স্বর্ণলতা part 22

0
388

#স্বর্ণলতা
পর্ব-২২
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই গা এলিয়ে বসেছে।নানারকম গল্পগুজবে মেতে উঠছে স্নেহার বাসার ড্রয়িং রুমে।

—“বুঝলা বুবু খাওন ডা মনে হয় বেশি খাইয়া ফেলছি।স্নেহার যা রান্দনের হাত।সাথে স্বর্ণলতাও আছিলো।দেশী মুরগীটা যা জমাইয়া রানছে না।পুরা আয়েশ কইরা খাইছি।
তোগো বাসায় বকুল মাইয়াডা ভালাই কাজ জানে।হেয়ও রানছে বুঝি?”

—“হু মামা।ও খুব ভালো রান্না করতে পারে।আজকে চিংড়ির মালাইকারী টা ঐ তো রান্না করেছে।”

—“আহ্ কি খাইলাম আইজকা।পুরাই অমৃত।”

—“তোরা কি ঘুমাবি না?আমার তো ঘুম দরকার।আমি গেলাম গা।তোরা থাক।”

—“জাফর আরেকটু থেকে গেলে পারতি।”
সৈকত তার শ্বাশুড়ির কথার সাথে তাল মিলিয়ে জাফর কে বললো-
—“হ্যাঁ মামা আরেকটু বসে যান।আমরা সবাই কত রকম গল্প করছি।”

—“গল্প! গল্প তো রোজই করি।আইজ একটু ঘুমাই”।
হাই তুলতে তুলতে জাফর ঘুমাতে চলে গেলো।মনে হচ্ছে দুচোখ ভরে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে।আয়েশ করে খাওয়ার পর জম্পেশ ঘুম হলে জাফরের আর কিছু লাগেনা।
এর মধ্যে স্বর্ণলতা সবাইকে তার হাতের চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলো।সে এক বিশেষ চায়ের রেসিপি শিখেছে।সবাই কে টেস্ট করার জন্য বলছে।
স্নেহা বলে উঠলো-
—“তুমি আমার বাড়ি এসে কাজ করবে?তাও প্রেগনেন্ট অবস্থায়?”

—“আপু!চা বানানো কোন কাজের মধ্যে পড়ে?”

—“তাও,কত কাজ করলে।”

—“কিছুই হবেনা আপু।আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই করে নিয়ে আসবো।”

—“চলো তাহলে আমিও যাই।তোমাকে সাহায্য করি।”

—“আমি একাই পারবো আপু।তুমিও তো প্রেগনেন্ট।আজকে আমার চেয়ে বেশি কাজ করেছো।আর রেসেপি টা আমার আবিস্কার।আগে আমি তোমাদের টেস্ট করাই।তোমরা রেটিং দাও।এরপর তোমাকে শিখিয়ে দিবো না হয়।আজ বরং আমি একাই এক্সপ্রিমেন্ট করি?”

—“কোন দরকার নেই একা একা কাজ করার।”

—“বকুল আছে তো আপু এতো চিন্তা করছো কেনো!!”

দুজনের বাকবির্তকে রূপকের মা স্বর্ণলতার প্রস্তাবে রাজি হলো।আর বললো-
—“থাক না। ও চা করতে চাচ্ছে করুক।তুই একটু বস।”
রূপকের মায়ের হ্যাঁ সূচক বাক্যে স্বর্ণলতা সোজা রান্না ঘরে চলে গেলো।ফিরবে তার স্পেশাল হাতের স্পেশাল চা নিয়ে।

স্বর্ণলতার স্পেশাল চা খেয়ে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্নেহা তো কৌতূহলে বারবার জিজ্ঞেস করছিলো চা এর রেসিপি যেনো তাকে বলা হয়।
স্বর্ণলতাও মজার ছলে বললো-
—“আগে গিফ্ট তারপর রেসিপি।”
আড্ডা মুখর পরিবেশের কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাপ্তি হলো।সবাই যে যার ঘরে চলে গেলো।
রাত তখন ১১ টা ছুঁইছুই।স্নেহা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।সৈকতের বোধহয় ঘুম পাচ্ছেনা তাই সে ড্রয়ং রুমে বসে টিভি দেখছে।
স্বর্ণলতা এই সুযোগেই ছিলো।সৈকত কখন একা হবে। কখন তার সাথে কথা বলবে।বকুল টারও কোন পাত্তা নেই।মামা অনেক আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছে।মহল এখন পুরোই ফাঁকা।

স্বর্ণলতা হালকা কেশে সৈকতের উদ্দেশ্য বললো-
—“আসতে পারি?”

—“তুমি আসবে আর আমার পারমিশন নিতে হবে?এসো বসো।একটা মুভি দেখছিলাম।”

—“কেনো ঘুম আসছেনা ভাইয়া?”

—“আর ঘুম! জোর জবরদস্তি করে দু কাপ চা খাইয়ে দিলে।ঘুম কি আর আসে?”

—“আপু তো ঠিকি-ই ঘুমাচ্ছে।”

—“কি জানি আজ বেচারীর কি হলো।বিছানায় পড়তে না পড়তেই ঘুম।ওর আবার চা খেলে কেউ ওকে আটকাতে পারেনা।মানুষ চা খায় ঘুম না আসার জন্য।আর বেচারীর উল্টো।তার মধ্যে আদা ছিলো।এতো ওর ঘুমটা প্রখর হয়েছে।

স্বর্ণলতা মনে মনে ভাবতে লাগলো,তাকে ঘুম পাড়ানোর জন্যই তো এতো কিছুর সংমিশ্রণে আমার চা বানানো।
এরপর স্বাভাবিক ভাবেই সৈকত কে বললো-
—“আজকে অনেক ক্লান্ত ছিলো তাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।”

—“হুম প্রেগনেন্ট অবস্থায় অনেক কাজ করলে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে যায়।”

—“ভাইয়া একটা কথা বলেন তো,আপনি কি আমাকে আপন বোনের মতো ভাবেন?”

—“এ কি বলছো স্বর্ণলতা?তুমি আমার আপন বোন-ই”।

—“স্নেহা আপুও প্রেগনেন্ট আমিও প্রেগনেন্ট তাহলে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে আমাকে কেনো বিপদে ফেলে দিচ্ছেন”?

—“মানে!!কি বলছো তুমি?”

—“নিজের বাবার বাড়ি যার জন্য বিপদজনক সেখানে অন্য বাড়ির মেয়ের জন্য কতটুকু নিরাপদ?”

সৈকত প্রচুর ঘামছিলো।আমতা আমতা করে উত্তর দিলো-
—“স্বর্ণ কি বলছো এসব?আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

—“বুঝতে পারছেন না,নাকি বুঝেই বুঝতে চাইছেন না?”

—“আমি উঠছি।তুমি থাকো।”

—“ভাইয়া,এক কাজ করুন।আমাকে মেরে ফেলুন।দিনের পর দিন এগুলো আর সহ্য করতে পারছিনা।”

—“কি সহ্য করছো তুমি?এখনও তো তোমাকে ওরা আদরেই রেখেছে।”

স্বর্ণলতা ভ্রু কুঁচকে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বললো-
—“এখনও রেখেছে মানে!তাহলে ভবিষ্যৎ এ আমার সাথে খারাপ কিছু হতে চলেছে?”

—“আমি এসব কিছুই জানিনা।আমাকে বাধ্য করোনা।দয়া করে চলে যাও।”

—“অনাগত সন্তানের কসম খেয়ে তার ক্ষতি চাচ্ছেন না তাইনা?আর এদিকে আমার গর্ভেও বেড়ে উঠছে তরতাজা এক প্রাণ।যার ভবিষ্যৎ চিন্তা আমাকে উন্মাদ করে তুলছে।আপনার শিশু ভালো থাকুক দোয়া করি।আমার ছোট্ট মাসুম বাচ্চার জন্য কি আপনার ভেতর টা একটুও কাঁদবে না?”

—“স্বর্ণ।ঘরে যাও।আমি কিছু বলতে পারবো না কারন….

—“কারন আপনি বাচ্চার নামে কসম খেয়েছেন তাই।”

—-“তুমি এটা কিভাবে জানলে?”

—“আল্লাহ আমাকে জানিয়েছে।”

সৈকত উঠে চলে যেতেই স্বর্ণলতা দু হাত দিয়ে পথ আটকে ধরলো।আখিঁদ্বয় জলে ভিজে উঠেছে।টপটপ করে দু গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তার কাঁদো কাঁদো কন্ঠস্বরে একটা কথাই ভেসে আসলো-
—“এভাবে চলে যাবেন না ভাইয়া”।
সৈকত তারপরেও চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।আর স্বর্ণলতা দুই পা জড়িয়ে ধরলো-
—“আমাকে দয়া করুন ভাইয়া।আমার মা বাবা কেউ নেই।আমি এই দুনিয়ায় পুরো একা।আমি অনেক যুদ্ধ করেছি এতোদিন।আমার বাচ্চা টা পৃথিবীর আলো দেখবে আমি কত স্বপ্ন বুকের ভেতর পুষে রেখেছি।এখন আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বাচ্চা মাতৃগর্ভেই ভালো আছে।নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে মানুষরূপী পশুদের থেকে রক্ষা পাবে।”

—“তুমি যেসব ভাবছো সেসব কিছুনা।”

—-“তেমন না হলে স্নেহা আপু কেনো ভয় পায়?কেনো সে সেদিন এতো দ্রুত চলে এলো?সে যখন ঐ বাড়িতে থাকতো কোনোদিনও তার চোখে মুখে ভয় দেখিনি।প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকেই সে ভীত হয়ে আছে।কি আছে ঐ বাড়িতে?”

সৈকত স্বর্ণলতাকে উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই স্বর্ণলতা বললো-
—“আজকে আপনি আমাকে সাহায্য না করলে আমার মরা ছাড়া কোন উপায় নেই।রূপক নেই চলে গেছে।মামা,আম্মা কে যেতে দেখেছিলাম জঙ্গলে।কি এমন আছে সেখানে?লুকিয়ে চুড়িয়ে এ বাড়ির সবাই যায়।আমি আমার বাচ্চাকে পেটে নিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিলাম।মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছি।আমি ঐ বাড়িতে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।ঐ বাড়ি, সামনের জঙ্গল আমার জীবনে কে বিষিয়ে তুলেছে।ঐ বাড়িতে থাকতে শঙ্কা বোধ করছি।যেমন শঙ্কাবোধ স্নেহা আপু নিজেই করে।নিজেকে ঐ বাড়িটাতে নিরাপদ বোধ করেনা।আজকে আপনার যদি আপন বোন হতাম তাহলে পারতেন এভাবে বিপদে ঠেলে দিয়ে নিজের পিঠ বাঁচাতে?”
সৈকত কাচুমাচু করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো-
—“স্বর্ণলতা।দুই হাত জোড় করে তোমার কাছে মাফ চাচ্ছি। এখন স্নেহা উঠে গেলে প্রচুর খারাপ হবে।আমি চাই তুমি ভালো থাকো। তোমার বাচ্চা ভালো থাকুক।আমি দোয়া করি সব বিপদ কেটে যাক।কিন্তু আমাকে তুমি কিছুই বলতে বলোনা।আমার হাত পা বাঁধা বোন।”
স্বর্ণলতার দুই পা জড়িয়ে ধরতে গেলো সৈকত।
—“ছিঃ ছিঃ একি করছেন?আমার পায়ে হাত দিয়েন না ভাইয়া।”

—“স্বর্ণলতা বোন আমার।তুমি কান্না করোনা।তোমার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করবো।সব বিপদ থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করবো।কিন্তু আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারবো না।আমি আমার বাচ্চার নামে শপথ করেছি।”

—-“ভাইয়া শুধু এতটুকু বলেন ঐ বাড়ি কি আমার জন্য বিপদজনক, নাকি ঐ বাড়ির মানুষগুলো?স্নেহা আপু কি ভয় পায়?বাড়িকে নাকি তার চিরচেনা আপনজনদের? ”

দ্রুত পায়ে কারও হাঁটার শব্দ কানে আসতেই স্বর্ণলতা উল্টোপাশে চোখের পানি মুছে নিলো।
—“স্বর্ণলতা!এতো রাতে এখানে কি করো?ঘুমায় নি কেনো এখনো?”

—”চা খাওয়ার জন্য ঘুম আসছিলো না আপু।দেখলাম ভাইয়া বসে আছে তাই ভাইয়ার সাথে বসে গল্প করছিলাম।”

স্নেহার চোখমুখ চুপসে গেছে।মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব চিন্তিত। বারবার চারপাশ টায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।
একপ্রকার চিলের মতো ছোঁ মেরে সৈকতকে নিয়ে ঘরে চলে গেলো।সৈকতকে আজ অনেক জবাবদিহিতা করতে হবে।সৈকত যেতে যেতে পিছনে ঘুরে স্বর্ণলতার দিকে তাকালো।স্বর্ণলতা করুন চোখে হাত জোড় করে ইশারা করলো।
সৈকত বুঝতে পারলো স্বর্ণলতা তাকে কি বোঝাতে চাচ্ছে।তার প্রচন্ড মায়া হতে লাগলো।
বুকটা ভারী হয়ে যাচ্ছে।ভীষণ অপরাধ বোধ কাজ করছে।
মেয়েটা আসলেই ভীষন অসহায়।
স্নেহা অনেক কঠিনস্বরে আরও একবার সৈকতকে মনে করিয়ে দিলো তার শপথের কথা।
এবার সৈকত খুব তাচ্ছিলের সুরে বললো-
—“স্নেহা,যদি তুমি নিজের ব্যাথা টের পাও তাহলে তুমি জীবিত। আর যদি অন্যের ব্যাথা টের পাও তাহলে তুমি মানুষ”।
স্নেহা থমকে গেলো।আর একটিও টু শব্দ করলো না।
সৈকত উল্টোপাশ ঘুরে শুয়ে পড়লো।

এর দুইদিন পরই স্বর্ণলতা,মামা,মা সবাই বাড়ি ফিরে এলো।যদিও থাকার কথা ছিলো বেশ কিছুদিন।
স্নেহার ভাবসাবে স্বর্ণলতাও বুঝে গিয়েছিলো সে চাইছে না তারা এখানে থাকুক।
যতদিন যাচ্ছিলো স্নেহা আরও সাবধানী হয়ে উঠছিলো।স্বর্ণলতার সাথে ১ সেকেন্ড ও একা থাকতে দিতোনা সৈকত কে।উপায়ন্তর না দেখে স্বর্ণলতা বাড়ি ফিরে এলো।
এতোদিন বাইরে ছিলো।বাড়ির অবস্থায় বেশ খারাপ।ধুলোবালি পড়ে গেছে।
স্বর্ণলতা প্রয়োজনীয় সকল জিনিস ড্রেসিং টেবিলে রাখবে।কিন্তু টিস্যু প্রয়োজন টেবিল মোছার জন্য।স্বর্ণলতার ব্যাগে টিস্যু থাকে।
তাই টিস্যু খোজার জন্য ব্যাগ খুলতেই একটা চিরকুট দেখতে পেল।
চিরকুট টা দেখে বেশ অবাক হলো স্বর্ণলতা।
চিরকুট টি খুলে দেখলো।চিরকুটে লেখা ছিলো-
“তোমার জঙ্গলে যাওয়ার সঙ্গী থেকে দূরে থাকবে”।

ভ্রু কুঁচকে বেশ কয়েকবার চিঠি টা পড়লো।হাতের লেখাটা কার বুঝতে পারছেনা।স্বর্ণলতা কৌতুহলী মনকে বারবার প্রশ্ন করতে লাগলো-
—“কিন্তু জঙ্গল যাওয়ার সঙ্গী কেনো লিখলো!!জঙ্গলে যাওয়ার কথা শুধু সৈকত ভাইয়া কে বলছি।তাহলে কি ভাইয়া লিখেছে?
না পুরোপুরি নিশ্চিত ভাবে তো বলা যাচ্ছেনা ভাইয়াই লিখেছি। কারন জঙ্গলে যাওয়ার বিষয় টা স্নেহা আপু অবশ্যই জানবে।তারা তো একদলের ই।
কিন্তু ভাইয়া কে বলেছিলাম জঙ্গলে গিয়েছি কিন্তু কার সাথে গিয়েছি এটা তো বলিনি।
উফ্ কিচ্ছু মেলাতে পারছিনা।
সাবধানী চিরকুট টা কে দিলো আমাকে?
ভাইয়া নাকি আপু!!!”

ফিসফিস কথার আওয়াজে স্বর্ণলতার ভাবনার সমাপ্তি ঘটলো।
ড্রয়ং রুম থেকে ফিসফিস করে মামা,এবং রূপকের মা কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে।স্বর্ণলতার দেয়ালের সাথে মিশে গিয়ে প্রানপণ চেষ্টা করলো তাদের কথা শোনার জন্য।

চলবে……………
✍️Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here