স্বর্ণলতা part 1

0
1873

#স্বর্ণলতা
সূচনা পর্ব

নিকষ কালো অন্ধকারের বুক চিরে ঘন জঙ্গলের ভেতর দ্রুত পায়ে অপরূপা সুন্দরী এক নারী দৌড়ে বেড়াচ্ছে।অন্ধকারে দিক-বেদিক কিছুই ঠাওর করা যাচ্ছেনা।সে জানেনা সে কোথায় যাবে। তবে তার যেতেই হবে।কোলে দিনকয়েক আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া ফুটফুটে এক সন্তান।
দৌড়াতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।তবুও তাকে দৌড়াতে হবে।
একটা সময় এসে পড়ে নদীর তীরে।কিছু সময় ক্ষেপনের পর মাথার পেছনে সজোরে কোন কঠিন বস্তু দ্বারা কেউ আঘাত করে।আঘাতের যন্ত্রনায় কোকড়ে ওঠে সে।
আখিঁদ্বয় নিভু নিভু প্রদীপের ন্যায় ওঠানামা করতে থাকে।চারদিক ঝাপসা হতে থাকে।টনটনে বিচ্ছিরি ব্যাথা মূর্ছা যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ব্যাথার সাথে লড়াইয়ে হেরে গিয়ে নদীর পাড়ে লুটিয়ে পড়ে অপরূপা সুন্দরী সেই নারী।
_____________________

বছর খানেক আগের কথা….
_____________________
রূপক এর আজ গায়ে হলুদ।চারপাশে হৈ হুল্লোড়। অফিসের সব কলিগ, বন্ধুবান্ধবদের মাতামাতি। রূপক ব্যাংক অফিসার।অল্প বয়সে অনেক কিছু অর্জন করেছে সে।স্কুল জীবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তাদের সবার মধ্যে যদি নম্র,ভদ্র,চরিত্রবান কারও প্রতিযোগিতা হয় তবে রূপক থাকবে প্রথম স্থানে।এটা সবার কথা।রূপকের না ছিলো কোন নেশা,না ছিলো কোন প্রকার ভালোবাসা।তাকে তার বন্ধুরা বলতো-
‘তোকে কুমারতলী থেকে অর্ডার করে বানিয়েছে আংকেল আন্টিরা!এতো গুন একজন মানুষের হয়?’

সেই মানুষটার আজ বিয়ে হতে চলেছে।নিঃসন্দেহে কোন এক ভাগ্যবতী ই হবেন,যিনি এই শুদ্ধ মানুষটির গলায় মালা পড়াবেন।বিয়েটা এরেন্জড। রূপক মা-ই কনে ঠিক করেছিলো।কনের বর্ণনা দেওয়ার সময় রূপকের মা বলেছিলো –
—“কোন এক রূপকথার রাজকুমারী দেখে আসলাম।যেমন ফর্সা গড়ন,ছিমছিমে গঠন,লম্বা লম্বা চুল।মাশাল্লাহ”।
সেদিন থেকেই রূপক মনে মনে তার স্বপ্নের রাজকুমারীর প্রতিচ্ছবি এঁকে রেখেছে।তবে সামনাসামনি তাদের দেখার সৌভাগ্য হলেও কেউ লজ্বায় মুখ তোলেনি।তাই তাদের শুভদৃষ্টি ও আর হলোনা।

আজকে তার রাজকন্যার ও গায়ে হলুদ।সে এতটাই লাজুক যে তার রাজকন্যার নাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেনি।তা তে তার কোন আফসোস নেই।সে নিজেই বিয়ের দিন জিজ্ঞেস করবে।তবে রূপক এটাই ভাবছে এতো সাহস কি তার ১ দিনে সন্ঞ্চার হবে?সে যা লাজুক!

সবাই হলুদ মাখামাখি করে একাকার অবস্থা করে ফেলেছে।সবাই মধ্যে আনন্দের বন্যা।কনের বাড়ির দিকে রওনা হতে হবে সকাল সকাল।অনুষ্ঠান দ্রুত শেষ করা দরকার।

পরদিন বরযাত্রী নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সবাই।বিয়ের সবকাজ সম্পন্ন করে তার রাজকন্যাকে সে তার প্রাসাদে নিয়ে এলো।বিয়েতে রূপক যা কান্ড করেছে তা না বললেই নয়।যেখানে যে টাকা আবদার করা হয়েছে বিনাবাক্যে সে সব টাকা দিয়ে দিয়েছে।তার শালীরা ও মহাখুশি ‘এমন দুলাভাই যেনো সবাই পায়’ স্লোগানে মত্ত ছিলো তারা।

আসলে রূপক খুব লাজুক প্রকৃতির।সেইজন্য সে ভেবেছে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই বউকে নিয়ে আসতে পারলেই হয়।তার ফ্রেন্ডসরা তো রেগেমেগে অস্থির!
রূপকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাফা বললো-
—“এমন একটা ঢেড়শ কে বিয়ে করতে নিয়ে গেছে! যে সেদ্ধ হবে কি আগেই ভর্তা হয়ে গেছে”।
সাফার মুখে উক্ত কথাটি শুনেই
সবার হাসির রোল পড়ে গেলো।কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রূপকের হাসি পাচ্ছেনা।সে শুধু টেনশন করছে আর একের পর এক কথা সাজাচ্ছে সে কি বলে তার রাজকন্যার সাথে কথা শুরু করবে।তার জন্য একটা গিফ্ট কিনেছে সে। সেই গিফ্ট টা তাকে দিবে কিভাবে বুঝতে পারছেনা।বিয়ে বাড়িতে এতো লোকজনের ভীড়ে সে ঠিকমতো গুছিয়ে কথা বলার রিহার্সেল করতে পারছেনা।অবশ্য এর আগে বহুবার রিহার্সেল করা শেষ কিন্তু আজকে তার সেসসব কিছুই স্মৃতিতে আসছেনা।
রাজকন্যাকে নিয়ে কবিতাও লিখে রেখেছে সে।কতশত ভাবনার সূতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তরে গেঁধে আছে।সবকিছু বলতে পারবে তো!

সব ঝুটঝামেলা শেষ করে রাত ১১.৩০ মিনিটে তাকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।সবাই বাইরে থেকে মজা নিচ্ছে আর বলছে-
—“রূপক হার্ট এ্যাটাক করতে পারে।প্রথম বার কোন মেয়ে মানুষের সাথে একলা কথা বলছে।এম্বুলেন্স রেডি রাখিস।”

রূপক রুমে ঢুকে কি করবে বুঝতে না পেরে লম্বা একটা সালাম দিলো।ঘোমটার আড়াল থেকে শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বরে সালামের প্রতিউত্তর ভেসে আসলো।তার দৃষ্টি এবার খাটের ওপর বসে থাকা রমনির ওপর নিবদ্ধ হলো। লাল বেনারসি জড়িয়ে অর্ধঘোমটায় বিছানায় বসে থাকা একটা পরী, হুম তাইতো আসমানের হুরপরী।পূর্নিমার চাঁদ এসে পড়েছে তার গৃহে।ঝলসে দেওয়া রূপ তাকে মোহিত করছে বারংবার।পায়ে আলতা, হাতভরা মেহেদী, কমলার কোঁয়ার মতো ঠোঁট,খোপায় ফুল,সৌন্দর্যের ব্যাখার দেবার মতো এমন কোন শব্দ হয়তো সৃষ্টি হয়নি যা দ্বারা তার সৌন্দর্যের ব্যাখা করা যাবে।

তাকে দেখে শুধু একটা জিনিস ই রূপকের মাথায় এলো-
‘আমার আধার ঘরে স্বয়ং পূর্ণিমার চাঁদ আলো বিলাতে এলো।’

রূপকের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম,চোখ না ফেরানোর মতো সুন্দরী ছিলো তার রাজকন্যা।
সালামের প্রতিউত্তর তার রাজকন্যা এতো সুন্দর রিনিঝিনি কন্ঠে দিলো যে এই সুমিষ্ট কন্ঠ বারংবার শোনার জন্য মনপাখিরা আন্দোলন ঘটাবে।

হাজারো দ্বিধা ঠেলে রূপক বলে উঠলো-
—“আপনি কেমন আছেন?কোন অসুবিধা হচ্ছে আপনার?আচ্ছা এক কাজ করুন শাড়ী বদলে ফ্রেশ হয়ে আসুন খুব ধকল গেছে।”

—“না ঠিক আছে সমস্যা নেই।এভাবেই ঠিক আছি।”
ঘোর আপত্তিমাখা গলায় রূপক বললো-
—“না ঠিক নেই।আপনি বদলে আসুন।ঠিকমতো খাওয়া ও বোধহয় হয়নি।আপনি লজ্বা পাবেন না।এতোভারী গহনা শাড়ী বেশিক্ষণ পড়ার জিনিস না।যান বদলে আসুন আমি আছি।”

তার রাজকন্যা কোন কথা না বাড়িয়ে গুটি গুটি পা ফেলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।
রূপক তার রাজকন্যার রিমঝিম পায়ের নূপুরের আওয়াজ উপলব্ধি করছিলো।অনুভব করছিলো তার রাজকন্যার উঠে চলে যাওয়া।তার রাজকন্যা এতো সুন্দর হবে তা ছিলো তার কল্পনার ও বাইরে।

দরজা খোলার আওয়াজে রূপক মাথা ঘুরিয়ে দেখলো এ আরেক রূপ।এতো সাধারণ ভাবেও তাকে অসাধারণ লাগছে।সুমিষ্ট এক সুবাসে ঘর ভরে যাচ্ছে।হয়তোবা তার রাজকন্যার চুলের বেলি ফুলের সুবাস।

রূপক নিজেকে সংযত করে ব্যস্ত গলায় বললো-
—“আসুন,আসুন, বসুন।এখন ঠিক লাগছে কি?”

—“জ্বী ঠিক আছে সবকিছু। আপনি ব্যাস্ত হবেন না।”

—“আচ্ছা শুনুন,আপনার ক্ষুধা পেয়েছে নিশ্চয়ই? সারাদিন নানা টেনশনে ঠিক করে বোধহয় খাওয়া হয়নি।আমি কিছু খাবার এনে রেখেছি।দিচ্ছি সেগুলো।”

—“না,না আমার ক্ষুধা নেই।বরং আপনি খান।”

—“বললেই হলো ক্ষুধা নেই?সারাদিন এতো ভারী শাড়ি সামলিয়েও মানুষের ক্ষুধা লেগে যায়।দাড়ান খাবার গুলো আনছি।”

এই বলে রূপক বেলকুনীতে চলে গেলো।বেলকুনিতে থেকে একটু পর মাথা বের করে ডাকলো__
—“এইযে শুনছেন?একটু কষ্ট করে এদিকে আসবেন?”

নিম্নস্বরে আওয়াজ আসলো-
—“জ্বী আসছি।”

পুরো বেলকুনিতে বেলুন,ফুল,মোমবাতি দিয়ে সাজানো।সামনে একটা কেক।আর কেকের ওপর লেখা “শুভ জন্মদিন বউ।”
একরাশ বিস্ময় ভরা চোখ মুখ নিয়ে রূপকের দিকে একটি কন্ঠস্বর ভেসে আসলো–
—“আজকে আমার জন্মদিন আপনি জানলেন কিভাবে?”
হেয়ালি হেসে রূপক উত্তর দিলো-
—“কিভাবে জানি সে না হয় আরেকদিন বলবো।”

সদ্য বিবাহিত নববধূ বেনারসি জড়িয়ে বাসর ঘরে বসে আছে।আর সে রাতেই তার স্বামী তাকে জন্মদিনের সারপ্রাইজ দিয়ে চমকে দিলো।বিয়েটা ছিলো এরেন্জ ম্যারেজ।নববধূ বিস্মিত কন্ঠে তার বরের কাছে জিজ্ঞেস করছে আজকে তার জন্মদিন সেটা সে জানলো কি করে!
বিষয় টা কতটুকু রোমাঞ্চকর!

এর মধ্যেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ।কেউ একজন দরজা ধাকাচ্ছে।এক সেকেন্ড ও তর সইছে না।দরজা খুলে দেওয়ার ও সময় দিচ্ছেনা।বিরক্ত মুখে রূপক দরজা খুললো।দেখলো তার বড়বোন স্নেহা।স্নেহা বললো-
—“রূপক সর তো স্বর্ণলতার সাথে একটু কথা আছে।”
ভ্রুঁ বাঁকিয়ে রূপক বললো-
—“স্বর্ণলতা!!কে স্বর্ণলতা?”
বিস্মিত কন্ঠে স্নেহার প্রত্যুক্তি-
—“কে স্বর্ণলতা মানে?তোর বউ স্বর্ণলতা।কি অদ্ভুত এই ছেলে! এই রামছাগল তুই তোর বউয়ের নাম এইমাত্র জানছিস?”

?চলবে?
লেখিকাঃশারমিন সুমি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here