স্বর্ণলতা part 26

0
354

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ২৬
_____________
মন্টুর এরূপ কথাতে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো স্বর্ণলতা।স্বর্ণলতা মনে মনে ভাবলো,একা বাড়িতে এসেও শান্তি নেই!এখানেও দ্বিতীয় মামা পেয়ে গেলাম।
কিছুক্ষন স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে থেকে পেছন দিক ঘুরে জোরপূর্বক একটা হাসি দিলো।আর বললো-
—”মন্টু! তুমি এতো রাতে এখানে কেনো?”

—”আমি তো এনেই থাকি,আপনি এতো রাইতে এইহানে ক্যান?”

স্বর্ণলতা কিছুটা চমকে গেলো!চমকপ্রদ দৃষ্টিতে আগা গোড়া মন্টুকে দেখে নিলো।এরপর প্রশ্ন করলো-
—”এখানে থাকো মানে!”

—”হ আমার কাম এই পাশ টা পাহাড়া দেওয়া।তয় আসলে নির্দিষ্ট কই থাকি এইডা তো আপনারে কওয়া যাইবো না।”
দুই হাত কোমড়ে উঠিয়ে স্বর্ণলতা বললো-
—”বলা নিষেধ?”

—”না বলা নিষেধ না।আপনারে কমু না আমি।আমার তরফ থিকা নিষেধ।”

—”কেনো!!!”

—”এই কেনোর উত্তর টা -‘বলা নিষেধ’।

স্বর্ণলতার মুখটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।কিছুক্ষণ আগেই সেই উদ্বেগ ছিলো,এই বুঝি মন্টু মুখ খুলবে।আশার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়ে ধপ করে নিচে পড়লে ঠিক যেমন ভ্যাবাচাকা মার্কা মুখ হয়।স্বর্ণলতার ঠিক তেমন হলো।আশাহত হৃদয় নিয়ে রাগে কটমট করে মন্টুর দিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকালো।
তারপর হনহনিয়ে শব্দ করতে করতে স্থান ত্যাগ করছিলো।
—”বুবু হোনেন,এমনে শব্দে কইরা হাঁটা লাগেনা।”

—”কেনো!”

—”বলা…..
পুরোপুরি কথা শেষ না করতেই,স্বর্ণলতা মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো-

—”বলা নিষেধ?”

—”না বলা নিষেধ না।বলা বারণ”।

—”অনেক উপকার হইলো মন্টু।এক বাক্য শুনে শুনে কান পঁচে যাচ্ছিলো।অনেক উপকার করলা,শব্দ টা কিছুটা পরিবর্তন করে।”

পুনরায় গজগজ শব্দ করে ঘরে চলে আসলো।তার ঘরে একটা জানালাও পর্যন্ত নেই।মন খারাপ থাকলে সে আকাশ দেখে সময় কাটায়।
আজকে সেটাও পারবেনা।পাশে মেহুল ও নেই।মেহুল থাকলে ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে হলেও কথা বলতাম।
বাইরে কি যাওয়া যাবেনা নাকি!গেইট তো বন্ধ মনে হয়।
স্বর্ণলতা একবার ভাবলো বাইরে যাবে।পরে ভাবলো দরকার নেই।মন্টুর সামনে নিজের এতো গোয়েন্দাগিরি জাহির করলে তার-ই বিপদ।সে মন্টুকে বাগে এনে সব কিছু শুনতে চায়।এভাবে চলতে থাকলে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে না।
স্বর্ণলতা ঘুমিয়ে গেলো……….

সকাল-৬.০০।
হালকা কুয়াশার চাদরে প্রকৃতি নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে।গ্রামে আগে থেকেই ঠান্ডা পড়ে।আর এই বাড়িতে এতো গাছপালা যে ঠান্ডা টা বেশি-ই লাগছে।
চাদর ছাড়া বেড়িয়ে পড়ে স্বর্ণলতা। এ জন্য ঠান্ডা টা হারে হারে টের পেলো।
এ পাশ ঘুরে দেখতে লাগলো।বাড়িটা এতো বিশাল যা বলার মতোনা।
বাড়ির ভেতরেই চার/পাঁচ সাড়ি সাড়ি- মেহগুনি,আম,জাম,আর লিচুর বাগান।আরেকটা অদ্ভুত দেখতে গাছ।সেটার নাম স্বর্ণলতা জানেনা।
দেখতে কিছুটা রাক্ষস আকৃতির হওয়ায় নাম দিয়েছে রাক্ষস গাছ।
ঘুরতে ঘুরতে বাগানের পেছনটায় এসে পড়লো।
দেখলো মন্টু নগ্ন গায়ে কুঠার দিয়ে গাছ কোপাচ্ছে।

তার পাশে পাশাপাশি চারটা দীঘি।দীঘির পাড়ে এসে বসলো স্বর্ণলতা।
মন্টু তাকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়েছে।আর কোন কথা বলছে না।সে নিজের কাজে মন দিয়েছে।
স্বর্ণলতা একটু চেচিয়ে বললো-
—”মন্টু……এখানে যে বসলাম কিছু বললে নাতো!তার মানে এখানে আসা নিষেধ না তাই তো?”

—”আছে,এইহানের একটা জায়গায় যাওয়া নিষেধ”।

—”কোন টা?”

—”সেইডা আপনারে বলা যাইবো না।তাইলে সব জায়গা ছাইড়া আপনি হেই জায়গাতেই আগে আইবেন”।

মন্টু বেশ বুদ্ধিমান।বিচক্ষণ চাহনি,বিচক্ষণ কথাবার্তা।
এ বাড়িতে মন্টু না থাকলে স্বর্ণলতা কে কখনো একা রাখা হতোনা এটা সে ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে।পূর্বের সব ধারনা ভুল প্রমানিত হলো।
স্বর্ণলতার রহস্যের কিনাড়া খুঁজে বের করতে হলে মন্টুকে তার বাগে আনতে হবে।স্বর্ণলতার কাছে যে ছিলো দ্বিতীয় মামা।আর মামা কিংবা হুবহু মামার মতো কাউকে বশে আনা কি এতো সোজা?”
—”কি বুবুজান আপনে এতো কি চিন্তা করেন?”

—”আমাকে তুমি বুবুজান বলো কেনো?”

—”ভালা লাগে।”

—”কুসুমের কথা মনে পড়ে?”

কুসুমের কথা শোনা মাত্রই মন্টুর কাজের গতি ক্ষীন হয়ে যায়।আস্তে আস্তে একবার আড়চোখে স্বর্ণলতাকে চোখ বুলিয়ে আবারও কাজের গতি বাড়ায়।
—”কি উত্তর নাই কেনো?
নীরবতা কিন্তু সম্মতির লক্ষন।”

—”সব নিরবতা সম্মতির লক্ষন হয়না।কিছু নিরবতা হিমালয় সম কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ও হয়।”

—”কুসুম কিভাবে মারা গেলো”।

—”আপনার মতো কপাল লইয়া জন্মাইছিলো যে,”।

মন্টু কুঠার ফেলে দিয়ে চলে গেলো।মনে হচ্ছিলো চোখ ভিজে একাকার হয়ে গেছে।আপনজন দের কথা মনে পড়লে, দুনিয়ায় সব সুখ যদি পায়ের নিচেও এনে দেওয়া তবুও সেই সুখের স্বাদ পানসে মনে হয়।অন্তর টা ছুরিক্ষাতের মতো রকাক্ত হয়ে যায়।ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যায়।কিন্তু ভেতরের রক্তক্ষরণ না হয় দৃশ্যমান।না দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার শব্দ শ্রবনীয়।
মৃত্যু এমন এক শব্দের নাম,যেটা জীবনের গল্পকাহিনীর শেষ পাতা।এরপর না থাকে অবশিষ্ট পৃষ্ঠা না থাকে দোয়াত।
কিভাবে সাজাবে নতুন কোন গল্প?সেই জীবনের সেখানেই সমাপ্তি।
হোক সে জীবন পূর্ণ কিংবা অপূর্ণ।মৃত্যুই তার পরম সুখ কিংবা দুঃখের অবসান অথবা পূর্নতা এবং ইতিকথা।

মন্টুর এহেন চলে যাওয়ায় স্বর্ণলতা খুঁজে পেয়েছিলো সে কিসের কাঙাল।তাকে বধ করার মখ্যম হাতিয়ার।তার দরকার কোমল পরশ,স্নেহ,মমতা।বড় বোনের আদর মাখা ভালোবাসা।
কিন্তু পাশাপাশি স্বর্ণলতার নিজেকে নিয়ে চিন্তা হয়।
কুসুম নাম টি মন্টুর কাছে অসহনীয় দুঃখ।
কেনো এই দুঃখ।তার আমার মতো কপাল?তাহলে কয়েকদিন পর কুসুমের মতো আমিও বিলীন হয়ে যাবো!
হলে কখন,কেনো,কিভাবে?
এসবের উত্তর মন্টু ছাড়া তো আমাকে কেউ দিতে পারবে না।

_______________________
দুপুর বেলা মন্টুকে ডেকে আনলো স্বর্ণলতা।
—”হাঁস আছে এই বাড়িতে?”

—”সব আছে।কি করবেন কন?”

—”হাঁসকে তোমার সাথে বিয়ে দিবো।”

মন্টু লজ্বা পেয়ে গেলো।কিন্তু চালাকির সাথে উত্তর দিলো-
—”হাঁস আমারে পছন্দ করলেও তো আমি হেরে বিয়া করমু না”।

—”কেনো!!”

—”আমার চেহারায় তো কত জন-ই মরবার চায় তাই বইলা আমি কি সবাইরে এই ছোট্ট দিলে জায়গা দিবার পারমু!”

মন্টুর রসিকতায় স্বর্ণলতা খুশিতে গদগদ হয়ে যায়।মন্টু তার সাথে স্বাভাবিক হচ্ছে।আর স্বর্ণলতা এটাই তো চেয়েছিলো।হয়তো তার চেহারা তার বোনের মতো।এইজন্যই তার প্রতি তার স্পর্শকাতর অনুভুতি।

—”থাক মন্টু সাহেব নিজের গুনগান আর করা লাগবো না।আপনি একটা হাঁস জবাই করে আনুন।

—”ওমা যারে আমার লগে বিয়া দিবার চান তারেই মাইরা ফেলবেন!আমারে বিয়া না করবার পারায় তার শাস্তি কি মৃত্যুদন্ড নাকি বুবুজান?”

—”কথার ফুলঝুরি ফুঁটছে দেখি আজকে!! যাইহোক,আমি রান্না করবো আপনার জন্য।ধরেন আপনার বোন কুসুম আপনার জন্য রান্না করছে।”

মন্টু এই কথা শোনা মাত্র খুশির রঙ্গিন আভা তার চোখে মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো।

ভেতরে মন্টু হাসছে আর বাইরের মন্টু নিশ্চুপ।
স্বর্ণলতা ঠিকই বুঝলো সে কতটা খুশি।
মানুষ দুটো জিনিস লুকিয়ে রাখতে পারেনা।
এক কান্না আরেক হাসি।
ভেতরে খুশি ঠোঁট জানান দেয়।আর ভেতরের কান্না চোখ জানান দেয়।
চাইলেও কি তাদের আঁটকে রাখা যায়!

মন্টু হাসঁ ধরে জবাই করে ফেলে।স্বর্ণলতা মেহুল হাতে হাতে দুপুরের রান্নাটাও সেরে ফেলে।
মন্টু খুব তৃপ্তি সহকারে হাঁসের মাংস খায়।
—”আরেকটু দেই মন্টু?”

—”না বুবুজান আর লাগবো না।”

—”তোমার না লাগতে পারে আমার লাগবে।”

—”বুঝলাম না বুবুজান”।

—”তোমার খেয়ে পেট ভরছে,আর আমার ভরছে মন।তুমি আরেকটু নাও।আমি দেখে আমার চোখ জুড়াই।কি তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে আমার ভাইটা।এই দৃশ্য টা আমার কাছে মূল্যবান হীরের মতো।চাচ্ছিনা এই দৃশ্যের ইতি ঘটুক।”

চোখের নোনা জল গড়িয়ে প্লেটে পড়ে মন্টুর।
ছেলেরাও এতো ইমোশনাল হয়?জানতাম ছেলেরা খুব বেশি কষ্ট না পেলে চোখের জল দেখায় না।তবে মন্টু কি খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে!চোখের সমুদ্রকে আর আটকানো যাচ্ছেনা!ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে এসে মনকে প্রশান্তি দিচ্ছে?
কিছু কিছু অশ্রুফোঁটা থেকে বিষ ঝরে আবার কিছু কিছু অশ্রুফোঁটায় সুখের রংধনু ঝিলিক মারে।
মন্টুর দুটোই এক সাথে হচ্ছে।
উল্টোপাশে চোখ মুছে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে।

চলবে…………..
✍️Sharmin Sumi-শারমিন সুমি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here