#স্বর্ণলতা
পর্বঃ১০
____________
রূপকের আসার কথা শুনে স্বর্ণলতার চোখ মুখ চকচক করে উঠলো।দীর্ঘ ৫ মাস পর তার সাথে আবার দেখা।সে শুধু তার আসার দিন গুনবে আজ থেকে।
মেহুল তার চোখ মুখ দেখে শীতল কন্ঠে বললো-
—“আপামনি!
আপনে খুব খুশি হইছেন ভাইজান আইবো যে?
আপনে ভাইজানরে খুব ভালোবাসেন।”
—“হুম মেহুল।তোমার ভাইজানকে খুব ভালোবাসি আমি।প্রার্থনা করছি যাতে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আল্লাহ দ্রুত আমার কাছে এনে দেন।”
স্বর্ণলতার পাঁচ মাস প্রেগেনেন্সিতে প্রথমবারের মতো তার সৎ মা আসলো।তার সৎ ভাই নীরব কে নিয়ে।স্বর্ণলতার জন্য অনেক উপহার নিয়ে আসলো।
স্বর্ণলতা কে এতো আদর করে নাকি তার সৎ মা! এতো দরদ কেনো দেখানো হচ্ছে!বড়লোক জামাই,শ্বশুরবাড়ি তাই কি এতো আয়োজন করে ঘরে আসা?
স্বর্ণলতার সৎমায়ের সাথে তার শ্বাশুড়ির খুব ভাব হয়ে গেলো।দুজন গল্প করছে,খাচ্ছে রান্না করছে।আর স্বর্ণলতাকে কোন কাজ করতে দিচ্ছেনা।
মেহুল আর স্বর্ণলতা রুমে বসে গল্প করছে।
মেহুল কথার মাঝখানে বলে উঠলো-
—“আপামনি আপনার মা আপনারে খুব আদর করে।”
স্বর্ণলতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো-
—“খুব আদর করে?হুম আদর করে।ছোটবেলা থেকে অনেক আদর করে।এতো আদর বোধহয় কোনো মানুষের কপালে নেই।”
—“আপামনি জানেন কাল কি হইছে?সামনের বিল্ডিং এর একটা মাইয়া মইরা গেছে।বয়স কত হইবো আর ১৪ কি ১৫।সৎমা ঘরে ছিলো খুব অত্যাচার করতো।শ্যাষে না পাইরা গলায় দড়ি দিলো।সৎ মা কত খারাপ!”
স্বর্ণলতার ফর্সা গাল বেয়ে অশ্রু পড়তে লাগলো।
তার ছোটবেলার অত্যাচারের কথা গুলো মনে পড়ে যেতে লাগলো।
অত্যাচারের মাত্রা এতোটাই বেড়ে যেতো যে,সে বহুবার নিজের মৃত্যু কামনা করতো।আত্মহত্যা করার সাহস ছিলো না তার।
সে শুধু তার বাবা’র স্মৃতি নিয়ে বিলাপ করতো।
কত শত পুরোনো স্মৃতি।
স্বর্ণলতাকে এভাবে কাঁদতে দেখে মেহুল বিচলিত হয়ে গেলো।এরপর হাত ধরে বললো-
—“আপামনি!! ও স্বর্ণ আপামনি! কানতাছেন ক্যান?”
স্বর্নলতা চোখ মুছে বললো-
—“মেহুল তুমি তো আমাকে স্বর্ণ আপামনি কোনদিনও বলো নাই! ”
—“আপামনি পুরা নাম অনেক বড় কইতে কষ্ট হয়।তাই ছোট করে কইছি।আপনে রাগ করছেন?”
—“না রাগ করিনি।তোমার ভাইজান আমাকে এই নামে ডাকতো।
চলো ওঠা যাক।দেখি রান্না কতদূর।আজকে ডক্টরের চেকআপ আছে।তোমাকেই নিয়ে যাবো ভাবছি।একা হাঁটতে এখন একটু কষ্ট হয়।”
এর মধ্যেই স্বর্ণলতার সৎমা শোভার প্রবেশ-
—“স্বর্ণলতা তোর শ্বাশুড়ি আর আমি তোর জন্য আচার বানাবো।কোন আচার বেশি পছন্দ তোর?কোনটা খাবি?”
—“না তোমাদের কষ্ট করতে হবেনা।লোকদেখানো ভালোবাসা আমাকে না হয় নাই দিলে।”
এই বলে স্বর্ণলতা উঠে চলে গেলো।
স্বর্ণলতার চলে যাওয়া তার সৎমা রাগান্বিত চোখ নিয়ে দেখলো।
___________________
স্বর্ণলতা,মেহুল বসে আছে।একটু পর তারা ডক্টরের কাছে যাবে।তৈরী হতে হতে মেহুল বলে উঠলো-
—“আপামনি!আপনে আপনার মার লগে অমন করেন ক্যান?”
গাঢ় শ্বাস ছেড়ে স্বর্ণলতা বললো-
—“তোমার মা আছে?”
ক্ষনিকের মধ্যেই মেহুলের মুখটা বিষাদ কালো মেঘে ঢেকে গেলো।আফসোসের গলায় উত্তর দিলো-
—“না……নাই।আমার এই দুনিয়ায় কেউ নাই।আমি মায়ের আদর পাইনাই।বাপের আদর ও নাই।রাস্তায় পইড়া থাকছি।কেউ দেহে নাই।একদিন এক হুজুর আমারে তুইলা লইয়া এতিম খানায় রাইখা আইছে।আমার বাপ মারে আমি কই আমারে পালতে না পারলে জন্ম ক্যান দিছিলা!আমি তো আল্লাহর কাছেই ভালা ছিলাম।জন্মই আমার আজন্ম পাপ।আমি ঘুমাইছি গায়ের ওপর দিয়া বৃষ্টি গেছে।
রাস্তা দিয়া হাটছি কেউ মায়া কইরা দুই টা ভাত খাইতে দেয়নাই।
অন্য পোলাপান গো দেখছি মায়েরা কত আদর করে।ওগো খাওয়াইয়া দেয় আমারে কেউ করেনাই।আমি আবদার করার কাউরে পায়নাই।দূর থিকা দেখছি।আর চিৎকার পাইরা কানছি।আমারে কেউ বাপ মার আদর ভিক্ষা দেয়নাই।
ঈদে নতুন জামা কিনমু এমন আবদার কাউরে করতে পারেনাই।
আবদার করার স্বাদ কেমন আপা?কেমন লাগে আবদার করলে?
একদিন অনেক টাকা কামাই কইরা মা কিনমু।তার কাছে আমি আবদার করমু।মা আমারে খাওয়াইয়া দাও।মা আমার জামা লাগবো।মা আমার মাথায় হাত রাইখা হাত বুলাইয়া দাও।আমি একটু শান্তির ঘুম ঘুমামু।সত্যি কইতাছি আপামনি আমি যদি মা কিনতে পারি তাইলে মায়ের কোল থেকে উঠতাম না।আমি উঠলে যদি মা ও উইঠা যায়গা! আমার তো আর টাকা থাকবো না।দ্বিতীয় বার মা কিনমু ক্যামনে আপা?
এতোক্ষনে কান্না করতে করতে হেঁচকি উঠে গেলো মেহুলের।নিজেকে সামলে ঢোক গিলে আবারো বলতে শুরু করলো-
আপামনি গো…
বাপ মার আদর পাইতে কপাল লাগে।আল্লাহ ক্যান আমারে সেই কপাল দিলোনা? মরার আগে একবার সেই স্বাদ নিবার চাই।আবদারের স্বাদ,আদরের স্বাদ।”
স্বর্নলতার সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে।
জাপটে ধরে মেহুলকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।সে ও যে আদরের কাঙাল। এক কাঙাল আরেক কাঙালের কষ্ট বুঝবে।হৃদয়ে রক্তক্ষরন হচ্ছে তার।এ রক্তক্ষরন কি দিয়ে বন্ধ করবে সে?তার যে মমতা লাগবে।তার মায়ের স্নেহ লাগবে।মস্ত বড় পৃথিবীতে বাবা মা হীন সে বড্ড একা।
___________
ডক্টর দেখিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।ডক্টর সবকিছু পজেটিভ বললো।তার পেট স্বাভাবিক এর তুলনায় একটু বেশি বড়।বাচ্চা হেলদি হবে। সে খুব খুশি।রূপক ও খুব খুশি হবে।
বাসার সামনে এসে রিক্সা ভাড়া দিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো মেহুলকে কিছুই কিনে দেওয়া হয়নি।ও আইসক্রিম খুব পছন্দ করে।মোড়ের দোকান থেকে একটা আইসক্রিম কিনবে।
মেহুলকে এক প্রকার জোর করে দোকানে নিয়ে আসলো।
হঠাৎ ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় তিনজনকে তড়িঘড়ি করে হাঁটতে দেখা গেলো।বাড়ির পেছন দিকে যাচ্ছে।একটু সামনে এগিয়ে দেখতে পেলো
রূপকের মা,শোভা আর নীরব।
নীরবের হাতে একটা চটের ভারী ব্যাগ।
স্বর্ণলতা তাদের পিছু নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।তড়িঘড়ি করে মেহুলের কাছে এসে বললো-
—“মেহুল তুমি বাসায় যাও আমি আসছি।”
আপত্তির স্বরে মেহুল বললো-
—“আপামনি এই অবস্থায় কই যান?কোথাও যাইয়েন না একা।আমি আহি।”
—“না তুমি যাও।দ্রুত বাসায় যাও।”
শাড়ির আঁচলে মুখ পেচিয়ে দ্রুত ওদের পিছু নিলো।
ওরা দ্রুত হাঁটছে। স্বর্নলতার কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। পেট ধরে ধরে তবুও ওদের পিছু নিচ্ছে।
ওরা একটু পর পর পেছনে তাকাচ্ছে।আর স্বর্ণলতা লুকিয়ে যাচ্ছে।
তারা বাড়ির পেছনে চলে গেলো।সেখান থেকে একটা বড় মাঠে উঠলো।চারপাশে ধানের বীজ লাগানো।আইল দিয়ে তিনজন হেঁটে যাচ্ছে।পিছু নিচ্ছে স্বর্ণলতা।এতোক্ষনে নিকষ কালো অন্ধকারে পৃথিবী ছেয়ে গেছে।
হঠাৎ ওরা দাড়িয়ে পড়লো।স্বর্ণলতা দ্রুত একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়লো।
বরই গাছ ছিলো।বরই এর কাটা পায়ের তালুতে ঢুকে গেলো।বিষযন্ত্রণা নিয়ে স্বর্ণলতা মুখ চেপে মাটিতে বসে পড়লো।
এই অবস্থায় তার হাঁটতে চলতেই কষ্ট হচ্ছে।এর মধ্যে কাটাঁ বিঁধলো।
চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।তবুও টু শব্দও করছেনা সে।
নীরব শোভা কে বললো-
—-“আমার মনে হয় কেউ আমাদের পিছু নিচ্ছে।”
শোভা বললো-
—“আরে এখানে কে আসবে?চারদিকে জনমানব শূণ্য।সামনে জঙ্গল।তারপর আবার কবরস্থান। ভূতুরে জায়গা সব।এখানে কে আসবে মরতে!”
—“দাড়াও একটু সামনে এগিয়ে দেখি”।
স্বর্ণলতা আস্তে আস্তে আরও আড়াল হয়ে গেলো।এবার কাটা টা পুরোপুরি তার পায়ে ঢুকে গেলো।এক হাত দিয়ে মাটি খামচে ধরলো।অন্যহাত দিয়ে মুখ।
নীরব যত সামনে আসছে ততই হৃদপিন্ডের স্পন্দন বৃদ্ধি পাচ্ছে।শুকনো মাতার মড়মড় শব্দটাও বড্ড বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।নীরব এগিয়ে এসে কিছু না পেয়ে আবার আগের মতো হাঁটা শুরু করলো।
স্বর্ণলতা অনেক কষ্টে মাটিতে বসলো।কাঁটা এক টানে উঠিয়ে ফেললো।ব্যাথায় তার প্রান বেরিয়ে যাবার উপক্রম।
তাজা রক্ত গলগলিয়ে বের হতে লাগলো।
তবুও সে উঠে দাড়ালো।
সে এতো শক্তি কোথায় পেলো?এতো সাহসী কিভাবে হলো সে?
গাছ থেকে বের হয়ে কাউকে দেখতে পেলোনা।
যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্য বেলাভূমি।
সামনে একটা জঙ্গল আছে।জঙলে যাওয়া রাত করে ঠিক হবে না।
বাড়ি ফেরা যাক।এদের কড়া নজরে রাখতে হবে।
বহুকষ্টে প্রান হাতে নিয়ে স্বর্ণলতা বাড়ি ফিরলো।তার ড্রেস মেখে গেছে রক্ত দিয়ে।ফর্সা পা দুটো লাল রক্তে মাখামাখি অবস্থা।
পেট ধরে ধরে সিড়ি বেয়ে বেয়ে চারতলা উঠলো।লিফ্ট নষ্ট ছিলো।একে পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট অন্যদিকে বরই কাটা লাগা ক্ষতস্থানে ব্যাথা টনটন করছে।
কলিং বেল একবার প্রেস করতেই দরজা খুলে গেলো।দরজা খুলে চমকে গেলো স্বর্ণলতা।
দরজা খুললো তার শ্বাশুড়ি।
নিজমনেই বুলি আওরাতে লাগলো স্বর্ণলতা-
‘আশ্চর্য! আমার আগে এরা আসলো কিভাবে!অন্যকোন পথ আছে?আমি তো কোন পথ পেলাম না।উফ্ মাথায় আসছেনা।আমি যেই পথ দিয়ে পিছু করেছি সেই পথ দিয়েই তো ফেরার কথা।এনারা আগে আসলো কিভাবে! নাকি এনারা কেউ যাননি! আমি এতোক্ষণ কাদের পিছু করলাম?’
স্বর্ণলতার ঘোর কাটলো শ্বাশুড়ির ডাকে-
—“এই মেয়ে গেছিলে কোথায় তুমি?তোমার জন্য চিন্তা করে করে আমার প্রেসার বেড়ে গেছে।মেহুল বললো ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছো।তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?”
—“খালাআম্মা,আপামনির পায়ে রক্ত।”
—“রক্ত!!!!!!!আল্লাহ কি হইছে তোমার??ঘরে আসো।”
চিল্লাফাল্লা শুনে জাফর ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বিরক্তিগলায় প্রশ্ন করলো-
—“বাড়িত কি মানুষ মরছে নি! এতো চিল্লাচিল্লি ক্যান?”
—“জাফর দেখ বউমার কি হইছে!
জাফর ডাক্তার ডাক।ওর পা দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পরছে।আমার নাতি ওর পেটে।কি অবস্থা!!”
শোভা মেকি চিন্তিত গলায় বললো-
—“এই স্বর্নলতা তুই গেছিলি কোথায়? এই অবস্থা কি করে হলো?আমি তোর সৎ মা।কিন্তু আমি তোর ভালো চাই।”
স্বর্নলতা নিশ্চুপ…ও হিসেব মেলাতে পারছেনা।ওর মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।ও মাথা ঘুরে পড়ে গেলো।
সবাই ধরা ধরি করে রুমে নিয়ে গেলো।ডক্টর আসলো চেক-আপ করলো।ওর পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।বেড রেস্ট দিলো।ঘুমের ইনজেকশন দিলো।যাতে ঘুমটা ভালো হয়।
রাত তখন ২.০০ টা।
স্বর্ণলতার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।পুরো রুমে আবছা আলো আসছে।আবছা ভাবে দেখলো মেহুল তার পাশে আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে।
মাথা ভীষন ভাবে যন্ত্রণা করছে।
পা টা ব্যাথায় টনটন করছে।একটু উঠে বসতে চাইলো কিন্তু ব্যাথায়
ও মা গো বলে কেঁদে উঠলো। ওমনি মেহুলের ঘুম ভেঙে গেলো।
—“আপামনি!! কিছু লাগবো? উইঠেন না।আপনারে ডাক্তার শুইয়া থাকতে কইছে।কই গেছিলেন?এইরকম অবস্থা কইরা আইলেন ক্যান?”
—“মেহুল।তুমি যখন আমার সাথে নিচে ছিলে তখন নীরব,মা এবং আমার সৎমা কে হাঁটতে দেখো নি?ওদের দেখে যে আমি পিছু নিলাম?”
খানিকটা বিস্মিত কন্ঠে মেহুল জিজ্ঞেস করলো-
—“ওইডা আপনার আপন মা না!”
—“আরেহ ওটা বাদ দাও আগে এটা বলো।”
—“নাতো আমি তো কাউরে দেহিনাই।আপনে খালি কইলেন তুমি উপরে যাও।”
—“উপরে এসে কাকে কাকে দেখেছিলে?”
—“কারে কারে দেখমু ক্যান! সবাই তো ঘরেই আছিলো।নীরব ভাই,মামা,আপনার মা আপনার শ্বাশুড়ি সবাই।আপনারে না দেইখা হেরা তো খুঁজতেও গেছিলো।আমিও তো হেগো লগে গেলাম।বড় রাস্তা পর্যন্ত খুইজা আইলাম”।
চলবে
?️Sharmin Sumi