স্বর্ণলতা part 32

0
327

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৩২
________________
রাত তখন আড়াইটা।স্বর্ণলতা ধীর গতিতে দরজা খুললো।সঙ্গে মেহুল।মন্টু মামার ঘরে।এক কদম দু কদম করে এগিয়ে চললো বাঁশঝাড়ের দিক।
ঘন কুয়াশা চারদিক।সাথে ঘুটঘুটে অন্ধকার।অন্ধকার ভেদ করেই হেঁটে চলছে মেহুল আর স্বর্ণলতা।
বাঁশঝাড় বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে ছিলো না।মাত্র ৫ মিনিটের পথ।স্বর্ণলতা চাদরে মুড়িয়ে একটা ছোট কাস্তে এনেছে।যেটা মেহুল জানেনা।কাস্তে টা মন্টু জোগাড় করে দিয়েছে।স্বর্ণলতা তাকে বলেছিলো রাতে একা থাকতে ভয় করে।জীবনসংকটে ভুগছে সে।তার আত্মারক্ষার্থে ধারালো কিছু তার অতীব প্রয়োজন।

যেহেতু মন্টু চেয়েছিলো স্বর্ণলতাকে কথার মাঝে শান্ত রাখতে তাই সে কোন কথা না বাড়িয়েই সবার অগোচরে কাস্তে জোগাড় করে দেয়।কিন্তু কাস্তে দিয়ে স্বর্ণলতা আসলেই কি করবে সেটার বিন্দুমাত্র ধারনা ছিলোনা মন্টুর।আর এদিকে মেহুল তাকে শুধু কবর টা দেখিয়ে শান্ত করতে চেয়েছিলো তাই সে সবার অগোচরে স্বর্ণলতাকে নিয়ে এসেছে।এদিকে স্বর্ণলতার মনে ছিলো ভিন্ন কিছু।
হারিকেনের নিভু নিভু আলোতে এগিয়ে যাচ্ছিলো দুজন।একটা সময় দুজনেই থামলো।
মেহুল হাতের ইশারায় স্বর্ণলতাকে দেখিয়ে দিলো কবর টা।
—”আপামনি,ঐ যে কবর।”
একটা ছোট নিষ্পাপ শিশু মাটির ভেতর!ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো স্বর্ণলতার।নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিলো।চোখ গুলো ঘোলা হয়ে যাচ্ছিলো।আর অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো-
—”আমার বাচ্চা!আমার সোনামনি!”
তখনি আবার নিজেকে সংযত করে চোখ মুছে মেহুল কে বললো-
—”তুমি এখানেই থাকো মেহুল।আমি আমার বাচ্চার সাথে একান্তে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে চাই।”

মেহুল গলা ভারী করে বললো-
—”না,না আপামনি! ঐ ডা কবরস্থান। এতো রাইতে আপনার একা যাওয়া ঠিক হইবো না।”

—”ওখানে তো শুধু একটাই কবর দেখতে পাচ্ছি।”

—”হ একটাই,তয় কবর তো!আর অহন কত অন্ধকার!”

—”তুমি হারিকেন নিয়ে এখানে দাড়াও।আমার বাচ্চাকে আমি ভয় পাবো না।তাছাড়া পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো জীবিত মানুষ।আর যদি আলোর কথা বলো তাহলে আর আমার কাছে ছোট্ট একটা টর্চ আছে।আমি যেতে পারবো।তোমাকে অনুরোধ করছি এখানে থাকো।আর এখান টা পাহারা দাও।”
—”কিন্তু আপামনি……..”
মেহুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই স্বর্ণলতা চলে গেলো।

_________
সামনে ছোট্ট একটা কবর।কবরের কাছে এসে ধুপ করে মাটিতে বসে পড়লো স্বর্ণলতা।আর চোখের পানিতে কবরের মাটি ভিজিয়ে ফেললো।কবরের মাটি স্পর্শ করে কান্না করতে লাগলো।আর বললো-
—”আমার তোর কবর খুঁড়তে খুব ভয় হচ্ছে সোনা।যদি সত্যি কবরের ভেতর তোর মুখ দেখতে পাই আমি কি সহ্য করতে পারবো!তোর মুখ খানা দেখে আমার বুকের সাথে তোকে মিশিয়ে নিবো।আমার বুকের উষ্ণতায় কি তুই প্রাণ ফিরে পাবি?তুই যদি সত্যি ভেতরে থাকিস তাহলে তোর কবর খোঁড়ার জন্য তোর হতভাগা মা কে মাফ করে দিস।আমি চাইনি তোর সাথে এমন টা হোক।”
স্বর্ণলতার নাক লালবর্ণ ধারন করলো।ভেতরে ভেতরে মাটি কাপানো আত্মচিৎকার আর বাইরে নীরব থমথমে জলে ভেজা আঁখিদ্বয়।

বিসমিল্লাহ বলে হাতে থাকা কাস্তে দিয়ে কবর খুঁড়তে শুরু করলো।বেশি সময় নেই তার হাতে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করতে হবে।
পাগলের মতো মাটি খুঁড়তে লাগলো।মিনিট ৫ এক খোঁড়ার পর একটা মাচা দেখতে পেলো।মাচার নিচে কাফনে মোড়ানো একটি ছোট্ট দেহ।কি নিষ্ঠুর এই দৃশ্য!
স্বর্ণলতার বুকের খাঁচায় যেসব আশার পাখিরা বাসা বেঁধেছিলো,তারা এই দৃশ্য দেখে উড়াল দিলো।শুধু রেখে গেলো অশ্রু মেশানো এক বুক হাহাকার।
মাটি খামচে ধরলো স্বর্ণলতা।পৃথিবীর বুকে এ দৃশ্য দেখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো না?
নিজের সন্তানের কবর নিজে খুঁড়েছে।
অপরাধবোধ দূরে ঠেলে দিয়ে মাচা সড়ালো স্বর্ণলতা।বাচ্চার মুখ টা অন্তত্য দেখবে সে।কপালে চুমু এঁকে দিবে।মাফ চেয়ে নিবে।

মাচা সড়িয়ে কাফনে মোড়ানো দেহটি স্পর্শ করতেই আৎকে উঠলো স্বর্ণলতা।
—”একি!! এতো শক্ত কারও দেহ হয়?”

ভালো করে হাতড়ে দেখলো স্বর্ণলতা।

—”নাহ এটা তো কারও শরীর মনে হচ্ছেনা।”
কাফনে মোড়ানো বস্তুটি স্বর্ণলতা মাটি থেকে উঠিয়ে কোলে তুলে নিলো।আর কাফন সড়াতেই দেখতে পেলো কলাগাছের এক অংশ কেটে কাফনের কাপড় দিয়ে পেঁচানো হয়েছে।
স্বর্ণলতা স্মিত হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো-
—”চোখে ধুলো দেওয়ার কি অভিনব কৌশল তারা জব্দ করেছে।বাচ্চাকে লুকিয়ে রেখে বলে বাচ্চা মারা গেছে।আমি যদি বাচ্চাকে না পাই সবাইকে নিজ হাতে খুন করে ফেলেবো।এখন বুঝতে পারছি কেনো স্নেহা আপু ঐ বাড়িতে ভয় পেতো।তারা তো মানুষ না।নিজের ছেলের সন্তানকে লুকিয়ে রাখে!
দু হাত দিয়ে দু চোখ মুছে চুল ঠিক করে নিলো স্বর্ণলতা।আর বললো-
—”না অনেক হয়েছে কান্না।এবার মরণ যুদ্ধে নামবো।
সাহসী সৈনিকদের মতো জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করবো।আমার বাচ্চাকে আমি খুঁজে বের করবো।”

মরমর পাতার শব্দে কারও এগিয়ে আসা লক্ষ্য করছিলো স্বর্ণলতা।টর্চ ধরলো,দেখলো মেহুল হারিকেন নিয়ে এগিয়ে আসছে।দ্রুত মাটি সরাতে লাগলো।মেহুলের এখানে আসতে আসতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে।দ্রুত মাটি ঠিক করতে লাগলো স্বর্ণলতা।
কিছুক্ষণের মধ্যে কবরটা ঠিক আগের মতো করে ফেললো।
মেহুল এগিয়ে আসলো।এবং হারিকেনের আলো স্বর্ণলতার দিকে ধরলো।
সে দেখলো স্বর্ণলতার শাড়ি,মুখে মাটি লেগে আছে।উৎসুক দৃষ্টি তে মুখ পানে চেয়ে স্বর্ণলতার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-
—”আপামনি!আপনার এই অবস্থা ক্যান?কপালে,গালে,শাড়িতে মাটি ক্যামনে লাগলো?আর আপনার হাত ভরা মাটি!!”

—”মাটি লেগেছে কারন কবরে শুয়ে কান্না করছিলাম।”

—”বাচ্চা তাইলে সত্যি আছে?”

—”কেনো! থাকার কথা না?”

মেহুল আমতা আমতা করে ঢোক গিললো আর শান্ত কন্ঠে বললো-
—”মইরা গেলে তো মানুষ কবরেই থাকে।থাকবো না ক্যান আপা!আপনি বিশ্বাস করতাছিলেন না তাই কইছি আর কি।”

—”চলো বাড়ি চলো।অনেক দেরী হয়ে গেছে।”

কেউ আর কোন কথা বললো না।সারারাস্তা স্বর্ণলতা শক্ত করে কাস্তে টা ধরে নিয়ে গেলো।পুরো শরীর মাটিমাখা।এ শরীরে কেউ দেখলে বুঝে যাবে স্বর্ণলতা এতোক্ষণ মাটির সাথে যুদ্ধ করেছে।কোন অবস্থাতে কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা সে কোথায় গিয়েছিলো।
তাদের বাসার সামনে একটা পদ্মপুকুর আছে।পদ্ম পুকুরের পানি বেশ টলটলে। মন্টু প্রায় সময়-ই পুকুরে গোসল করতো।
স্বর্ণলতা পুকুরের দিক যেতে লাগলো।
মেহুল ফিসফিসিয়ে বললো-
—”ও স্বর্ণ আপা! কই যান আপনে?ওইদিক পুকুর তো! ও আপা দাড়ান।জোরে কথা কইলে মামা উইঠা যাইবো।
ও আপা!!!!!”

স্বর্ণলতা বিনাবাক্যে পুকুরে নেমে গেলো।না ফিরলো পেছন, না দিলো একটা কথার উত্তর। পুকুরের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে পুকুরে পা ভিজালো তারপর কোমড়, শেষ পর্যন্ত গলা।এরপর এক ডুব দিলো।আর মেহুল পদ্মপাড়ে ঠায় দাড়িয়ে রইলো।ঠিক বুঝতে পারছিলো না এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত।মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
স্বর্ণলতা কি আত্মহত্যা করার জন্য নামলো?সে কি বাচ্চার জন্য পাগল হয়ে গেলো।এখন সে কি করবে?বহু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো সেও পুকুরে নামবে।স্বর্ণলতাকে বাঁচানোর জন্য সেও ঝাপ দিবে।

পুকুরের দিকে আগালো মেহুল।এরপর পুকুরে নামলো।গোড়ালি পর্যন্ত ভিজতেই স্বর্ণলতা মাথা তুললো।
কি অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো তাকে তা ভাষায় ব্যক্ত করা যাবেনা।পদ্মফুলের ভেতর থেকে অপরূপা এক সুন্দরী নারীর আবির্ভাব।চারদিকে পদ্ম আর তার মাঝখানে পদ্মাবতী।কয়েটা ফুলের পাপড়ি তার মুখশ্রী তে শোভা পাচ্ছে।চুল এলোমেলে হয়ে মুখে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এ যেনো এলোকেশি এক পদ্মাবতী কন্যা।মৃদু আলোতেও তার রূপ ঢাকা পড়ছে না।তাকে এই মূহুর্তে কোন কবি যদি দেখতো সে হয়তো তার রূপের প্রশংসায় কাব্য রচনা করে ফেলতো।অথবা তার রূপের ঝলকে হারিয়ে যেতো কবির ছন্দ।শুধু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকতো তার পানে।
মেহুল তো কোন কবি নয়,তাই সাধারণ ভাবেই নিজেকে বললো-
‘মনে হইতাছে জলের ভেতর থিকা জলপরী বাহির হইলো।এতো সৌন্দর্য কোনো মানুষের হয়?মানুষ রূপে সাক্ষাৎ পরী।এতো রূপ!আমার চোখ ঝলসাইয়া যাইতাছে’।

অস্ফুট স্বরে শুধু একটা কথাই বের হলো-
”পদ্মাবতী জলপরী”।
স্বর্ণলতা মেহুলের দিকে তাকিয়ে দেখে মেহুল হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।মৃদু হেসে স্বর্ণলতা বললো –
—”ভয় পেয়োনা।মরার জন্য নামিনি।মারার জন্য নেমেছি।এই শরীরে বাড়ির কেউ দেখে ফেললো বুঝে যাবে আমরা কোথায় গিয়েছিলাম।তাই আমি গোসল করে নিলাম।
বাড়িতে গিয়ে কাপড় বদলে নিবো।আর এগুলো ভালো করে চিপে আমার ঘরে শুকাতে দিবো।আর হ্যাঁ আমি যখন ঘরে যাবো তখন পানির ছিটফোঁটাও যাতে না থাকে।তুমি কোন কাপড় দিয়ে আমার ঘর পর্যন্ত পানি গুলো মুছে দিবে।তারপর নিজের ঘরে শুয়ে পড়বে।

স্বর্ণলতা পানিতে ডুব দিয়েই কাস্তে টা পানিতে ফেলে দিয়েছিলো।কারন কাস্তে টা তে মাটি লেগে ছিলো।এই অবস্থায় সে মন্টু কে এটা ফেরত দিতে পারবে না।আর মন্টু কে দিতে গেলে এটা পরিষ্কার করে দিতে হবে যেটা মেহুলের সামনে সম্ভব না।
স্বর্ণলতা যেমন নিজেকে সাহসী করে তুলেছে ঠিক তেমনি নিজেকে সাবধানী ও করে তুলেছে।
পাগলের মতো দৌড়ঝাঁপ আর না।আজকে থেকে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় সে রচনা করবে।
যে অধ্যায়ের নাম হবে সাবধানী এবং সাহসী স্বর্ণলতা।

চলবে……………
✍️Sharmin Sumi.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here