#স্বপ্নছায়া
#২১তম_পর্ব
অভ্রের মুখে “হ্যা” শুনেই ঐন্দ্রিলা চুপ হয়ে গিয়েছিলো। এই সত্যটা অনেক আগ থেকে আন্দাজ করেছিলো সে। দিশানের চোখের সাথে অভ্রের চোখের অসম্ভব মিল। সে ভেবেছিলো অভ্রের মুখে সত্যটা জানলে এতোও কষ্ট লাগবে না। কিন্তু সে ভুল ছিলো। তার মনে হচ্ছে অসংখ্য সুচ তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে। এটাকেই হয়তো বিষাক্ত ভালোবাসা বলে। ঐন্দ্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে অভ্র প্রশ্ন করে,
– কি হলো? রাগ করলে? ঘৃণা হচ্ছে আমার প্রতি? সত্যিটা কি দিশানের প্রতি তোমার ভালোবাসাটাকে ম্লান করে দিলো?
ঐন্দ্রিলা অভ্রের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সে এখনো অভ্রের বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– আমি মানুষটা ছোটবেলা থেকে খুব লিবারেল। মানুষের কাছে এতোটা জাজ হয়েছি যে, মানুষকে জাজ করার ফিচারটাই আমার মাঝে ইন্সটল হয় নি। সেকারণে আমি মানুষের ঠিক ভুল কখনো বিচার করতে যাই না। যে কোনো পরিস্থিতিটাকে সহজভাবে নেবার ট্রাই করি। ভাগ্যের নির্মমতার প্রহার বলে মেনে নেই। আজ কেনো যেনো পারছি না। আমার রাগ হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে। দিশানের ব্যাপারটা জানার পর কষ্টটার মাত্র যেনো দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আপনার প্রতি আমার প্রেমটা বিষাক্ত ভালোবাসায় পরিণত৷ হয়েছে। তাই তো স্বার্থপরের মতো আপনার উপর অন্য কারোর অধিকারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। তবে আমি আপনাকে বা দিশানকে ঘৃণা করবো না। ওই যে বললাম আমার স্বভাবে নেই।
– মানুষ যে তোমাকে আত্নসম্মানহীন বলবে! নিজের স্বামীর পাপকে ভালোবাসবে?
অভ্রের কথায় শব্দ করে হাসলো ঐন্দ্রিলা। তারপর বললো,
– আপনার পাপ,পূন্যের হিসাব করার মতো ক্ষমতা বা অধিকার আমার নেই। তাই আমি সেটা করবোও না। আমি তো সামান্য মানুষ, সৃষ্টিকর্তা তো নই। সেজন্য আপনার আর জ্যানিফারের সম্পর্ক নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করবো না। তবে আমার সময় লাগবে। আমার না অস্বস্তি হচ্ছে এখানে থাকতে। একটু হাওয়া বদল হলে খুব মন্দ হবে কি?
– পালাতে চাচ্ছো?
– না, নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করতে চাচ্ছি। যে কন্টকময় পথ বেঁছে নিয়েছি সেটায় হাটতে হলে মনকে স্থির রাখতে হবে। আমি এতোটাও দূর্বল নই যে পালিয়ে যাবো। আর আপনিই তো বলেছেন আপনার বাঘিনী ঈর্ষাকেও হার মানাবে। আমি সেটাই চাচ্ছি। আমাদের সম্পর্কের জন্য নয়। ওই নিস্পাপ বাচ্চাটার জন্য। তবে আপনি ওর সত্যটা বাসায় কেনো লুকিয়েছেন?
ঐন্দ্রিলার কন্ঠ কাঁপছে। তার নোনা জলের স্রোত চোখ থেকে গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। অভ্র আলতো হাতে তার চোখ মুছে বলে,
– আজ না, কিছু কথা তোলা থাক। যেদিন আবার দেখা হবে আমাদের, সেদিন তোমাকে সব বলবো। নিজেকেও না হয় সেদিন ই উজার করে দিবো। আজ থাক।
ঐন্দ্রিলার হৃদয় হু হু করে উঠলো। বিষাদের বিশ্রি স্ফুলিঙ্গে তার চোখ জ্বলছে। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বুকটা ভার হয়ে আসছে। মনের কোনে জমা বিষাধসিন্ধু মুক্তির অপেক্ষা করছে। বিষাধের এই ঢেউ হয়তো এলোমেলো করে দিবে, তিন জনের এই পরিবার!!!
১১.
দিনটা শনিবার, কানের কাছে শো শো করে বাতাস বইছে। বদরুল সাহেব বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছেন, হাতে পেপার। বাতাসের গতিতে বোঝা যাচ্ছে হয়তো আবারো ঝড়ের আগমণ ঘটবে। আজকাল বলা নেই কওয়া নেই ঝড় হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে। যদিও ঢাকা কোনো সমুদ্রের আশেপাশের জায়গা নয়। বদরুল সাহেবের মতে সমুদ্রের আশেপাশের অঞ্চল হলে এই ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি মানা যায়। ব্যাপারটা প্রকৃতির সাথে যায়। কিন্তু এই ইট পাথরের শহরে যেখানে মানুষের এক এক মিনিট টাকার থেকেও মূল্যবান; সেখানে এই প্রাকৃতিক মায়াজালটা ঠিক মানায় না। শহরের মানুষের কাছে পরিবারকে সময় দেবার মতো সময় নেই, সেখানে বৃষ্টিবিলাসের মতো বিলাসী ব্যাপারটা বেশ বেমানান। আর এই ঝড় বৃষ্টিতে লাভের লাভ তেমন হয় না, শুধু তা হতদরিদ্র মানুষের উপর প্রকৃতির বৈরী অত্যাচারের মাধ্যম, বলা যেতেই পারে। আকাশ জুড়ে নেমে এসেছে ঘোর বিষন্নতার আধার। টিপ টিপ বৃষ্টি নামলো। দালানের বানানোর ত্রুটির কারণে তার গায়েও বৃষ্টির পানি ছিটে আসছে। পেপারের পাতলা পৃষ্ঠা ভিজে যাচ্ছে। তবে বদরুল সাহেব উঠছেন না। তিনি সরু দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেঁচি গেটটা বারান্দা থেকে বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। আর তিনিও সেকারণেই আজ বারান্দায় বসেছেন। আজকাল তিনি নিজেকে বমকেশ বক্সী এর কাতারে ফেললেন। সত্যান্বেষণ করবেন তিনি। ব্যাপারটা একটু জটিল, সহজ ভাষায় বললে তিনি পিউ এর উপর নজর রাখছেন। মেয়েটা আজকাল অন্যমনস্ক থাকছে। সারাক্ষণ মিটিমিটি হাসে, গুনগুন করে গান গায়, আবার একটু কিছুতে মন খারাপ করে। ব্যাপারটা আরোও খারাপ হলো যখন তিনি জানতে পারলেন আজকাল পিউ রাত্রীযাপন ও করছে। এই সব সিম্পটম একটা রোগের ই হয়ে থাকে সেটা হলো “প্রেম”। তিনি নিজেও প্রেম করেছেন, তাই ব্যাপারগুলো ধরতে খুব একটা কষ্ট হয় নি তার। কেঁচি গেট থেকে পিউ কে ছাতা হাতে ঢুকতে দেখে খানিকটা নড়ে চড়ে বসেন তিনি। আশেপাশে চোখ ঘুরাতে লাগলেন। কোনো ছেলের চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করছেন। নাহ কোনো ছেলে নেই। এর মিনিট পাঁচেক বাদের মাথায় হাত দিয়ে ছুটতে ছুটতে কেঁচিগেট দিয়ে নীলাদ্রি প্রবেশ করলো। নীলাদ্রিকে দেখেই বদরুল সাহেব চেঁচিয়ে বললেন,
– নীল, একটু উপরে আসো তো!
হঠাৎ বদরুল সাহেবকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই নীলাদ্রীর কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। বুক দুরুদুরু করছে, একই রিক্সা থেকে নামাটা কি তবে বদরুল সাহেব দেখে ফেললেন। বিগত এক সপ্তাহ যাবৎ লুকিয়ে প্রেম করছে এই কপোত কপোতী। বদরুল সাহেবের চোখ এড়িয়ে একটা সপ্তাহ বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দিয়েছে তারা৷ কিন্তু শেষ রক্ষা বোধ হয় হলো না। বদরুল সাহেবের কন্ঠ কানে আসতেই পিউ এর হাতপা ঠান্ডা হতে লাগলো। সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে নীলাদ্রির দিকে আশংকা মুখে তাকালো। নীলাদ্রির উত্তর না পেয়ে বদরুল সাহেব আবারো বললেন,
– কি হলো? আসো!
– আসছি খালু।
বলেই নীলাদ্রি সিড়িঘরের দিকে হাটলো৷ পিউ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
– মামু ধরে ফেলেছে, বলছিলাম আলাদা রিক্সা নিতে। এবার শান্তি হলো তো?
– অফ যা গাধা, একেই আমার বুক ধরফর করছে। কোথায় সাহস দিবি। না মহারানী আরো ভয় দিচ্ছে।
– ভয় দিচ্ছি না, ফ্যাক্ট বলছি। মামু আমাকে মেরেই ফেলবে। আমি বাসায় যাবো না।
– কিচ্ছু হবে না, প্যানিক নিস না। চল আমার সাথে। এমন হতেই পারে খালু কোনো কাজে আমাকে ডেকেছে। শুধু শুধু এতো চিন্তা করার মানেই হয় না।
– বলছো!
– হু, চল
বুকে তিনবার আয়াতুল কুরসি পড়ে ফু দিলো পিউ। মামুর রাগ সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। আজ না জানি কোনো ভুমিকম্প তার জন্য অপেক্ষা করছে।
নীলাদ্রি আর পিউ একই সাথে বাসায় প্রবেশ করলো। বদরুল সাহেব বসার ঘরে পায়চারি করছেন। পিউকে দেখে থমথম কন্ঠে বললেন,
– পিউ মা, তুমি ফ্রেস হয়ে নাও। আমার নীলাদ্রি সাথে জরুরি কথা আছে।
পিউ কথা বাড়ালো না। সোজা ভেতরে হাটা দিলো। নীলাদ্রিকে একটা গামছা এগিয়ে দিলো। নীলাদ্রি হাসিমুখে গামছাটা হাতে নিলো। মাথা মুছতে মুছতে সোফায় বসলো সে। তখন বদরুল সাহেব বললেন,
– অফিস তো আজ বন্ধ, তা কোথায় গিয়েছিলে?
– জ…জ্বী খালু?
– বললাম আজ তো বন্ধের দিন। আজ ও বাহিরে গেলে, বাইরে বৃষ্টি তো। কিছুদিন আগেও জ্বর হলো। সেকারণেই বলছি।
– কাজ ছিলো আর কি!
– অহ
নীলাদ্রির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। গামছাটা দিয়ে ঘাম মুছে নিলো সে৷ তার মনে হচ্ছে সে থানায় বসে আছে। আর বদরুল সাহেব সেই থানার ইন্সপেক্টর। তাকে চুরি করার দায়ে ইন্টারোগেশন করছেন। এবার বদরুল সাহেব ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলেন,
– তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। আমার মনে হয় পিউ প্রেম করছে। প্রেম করাটা খারাপ কিছু নয়। তবে ছেলেটা কেমন সেটা জানা জরুরি। তুমি আমার বিশ্বস্ত সেপাই। আমি চাই তুমি ছেলেটার পুরো খোঁজ নিবে এবং আমাকে জানাবে। পারবে?
বদরুল সাহেবের আবদারে বেকুব বনে গেলো নীলাদ্রি। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকলো সে৷ মনে মনে হাসি পাচ্ছে খুব, যে চুরি সেই করেছে সেই চুরির চোর খোঁজার দায়িত্ব ও তার ঘাড়েই পড়লো। ব্যাপারটা কি হাস্যকর নয়!
টেবিলে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। তার সামনে জ্যানিফারের ডাইরি। আজ তিনদিন হতে চললো সে তার বাবার বাড়ি এসেছে। প্রথমে ভেবেছিলো একাই আসবে। কিন্তু দিশানটা হাত ছাড়লো না। জিদ করে বসলো, “মাম্মামের সাতে দাবো”
আর কি বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হলো। তবে ঐন্দ্রিলা অবাক হচ্ছে তার মনে দিশানের প্রতি কোনো কঠোরতা নেই, বরং ছেলেটা মাম্মাম বলে জড়িয়ে ধরলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ঐন্দ্রিলা আবারোও ডাইরির পাতা পাল্টাতে লাগলো। তার মনের কৌতুহল তাকে শান্তি দিচ্ছে না।
৭ অক্টোবরের পর থেকে বেশ কিছু পাতা খালি। ঐন্দ্রিলার নজর গিয়ে ঠেকলো ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ তে।
১৯ নভেম্বর, ২০১৭
যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই হয়েছে, আমি মা হতে চলেছি। আমার মাঝে অভ্রের অস্তিত্ব বাড়ছে। সে রাতে অভ্রকে না বলেই আমি বাংলাদেশ ছাড়ি। যখন অভ্র ঘুমে বিভর আমি তখন কানাডার পথে যাত্রারত। জানি না পাগল ছেলেটা কি করছে! হয়তো পাগলামি করছে, রাগ ঝাড়ছে। ছেলেটা হয়তো সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজের অভিমানের অন্ত করছে। জানি না! কানাডায় আসার পর থেকে আমি তার সাথে যোগাযোগের কোনো সুযোগ রাখি নি। নিজ থেকে করিও নি। দরকার কি! মায়া বাড়িয়ে শুধু কষ্ট ই পেতে হবে। তবে আমি কান্ড করেছি তাতে ঈশ্বর হয়তো আমায় ক্ষমা করবেন না। কারণ এটা একটা পাপ। আমি নিজেও জানি। তবুও পাপটা করেছি, ভালোবাসায় দায়ে। আমি জানি না যে আসছে তার পরিণতি কি হবে। আমার ভয় হয়, প্রচুর ভয় হয়।
৩০ নভেম্বর, ২০১৭
বাবাকে আজ সত্যটা খুলে বলেছি। বাবা প্রথমে হেসেছেন। তারপর আমাকে চড় মারলেন। উনার দোষ নেই, যেকোনো পিতাই এই কাজটি করবেন। মেয়ে অপরাধ করেছে। শুধু অন্যধর্মী ছেলেকে ভালোই বাসে নি, তার বাচ্চার মা হতে চলেছে সে। আমার ভয় হচ্ছে। উনি হয়তো আমার বেবিকে বাঁচতে দিবেন না। আমার খুব হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে আমার এবোর্শন করাবেন তারপর বিয়ে দিবেন………
চলবে
[ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট দিবো। অনুগ্রহ পূর্বক কার্টেসী ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি