স্বর্ণলতা part 18

0
430

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ১৮
______________________________________
স্বর্নলতা জঙ্গলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।যে করেই হোক জঙলে গিয়ে পুরো বিষয়টার খোলাসা করতেই হবে।কি আছে ঐ বড় মাঠে!ওখানে গেলেই আর কাউকে কেনো পাওয়া যেতোনা।
মামা একটু খোঁচা মেরে স্বর্ণলতা কে বললো-
—“সারাদিন কি এতো চিন্তা করো তুমি?সংসারের চিন্তা বইলা তো মনে হয়না।থাইকা থাইকা থম মাইরা যাও।যারে তোমরা ইংরেজি তে কউ ইস্টটেচু”।

রূপক হেসে উত্তর দিলো-
—“মামা ওটা তো ইস্টটেচু না ওটা স্ট্যাচু।”

—“তোরা আছোত খালি আমার ভুল ধরবার”।

—“জাফর রাগ করিস না।ওরা তো মজা করছে।”

—“হ হইছে বুবু তুমি আর পোলার পক্ষ নিও না।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করে স্নেহা চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
—“তোকে কত করে বললাম মা, আজকে থেকে যা।না তুই তো থাকবিনা।তোর নাকি কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ।”
—“মা কষ্ট পেওনা আরেকদিন আসবো।”
—“সাবধানে যাবি।আর সৈকত ওর খেয়াল রাখবে কেমন?”
—“চিন্তা করবেন না আম্মু। আমি সবসময় ওর খেয়াল রাখবো।আজকে তাহলে আসি।”
মামা গম্ভীর কন্ঠে বললো-
—“হ যাও জামাই সাবধানে যাও।”
স্নেহা সৈকত চলে যাচ্ছিলো আর স্বর্ণলতার থেকে থেকে বুকটা কেঁপে উঠছিলো।স্নেহা কত ভয় নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে।আবার ভয় নিয়েই চলে যাচ্ছে।তার নিজের কি হবে!তার তো যাওয়ার মতো কোন জায়গা নেই।”

স্নেহাকে বিদায় দিয়ে মামা,রূপকের মা ড্রয়ং রুমে বসে টিভি দেখছিলো।রূপক ঘরে বসে মনোযোগ সহকারে ল্যাপটপে মুভি দেখছিলো।স্বর্ণলতার প্রবেশে তার মনোযোগ ছিন্ন হলো।আর পুরো মনোযোগ স্বর্ণলতাকে আচ্ছাদন করলো।
—” কি করছিলেন?”

—“এই তো মুভি দেখছিলাম।”

—ছাঁদে যাবেন?রাতের আকাশ দেখবো।”

—“এতো রাতে!তুমি প্রেগনেন্ট!”

—“আমি প্রেগনেন্ট।আমি তো অসুস্থ না।আমার খুব ইচ্ছে করছে যেতে।আমাকে নিয়ে যাবেন না?”

—“সুন্দরী বউ যদি এতো রোমান্টিক একটা বায়না করে তাহলে তো নিয়ে যেতেই হয়।চলো বউ নিয়ে যাচ্ছি”।

রূপকের মা তাদের বের হতে দেখে প্রশ্ন করলো-
—“কিরে কোথায় যাচ্ছিস?”

—“ওকে নিয়ে একটু ছাঁদে যাবো।”

—“এতো রাতে! স্বর্ণলতা কিন্তু প্রেগনেন্ট।”

—“তো! ওর কি ইচ্ছে করতে পারেনা নাকি একটু ছাঁদে যেতে?সারাদিন ঘরে বসে বসে অসুস্থ হবে নাকি!”

—“থাক বুবু যাক।কিছু কইও না।স্বর্ণলতা তুমি চুল ভালো কইরা শক্ত কইরা খোঁপা বান্ধো।এরপর মাথায় কাপড় দিয়া যাও।আর জলদি আইবা”।

—“জ্বি মামা।”

স্বর্ণলতা আর রূপক চলে যাওয়ার পর কঠিন স্বরে রূপকের মা জাফর কে বললো-
—“তুই যেতে দিলি কেনো ওদের?স্বর্ণলতা আর ওকে একলা ছাড়া যাবেনা।ও খুব বেয়াদব হয়েছে।একটা কথাও শোনেনা আমার।স্বর্ণলতা যেটা বলে সেটাই করতে যায়।”

—“ডরাইও না বুবু।ছাঁদের ভিতরে এমন কোন কাম করতে পারবো না।আর না যাইতে দিলে তোমার পোলাই ঝামেলা করতো।ওর কথার ঝাঁঝ দেখোনাই?”

—“জানিনা কি হবে।ভালোয় ভালোয় সবকিছু হলে হয়।”

স্বর্ণলতা আর রূপক দুজনে ছাঁদে।ছাঁদের দমকা হাওয়া শরীরে শীতল পরশ জাগিয়ে দিচ্ছে।আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার।নক্ষত্র গুলো হীরের মতো ঝিলমিল করছে।এ যেনো এক নক্ষত্রের রাত।
স্বর্ণলতা তার লম্বা লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিলো।লম্বা চুল ছাড়ার সময় ওপর থেকে চুল গুলো যখন নিচে পড়ছিলো তখন রূপকের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ দোলা দিচ্ছিলো।এতো ঝলমলিয়ে চুল গুলো নিচে পড়লো যে রূপকের ইচ্ছে করছিলো স্বর্ণলতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখতে।আর চুল গুলো সরিয়ে ঘাড়ে চুমু একে দিতে।স্বর্ণলতার খোলা চুল উজ্জল হাসি আর তারার সামান্য আলোতে স্বর্ণলতার মুখশ্রী ছুঁয়ে দেওয়া।এ যেনো এক নৈসর্গিক দৃশ্য।

—“জানেন আপনি যখন ছিলেন না তখন আমার একা রাত গুলো কিভাবে কেটেছে?”

স্বর্ণলতার চোখ থেকে চুল সড়াতে সড়াতে রূপক বললো-
—“কিভাবে কেটেছে”?

—“জোসনা দেখে।আর আপনাকে অনুভব করে।”

—“এখন ভালো লাগছে স্বর্ণ?”

—“খুব ভালো লাগছে।”

—“আচ্ছা আমাদের ছেলে হলে নাম কি রাখবো আর মেয়ে হলে কি নাম রাখবো?”

—“তুমি কি নাম ঠিক করে রেখেছো?”

—“হুম।ছেলে হলে নাম রাখবো ‘কল্প’

—” আর মেয়ে হলে কি নাম রাখবে কথা?”

—”মেয়ে হলে নাম রাখবো ‘মেহুল’

রূপকের মুখটা ম্লান হয়ে গেলো।স্বর্ণলতার গাল বেয়ে নোনাস্রোত ভেসে যাচ্ছিলো।রূপক দু হাত দিয়ে স্বর্ণলতার চিবুক স্পর্শ করলো।
—“স্বর্ণলতা কান্না করোনা।মেহুল ফিরে আসবে।আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসবো ওকে।”

—“কথা দিন আমার সাথে থাকবেন”।

—“কথা দিলাম”।

—“আজ রাতে আমি জঙ্গলে যাবো।”

—“জঙ্গল!!”

—“যে জঙ্গলে আমি মামার পিছু নিয়েছিলাম।আমার পুরোপুরি বিশ্বাস ওখানে কিছু না কিছু তো আছেই যেটা দিয়ে আমি হয়তো এ সব রহস্যের সমাধান খুঁজে পাবো।আর মেহুল কেও”।
ভ্রু কুঁচকে স্বর্নলতাকে জিজ্ঞেস করলো রূপক-
—“মেহুল কে পাবে মানে?”

—“মামা হয়তো ওকে জঙ্গলে রেখেছে।”

—“একটা মানুষ কে জঙ্গলে কিভাবে রাখতে পারে?”

—“আমি জানিনা।কিন্তু এতোটুকু জানি এ বাড়িতে কিছু না কিছু রহস্য তো আছেই।স্নেহা আপু কেনো এ বাড়িতে থাকতে ভয় পায়!”

—“স্নেহা আপু ভয় পায় মানে?”

—“স্নেহা আপু যেদিন জানতে পারে সে প্রেগনেন্ট।সেদিন-ই সে তাড়াহুড়ো করে এ বাড়ি থেকে চলে যায়।আর আজ ও সেটাই হয়।আপু নিজেই দুলাভাই কে বলেছিলো সে থাকতে চায়না তার কোন কাজ নেই বাসায়।সে আমাদের সবাইকে মিথ্যা বলেছিলো।আপুর যদি কোন নিজের বাসায় থাকতে নিরাপদ বোধ না করে তাহলে আমি কিভাবে থাকি এই বাসায়!”

—“স্বর্ণলতা তুমি সবকিছু ঠিক বলছো?তুমি এসব কি করে জানলে?”

—“আমি শুনেছি সবকিছু।যখন আপু ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলো তখন”।

রূপক নিশ্চুপ হয়ে গেলো।তার কপালে ঘাম ঝরছে।তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
—“ভাইয়া হয়তো কিছু একটা জানে কিন্তু আপুর পিড়াপিড়িতে ভাইয়া মুখে তালা লাগিয়ে আছে।আপনি-ই বলুন আমার জন্য এ বাসা কি নিরাপদ?”

—“এটা আমার বাড়ি স্বর্ণ।তোমার জন্য এটা শতভাগ নিরাপদ।তুমি এসব বিষয় নিয়ে টেনশন করো না।আমি সবকিছু দেখে নিবো।”

—“আমি আজকে জঙ্গলে যাবো।আজ রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে তখন আমি যাবো।আপনি মামাকে দেখে রাখবেন?”

—“তুমি কি বলতে চাচ্ছো আমি মামাকে পাহারা দিবো আর তুমি একা একা এতোদূর যাবে?”

—“না দূর না।এটা কাছেই”।

—“যত যাই হোক তুমি প্রেগনেন্ট।তোমাকে তো আমি একা ছাড়বো না।কখন-ই না।আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।”

—“আর মামা যদি টের পেয়ে যায়?”

—“এতে ধরা খেলেও সমস্যা নেই।কারন তুমি আমি একসাথেই থাকবো।কোন একটা বাহানা করে নিতে পারবো।”

কারও পায়ের শব্দ ভেসে আসছে।স্বর্ণলতা এবং রূপক তাদের আলোচনার ইতি টানলো।
অন্ধকার ভেদ করে মামার প্রবেশ-
—“কিরে তোগো কি কইছিলাম আমি বেশি দেরী করবি না।আর তোমার চুল খোলা ক্যান!!তুমি কি নিজেরে বেশি পন্ডিত মনে করো?কতবার কইলাম চুল শক্ত কইরা বানবা।দুই দিন পর ছয় মাসের পোয়াতি হইবা বাচ্চার চিন্তা নাই”।

—-”স্বর্ণলতা চুল শক্ত করে খোঁপা বেধে নাও।নিচে যাবো চলো।অনেক রাত হলো।” রূপক বলেছিলো কথাটা।

মামা,স্বর্নলতা রূপক নিচে চলে গেলো।
জঙ্গলে যেতে হবে যে করেই হোক।তাই আর দেরী করে যাবেনা।

রাতঃ২.০০ টা।
পুরো বাড়ি অন্ধকারে আচ্ছন্ন।সবাই হয়তো গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে।স্বর্ণলতা দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনতে পেলো।নিশ্চয়ই রূপক এসেছে।স্বর্ণলতা আস্তে করে দরজা খুলে দিলো।
রূপক ফিসফিসিয়ে স্বর্ণলতাকে বললো-
—“মামা গভীর ঘুমে চলে গেছে।রীতিমতো নাক ডাকা শুরু করেছে।এখন সুযোগ। চলো যাওয়া যাক।একটা টর্চ নিয়ে নিলাম।অন্ধকারের জঙ্গল এর রাত।আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিলাম।দেখো ছুরি আর দিয়াশলাই নিয়েছি।আমাদের রক্ষা করবে।”

—“এতো কিছু নিয়েছেন আপনি!!”

—“অবশ্যই নিবো।তোমার সুরক্ষা বিষয়ে কোন প্রকার ছাড় দিতে আমি রাজি না।”

—“ঠিক আছে চলুন যাওয়া যাক।”

—“চলো সাবধানে পা টিপেটিপে আসো।আর চুলগুলো একটু বেঁধে নাও।ভয় পাবেনা স্বর্ণলতা।আমি তোমার পাশে আছি।”

স্বর্ণলতার মনে হলে এ যুদ্ধে তার যুদ্ধসঙ্গী পেয়ে গেছে।আর তার যুদ্ধসঙ্গী-ই তার জীবন সঙ্গী।বুক দিয়ে তাকে আগলে রাখবে।সে থাকতে তাকে কেউ আচর কাটতে পারবেনা।ক্ষতি করা তো দূরে থাক।
স্বর্ণলতা মৃদু হেসে বললো-
—“আপনি-ই আমার সুরক্ষাকবজ।”
রূপক স্বর্ণলতাকে জড়িয়ে ধরলো।স্বর্ণলতারও তার পুরো শক্তি দিয়ে রূপককে জড়িয়ে ধরলো।রূপক স্বর্ণলতার চিবুক স্পর্শ করে ঠোঁটের দিকে তার ঠোঁট এগিয়ে নিচ্ছিলো।আর স্বর্ণলতা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো
—” এখন না।আমাদের দেরী করা চলবেনা।”

—“তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে স্বর্ণলতা”।

—“রাগ করবেন না।এখন আমাদের ওখানে যাওয়া টা বেশি গুরত্বপূর্ণ।”

রূপক নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-
—“রাগ করোনা স্বর্ণলতা।আর তুমি ঠিক বলেছো।চলো কেউ দেখে ফেলার আগেই যেতে হবে।”

মধ্যরাত………….
দূর থেকে পেঁচার ডাক ভেসে আসছে।চারদিক শুনশান নিরবতা।পিচঢালা রাস্তায় ব্যস্ত পায়ে এক যুগল হেঁটে যাচ্ছে।কিছু দূর কয়েকটা কুকুর কুন্ডলি পাকিয়ে বসে আছে।আবার কিছু দূরে আরও কিছু কুকুর মারামারি শুরু করে দিয়েছে।
সাবধানে তারা জায়গা অতিক্রম করছে।আস্তে আস্তে বড় মাঠের সামনে এলো।সেই বরই গাছ ঠায় দাড়িয়ে। সেই আঁকাবাকা ক্ষেতের আইল।বরই গাছ টাকে দেখিয়ে স্বর্ণলতা বললো-
—“জানেন এই বরই গাছ থেকেই আমার পায়ে কাটা ফুটেছিলো।কি অসহ্য যন্ত্রনা যে পার করেছি এখানে বসে। মৃত্যু সমান মনে হয়েছিলো”।

—“এই বরই গাছ তোমার পায়ে কাটা ফুটিয়েছিলো? দাড়াও।আসছি এক্ষুনি”।

—“কোথায় যাচ্ছেন?”

—“দাড়াও আসছি।”
স্বর্ণতা দেখতে পেলো রূপক বরই গাছ টাকে সজোরে কয়েকটা লাথি মারছে।এতো জোরে জোরে লাথি মারলো যে সে নিজেই ব্যাথা পেলো।
এতো ভয়ের মধ্যে ও স্বর্ণলতা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেলো।আর রূপক কে ডাক দিয়ে বললো-
—“কি করছেন আপনি?গাছটার তো ঠায় দাড়িয়ে আছে।মনে তো হয়না সে ব্যাথা পেলো।ব্যাথা তো আপনি পেলেন।”

রূপক চুলে হাত দিতে দিতে মাথা নিচু করে বললো-
—“গাছ ব্যাথা না পাক।কিন্তু এই কাজের জন্য আমার পরীর মুখে হাসি ফুটেছে।এতেই আমি ধন্য”।
—“হয়েছে হয়েছে চলুন এবার।সামনেই তো জঙ্গল।”!

চলবে………
?️Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here