স্বর্ণলতা part 19

0
428

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ১৯
______________________________________
স্বর্ণলতা রূপকের এই অদ্ভুত কান্ড দেখে হেসে লুটোপুটি খেলো।সাথে সাথে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো।এতো মুগ্ধতা ভালোবাসার!
এই মুগ্ধতা খাঁটি একটা মানুষ পাশে থাকার।পুরোনো সব গ্লানি ধুয়ে মুছে শেষ করে স্নিগ্ধতার সুবাস ছড়াচ্ছে।ভালোবাসা ময় পৃথিবী হোক।

জঙ্গল বেশি দুরে নয়।স্বর্ণলতার হৃদস্পন্দন জোরে জোরে ডাকতে লাগলো।কোন এক অজানা শঙ্কা তাকে ঘিরে ধরেছে।অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙলের গাঢ় অন্ধকার ঘিরে রেখেছে চারপাশ।অন্যসময় চাঁদের আলো থাকে।কিন্তু আজকে চাঁদ ও হয়তো স্বর্ণলতাকে সাহায্য করবেনা ভেবে রেখেছে।তাই তার মেঘের বাড়ি থেকে বারবার উঁকি দিচ্ছে।কিন্তু পুরোপুরি বাইরে এসে অন্ধকার কে দূরে ঢেলে আলোকিত করছে না।
জঙ্গলের একদম সামনে রূপক আর স্বর্ণলতা।রূপক কিছুটা চুপ হয়ে গেলো।
শুকনো গলায় ঢোক গিলতে গিলতে স্বর্ণলতা কে বললো-
—“স্বর্ণলতা।জঙ্গলে কি সত্যি যাবে?”
ভ্রু কুঁচকে স্বর্ণলতার রূপকের দিকে তাকাতেই রূপক আবার বললো-
—“না মানে বলছিলাম কি দেখো কতটা অন্ধকার। এখানে গিয়ে কি করবে?দিনে আসবো। এখন চলো”।

—“জানেন মানুষ এতো অন্ধকার কে ভয় কেনো পায়?”

—“কেনো?”

—-“অপরাধ জগৎ টাই অন্ধকারের।মানুষ দিনের আলোতে যে ভালো মানুষিটা দেখায় সেটা রাতের অন্ধকারেই ফানুস হয়ে দূর আকাশে উড়ে যায়।অন্ধকার শুধু আলোকেই দূরে রাখেনা।পাপীদের পাপের মস্ত বড় বোঝা এই অন্ধকার-ই ঢেকে রাখে।আপনাকে পাপ ধরতে হলে আলো খুঁজতে হবে।আর পাপীকে ধরতে হলে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হবে।পাপ আলোতে অন্ধকারে সবজায়গা-ই করা যায়।কিন্তু পাপী শুধু অন্ধকারেই দৃশ্যমান হয়।পাপের সন্ধান আগেই পেয়েছি।এখন পাপীকে চাই।অন্ধকারের কোল থেকে টেনে হিচড়ে আলোতে নিয়ে যেতে চাই।যাতে তার মুখটা সবাই স্পষ্ট দেখতে পারে।সবাইকে পরিচিত করে দিতে চাই সেই কালো মুখের সাথে।যেটা এতোদিন অন্ধকারে লুকিয়ে ছিলো।”

স্বর্ণলতার বলা প্রতিটা শব্দ রূপকের বুকে তীরের মতো বেঁধে। সে যেনো আরও সাহসী হয়ে যায়।মনোবল দৃঢ় হয়।এতো সাহসী একটা মেয়ে তার পাশে আছে !এ যেনো অন্ধকার পৃথিবীতে একটা আলোকছটা।যার আলোতে আলোকিত হবে গোটা অন্ধকার জগৎ। পাপ,পাপীরা পালিয়ে বেড়াবে।
রূপক আর কোন না সূচক বাক্য মুখ থেকে বের করলোনা।স্বর্ণলতা যেনো তার শঙ্কা কে মুখে কুলুপ লাগিয়ে দিয়েছে।তার আর ভয় লাগছেনা।রূপক কঠিন স্বরে স্বর্ণলতাকে বললো-
—“স্বর্ণ যা হবে দেখা যাবে।তোমাকে শুধু এগুতে হবে।”
—“স্বর্ণলতা বলেননি এই সৌভাগ্য আমার!”
রূপকের প্রান্যোচ্ছল একটা হাসিতে স্বর্ণলতা সজীব হয়ে গেলো।
—“চলুন যাওয়া যাক।আর টর্চ টা অন করতে হবে।এখানে মানুষের ভয়ের থেকে হিংস্র জীবজন্তুর ভয় ও বেশি।”

—“আমি আগে যাই তুমি আমার পেছন পেছন এসো।”

জঙ্গলের ভেতর ঢুকলো দুজন।এ যেনো এক অন্যরকম পৃথিবী।বাইরে থেকে যতটুকু আলো আসছিলো ভেতরে তার ছিটেফোঁটাও নেই।মনে হচ্ছে নরকে চলে এসেছে।
শেয়ালের ডাক যে এতো ভয়ংকর তা এখানে না আসলে স্বর্ণলতা বুঝতে পারতো না।কি কঠিন করে শেয়াল ডাকছে।পেঁচা করুন সুরে ডাকছে।অদ্ভুত সব ভূতুরে পরিবেশ।গা ছমছমে এক অন্যরকম পৃথিবী।আস্তে আস্তে করে সামনে এগিয়ে চললো স্বর্ণলতা এবং রূপক।মাথার ওপরে কয়েকটা পাখি উড়ছে।
—“এগুলো কি পাখি?এগুলো কি বাদুড় নাকি!”

—“জানিনা স্বর্ণলতা।হতে পারে।আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা।”

—“অদ্ভুত দেখাচ্ছে পাখি গুলো কে।আস্তে আস্তে সামনে আগান।সাপ টাপ থাকতে পারে।”

—“এতো বড় জঙ্গলে কোথায় খুঁজবে তুমি মেহুল কে?”

—“জঙ্গল আহামরি বড় না।আমি ছাঁদে গিয়ে কয়েকবার পর্যবেক্ষন করেছি।আমাদের বাসা থেকে জঙ্গল দূরে তবে ছাঁদ থেকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করা যায়।কারন আশে পাশে তো আর বাড়ি নেই।”

—“স্বর্ণ আমরা যদি পথ হারিয়ে ফেলি?”

—“ফেলবো না।জঙ্গলে ঢোকার পথেই আমি একটা গাছের সাথে একটা কাপড় বেঁধে দিয়েছি। দেখুন ঐ যে।কিছুদূর আবার আরেকটা বেঁধে দিবো।আমরা যেহেতু সোজা জঙ্গলে ঢুকছি সেহেতু সোজাই বের হবো।আর আমাদের হাতে সময় খুব কম।”

—”চলো সামনে আগাই।”

এ পাশ ওপাশ টর্চ ধরে কোনকিছুই পেলোনা স্বর্ণলতা আর রূপক।শুধু রাতের অন্ধকারে কয়েকটা ঝিঁঝি পোকা ডাকছে।শেয়াল ছাড়া কোন প্রানীও নেই হয়তো।
ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা পথ এসে গেছে তারা।

—“নাহ স্বর্ণলতা কিছুতো পাচ্ছিনা।”

—“দাড়ান একটু ওদিক টায় চলুন।”

—“কিন্তু!”।

—“ভয় নেই রাস্তা হারাবো না।”

স্বর্ণলতার কথা মতো এবার তারা ডানপাশে মোড় নিলো।ডান পাশ পুরোটা খুঁজে কিচ্ছু পেলোনা।দূরে একটা কবরস্থান দেখতে পেলো।কবরস্থানের সামনে লাইট ধরতেই অদ্ভুত কিছু একটা জিনিস দেখতে পেলো।ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে গেলো দুজন!

—“ওটা কি বলুন তো?ওপাশ ঘুরে আছে।কোন হিংস্র প্রানী হবে নাকি?”

—“বুঝতে পারছিনা।সামনে আগাচ্ছি আমি।দাড়াও তুমি এখানে।”

কিছুদূর গিয়ে স্বর্ণলতার দিকে আলো ধরে হাত দিয়ে ইশারা করলো রূপক।রূপক ইশারা করছিলো স্বর্ণলতাকে চলে যেতে কিন্তু স্বর্ণলতা না বুঝে আরও রূপকের দিকে এগিয়ে আসলো।
—“তোমাকে আস্তে আস্তে চলে যেতে বলেছি তুমি আবার আসলে কেনো?”

—“কি এটা!”

স্বর্ণলতা আৎকে উঠে রূপকে খামচে ধরে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

একটা বুনো শেয়াল একটা লাশকে উন্মুক্ত করে ছিড়ে খাচ্ছে।লাশটাকে দেখে মনে হচ্ছে মারা গেছে বেশিদিন হয়নি।কাফনের কাপড় পরিহিত।তার মানে লাশটার দাফন সম্পন্ন হয়েছিলো।তাহলে এখানে আসলো কি করে লাশটা?
কে আনলো লাশ!!
কারও পায়ের শব্দ শোনা গেলো।একজন না কয়েকজনের পায়ের শব্দ।
স্বর্ণলতা রূপক পেছনে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।
মোটাসোটা লম্বা লম্বা চুলওয়ালা কিছু লোক কবরস্থানের ভেতর ঢুকছে।অন্ধকারের জন্য পুরো চেহারা স্পষ্ট না।
এরপর মাটি খোড়ার শব্দ কানে ভেসে আসলো।
একটু উঁকি দিয়ে দুজন দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছিলো না।
স্বর্ণলতা ফিসফিসয়ে রূপককে বললো-
—“আপনি কি কিছু দেখতে পাচ্ছেন?”

—“না আমি তো তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছিনা।”

—“কি করছে ওরা বলুন তো!”

—“মাটি খুঁড়ছে।হয়তো কোন লাশকে দাফন করবে।”

—“রাত আড়াইটার সময় কে লাশ দাফন করে?”

লোকগুলোর মাটি খোঁড়ার শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো।চারদিক আলোকিত হয়ে গেলো।অনেকগুলো টর্চ একসাথে মারা হয়েছে।চারপাশটা তারা পর্যবেক্ষন করছে।
স্বর্ণলতা এবং রূপক দ্রুত পাশের ঝোপের নিচে লুকিয়ে গেলো।
কিচ্ছুক্ষনের মধ্যেই আবার ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেলো।তারা মাটি কেনো খুড়ছিলো কিছু বোঝা যায়নি।তাদের কাজ শেষ বলে মনে হলো।কবরস্থান থেকে বের হয়ে তারা হাঁটা শুরু করলো।
স্বর্ণলতা তাদের পিছু নেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রূপক হাত টেনে ধরলো।
—“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

—“কেনো ওদের পিছে যাচ্ছি।”

—“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?ওরা ভালো মানুষ না।”

—“ভালো মানুষ না?”

—“এই অন্ধকারে কোন ভালো মানুষ জঙ্গলে আসবে?”

—“আমরা তো এসেছি।”

—“তুমি না একটু আগে বললে পাপীকে ধরতে এসেছো?”
আমরা তো সেটাই করতে এসেছি”।

—“তো আমি তো সেটাই করছি!”

—“তুমি প্রেগনেন্ট স্বর্ণলতা।ওরা ভালো মানুষ না।টের পেয়ে গেলো রক্ষা থাকবেনা।”

—“আমি যাচ্ছি। আপনি আসলে আসতে পারেন আর নাহয় বাড়ি চলে যান।”

—“তোমাকে একা ছাড়বোনা বলেই আমি তোমার সাথে এসেছি।আর এখন তুমি ছেড়ে যেতো বলছো আমাকে?”

স্বর্ণলতা রূপকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-
—“তাহলে চলুন রহস্য ভেদ এর তীর টা দুজনেএকসাথেই ছুড়ি?পাপীদের মুখোশ খুলে দেওয়ার যুদ্ধ টা একসাথেই লড়ি?”
রূপক আর কোন কথা বলতে পারলো না।নিশ্চুপ থেকে স্বর্ণলতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।দুজনে লোকগুলোর পিছু করতে থাকলো।
লোকগুলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বামে মোড় নিয়ে হাটছিলো।

হাটাচলা বেশ অদ্ভুত। মনে হচ্ছে তালে তালে হাটছে।একজনের বাম পা আগে হলে বাকীদের ও বাম পা আগে।ছোটবেলায় স্কুলের ব্যায়াম চর্চা করার সময় মানুষ যেভাবে হাটে তারাও সেভাবে হাটছিলো।
রূপক স্বর্ণলতাকে জিজ্ঞেস করলো-
—“তোমার কি এতো দ্রুত হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”

—“না তেমন সমস্যা হচ্ছেনা।”

—“মিথ্যা বলোনা।কপালে ঘাম ঝরে পড়ছে।আর পেট ধরে হাটছো তুমি।”

—“না তো ঠিক আছি আমি।চিন্তা করবেন না।”

—“চলো চলে যাই।”

—“না না অসম্ভব আমি এখন কিছুতেই যাবোনা।”

—“আহ্ এতো জেদী কেনো তুমি?বাচ্চার ক্ষতি করোনা।”

—”আমার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়ে বলবে আমি আমার সাহসী মায়ের গর্ভে ছিলাম।যে আমাকে পেটে নিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পাড় করেছে।”

রূপক আজকে স্বর্ণলতার সাথে কথায় পেরে উঠছেনা।স্বর্ণলতা আজকে জেদ করে বসে আছে সে রহস্য ভেদ করবেই এতে তার যা হয়ে যাক।
তারা আবার ও চুপচাপ লোকগুলোর পিছু নিতে থাকলো।
তারা হেঁটে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই কোন গন্তব্য কি তাদের নেই?।কেউ কারও সাথে কোন কথা বলছেনা।
তারা কিছুদূর গিয়ে কিছু একটা মাটিতে রাখলো।এখানেও মাটি খোড়ার শব্দ।কি করছে টা কি তারা!!!আবারও পুরো জঙ্গল জুড়ে আলোর ঝলকানি।এবার রূপক আর স্বর্ণলতা তাদের বেশ কাছেই ছিলো।কিন্তু এবার তাদের আলো ধরার মাঝে ভিন্নতা ছিলো।কেনো তারা এগুলো করছে!

রূপক স্বর্ণলতাকে ফিসফিসয়ে বললো-
—“এরা বোধহয় লাশ চুরি করে।”

—“সত্যি!হুম ঠিক বলেছেন।এরা কবরে খুড়ছিলো কেনো!!।আবার পাশে শেয়াল লাশ খাচ্ছিলো।কিন্তু এরা যে লাশ চুরি করে তা তো শতভাগ নিশ্চিত না কারন দূর থেকে কিছু দেখিনি আমরা”।

হঠাৎ রূপকের ফোনে ভাইব্রেট করে উঠলো পকেটে।রূপক কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন বের করে দেখলো তার মায়ের নাম্বার।
—”স্বর্ণলতা মা কল দিচ্ছে।মনে হয় তারা জেগে গেছে।সব বিপদ একসাথে!”
স্বর্ণলতার মাথা চিনচিন করতে শুরু করলো। একে জঙ্গলে যাকে খুঁজতে এসেছিলো তাকে তো পেলোনা উল্টো নতুন আরেক রহস্য উদ্ভব হলো।এরা কারা!এই জঙ্গলের সাথে এদের সম্পর্ক কি?মামা কেনো এদিকে আসতো!
তারা যাচ্ছে কোথায় তাদের আস্তানা কোথায়?
আকাশ পাতাল ভাবছিলো আর তারা পিছু নিচ্ছিল।

হঠাৎ করে লোকগুলো কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ থেমে গেলো।উল্টোদিক ঘুরে হাহাহা করে মাটি কাঁপানো বিকট শব্দে সবাই একসাথে হাসি দিলো।স্বর্ণলতা আর রূপক গাছের পাশে দ্রুত লুকিয়ে পড়লো।শুকনো পাতা রূপকের পায়ে লেগে মরমর শব্দ সৃষ্টি করলো।
এদিকে স্বর্ণলতার ধরে প্রান নেই।যাই যাই অবস্থা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।
তারা কি ধরা পড়ে গেলো?
—“স্বর্ণলতা আর রূপককে উদ্দেশ্য করে লোকগুলো একসাথে বলতে লাগলো-
—“বেড়িয়ে এসো”

চলবে…………
?️Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here