#স্বর্ণলতা
পর্বঃ২৮
_________________
বেডে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে স্বর্ণলতা।হয়তো এটা প্রসব যন্ত্রণা।হুট করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ায় তার এই দূর্গতি।মন্টু সেসময় স্বর্ণলতাকে ধরতে পারেনি।সঠিক সময়ে ধরার অভাবে স্বর্ণলতা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।আর সে পেটে আঘাত পায়।পেটে ব্যাথা শুরু হয়।
খবর টা শুনে মন্টু নিজেও দিকহারা হয়ে যায়।যার ভালোবাসার মিষ্টি কাব্য একটু আগেই মন দিয়ে শুনছিলো।কল্পনাতে একজোড়া মিষ্টি যুগলের প্রতিচ্ছবি একেঁ নিয়েছিলো,কিছু সময় ব্যবধানে এ কোন দুঃস্বপ্ন ঘনিয়ে এলো!যাকে ভালোবেসে মানুষ টা রঙ্গীন সুতোর স্বপ্নজাল বুনছিলো কিছু সময়ের ব্যবধানে ছিড়ে গেলো সেই স্বপ্নজাল!
ভালোবাসার যদি এতো নির্মম ভাবে ইতি ঘটে তাহলে সৃষ্টিকর্তা বুক ভরে ভালোবাসার সমুদ্র কেনো ঢেলে দেয়?
এ সমুদ্রে তো দুজন ভেসে বেড়ানো যায়।একজন হাত ছিটকে গভীর তলদেশে হারিয়ে গেলে তীরে থাকা আরেকজনের কি নিষ্ঠুর পরিনতি হয় এ বুঝি বিধাতা বোঝেনা!!
মৃত্যু সংবাদ আসলেই খুব বিশাল এক দুঃসংবাদ।মন্টু নিজেই হকচকিয়ে গিয়েছে।সেখানে স্বর্ণলতার কি অবস্থা হবে তা ভাবাও যাচ্ছেনা।
মামা,রূপকের মা এ সেখানে মামার সাথে এসেছিলো।আর এসেই দেখেই এই অবস্থা।
অন্যরুম থেকে ভেসে আসছে স্বর্ণলতার গলা ফাটানো চিৎকার।মেহুল তার হাত ধরে আছে।আর এদিকে চিন্তামগ্ন জাফর এবং রূপকের মা।
জাফরের সাথেই এসেছিলো রূপকের মা।সে একটু পরে ঢুকেছিলো।এসে দেখে তার পুত্রবূধু মাটিতে লুটিয়ে কাতরাচ্ছে।
জাফর মনে মনে নিজেকে গালি দিচ্ছিলো।তার এভাবে বলা টা উচিত হয়নি।শত হলেও স্ত্রী।স্বামীর মৃত্যু শোক কোন স্ত্রী সহজ ভাবে নিতে পারেনা।
রূপকের মা চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।
—”আল্লাহ! একি সর্বনাশ হলো রে।ওর তো পানি ভেঙে গেছে।ওর কি অবস্থা হবে এখন!এই মূহুর্তে ওর ডেলিভারি করাতে হবে।”
মামা গলা ভারী করে বললো-
—”মন্টু,মেহুল এদিক আয় তো।বুবু আর আমার লগে সাহায্য কর।”
মেহুল ঘুমিয়ে ছিলো।হঠাৎ করে এতো চেঁচামেচি তে এক লাফে বিছানা থেকে উঠেছে।হঠাৎ করে ওঠার জন্য তার মাথা ভনভন শুরু করেছে।হোঁচট খেয়ে দুই,তিনবার পড়তে পড়তে পড়েনি।
টালমাটাল অবস্থায় অজানা বিপদের আশঙ্কা নিয়ে বাইরে ভো দৌড় দিলো।আর বাইরে গিয়ে দেখে মন্টু,জাফর আর রূপকের মা।নিচে স্বর্ণলতা পড়ে আছে।
আর সবার ই কপালে হাত।
চিৎকার করে মেহুল ডাকলো-
—”কি হইছে আপামনির?”‘
—”সেন্স হারাইছে।চাচা কইছে রূপক ভাইজান মইরা গেছে।”
—”কি কও মন্টু ভাই!তোমার মাথা ঠিক আছে?”
—”হ আমি ঠিক কইতাছি।আর এই খবর শুইনাই বুবুজানের এই অবস্থা।”
জাফর কর্কশ কন্ঠে বললো-
—”তোগো দাড়াইয়া দাড়াইয়া তামশা দেখবার কইছি?কিয়ের এতো আলাপ তোগো!ধর আমগো লগে।”
—”হ চাচা,আমি আর মেহুল দুইজন-ই আইতাছি।”
চারজন মিলে ধরাধরি করে স্বর্ণলতাকে বেডে শুইয়ে দিলো।
মেহুলের সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছে।একটু আগে সে যেটা শুনলো সেটা কি সত্যি! নাহ্ সে নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে।নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার জিজ্ঞেস করলো-
—”মামা,রূপক ভাইজান কই?”
—”নাই।”
—”নাই মানে! কই গেছে হে?”
—”মইরা গেছে।”
—”কি কন মামা!ক্যামনে কি হইছে?আর অহন আপামনির কি হইবো”
মামা নিশ্চুপ। কোন কথাই যেনো মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা।
রূপকের মা মুখে আঁচল দিয়ে কান্না করছে।
মেহুল নিজে নিজে বিলাপ করছে-
—”আল্লাহ আপামনিরে কিসের মধ্যে ফেললো।এতো ভালো একটা মানুষের এতো দুঃখ।আসলে ভালা মানুষ গুলা হয়তো দুঃখ পাওয়ার লিগাই জন্মায়।”
মামা গম্ভীর কন্ঠে বললো-
—”মন্টু, মেহুল থাক তোরা এইহানে,আমি আর বুবু দেখতাছি কি করা যায়।”
চলো তো বুবু।একটু ঐ রুমে আহো।তোমার লগে কথা আছে।”
রূপকে মা এবং মামা অন্যরুমে চলে আসলো।এবং তাদের মধ্যে কথোপকথন –
—”জাফর,কিছু একটা তো করতে হবে।বাচ্চা টা হয়ে যাবে নাকি?ও মাটিতে পড়ার জন্য পেটে ব্যাথা হয়েছে।নিশ্চয়ই কোন একটা সমস্যা হয়েছে।বাচ্চাটাকে তো সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আনতে হবে নাকি?”
—”বুঝতাছিনা বুবু!হুট কইরা এসব কি হইয়া গেলো।মন্টুর ধরার সময় টুক পাইলো না।
বাচ্চার তো ক্ষতি হওন দেওয়া যাইবো না।”
মন্টু ছুটতে ছুটতে তাদের কাছে দৌড়ে এলো-
—”চাচা,খালাআম্মা বুবুরে জলদি হাসপাতালে লইয়া যান।হের অবস্থা কিন্তু ভালা না।”
—”না না হাসপাতালে নেওয়া যাবেনা।এখানেই কিছু একটা করতে হবে।”
মামা মন্টুকে বললো-
—”মন্টু এইহানে কোন দাই নাই নাকি?তোর মায়েরে খবর দে জলদি।”
জাফরের কথা শুনেই মন্টু দৌড়ে গেলো তার মায়ের কাছে।বাড়িটা লোকালয় থেকে ভালোই দূরে।এক সেকেন্ড সময় ও নষ্ট করা যাবেনা।
জাফর,রূপকের মা হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো।এতো চিন্তা তাদের গ্রাস করেছে।কিসের এতো চিন্তা তাদের!
জাফর অজানা ভয় নিয়ে রূপকের মাকে বললো-
—”বুবু! স্বর্ণলতা যদি মইরা যায়?”
—”যাক,বাচ্চাটা বেঁচে থাকলেই হবে।”
—”মা মরলে বাচ্চা ক্যামনে বাঁচে?কি কও তুমি?”
—”জানিনা রে,আমি শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছি বাচ্চাটার যাতে কিছু না হয়।”
—”মামা,মামা আপারে হাসপাতালে নিবেন না?হের অবস্থা বেশি ভালা না।বাচ্চা মনে হয় পেটে উল্টাইয়া গেছে।”
—”কিরে মেহুল!তুই কি ডাক্তার নাকি?তুই বুঝলি ক্যামনে বাচ্চা পেটে কি হইছে।যা ওর লগে থাক।আমি মন্টুরে পাঠাইছি দাই আনতে।”
—”কিন্তু মামা,!
—”তুই যাবি?”
—”যাইতাছি মামা”।
মেহুল দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো……
—”জাফর! সব বিপদ কি খালি আমাদের-ই হবে!তীরে এসে তরী ডুববে!”
—”দেহা যাক।কি হয়।”
—”তোর ওভাবে এই খবর না দিলে হতোনা?”
—”ও এমন অবস্থা হইবো আমি কি আগাম জানছি নাকি বুবু!!কি কও তুমি আবার।মাথা ডা ঠিক নাই।চুপ থাকো তো।আমারে একটু চিন্তা করবার দাও।”
৩০ মিনিট পর মন্টু তার মা এবং একজন দাই কে নিয়ে হাজির হলো।
জোবেদা জিজ্ঞেস করলো(জোবেদা দাই এর নাম)
—”কি মন্টু বউ কোন ঘরে?”
—”ঐ সামনের ঘরে যাও দাদী।”
মামা মন্টুকে জিজ্ঞেস করলো-
—”কিরে মন্টু! কাম ভালা পারে তো!”
—”হ,চাচা হে অনেক ডেলিভারি করছে।”
—”বুঝিস কিন্তু! বাচ্চার যাতে কোন ক্ষতি না হয়।”
—”চাচা এক কাজ করেন।আপনে হেরে হাসপাতালেই নিয়া লন।রিস্ক কম হইবো।বুবুজানরেও কিন্তু বাঁচানো লাগবো।”
—”থাক,তোর এতো চপর চপর করা লাগবো না।ঐডা আমি বুঝমু।কই নিয়া যামু কি না নিয়া যামু।আনার সময় কোন মানুষ টের পাইছে নি?”
—”না, এতো রাইতে জাগনা আছে কে যে দেখবার যাইবো।”
—”কাম শেষে বুড়িরে সবকিছু বুঝাইয়া দিবি।নাইলে তোর কিন্তু খবর আছে”।
—”দিমু বুঝাইয়া।আপনি খালি আল্লারে ডাকেন।স্বর্ণ বুবুজানের যাতে কিছু না হয়।”
দাই,সাইবুরি এবং মেহুল স্বর্ণলতার পাশে বসে আছে।দাই খুব চেষ্টা করছে যাতে তার ডেলিভারি হয়ে যায়।
—”বুঝছোস সাইবুরি,অহন ডেলিভারি করতেই হইবো।মন্টু কইলো মাটিতে পইরা গেছিলো গা।পইড়াই তো পানি ভাইঙ্গা গেছে।অহন ই ওর বাচ্চা বাইর করতে হবে।”
—”হ আম্মা,করেন। আপনার যেমনে ভালা মনে হয়।তয়,মাইডারে বাঁচাইয়েন।কি সুন্দর মাইয়া”।
—”আল্লাহরে ডাক।”
স্বর্ণলতা শুয়ে আছে আর চিৎকার করছে।দু চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।শুয়ে থাকার জন্য দুইপাশ বেয়ে পানি কানে চলে যাচ্ছে।চোখ লালচে হয়ে গেছে।পুরো মুখ ব্যাথায় নীলাভ বর্ণ ধারন করেছে।
একে রূপকের মৃত্যু সংবাদে বুকটা ছিড়ে যাচ্ছে।আর অন্যদিকে তার প্রসব যন্ত্রণা।
ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে।আর আল্লাহ কে ডাকছে।
—”আল্লাহ,আমাকে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।আমাকে মৃত্যু দাও।এই যন্ত্রণার থেকে তো মৃত্যু যন্ত্রণা কম”।
__________________________________
টানা ৪ ঘণ্টা মৃত্যু সমান যন্ত্রণার পর একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম নিয়েছে।যার নাম রাখার কথা ছিলো ‘কল্প’।স্বর্ণলতার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছে।ব্যাথায় নীলাভ বর্ন ঠোঁট দুটি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে।আর আওয়াজ বের হচ্ছেনা।আওয়াজ ক্ষীন হয়ে গেলো।চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।ওপরের সিলিং, আশেপাশের মানুষ গুলো ঘোলা দেখাচ্ছে।হাত পা থেমে গেছে।হাতের মুঠোতে ছেড়া চাদরের অংশ।ব্যাথায় খামচে ধরেছিলো চাদর।এতোটাই জোরে ধরেছিলো যে চাদর ছিড়ে চলে এসেছে।নখে ঢুকে গেছে সুতা আর কাপড়ের কিছু অংশ।আশেপাশের মানুষের কথা ডাবল হয়ে কানে আসছে।এরপর পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলো এবং
বাচ্চার একটা চিৎকারের আওয়াজ শুনেই স্বর্ণলতা সেন্স হারিয়ে ফেললো।
সেন্স হারানোর আগ মূহুর্ত্যে মনে মনে আল্লাহ কে শুকরিয়া জানালো।
চলবে………
✍️Sharmin Sumi