#স্বপ্নছায়া
#২৮তম_পর্ব
১৪.
শুক্রবার, পিউদের বাসায় সকাল থেকে রান্নার ঢল পড়েছে। ঐন্দ্রিলাও খালার সাথে হাত লাগিয়েছে। বদরুল সাহেবের এক বন্ধু আসছেন বাসায় তার ই প্রস্তুতি চলছে। নীলাদ্রি এবং সে সকাল সকাল বাজার করে এনেছে। মোটা মোটা চিংড়ি, বড় রুই, এক কেজি পাবদা। একেবারে এলাহী আয়োজন। পিউ বুঝে পাচ্ছে না, তার মামা আজ এতো খুশি কেনো! দিশা বাবার হাবভাব সকাল থেকেই দেখে যাচ্ছে। সেও এই রহস্যের উম্মোচন করতে পারছে না। তাই শান্ত ভাবে দুপুরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কাজ নেই।
দুপুর গড়াতেই কলিংবেল বাজলো, বদরুল সাহেবের বন্ধু, তার স্ত্রী এবং ছেলে এসেছেন। বদরুল সাহেব বেশ আপ্পায়নে জুটে গেলেন। ছেলেটিকে আড় চোখে দেখে যাচ্ছে নীলাদ্রি। দেখতে মন্দ নয় সে। উচ্চতা, চেহারা, ব্যাবহার বেশ মার্জিত। হঠাৎ বদরুল সাহেব বলে উঠলেন,
– আসমা, পিউ কে নিয়ে আসো। উনারা তো পিউ মাকেই দেখতে এসেছেন। যাও, পিউ মাকে তৈরি করে দাও।
বদরুল সাহেবের কথা শুনে উপস্থিত সকলের আক্কেলগুড়ুম হবার যোগাড়। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো অথচ তারা কেউ টেরটুকু পেলো না। তিনি আসমা বেগমকেও ব্যাপারটি জানান নি। আসমা বেগম মুখে জোর পূর্বক হাসি টেনে বললেন,
– আপনি একটু ভেতরে আসবেন কথা আছে।
বদরুল সাহেব অতিথিদের থেকে সময় নিয়ে আসমা বেগমের সাথে কথা বলতে চলে গেলেন। নীলাদ্রির ঠিক পাশে দিশা দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের দুজনের মুখ দেখার মতো ছিলো। নীলাদ্রি দাঁতে দাঁত চেপে দিশাকে বলতে লাগলো,
– এই আইটেমটাকে কোথা থেকে উঠিয়ে আনলো তোর বাপ?
– জানি না, সত্যি জানি না ভাই। আমার একটা খটকা লাগছিলো। সকালে যখন তোড়জোড় করছিলো বাবা।
– তুই বলেছিলি তোর প্লান কাজ করবে, এতো ব্যাকফায়ার করলো।
– তুমি চিন্তা করো না। এই ব্যাটাকে কিভাবে তাড়াতে হয় যে বুদ্ধি বের করছি। তুমি শুধু তোমার গ্রুপকে রেডি রেখো।
– এটাকেও রামধোলাই দিবো নাকি?
– ব্যাটা, যদি সোজা কথায় না মানে, তাহলে তো দিতেই হবে।
নীলাদ্রির মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এক অজানা ভয় মস্তিষ্ককে গ্রাস করছে। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। পিউকে হারাতে চায় না সে। কিন্তু শত চেষ্টা করলেও ভাগ্যের সাথে জেতা যে বড় কঠিন।
আসমা বেগম পায়চারী করছেন। তার মেজাজ অত্যধিক খারাপ। ভ্যানের ভলিউম বাড়িয়ে দিলেও অশান্তি লাগছে তার। বদরুল সাহেব বিছানায় বসে তার পায়চারি দেখছেন। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
– তুমি কি এখানে তোমার হাটা দেখাতে ডেকেছো আমাকে? বাইরের লোক বসে আছেন, কি ভাববে বলতো?
– তোমার আক্কেল কি কখনো হবে না? তুমি পিউ এর জন্য ছেলে পছন্দ করেছো অথচ কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না? পিউ জানতে পারলে কি ভাববে বলো তো?
– আসমা আমি যা করছি ভেবে করছি।
– কি ভেবে করছো শুনি? এভাবে কাউকে না জানিয়ে এই হনুমানকে তুলে আনলে। এখন তার সামনে আমাদের মেয়েকে সং সেজে বসতে হবে, এটা ভালো।
– আহা! চটছো কেনো? আরিফ ভাই আমাকে আগ থেকে জানান নি। আর উনার ছেলে পারভেজ, কোনো হনুমান নয়। পারভেজের জন্য উনি মেয়ে খুজছিলেন। পারভেজ ছেলেটা খুব ভালো। এই তো এক মাস হয়েছে বিদেশ থেকে এসেছেন। ছেলেকে বাংলাদেশী মেয়ের সাথে বিয়ে দিবেন বলেই আমার বাড়ি এসেছেন। তিনি সকালে আমাকে ফোন করে বলেন পিউকে তার ছেলের সাথে দেখা করিয়ে দিবে। পিউ এর প্রেমিকের কথা বলাতেও তারা কি সুন্দর মেয়ে নিয়েছেন। বলেছেন, এমন সুন্দরী মেয়েদের দু-তিনটা পাগল প্রেমিক থাকেই। এখন একজন সামনে থেকে বললে মানা করা যায়? যেখানে উনি ই দাওয়াত নিয়েছেন। আরিফ ভাইয়ের পরিবার একটা মার্জিত পরিবার, পারভেজ ও শিক্ষিত ছেলে। তাই আমিও অমত করি নি।
– আমাদের সাথে বোঝার দরকার কি ছিলো না?
– আরে বাবা এখন তো জানালাম ই। ছেলেকে দেখো। যদি ভালো না লাগে আগাবো না। আমি তো আজ ই বিয়ে দিচ্ছি না তাই না?
– যতসব। বলে দিলাম এই হনুমানের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না।
– এই শোনো, হনুমান হনুমান করো না। ছেলেটা না হয় একটু কলা খেতে ভালোবাসে তাই বলে হনুমান! ও এখন বড় হয়েছে। আমি বাইরে গেলাম। পিউকে বেশি সাজানো লাগবে না। শুধু মাথায় কাপড় দিয়ে নিয়ে আসো।
বলেই বদরুল সাহেব বেরিয়ে গেলেন। আসমা বেগমের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছেন। পারলে বদরুল সাহেবকেই কাচা চিবাতেন তিনি। আফসোস হচ্ছে নীলাদ্রির জন্য। তার চুপসে যাওয়া মুখটা একেবারেই দেখতে চান না তিনি। কিন্তু কি করবেন, করার কি আদৌ কিছু আছে!!
ছাদের এক কোনায় পাস্টিকের ফোল্ডিং টেবিলের উপর চায়ের কেটলি রাখা। তার দুপাশে দুটো কাপ এবং একটা প্লেটে লেক্সাস বিস্কিট। লেক্সাস বিস্কিটের সাথে চা টা ঠিক জমে না। দুটোর স্বাদ একে অপরকে বাজে ভাবে ক্ল্যাশ করে। তবুও ঐন্দ্রিলা এই বিস্কিটের প্লেটটা দিয়ে গেছে। টেবিলের দুপাশে প্লাস্টিকের চেয়ার দেওয়া হয়েছে। পিউ বাসার জামা পড়েই পারভেজের সামনে বসে রয়েছে। তার চুল গুলো বেনুনী করা। মাথায় ওড়না টানা। দিশা একটা প্লেটে বারোটা কলা সাজিয়ে দিয়েছে। কেনো দিয়েছে সেটা ভালো ভাবেই জানে পিউ। তার অপজিটের প্লাস্টিকের চেয়ারে যে মানুষটি বসে রয়েছে সে কলা খেতে ভালোবাসে। পারভেজকে ছোট থেকেই পিউ চিনতো। লোকটা তখন ক্লাস সেভেনে পড়তো। যখন ই এবাড়িতে আসতো কলা খেতো, তাও আবার সাগর কলা। তখন থেকে “হনুমান” নামটা তাকে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন আর সেই নামটা তার সাথে যায় না। বেশ সুদর্শন বলা চলে, ভালো ইনকাম ও করে। অস্ট্রেলিয়ায় পারমানেন্ট জব তার। সূর্যের মিষ্টি রোদে মুখোমুখি বসে রয়েছে পারভেজ এবং পিউ। কিন্তু পিউ এর কাছে এই রোদটা মোটেই মিস্টি লাগছে না। বরং মেজাজ খারাপ হচ্ছে। পারভেজ বিগত বিশ মিনিট ধরে নন-স্টপ অস্ট্রেলিয়ার জীবনের বকবক করে যাচ্ছে। যা শুনতে মোটেই ইচ্ছে করছে না পিউ এর। সে এক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কতগুলো রিক্সা গলি থেকে যাতায়াত করছে সেটা দেখছে সে। হঠাৎ পারভেজ বলে উঠলো,
– আমি একাই কথা বলছি, আপনি ও কিছু বলুন
– আমার আপনাকে পছন্দ হয় নি। তাই আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
পিউ এর নির্লিপ্ত ভঙিতে কথাটা শুনে বিষম খেয়ে উঠে পারভেজ। নিজের বিষ্ময়কে সামলাতে না পেরে বলে উঠে,
– আমি আপনার কথার মানে বুঝি নি।
– মানে, স্পষ্ট। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। কিন্তু মামুর ভালো লাগবে বলে আপনার সাথে একাকিত্বে বসতে হচ্ছে। আপনার অহেতুক কথাগুলো শুনতে হচ্ছে। যাই হোক, চা টা শেষ করুন। ভেতরে যাবো।
– আমাকে আপনার কেনো পছন্দ হয় নি জানতে পারি
– কারণ আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।
– ওহ, এটা কোনো ব্যাপার না। বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।
– আমার ভালোবাসা আলু পটলের দামের মতো নাকি! যে প্রতিদিন সেটা পরিবর্তন হবে? নাকি আমার পছন্দ, অপছন্দের দাম আপনার কাছে নেই!
বেশ চটে গিয়ে কথাটা বললো পিউ। তার মেজাজ খারাপ লাগছে। কিন্তু পারভেজের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো বলে মনে হলো না। সে তার নির্লজ্জময় হাসিটা থামালো না। বরং বেশ ভাব নিয়ে বললো,
– দেখো ইট ডাজেন্ট রিয়েলি ম্যাটার। আমি ও বেশ কিছু প্রেম করেছি। প্রেম করলে সবার ই মনে হয় হি অর শি ইজ দ্যা ওয়ান। একে ছাড়া আমি বাঁচবো না। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঠিক হয় না। মানুষকে বদলাতে হয়। সময়ের সাথে সাথে আমরা নিজেকে খাঁপ খাইয়ে নেই। যার ফলে সেই মানুষটাকে ভুলে যাই।
– তার মানে আপনার এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই?
– না নেই, ইউ আর সো বিউটিফুল। তোমার একটা কেনো দশটা প্রেম হতেই পারে! ইটস নান অফ মাই বিজনেস।
– কিন্তু আমি তো আপনাকে পছন্দ করি না।
– আমি তো করে ফেলিছি। আমার তোমার প্রতি ফ্লিং কাজ করছে।
– উঠুন।
– হুম???
– বললাম, উঠুন। আপনার মতো অসভ্য মানুষের সাথে এক মূহুর্ত আমি সময় কাটাবো না। বিয়ে তো দূরের কথা! আমি ভেবেছি আপনার একটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। যে অন্যের পছন্দকে গুরুত্বই দেয় না সেই মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানোর কথা আমি ভাবতেও পারি না।
– তোমার বাসার লোকেরাই তোমার পছন্দকে গুরুত্ব দেয় না। আমি তো বাইরের একটা মানুষ!!
– কি বোঝাতে চাচ্ছেন?
– তোমার পছন্দের দাম যদি তোমার মামা দিতেন তাহলে তুমি নির্ভয়ে তাকে সেটা বলতে পারতে। তখন সেও আমার বিয়ের প্রস্তাবে মানা করে দিতেন। কিন্তু তুমি তা বলো নি। কারণ তুমি জানো তোমার মামার কাছে তোমার পছন্দের দাম নেই। সুতরাং আমার সাথে শাউট করে কোনো লাভ নেই। আমার পছন্দ হয়েছে। আর বিয়েটা হবেই।
আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথাটা বললো পারভেজ। পিউ দাঁতে দাঁত পিসছে। কিন্তু পারভেজকে উপযুক্ত উত্তর দিতে পারছে না। কারণ সে জানে পারভেজ যা বলছে না সত্যি। সে তার মামাকে সরাসরি কখনো বলেই নি সে কাউকে ভালোবাসে। তাই তো তার মামা উঠে পরে লেগেছে একটা হনুমানের সাথে তার বিয়ে দিতে। পিউ উঠে দাঁড়ালো, তার ভালোলাগছে না পারভেজের সামনে বসতে। মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলো সে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল কি হবে তা আন্দাজ করাটা খুব কঠিন নয়__________
রাত আটটা,
বদরুল সাহেবের রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিউ। দুপুরের খাবারের পর থেকে নীলাদ্রির দেখা মিলে নি আর। মামার সাথে কিছু একটা কানাগোসা করছিলো সে। তারপর হনহনিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছে। ফোনটাও বন্ধ। দুবার ফোন দেবার পর ও নট রিচেবেল দেখিয়েছে। তাই পিউকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। একটু পর ও বাড়ি থেকে ফোন আসবে। ওরা হ্যা বলে দেবার আগেই মামাকে সব খুলে বলা জরুরি। বুকে ফু দিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করবে, তখন ই তার কানে এলো,
– আরিফ ভাই, ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনার ছেলের সাথে আমি আমার ভাগ্নীর বিয়ে দিতে চাই না। আমার ভাগ্নী এ বিয়েতে রাজী নয়……………..
চলবে
[ ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল দুপুরে পোস্ট করবো। অনুগ্রহ পূর্বক কার্টেসী ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি