স্বর্ণলতা part 27

0
362

#স্বর্ণলতা
পর্ব-২৭
_________________
৩ মাসের মতো কেটে যায়।আর মন্টু স্বর্ণলতার প্রতি অনেকটা দূর্বল হয়ে যায়।তার বোনের মতো দেখতে স্বর্ণলতা।ওর জন্য মায়া হয়।
সে ভাবে তার বোন টা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো এভাবেই একদিন বিয়ে হতো,বাচ্চা হতো তাকে মামা ডাকতো।
স্বর্ণলতা নয় মাসের প্রেগনেন্ট।আর বিগত ৩ মাস তার এখানে এতো ভালো কেটেছে যে তার মামা,রূপকের মা কিংবা রূপকের রহস্য কিছুই মাথায় আসেনি।
৩ মাসে একবারের জন্যও মা কিংবা মামা আসেনি।কিন্তু স্বর্ণলতার এতে কোন মাথা ব্যাথা নেই।
মনে হচ্ছে মন্টু,মেহুল তার ভাই আর বোন।
তিনভাই বোনের কত মধুর কেটেছে দিন গুলো।
আর রূপকের কথা! সে ভেবেই নিয়েছে রূপক তাদের দলে।

স্বর্ণলতাও ইচ্ছে করে মন্টুর নিষেধ করা জায়গা গুলোতে যায়নি।সে মন্টুর বিশ্বাস অর্জন করতে চেয়েছে।
বিশ্বাস এমন একটি বস্তু যেটা মানুষে-মানুষের আত্মার মিলন ঘটায়।কঠিন হৃদয় গলে জল হয় বিশ্বাসের উত্তাপে।
বিশ্বাসের ওপর নাম ভরসা।ভরসা-ই মানুষের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করে।আমি তাকে ভরসা করি তার মানে আমি তার কাছে নিজেকে খোলা বইয়ের মতো উপস্থাপন করলাম।সে আমাকে যেভাবে ইচ্ছে পড়তে পারে।
স্বর্ণলতা চায় মন্টু তার কাছে খোলা বই এর মতো হোক।
যাতে করে প্রতিটা শব্দ স্বর্ণলতা অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারে।

—”স্বর্ণ বুবু!”

—”স্বর্ণবুবু!!মনটা জুড়িয়ে গেলো মন্টু।কত সুন্দর একটা নাম একজন ডাকে স্বর্ণ আপামনি।আরেকজন স্বর্ণ বুবু।কলিজা টা ঠান্ডা হয়ে যায়।”

—”আপনার পোলা হইবো না মাইয়া?”

—”সেটা তো জানিনা।ডক্টর কিছু বলেনি।”

পরক্ষনেই মন্টু চোখমুখ আতঙ্কিত হয়ে গেলো।মনে হচ্ছে বুকের ভেতর টা হু হু কেঁদে উঠলো।

—”মন্টু! হঠাৎ করে কি হলো?”

—”কিছুই হয়নাই বুবু।মেহুল শোন,বুবুর দিকে নজর রাখবি।আজকে আমার একটু বাইরে যাওন লাগবো আর আইতে মেলা রাইত হইবো।”

—”কই যাইবেন?”

—”কাম আছে।”

মন্টু চলে গেলো।স্বর্ণলতা ভাবলো এই সুযোগ। ডানপাশের ঘরটাও দেখা যাবে আর দিঘির পাড় টাও দেখা যাবে।মেহুল কে কিছুই জানানো যাবেনা।ওকে জানালেই ও না করবে।
তার একটু ভয় ও করছে।কারন নয় মাসের পেট।হাঁটতে একটু কষ্ট হয়।এই অবস্থায় ঝোপঝাড়ের ঐ দিক যাবে কিভাবে!‌‌
পরক্ষনেই আবার মনে হয়,আমার সোনামনি কে তো আমি কথা দিয়েছিলাম আমি তার সাহসী মা হবো।তাকে আঁধারে ভরা এই জগৎটাকে পবিত্র এক রোশনি বানাবো।
আমার সোনামনির জন্য আমার তো একটুক করতেই হবে।

___________________________
সন্ধ্যা ৭.৩০।গ্রামে এই সময় ই মানুষ রাতের খাবার শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।
মেহুল স্বর্ণলতার ঘরে বসে আছে।সে আজ ঠিক করেছে তার ঘরে ঘুমাবে।
স্বর্ণলতা এতোটাই বিরক্ত হলো যে তার চোখে মুখে বিরক্তিভাব স্পষ্ট!
—”স্বর্ণ আপামনি মনে হয় আমার ওপর রাগ করতাছেন?”

—”না না আমি রাগ করবো কেনো।তুমি থাকো।আমি খুশি হবো।”জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে স্বর্ণলতা বললো।

—”আপামনি আপনার বাচ্চার নাম ঠিক করছেন?”

—”হুম,তুমি চলে যাওয়ার পর তোমার ভাইয়া আর আমি ঠিক করেছিলাম।”

—”কি নাম,কি নাম,কন না আপামনি।”

—”ছেলে হলে নাম রাখবো কল্প,আর মেয়ে হলে মেহুল।”

—”আমার নাম আপামনি!”

—”হুম তোমার নাম।কেনো সুন্দর না?”

স্বর্ণলতার প্রশ্নের উত্তর ছিলো ‘মেহুলের’ স্বর্ণলতাকে জড়িয়ে ধরা।
কান্নামিশ্রিত ভেজা কন্ঠ নিয়ে মেহুল বললো-
—”একটা মানুষ এতো ভালা ক্যামনে হয় আপা!”

_____________
মেহুল ঘুমে বিভোর।অল্পতেই ঘুমিয়ে যাওয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো এই মেয়ে।বিকেলে চিতই পিঠা খেয়েছে।পেট বোধহয় ভরা।তাই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
ফ্রেবুয়ারী মাস।বাইরে ভীষন ঠান্ডা।অবশ্য শহরে এই সময়টায় অতোটা ঠান্ডা থাকেনা।তবে তাদের এখানে ঠান্ডার রেশ এখনো আছে।অর্ধেক সকাল তো কুয়াশাচ্ছন্নই থাকে।এই কনকনে ঠান্ডায় মন্টু ফিরবে কিভাবে!মন্টুর জন্য চিন্তা হচ্ছিলো স্বর্ণলতার।ঘড়িতে তখন ৯ টা ছুঁইছুই।
কেউ রাতের খাবার খায়নি।মন্টু আসলে মেহুল কে উঠিয়ে নিয়ে খাওয়াবে।
এতোক্ষনে সে পুরো বাড়িটা একবার চক্কর মেরে দেখবে।ঘরে সোলার বিদ্যুৎ।নিভু নিভু বাতি।
মোটা একটা শাল জড়িয়ে বের হলো স্বর্ণলতা।একদম গা ছমছমে পরিবেশ।

বাড়িটা বেশ বড়।আর পুরো বাড়িতে দুজন।কিছুটা ভয় পেলো স্বর্ণলতা।করুন সুরে পেঁচার ডাক ভেসে আসছে।পেঁচারা এতো ভয়ংকর ভাবে ডাকতে পারে!
আবার সাথে যোগ হয়েছে এক ঝাঁক শেয়াল।শেয়ালের ডাক শহরে খুব কম শুনেছে।জঙ্গলে যাওয়ার সময় একবার শুনেছিলো।
আস্তে আস্তে ডানপাশে মোড় নেয়।শেষের দুটো ঘরেই তো যাওয়া বারণ।
দেখা যাক তার জন্য নতুন কোন রহস্য অপেক্ষা করছে!
নিভু নিভু আলো ঠেলে সামনে গেলো স্বর্ণলতা।
কিন্তু সেই হতাশ মুখ।
দুটো দরজায়-ই শক্ত করে তালা লাগানো।

–”এ নিশ্চিত মন্টুর কাজ।আমি আসবো ভেবে তালা লাগিয়ে রেখেছে।তালা লাগাবেই না কেনো,এ যে দ্বিতীয় মামা।”

স্বর্ষলতা নিজের মনে মনে ভাবতে লাগলো,তবে কি দিঘির পাশে যাবে?এখানে যেহেতু কাজ হয়নি সেহেতু ওখানেই একবার যাওয়া যাক।
বাইরে গেলো।চারদিকে ঘন কুয়াশা।শীতে থরথর কাঁপছে স্বর্ণলতা।পা অবশ হওয়ার উপক্রম।এসব বাড়ি শীতের জন্য বরফখনি।গরমে এসব বাড়ি ঠিকঠাক।
স্বর্ণলতা বাম পাশে মোড় নিবে অমনি গেইট খোলার আওয়াজ।
—”মন্টু এসে গেলো নাকি!”
বুকটা ধক করে উঠলো স্বর্ণলতার।
—”এতোদিন যে বিশ্বাস,ভরসা সন্ঞ্চয় করেছিলাম তা কি এক নিমিষেই শেষ হবে!হয়তো আর কিছুদিন পর-ই মন্টু নিজে আমাকে সব বলতো।আর আমার একটু ও তর সইলো না!আমি কি ভুল করলাম!!”

এসব ভাবতে ভাবতে মন্টুর প্রবেশ।স্বর্ণলতা ঠায় দাড়িয়ে।একে অন্ধকার,দ্বিতীয়ত কুয়াশা।স্পষ্ট দেখতে পেলোনা মন্টু।
কঠিন কন্ঠে মন্টু বলে উঠলো
—”কে কে ওখানে?”
আমতা আমতা করতে করতে স্বর্ণলতা বললো-
—”আ.আমি মন্টু!বাড়ির পেছনটায় খচখচ আওয়াজ পেলাম।মেহুল আর আমি একা বাড়িতে।ভয় পাচ্ছিলাম তাই দেখতে এসেছি।”
ভ্রু কুঁচকে মন্টু বললো-
—”ভয় পেয়েও সাহস করে আপনি দেখতে চলে এসেছেন?
কিন্তু বুবুজান নয় মাসের প্যাট লইয়া আসা ঠিক হয়নাই”।

—”হুম ঠিক বলেছো।একটু দেখে আসোতো কি ওখানে?”

—”দেহা লাগবো না বুবুজান।বিড়াল হইবো হয়তো।এই বাড়িত আহনের সাহস কারও নাই।তয় ভূত হইলে সেইডা ভিন্ন।”

মন্টুর হাসিতে স্বর্ণলতা নিশ্চিত হলো সে কিছু সন্দেহ করেনি।তাকে ভরসা করতে শিখেছে।বিশ্বাস করে তাকে।
এতোটাই বিশ্বাস করে যে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে থেমে যায়।আর কয়েকটা দিন দেখবে সে।
মনে হচ্ছে সে সত্যি কিছু বলবে।
—”কি বুবু!খারাইয়া আছেন ক্যান?আহেন ভিতরে আহেন।”

—”হুম আসছি।”

ঘরে ঢুকেই মন্টুকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো স্বর্ণলতা।
—”তোমার জন্য মেহুল আর আমি না খেয়ে বসে আছি।আর মেহুল পাগলি তো ঘুম।”

—”এহনো না খাইয়া রইছেন!খারান আমি চটপট হাত মুখ ধুইয়া আহি।আমার ও খুব ক্ষুধা লাগছে।মেহুলরে ডাক দিয়া আনি।”

খাওয়া শেষ করতে না করতেই মেহুলের আবার বিছানায় পড়ে ঘুম।
এ মেয়ের নাম ঘুম পাগলি দেওয়া উচিত ছিলো।
ঘুম নেই মন্টু আর স্বর্ণলতার চোখে।খাটে বসে দুজন গল্প করছে।এর মাঝখানে মন্টু বললো-
—”এই কাজ আর কইরেন না বুবুজান।খুব বিপদ হইবো।”

—”কোন কাজ?”

—”একটু আগে যেইডা করবার গেছিলেন।আমি ঠিকি বুঝছি বুবু।ভাবছিলাম আপনারে কমুনা।কিন্তু এই কয়দিনে আমার কুসুম বুবুর জায়গা টা আপনি লইয়া লইছেন।তাই না কইয়া থাকতে পারলাম না।”

—”মন্টু,আমাকে যদি তোমার বোনের মতোই ভাবো তাহলে আমাকে সবকিছু খুলে বলো।”

—”বুবু আমি আসি।”

—”মন্টু। আমি একজনকে খুব ভালোবাসি।জানিনা সে আমাকে ভালোবাসে কিনা।
কিন্তু আমার প্রাণ আমি তার নামে দলিল করে দিয়েছি।আমার হৃদয় এ শুধু তার নাম।পুরো শরীর জুড়ে শুধু তার অস্তিত্ব।

—”রূপক ভাইজান!”

—”তুমি রূপককে চিনো?”

—”হ চিনমু না ক্যান।কোনদিন দেখা হয়নাই।কিন্তু চিনি তারে”।

—”কে বলেছে তার কথা?”

—”জাফর চাচা।যাইহোক কন আপনে।”

—”আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে সে থাকার পরও তার বুকে আমি শীতলতা খুঁজে পাইনা।আমার পুরো বাড়িটা রহস্য মনে হয়।আমার ক্ষনে ক্ষনে মনে হয় আমার জীবনের প্রদিপ নিভু নিভু করে জ্বলছে।আমি তোমার সত্যি যদি আপন বোন হতাম আমাকে তুমি বলতে না?”

—”বুবু শোনেন”…

—”দাড়াও আমাকে বলতে দাও।আমার মা বাবা কেউ নেই জানো।তোমাদের দুজনকে পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছি।এখানে যতদিন ছিলাম ততদিন স্বপ্নের মতো কেটেছে।…….

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। মন্টু আর স্বর্ণলতা এক-ই সাথে উচ্চারণ করলো-
—”এতো রাতে কে আসলো?”

—— বুবুজান খাড়ান আমি দেখতাছি।”

স্বর্ণলতাও বেড়িয়ে আসলো।
দরজা দিয়ে ঢুকলো জাফর।
ঢুকেই স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে বললো-
—”মন্টু ওরে ধর গিয়া।ও এই কথা শুনে ফিট হইয়া পড়তে পারে।একটা দুঃসংবাদ আছে।”
স্বর্ণলতার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো।ঢোক গিলতে গিলতে বললো-
—”কি দুঃসংবাদ?”

—”রূপক আর নাই।”

চলবে…………
✍️Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here