চাই।”
স্নেহা স্বর্ণলতার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো-
—”অবশ্যই পারবে তুমি।তুমি এক সাহসী নারী।সবকিছুর প্রতিশোধ তুমি নিতে পারবে।”

রূপকের মা সবাইকে খাইয়ে স্বর্ণলতার ঘরে এসেছিলো।আর স্বাভাবিক ভাবেই বলে গিয়েছিলো-
‘তোমার যেহেতু নীরবকে পছন্দ না তোমার সম্মতি নেই। সেহেতু জোর করে তোমাকে আর বিয়ে দিবো না।কিন্তু খুব শীঘ্রই তোমার পাত্র তোমার সামনে হাজির করানো হবে।তাকে বিনা দ্বিধায় তোমাকে বিয়ে করে নিতে হবে।জাফর কে মানানো খুব মুশকিল ছিলো।তবুও ওকে আমি বুঝিয়েছি।এখন তোমার দিক আমরা দেখলাম।আশা করি পরবর্তী তে আমাদের দিকটাও তুমি দেখবে।যেহেতু সবকিছু জেনেই গিয়েছো এখন আর ভনিতা করে লাভ কি?আমাদের বাচ্চা চাই।তুমি বাচ্চা দিতে পারলে মুক্ত হয়ে যাবে।’
স্বর্ণলতা কিছুই বললো না।কারন সে সত্যি টা জানে।রণক এর জন্য বিয়ে পন্ড হয়েছে।এসব সাজানো নাটক এখন তার সামনে বলা হচ্ছে।তবে নীরব নিশ্চয়ই খুব রেগে আছে।

_________________
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ।বিয়ে টা হবে না শুনে অনেকে অনেক মন্তব্য করছিলো।কিন্তু জাফর সবকিছু সামলে নিয়েছে।খুব চালাকির সাথে সবার উত্তর ও দিয়ে দিয়েছে।যাতে করে দ্বিতীয় কোন কথা সৃষ্টি না হয়।এদিকে আশু সর্দার জাফর কে বারবার চাপ প্রয়োগ করছে।কবে পাবে স্বর্ণলতা কে।
সবাইকে বিদেয় দিতে দিতে ঘড়ির কাটা ১১ এ তে চলে গেলো।গ্রাম্য রাত,৭/৮ টা বাজলেই ঘুটঘুটে আঁধারে প্রকৃতিকে জড়িয়ে ফেলে।অন্যদিকে শীতের রাত।প্রচুর ঠান্ডা।গুরত্বপূর্ণ গোলবৈঠক বসলো জাফরের ঘরে।
নীরব, রূপকের মা,শোভা(স্বর্নলতার সৎ মা),স্নেহা এবং সৈকত সবাই উপস্থিত।
নীরবের রাগ এখনো কমেনি।তাকে ঠান্ডা করতে তার মা ব্যস্ত।
মামা উঁচুগলায় বললো-
–”থাক শোভা।ওতো মাখন লাগানো লাগবো না।এমনি ঠিক হইবো।”

নীরব উঠে চলে যাবে এমন সময় শোভা হাত ধরে ফেললো।এবং চোখের ইশারায় বসতে বললো।
মামা বলতে শুরু করলো-
—”আমরা আমাগো একটা উদ্দেশ্যে আগাইতাছি।ঐডা সফল হইলে আমরা হমু অমর।আমগো শক্তি সব শক্তিরে ধ্বংস কইরা ফেলবো।স্বর্ণলতার জন্য রণক পাগল।আরও বাকীরাও পাগল।তয়,তারা শুধু এক রাত কাটাইতে চায়।রণক চায় সারাজীবনের লিগা।”
শোভা বলে উঠলো-
—”তো এখন করনীয় কি?”

—”রণক রে আবার রূপক সাজাইয়া এ বাড়িতে ঢুকামু।রূপক এর মরার খবর মিছা এইডা স্বর্ণলতা বিশ্বাস করবো।রণক পিছে পিছে আমগো লগে থাকবো কিন্তু উপরে উপরে স্বর্ণলতা রে বুঝাইবো ও স্বর্ণলতার দলে।স্বর্ণলতা যহন আবার গর্ভবতী হইবো তহন ওরে স্নেহা সব সত্যি কইয়া দিবো।

স্বর্ণলতা অবশ্যই তহন রণক এর থিকা দূরে যাইবো।স্বর্ণলতা নিজে না চাইলে রণক তহন তো ওর কাছে ঘেষতে পারবো না।স্নেহা ওরে দূরে নিয়া যাইবো।রণক রে ঘৃনা করবো স্বর্ণলতা।রণক এর তহন কিছু করার থাকবো না।”

স্নেহা বলে উঠলো-
—”রণক যখন জানতে পারবে আমি সব বলেছি তখন ও কি আমাকে আস্ত রাখবে?”

—”তুই স্বর্ণলতা রে কবি তোর কথা না বলতে।স্বর্ণলতার বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে ও তোর কথা বলবো না”।
নীরব বললো-
—”হুম,পরিকল্পনা ভালো।কিন্তু তার আগে আমি স্বর্নলতার সাথে ১ রাত থাকতে চাই।”
মামা কটমট করে নীরব এর দিকে তাকালো আর বললো-
—”কালকে আমার লগে মধুনগর যাইস”।

—”মধুনগর!”

—”হ মধুনগর।ঐখানে মাইয়া রা শরীর বেঁচে।দুইরাত থাইকা আহিস”।

—”না!আমি ওগুলার কাছে যাবো কেনো?ওরা কি ভালো নাকি?”

উপহাস মিশ্রিত কন্ঠে জাফরের প্রত্যুক্তি-
—”ওরে! বাবা! তুই কি ভালা?”

রূপকের মা বিরক্তি স্বরে বললো-
—”ও থাকতে চাচ্ছে থাকতে দে জাফর।এক রাতের ই তো ব্যাপার।”

—”ব্যাপার তো এক রাতের ই কিন্তু এই ভুলের মাসুল রাতের চাঁদ ডুবার লগে লগে দিনের আলোর মতো ঝকঝকা হইয়া যাইবো রণকের সামনে।রণক যহন আইবো স্বর্ণলতা তো রুপক মনে কইরা সব কইবো তহন কি করবো ও?”

—”হেরে এতো ডরান ক্যান আপনে?”

—”কেন ডরাই আমি জানি।
যাক গা।নীরব রে আমি ১ রাইত থাকার ব্যবস্থা কইরা দিমু তয় অহন না।”
সৈকত বললো-
—”মামা,রণক যেহেতু স্বর্ণলতা কে চিরদিনের জন্য চায় সেহেতু ওকে দিয়ে দিন।এমনি তে তো রূপক জানে স্বর্ণ বেঁচে নেই।অন্যদিকে রণক ও পাগল।মাঝখানে বলে দিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করার দরকার কি?”

—”পাগল দেইখাই একবারে দেওয়া যাইবো না।শোনো জামাই।মানুষের জীবনে কহনো দুইটা নিশানা থাকবার পারেনা।তাইলে মানুষ কোন নিশানায় আগে ছুটবো হেইডা চিন্তা করতে করতে অন্যরা আগাইয়া যায়।
লক্ষ্য আর নেশা দুইডা একলগে চুন আর দই এর মতো।দেখতে একই।কিন্তু একটা খাইলে মুখ পুড়ে আরেকটা খাইলে স্বাদ পায়।লক্ষ্য হইলো দই।আর নেশা হইলো চুন।এই নেশা আর চুন ই হইলো অন্ধ ভালোবাসা।ভালোবাসার নেশা।

আইজ না হোক কাইল,প্রেমের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে তীরে আইসা যহন পৌঁছাইবো তহন তীরের সৌন্দর্য দেইহা পানিরে অভক্তি লাগবো।এতোদিন পানির ভিতরে যে বড় হইলো হেই পানি তার কাছে বিস্বাদ,ঘোলা লাগবো।কারন হে তীরের সৌন্দর্য পাইয়া গেছে।তহন পানি তার শত্রু।আর শত্রুরে শ্যাষ করার জন্য বহু পদ্ধতি অবলম্বন করবো।”

—”কি কন এইগুলা?পানি,তীর,জোয়ার?হইতাছে তো স্বর্ণলতা আর রণক এর কথা।”
মামা কিন্ঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে নীরব এর দিকে একবার তাকালো।এরপর শোভাকে বললো-
—”শোভা,ওর বাপ তো ধুরন্দর চালাক।এইডা এমন মাথা মোটা হইছে ক্যান?”

—”কি বলেন?আমি মাথামোটা না।আপনার কথার যুক্তিখন্ডন করেন”।

—”জোয়ার হইলো স্বর্ণলতার প্রতি রণকের ভালোবাসা।আর ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে তীরে ওঠা হইলো স্বাভাবিক জীবন যাপন।আমরা অহন জলের মধ্যে অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটা সমাজের ভেতর আছি।যেইহানে খুন,রক্ত,সাধন দিয়া ভরা।ও এইহানে ছোট থিকা বড় হইছে।কিন্তু যহন ও আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হইবো তহন ওর এসব ভালা লাগবো না।তহন আইবো আমগো ক্ষতি করবার।স্বর্ণলতারে সব যদি কইয়া দেয় তাইলে বুঝবি কোন ঘাটের পানি কোনঘাটে গড়ায়।তাই রণক রে আলাদা করতেই হইবো।এই হইলো গিয়া পরিকল্পনা।অহন খালি রণক রে ঢুকানোর অপেক্ষা।”

চলবে…….
Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here