#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৩১
_____________
রূপকের মাএর হাকডাক।
–”মেহুল!!কই তুই?তোকে পাত্তা পাওয়া যায়না কেনো?”
—”হ খালাআম্মা কন।”
—”কিরে?এতো দরজা ধাক্কানোর শব্দ কেনো?”
—”আপামনিরে মামা ঘরের ভেতর বন্দী কইরা রাখছে।বাচ্চার খোঁজ করতাছিলো।”
—”ও!তাহলে মরে নি! বেঁচে আছে।”
—”হে অনেক কষ্ট পাইতাছে।ভাইজান নাই আবার বাচ্চাটাও কাছে নাই”।
—”তোর এতো দরদ উতলাইয়া পড়ে কেনো?”
—”মামা হেই কোন বেলা আটকাইয়া রাখছে।সারাদিন কিচ্ছু খায়নাই।এমনি তো হে অসুস্থ।”
—”শোন,মেহুল।তোকে কেনো এ বাড়িতে আমাদের কাছে আনা হয়েছিলো মনে নেই?ওর পক্ষে থাকার জন্য না।আর আমাদের বাচ্চা পেয়ে গেছি এখন আর ওকে দরকার নেই।মরলে মরুক।”
রূপকের মা চলে গেলো।বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।আর স্বর্ণলতার ভেতরে কষ্টের ঝড় বইছে।সারাদিন স্বর্ণলতা ঘরে বন্দী।মেহুল কতবার ছটফট করেছে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য কিন্তু মামার ভয়ে তা পারেনি।মন্টু ও কিছু করতে পারেনি।চোখ মুখ শক্ত করে নিরবে সহ্য করেছে।এখানে তারা ভৃত্য। মনিব যা বলবে তাই তাদের করতে হবে।
কিন্তু স্বর্ণলতার প্রতিটা আত্মচিৎকার তাদের শিরা উপশিরায় জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে।কিন্তু এ জ্বালা নেভানোর ঔষধ ব্যবহার করার তাদের সাধ্য নেই।মামার হুকুমের বাইরে এক পা নড়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু কে সামনে আনা।
একটু পর মামা আসলো।গলা নিচু করে বললো-
—”মেহুল!তুই বুদ্ধিমতি।আশা করি বুদ্ধি দিয়া কাজ করবি।তোর স্বর্ণলতার জন্য খারাপ লাগতাছে আমি বুঝি।তয়,তুই-ই পারবি ওর কষ্ট কমাইতে।ওর লিগা খাওন লইয়া যা।আর বুঝা যে বাচ্চাডা বাইচা নাই।মন্টু তুই ও যা।এমনে কানলে মইরা যাইবো।”
—”খালাআম্মা বইলা গেছিলো স্বর্ণআপা মরলেও নাকি যায় আহে না।”
—”বাদ দে,রাগে কইছে।অহন যা করতে কয়ছি কর গিয়া।”
মেহুল মন্টু আর কিছু বললো না।মামার মত পরিবর্তন হয়েছে এই অনেক।দ্রুত খাবার নিয়ে স্বর্ণলতার ঘরে গেলো।
স্বর্ণলতা ফ্লোরে শুয়ে আছে।কান্না করতে করতে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।চোখের পানি দিয়ে ভর্তি পুরো মুখ।আর চোখ মুখ অসম্ভব লাল বর্ণ ধারন করেছে।
—”আপামনি!উঠেন।আর কাইন্দেন না।একটু উঠেন।বিছানায় গিয়া বহেন।আপনার ঠান্ডা লাইগা যাইবো।”
স্বর্ণলতা নিভু নিভু দৃষ্টিতে মেহুলকে একবার দেখে আবার হু হু করে কান্না জুড়ে দিলো।
মন্টু বললো –
—”বুবুজান,আমি মন্টু! আমরা না আপনার ভাই বোন?কানতাছেন ক্যান?উঠেন।কাইন্দেন না।”
—”মন্টু! জানো ওরা আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলছে?আমার স্বামী নেই আমার বাচ্চাটাও নেই।তাহলে আমি কি করে শান্ত থাকবো?”
মেহুল কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে বললো-
—”আপামনি!আমগো ওপর ভরসা রাখেন।আপনি খালি খাটে উইঠা বসেন।আমি আসতাছি দাড়ান।”
মেহুল চলে গেলো।এবং সাথে করে ছোট একটা খাম নিয়ে আসলো।ততক্ষণে স্বর্ণলতাকে জোর করে খাটে বসিয়ে দিয়েছে মন্টু।
মেহুল স্বর্ণলতাকে খাম টি এগিয়ে দিলো।এবং বললো-
—”যহন আমি ঐ বাড়িতে ছিলাম।তখন একবার রূপক ভাইজান আমারে এইডা দিছিলো।আর কইছিলো এইডা যেনো আমি বাচ্চা হওয়ার পর আপনারে দেই।কইছিলাম আমি অহন দিলে কি হইবো? হে আমারে কইছিলো যদি বাচ্চা হওয়ার পর দেই তাইলে আপনে নাকি বেশি খুশি হইবেন।আমি তো আপনারে কোন কিছু দিয়া খুশি করবার পারতাছি না। যদি এইটা দিয়া খুশি হন তাইলেও মনডা শান্ত হইবো।”
স্বর্ণলতা খাম টি এ পাশ ওপাশ দেখে নিলো।খাম টি বের করে দেখলো একটি চিরকুট।ঠাসা ঠাসা করে সেখানে লেখা ছিলো-
”স্নিগ্ধ শীতল পরশমনি
ও আমার নিল নয়নী
তোমায় দেখে তৃষ্ণা আমার না জুড়ায়।
তুমি কিন্তু বেঁচে থাকবে আমার মায়ায়।
তোমার মধ্যে আমাকে রেখো।
পৃথিবী জুড়ে স্বপ্ন এঁকো।
তুমি কিন্তু পুষে রেখো,তোমার অন্তরের ঠিক পাশে।
আমাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো তোমার হৃদয় মাঝে।
কাজল মাখা মায়াবী চোখে বৃষ্টি যাতে না আসে।
আমি কিন্তু থাকবো তোমার ঠিক আশেপাশে।
তোমার মাঝেই হবে আমার বাস।
তুমি,আমি আর আমাদের কল্পকথা বিন্যাস।”
চিরকুট টা পড়ে স্বর্ণলতা থমকে গেলো।নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো আর ভাবতে লাগলো-
—”রূপক এখানে আমাকে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?তার মৃত্যুর ইঙ্গিত? সে কি করে জানলো তার মৃত্যু হতে পারে?আর মৃত্যু যদি সে জানতোই তাহলে নিজেকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা করলো না কেনো?
এখানে কল্পকথা বিন্যাস মানে কি! সে কি আমাদের বাচ্চা কথা বলেছে?সে কি জানতো বাচ্চা হওয়ার পর এমন কিছু হবে।যদি জানতো তাহলে তার বাচ্চা কে সে রক্ষা করলো না কেনো?আশ্চর্য! একজন বাবা তার সন্তানের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও চুপচাপ থাকবে?নাকি তারা আমার সন্তান কে লুকিয়ে রেখেছে?
আসলে লুকিয়ে রেখেছে না মেরে ফেলেছে?নিজের দাদী তার নাতি বা নাতনি কে মেরে ফেলতে পারবে?নিজের ছেলেকেই বা কি করে মেরে ফেলবে!রূপক কি বুঝতে পেরেছিলো আমি স্বামী সন্তান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবো।তখন সে আমাকে সামলানোর জন্য এই চিরকুট টি লিখলো!
মামা সেসময় কি বলেছিলো বাঁশগাছের নিচে কবর!আমি কবর এ যাবো।যদি সত্যি আমার বাচ্চা বেঁচে থাকে!এখন তো শুধু ওরা আমার বাচ্চার অপরাধী না রূপকেরও অপরাধী।না আমার ওখানে যেতে হবে।”
উল্টোপাশে চোখের পানি মুছে স্বর্ণলতা মেহুলকে বললো-
—”আমার বাচ্চার কবর কোথায়?”
—”আগে খাইয়া লন।”
স্বর্ণলতা হনহনিয়ে মামার রুমে চলে গেলো।মামা রুমে চিৎ পটাং হয়ে শুয়ে ছিলো।স্বর্ণলতাকে দেখে বেশ লজ্বিত হলো।আবার বিরক্ত বোধ ও করলো।
এক দলা থুথু ফেলে জিজ্ঞেস করলো-
—”কি সমস্যা?এনে আইছো ক্যান?ত্যাজ কি কমে নাই অহনো?”
—”মামা,আমার বাচ্চা টা মারা গেলো।আমাকে শেষ দেখা টাও দেখতে দিলেন না?”
—”তোমার কি জ্ঞান ছিলো নাকি?লাশ এতোক্ষণ রাখা যায়না।দাফন কইরা ফেলছি।কষ্ট তো আমরাও কম পাইনাই।”
—”কোথায় কবর দিয়েছেন আমার বাচ্চাকে?আমি কবর টা ছুঁয়ে দেখতে চাই।”
রূপকের মা ঝংকার দিয়ে উঠলো আর বললো-
—”কাল নাগিনী। বিষধর সাপের মতো ছোবল মেরে বাচ্চা,আর আমার ছেলে দুজনকে গিলে খেয়েছিস।এখন কবর ছুঁয়ে দেখতে চেয়ে ঢং করছিস?”
—”আহ্ বুবু! এগুলা কি ভাষা?তোমর নাতি মইরা গেছে তার হায়াৎ আছিলো না।আর তোমার পোলার ও তাই।অহন ওর লগে এমন করতাছো ক্যান?বাদ দাও।
স্বর্ণ, শোনো। পশ্চিমের বাঁশঝাড় টার সামনে কবর দেওয়া আছে চাইলে জিয়ারত কইরা আইতে পারো।তয় এহন না।এহন মেলা রাইত।কাইল সকালে যাইবা।”
স্বর্ণলতা আর একটিও কথা বাড়ালো না।দ্রত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।
—”কিরে জাফর!তুই ওরে কবরের হদিস দিলি কেনো?চিনিস না ও কেমন………?
—”আহ্ বুবু!তোমরা মাইয়া রা দুই লাইন বেশি বোঝো ক্যান?এতোক্ষণ বিশ্বাস-ই করতাছিলো না যে ওর বাচ্চা মইরা গেছে,আর অহন ঠিক-ই বিশ্বাস করছে।কবর ডা দেখলে বিশ্বাস আরও বেশি করবো।ঠান্ডা হইতে দাও ওরে।ওরে চেতানো আমগোর জন্য বিপদ।ঠান্ডা হোক চুপ থাকুক।”
রূপকের মা আর তর্ক বির্তকে গেলো না।জাফরের ওপর তার ভরসা আছে।সে যেটা করবে বুঝে শুনেই করবে।
স্বর্ণলতা ঘরে এসে মন্টুর পা জড়িয়ে ধরলো-
—”আল্লাহ! বুবুজান এসব কি করতাছেন?ছিঃ ছিঃ পা ছাড়েন।”
—”আমাকে একটু সাহায্য করো ভাই।তোমার পায়ে ধরি মামাকে কিছু বলবেনা।আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে।পায়ে ধরি।”
—“ছিঃ বুবুজান।ওঠেন।আমি আপনারে সাহায্য করমু।এতে আমার যা হয় হোক।মেহুল আর আমি আপনার পাশে আছি।আপনি খাইয়া লন।”
স্বর্ণলতা চুপচাপ খেয়ে নিলো।খেতে বসে কয়েকবার যে চোখের পানি গড়িয়ে প্লেটে পড়েছে তা অগণিত। বিষম খেয়েছে বারবার।প্রিয়জন দের হারানোর কষ্ট মানুষকে কাতর করে দেয়।শোকে পাথর করে দেয়।
তবুও আশায় খেয়েছে।মন্টু মেহুলের সাহায্য পাবে তাই।
মন্টু মেহুল স্বর্ণলতাকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে বাইরে এলো।মেহুল মন্টুকে জিজ্ঞেস করলো-
—‘মন্টু ভাই! তুমি আপামনির কথায় রাজী হইছো যে!এহন ক্যামনে কি করবা?তুমি কি সত্যি সাহায্য করবা?মামা জানলে কি হইবো জানো তো।”
—”মামার কথার বাইরে যামু না।কথা শুইনা যতটুকু শান্ত করা যায় ততটুকু শান্ত করমু।হে আমার কুসুম বুবুর মতো।কুসুম বুবুর মায়া ভরা মুখটা আইজও চোখে ভাসে।
চলবে…………..
✍️Sharmin Sumi