স্বর্ণলতা part 21

0
388

#স্বর্ণলতা
পর্ব-২১
__________________________________________
পরদিন স্বর্ণলতাকে কিছু না বলেই রূপক চলে গিয়েছে।ঘুম থেকে উঠে নিজেকে পুরো বাড়িতে একা আবিষ্কার করলো স্বর্ণলতা।
কিচ্ছুক্ষন পর রূপকের মা,এবং মামা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো-
—” বাইরে গিয়েছিলেন রূপককে বিদায় দিতে?”

—“হুম গিয়েছিলাম।তুমি কখন উঠেছো?”

—“আমাকে একটু ডাকতে পারতেন।আমি না হয় চোখের দেখাই দেখতাম।”

—“ন্যাকামি করবা না।ন্যাকামি আমার একদম পছন্দ না।যদি এতোই দরদ থাকতো তাহলে ওকে বিপদে ফেলতে না।”

—“কালকে সারাদিন পর আমি যখন ঠান্ডা ভাত খেয়ে উঠলাম।মামা যখন আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করছিলো তখন রূপকের সামান্য প্রতিবাদ করায় আপনার কাছে তখন আকাশ সমান বেয়াদবি মনে হয়েছে।আজকে আমার কান্না আপনার ন্যাকামি লাগছে।তবে যেদিন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসি সেদিন ঘটা করে আমার জন্মদিন পালন না করে ন্যাকামি সেদিন-ই কবর দিয়ে দিতেন।আমি আর আজকে ন্যাকামি করার সাহস দেখাতাম না।”

—“স্বর্ণলতা তুমি ঘরে যাও।তোমার শ্বাশুড়ির লগে হুদাই তর্ক কইরা পাপ কামাইও না।রূপক গেছে তবে আইবো পরে।এমন না যে আমরা জোর কইরা পাঠাইছি।যোগাযোগ করবো।অহন ঘরে যাও তো দেহি।”

—“জ্বী শ্রদ্ধেয় মামা।আপনার এবং আম্মার সাথে চরম বেয়াদবি করে ফেলেছি।আমি চাই আপনারা আমাকে শাস্তি দিন।আমি আর মাফ চাইবোনা।আমাকে আপনাদের মাফ করতে হবেনা।আমাকে আপনারা শাস্তি দিন।আর আমার শাস্তি হোক মৃত্যু। শাস্তি দিলেই আমি শান্তি পাবো।আমি শান্তি চাই।আর মৃত্যুর মতো শান্তি আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা।”

স্বর্ণলতার প্রস্থান জাফর এবং রূপকের মা কে হাফ ছেড়ে বাচালো।কঠিন কন্ঠে জাফর বললো-
—“দিন দিন কাজ আরও কঠিন হইয়া যাইতাছে।এই মাইয়ার সাহস দিন দিন বাড়তাছে।সরল সোজা ভাইব্বা আইন্না অহন কি সমস্যাডায় না পড়তাছি।”

—“ও যদি বুনো ওল হয় আমিও বাঘা তেঁতুল।ওর প্রাণ ভোমরা যদি আমার হাতে থাকে তাহলে ওর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হবে।”

জাফর তাচ্ছিল্যের গলায় বললো-
—“আছে তোমার কাছে?”

—“কি আছে?”

—“স্বর্ণলতার প্রান ভোমরা?”

—“সেটা ও নিজের হাতে আমাকে তুলে দিবে।”

—“কবে?”

—“সময় হলে।সময়ের জন্য অপেক্ষা কর জাফর।”

জাফর আর রূপকের মায়ের কঠিন ষড়যন্ত্র স্বর্ণলতা কিছুটা আঁচ পেলেও তার করার কিছু ছিলো না।
একটা মেয়ে হয়ে জন্মানো তার কাছে পাপ মনে হচ্ছে।আজকে হয়তো মেয়ে বলে এতোকিছু তাকে সহ্য করতে হচ্ছে।কিন্তু তাকে তো সহ্য করেই বাঁচতে হবে।একদিন না একদিন সবকিছুর অবসান হবেই হবে।
স্বর্ণলতা মনে মনে চিন্তা করলো-
—“আমাকে আগের মতো স্বাভাবিক হতে হবে।আমার কৌতুহলি চিন্তা ভাবনা আমার দুঃসাহসিক কাজ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে আমি তাদের জন্য বিপদজনক। আমাকে কাজ ঠিকি-ই করতে হবে।তবে সেটা লুকিয়ে।আপাতত অনেক প্রশ্ন মনে মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।জঙ্গলে রূপক কে দেখে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো তাহলে রূপক কি সবার দলেই? নাকি রূপককে তারা জোর করে তাদের দলে ভিড়াতে চাচ্ছে।সবকিছু ঘোলাটে থেকে আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।দিন দিন মুখোশের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে।মুখোশের আড়ালে বিলীন হচ্ছে প্রিয় মানুষের মুখগুলো।

রূপকের মা,স্নেহা সৈকত ছিলো তার কাছের মানুষ।কিন্তু এখন ভাবতে কষ্ট হয় এরাও কি আমার ক্ষতি করতে চায়!”
আমাকে আগের মতো হয়ে যেতে হবে।তাদের বোঝাতে হবে আমি সবকিছু ভুলে নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করতে চাই। সব সময় গায়ের জোর খাটিয়ে বা শক্তি দিয়ে সবকিছু হাসিল করা যায়না।শক্তি দিয়ে হয়তো মানুষকে পরাজিত করা যায়।কিন্তু জয় করতে গেলে শুধু ভালোবাসার প্রয়োজন হয়।
আমিও তাদের মতোই ভালোবাসার ফাঁদ পাতবো।
মিথ্যা অভিনয়ের মুখোশ সারা গায়ে জড়িয়ে নিবো।
আমি স্বর্ণলতা।এই পৃথিবীতে অসহায়,এতিম একা একটা মেয়ে।যাকে লড়াই করতে হবে।যাকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে।মেহুল কে খুঁজে বের করতে হবে।
———————————
রূপকের মায়ের ঘরে প্রবেশ করলো স্বর্ণলতা—-
—“আম্মা আমাকে মাফ করে দিবেন।আসলে আমি ছোটবেলা থেকে অনাদরে বড় হয়েছি। আমার সৎ মা প্রতিনিয়ত আমার ওপর অত্যাচার করতো।আমি মমতার কোমল পরশ পেয়েছিলাম আপনার হাতে।রূপকের ভালোবাসার রং এ রংধনুর মতোন নিজেকে সাজিয়েছিলাম।শ্রদ্ধা,ভরসা বিশ্বাস এর কুটির পেয়েছিলাম মেহুল এর কাছে।মেহুল চলে যাওয়াতে এক সমুদ্র সমান কষ্ট বুকে চাঁপা দিয়ে রেখেছি।যে কষ্টের ঢেউ প্রতিনিয়ত মনের অন্তঃস্থলে আছড়ে পড়ে।
আমার মা নেই।আপনাকে আম্মা বলে মনে প্রশান্তি পাই।আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দিবেন না।আমার পূর্বের সকল অন্যায়,আমার বলা বিষাক্ত জিহ্বা দ্বারা প্রত্যেকটা বেয়াদবি,আমার সবকিছু আপনি ভুলে যাবেন আম্মা।
আমি আপনার ছায়াতলে আবার আশ্রয় চাই আম্মা।আমাকে দূরে ঠেলে দিবেন না আম্মা।”

—-“স্বর্ণলতা ওঠো মা।তোমার কোন কিছুই মনে রাখিনাই।তুমি আর স্নেহা আমার কাছে এক।মা কি মেয়ের অন্যায় মনে রাখে?”

—“আম্মা আমি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চাই।আপনার স্পর্শে আমি শীতল হতে চাই”।

স্বর্ণলতাকে জড়িয়ে নিলো রূপকের মা।রূপকের মা সত্যি শান্তি অনুভব করছে।সে এতোক্ষণ যা বলেছে সব তো অভিনয়। তাহলে কেনো তার এতো শীতল লাগছে।হৃদয় টা কঠোর থেকে ফুলের মতো কোমল হয়ে যাচ্ছে।স্বর্ণলতার স্পর্শে নিজেকে পবিত্র মনে হচ্ছে।
ঐদিকে জাফর দূরে দাড়িয়ে সব দেখছিলো।তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এর বিশাল সৈন্যদল কে পরাজিত করে বিজয়ের মুকুট সে ছিনিয়ে এনেছে। সে যুদ্ধে বিজয়ী এক সৈনিক।
কিন্তু আফসোস!সে এটা ভুলে গিয়েছিলো ঝড় আসার আগে পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়।শান্ত পরিবেশর ওপর একটু পড়েই আছড়ে পড়তে পারে বিশাল বড় বিপদ।

এতো বড় একটা ঘটনা ঘটেছে।স্বর্ণলতা নিজে থেকে সবকিছু ভুলে মাফ চাইতে এসেছে।এখানে জাফর কথা না বলে থাকলে বিষয় টা জাফরের হজম হবে!তার বাড়তি কিছু মশলা তেই জমে যাবে পুরো বিষয়।
—“দেখছো বুবু তোমারে কি কইছিলাম?স্বর্ণ কিন্তু খুব ভালা মাইয়া।ও তোমারে কত ভালোবাসে।সবকিছু ঠিক করবার আইছে।স্বর্ণলতা তোমার কেউ নাই কেডা কয়?তোমার শ্বাশুড়ি তোমার আপন মা।আর আমি তো তোমার মামা।আমি তোমার মুসকিল আসানের মামা।”

—“মামা আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। আপনি শুরু থেকেই আমাকে সার্পোট করে গেছেন।আমি বুঝতে পারিনি।আর মেহুল! ও হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে তাই চলে গেছে।ওকে নিয়ে আর ভাবিনা।যে চলে যেতে চায় তাকে যেতে দিতে হয়।নীড়হারা পাখিদের কি বেঁধে রাখা যায়!”

—-“যাক গা।অহন তুমি একটু বিশ্রাম করো।তোমার শরীর সুস্থ রাখন লাগবো না?”

—“মামা অনেক তো বিশ্রাম হলো চলেন একটু ঘুরে আসি।”

—“ঘুরবা?৬ মাসের প্যাট লইয়া?”

—“মামা স্নেহা আপুদের বাসায় গিয়ে ঘুরে আসি?আপুতো আসতেই চায়না।”

—“ও ঠিক কথা বলেছে জাফর।আমাদের একটু ওদের ওখানে যাওয়া উচিত।বেয়াই,বেয়াইন তো গ্রামে থাকে স্নেহা একা আর একটা কাজের লোক।ও তো প্রেগনেন্ট।চল আমরা গিয়ে একটু ঘুরে আসি।”

—“তাইলে দুপুরেই যাই?ওরে জানাইয়া দাও।”

—“তোরা তাহলে ফ্রেশ হয়ে নে আমি স্নেহা কে জানিয়ে দেই”।

স্বর্ণলতা ঘরে চলে গেলো।পেটে হাত দিয়ে মনে মনে শপথ করলো-
—-“আমার অনাগত সোনামনি।তোর মা আজকে থেকে টিকে থাকার যুদ্ধে নেমেছে।তুই যেদিন আসবি আমার কোল জুড়ে তোর পবিত্র রোশনি তে পাপের গাঢ় আঁধার আমি আলোকিত করবো।তুই আমার অনুপ্রেরনা।
আমার মিষ্টি সোনামনি।”

স্নেহার বাসায় সবাই উপস্থিত। সাথে স্নেহার জন্য কয়েক রকমের ফল,মিষ্টি,খাবার।স্নেহা যা যা খেতে ভালোবাসে সবকিছু স্বর্ণলতা নিজে কিনে আনিয়েছে।তার তদারকি তে মা এবং মামার মুখের উজ্জ্বলতা দ্বিগুণ। তারা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করছে স্বর্ণলতা হয়তো সবকিছু ভুলে যাবে।
সে একা তাদের সাথে পারবেনা সেটা হয়তো সে বুঝতে পেরেছে।তাই তাদের সাথে শান্তি চুক্তি তে স্বাক্ষর করেছে।কিন্তু প্রকৃত গুপ্তকাহিনী তো তারা এখনো ঠাওর করতে পারেনি।
স্নেহা বেশ খুশি।
মনে মনে সে চাইতো তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে।প্রেগনেন্ট অবস্থায় একটা মেয়ের কতশত স্বপ্ন থাকে।
তার শঙ্কা তাকে এগুলো থেকে দূরে রেখেছে।
সে বাড়ির ছায়া মাড়ালে কেঁপে উঠতো।
এতো ভীত হয়ে আনন্দ করা যায়না।
সৈকত বাড়িতে এসে রীতিমতো সারপ্রাইজড হয়ে গেলো।

—“আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া।কেমন লাগলো আমাদের দেখে?”

—“আরেহ বাবারে বাবা!!আমার বাড়িতে আজকে কারা এসেছে!গরীবের বাড়িতে হাতির পারা”।

—“আপনি আমাকে হাতি বললেন!!”

—“আরে না না স্বর্ণলতা।”

—“আমাকে আপনার হাতি মনে হয়?”

—-“আরে বাবা নারে, একি জ্বালা হলো!”
স্নেহা তাদের খুনসুটির মধ্যে গলা টেনেটেনে বললো-
—“কি শুরু হয়ে গেছে তাইনা?ওকে না চেতিয়ে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না?”

—“আপু দেখোনা ভাইয়া আমাকে হাতি বলছে”।

চোখ কপালে তুলে স্নেহা প্রশ্ন করলো-
—“কিহ!!! ওকে তুমি হাতি বলছো?”

জাফর ভারী গলায় প্রশ্ন করলো-
—“হাতি!!!!এইডা কি জঙ্গল নাকি যে হাতি খুঁজতাছো তোমরা।হাতি আইবো কোনহান থিকা?”

—“মামা হাতি খুঁজছে না কেউ।সৈকত স্বর্ণলতাকে হাতি বলেছে”।

—-“আরে বাবা তোমরা আমাকে মাফ করো।আমার কথা টা শোনো রে বাবা।আমারে শাঁখের করাতের মধ্যে ফেললা।”

সৈকতের কাচুমাচু অবস্থা দেখে একগাল হেসে স্বর্ণলতা বললো-
—-“আপু এবং মামা,ভাইয়া আমাকে কটাক্ষ করে বলেছিলো গরীবের বাড়িতে হাতির পারা।সেটাই আমি এতোক্ষণ পেচিয়ে ভাইয়া কে শায়েস্তা করলাম।”

সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।সৈকত বলে উঠলো-
—“তোমাকে জীবনেও চটানো যাবেনা স্বর্ণলতা।আমি বরং ফ্রেশ হয়ে আসি।”
সৈকত ফ্রেশ হতে গেলো।আর স্নেহা স্বর্ণলতাকে উদ্দেশ্য করে বললো-
—“স্বর্ণলতা।এসো খেতে এসো।সৈকত ফ্রেশ হয়ে সোজা টেবিলে আসবে।
স্নেহা চেচিয়ে তার কাজের মেয়ে বকুল কে খাবার দিতে বললো।

চলবে…………
?️Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here