#স্বপ্নছায়া
#২৫তম_পর্ব
অভ্র থেমে গেলো। সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে। নদীর তীরে লাল রেখা জড়ো হয়েছে। পাখিরা বাড়ি ফেরার প্রচেষ্টায় রয়েছে। ঐন্দ্রিলা অভ্রের চোখে চোখ রাখলো। অভ্রের চোখে কোনে পানি চিকচিক করছে। ঐন্দ্রিলা এখন তার সিদ্ধান্ত জানাতে প্রস্তুত। কিন্তু আরেকটা প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া বাকি। সেটা জানতে তার মন ছটপট করছে। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– ভালোবাসেন আমাকে? আমি আজ এই প্রশ্নের উত্তর চাই। স্পষ্ট উত্তর।
– যদি বলি হ্যা, বিশ্বাস করবে? যদি বলি আমার হৃদয়ের গহীনে যে জায়গাটা শুধু জ্যানিফারের জন্য বরাদ্ধ ছিলো, সেই ঘরের বদ্ধ দরজা ভেদ করে তুমি নিজের রাজত্ব জমিয়েছো বিশ্বাস করবে? যদি বলি দ্বিতীয়বার ভালোবাসা নামক যন্ত্রণাকে আপন করে নিয়েছে শুধু তোমার জন্য বিশ্বাস করবে? যদি বলি আমার অনুভূতিতে, চিন্তাধারায় তুমি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছো, বিশ্বাস করবে?
– করবো। আমি কখনো চাইবো না আপনি জ্যানিফারকে ভুলে যান। প্রথম ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যদি এতোই সহজ হতো, তাহলে ভালোবাসা শব্দে এতো আবেগ থাকতো না। সে আপনার প্রথম ভালোবাসা, আপনার স্ত্রী, আপনার সন্তানের মা। জ্যানিফার থাকুক আপনার মনে, মস্তিষ্কে, স্মৃতির ছেড়াপাতায়। আমি না হয় বর্তমানটা জুড়ে থাকলাম। প্রতিটা মানুষের অতীত থাকে, অতীত না থাকলে মানুষের বর্তমান হতো না। সে মানুষটাকে ভালোবেসেছি, সেই মানুষটার অতীতকে ভালোবাসতে আমার আপত্তি নেই।
ঐন্দ্রিলা শান্ত কন্ঠে কথাগুলো বললো। তার মাঝে কোনো জড়তা নেই, নেই কোনো ইতস্তততা। অভ্র নদীর সরল গতির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
– তাহলে দ্বিতীয় সুযোগটা কি পাচ্ছি?
– সুযোগ পাচ্ছেন ঠিক ই, কিন্তু ওই যে শুকনো কথায় চিড়ে ভিজে না। কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলে না। আমি ও বাড়ি ফিরছি না। এই এক ঘেয়েমি ডিল আমার ভালো লাগছে না। আজ ডিল থেকে আমি রিজাইন দিবো। এসব ডিল ফিলের মধ্যে আমি নেই। এসব শর্ত, কন্ডিশন আমি আর নিতে পারছি না। এবার বুঝে দেখুন কি করবেন?
– তাহলে বলছো, এবার সত্যিকারের স্বামী স্ত্রী হবার পালা?
– বটেই, অভ্র মশাই এই পরীক্ষা যে খুব কঠিন। এখনো সময় আছে, পিছিয়ে যান। এই বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছেন
ঐন্দ্রিলা মিটিমিটি হাসছে। অভ্র তার হাতের ভাজে ঐন্দ্রিলার কোমল হাতটা ন্যায়। উষ্ণ ঠোঁট ছুইয়ে বলে,
– বারবার এই বাঘিনীর পাল্লায় ই পড়তে চাই, যে বাঘিনীর গভীর নয়তে আমি বারবার আহত হই। ব্যাপার না, পালিয়ে যাবার ইচ্ছে নেই। দেখি বাঘিনীর হৃদয়জয় হয় কি না!
– কবি কবি ভাব, শুধু কবিতার অভাব।
– সেটাও পূরণ করে দিচ্ছি,
“আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে
তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে”
খিলখিল করে হেসে উঠে ঐন্দ্রিলা। নদীর স্বচ্ছ প্রবাহের ন্যায় সে হাসি। অভ্র মুগ্ধ নয় তার বাঘিনীকে দেখছে। হাসলে মেয়েটির বা পাশে ছোট্ট করে টোল পড়ে, এই টোলেই হৃদয় হারিয়েছিলো সে। আজ বুঝতে পারছে, এ নারীতে কেনো বারে বারে মত্ত হয় তার হৃদয়। কেনো বারে বারে চিৎকার করে বলে উঠে,
” ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি”
নীলাদ্রির সামনে চোখ মুখ কুচকে বসে রয়েছে দিশা। দিশা বদরুল সাহেবের এক মাত্র মেয়ে। স্বভাবে বাবার কপি বলা চলে। এবার কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ, কিছুদিন পর উচ্চ মাধ্যমিক দিবে। চোখে চশমা, দু পাশে দুই বেনুনী। দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটানোর ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু নীলাদ্রি জানে, কতটা ধূর্ত সে। তাই নিজের দলে তাকে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলেই তার ধারণা। দিশাকে জরুরি তলবে নিজের রুমে এনেছে সে। নিজের এবং পিউ এর অবস্থা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছে। দিশা সব শুনে চোখ মুখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বিজ্ঞভাব নিয়ে বললো,
– বুঝলাম, কিন্তু আমাকে এসব কেনো বলছো? এতোদিন তো ভুলেই গিয়েছিলে তোমার একটা বোন আছে। এখন আমাকে তলব করলে কারণ কি?
– ক্ষেমা দে, মা। ভুল হয়ে গেছে। মহাবিপদে পড়েছি। তোর বাপ কেমন, তার বিবরণ তুই আমার থেকে ভালো জানিস। আমাদের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি দে, আমাদের একটু সাহায্য কর। প্লিজ বুনডি।
অসহায় মুখ করে নীলাদ্রি কথাগুলো বলে। কথাগুলো শুনে দিশা পৈশাচিক হাসি একে বলে,
– তা না হয় করলাম। কিন্তু এটা বাংলাদেশ ভাই। ঘুষ ছাড়া পাতাও নড়ে না। তুমি যেহেতু আমার বড় ভাই, আমি বেশি কিছু চাবো না। ওই কল্পকিছু চা পানির ব্যাবস্থা আর কি!
– কেনো মেরে তোর তালের বড়ার মতো নাকটা ভেঙ্গে দিতে ইচ্ছে করছে।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে নীলাদ্রি। দিশা তখন একটু জোরে হেসে বলে,
– কিন্তু তুমি তা করবে না, আমি জানি। কারণ আমি আহত হলে পিউ আপু আর তোমার কাহিনী বাবার কানে চলে যাবে। হাহাহা
– তুই এতো খারাপ কেনো রে? জানি না। এবার দেওয়া নেওয়াটা সেরে ফেলি?
নীলাদ্রি কিছু না বলে অগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করে দিশার উপর। দৃষ্টিতে তাকে ভষ্ম করার ব্যর্থ চেষ্টা করে নীলাদ্রি। দিশা তাকে পাত্তা না দিয়ে বলে,
– মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। তো লিষ্ট বলি, প্রথমত, তুমি৷ আমাকে “সুলতানস ডাইন” এ নিয়ে৷ যাবে। আমার যা ইচ্ছে আমি খাবো। তুমি বাঁধা দিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, আমাকে শপিং এ নিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার মন ভরে আমি শপিং করবো। আর তৃতীয়ত এবং শেষ, আমি যদি কখনো প্রেম করি তবে তুমি আমাকে এভাবে সাপোর্ট করবে। বাবাকে রাজী করানোর দায়িত্ব তোমার।
– একেবারে বাপের মতো হয়েছিস। জুনিয়র বদরুল আহমেদ। বেচারিই আমার খালা। কি বুঝে যে নানা এই সিংহের গুহোতে বিয়ে দিয়েছে কে জানে!
বিরবির করে কথাগুলো বলে নীলাদ্রি। দিশা মুখে বিরক্তিকর হাসি টেনে বলে,
– হয়ে গেছে গাইল্লানো? এবার প্লান বলি?
– যথাআজ্ঞা, আপনার ই মুখ, আপনার ই মাথা। আমরা তো কেবল আপনার কৃপার দাবিদার।
দিশার চুল টেনে টিটকারির স্বরে কথাগুলো বলে নীলাদ্রি। দিশা ভেঙচি কেটে বলে,
– তোমার মতো হুদুমকে পিউ আপু কেনো পছন্দ করেছে আল্লাহ জানে!
– তোর ই তো ভাই রে, হুদুমের ভাই তো গাদুম হবে না। তাই না?
– তোমার মনে হয় বিয়ে করার ইচ্ছে নেই! আমি গেলাম, থাকো তুমি
– এ না, বয় বোন আমার। বল, কি প্লান?
এর পর দিশা বিজ্ঞভাবে একটা মহাপ্রলয়কারী প্লান বললো। নীলাদ্রি তার দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
– কাজ হবে?
– দৌড়াবে। আমার ই তো বাবা। শতভাগ নিশ্চিত কাজ হবেই।
বহুদিন বাদে নীলাদ্রির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এবার মনে হচ্ছে তাদের প্রেমের একটা সুখময় পরিনতি হবে! এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!
চটপটির ঠেলার সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়িরসিটে বসে চটপটি খাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। অভ্র যথারীতি নাক শিটকাচ্ছে। তার ড্রেইনের পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চটপতি খেতে ভালো লাগে না। তার মতে হাইজিন ব্যাপারটা না কি এসব খাবারে মোটেই মেইনটেইন করা হয় না। কিন্তু ঐন্দ্রিলার সাথে তর্কে পেরে উঠলো না। মেয়েটা একবার বলেছে সে চটপটি খাবে মানে খাবেই। তাই বাধ্য হয়ে চটপটির ঠেলার সামনে গাড়ি থামাতে হলো তাকে। অভ্রের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে তুমুল ঝাল চটপটি অনায়াসে খাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। তার চটপটি জিনিসটা অধিক ডিম, অধিক মরিচ এবং অধিক টক দেওয়া পছন্দ। পেট জ্বলবে, মুখ, ঠোঁট লাল হয়ে যাবে কিন্তু খাওয়া থামবে না। অভ্র সিটটা পেছনে এলিয়ে দিয়েছে। গভীর নয়নে ঐন্দ্রির মুখ দেখে যাচ্ছে সে। ঝালে মেয়েটার অবস্থা খারাপ, চোখ থেকে পানি পড়ছে, একটু পর পর নাক টানছে। এতো ঝাল কখনোই খেঁতে পারে না অভ্র। খাওয়ার মাঝেই অভ্র বলে উঠলো,
– মা, তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। কবে আসবে এই সেই, দিশানকেও মিস করছে। না আমার পরীক্ষা কতোদিন চলবে?
– আমাদের ও বাড়ি রঙ্গমঞ্চ হচ্ছে। সেটা শেষ হওয়া অবধি তো চলবেই।
ঝালে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বললো ঐন্দ্রিলা। মেয়েটার ঠোঁট লাল হয়ে এসেছে তবুও খাওয়া কমছে না। এর মধ্যে অভ্র প্রশ্ন করে উঠলো,
– রঙ্গমঞ্চ মানে?
– “পিউ এবং নীলাদ্রির শুভবিবাহ”____ এই রঙ্গ ন্না শেষ হওয়া অবধি, আমি কোথাও যেতে পারবো না। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ভূমিকায় আছি আমি। আগুন লাগলে নেভাতে হবে তো।
– পিউ মানে তোমার ওই কাজিন?
– হুম, ভাইয়া ওকে ভালোবাসে। খালু আত্নীয়ের মাঝে বিয়ে পছন্দ করেন না। তাই একটু নাটকের সাহায্য নিতে হবে।
– শালাসাহেব প্রেম ও করতে পারেন?
– শুধু প্রেম, চুটিয়ে প্রেম। প্রেমিক পুরুষদের কমপিটিশন হলে আমার ভাই এক নম্বর থাকতো।
নাক টেনে কথাটা বলে ঐন্দ্রিলা। কথাটা শুনে অভ্রের দৃষ্টি সরু হয়ে গেলো। আজ চটপটি মামা একটু ঝাল টা বেশি ই দিয়ে৷ ফেলেছেন। ঠোঁট জোড়া একেবারে লাল হয়ে রয়েছে ঐন্দ্রিলার। হুট করেই অভ্রের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি জেকে বসলো। ঐন্দ্রিলা কিছু বোঝার আগেই অনুভব করলো……………
চলবে
[ ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আজ রাতে পোস্ট করবো। অনুগ্রহ পূর্বক কার্টেসী ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি