#স্বপ্নছায়া
#২০তম_পর্ব
ঐন্দ্রিলা খেয়াল করলো প্রতি পেজেই দু-তিনটা লাইন করে লেখা। ঐন্দ্রিলা একের পর এক পেজ উল্টাতে লাগলো। হঠাৎ একটা পেজে আটকে গেলো।
৩১শে আগষ্ট,
আজ আমি প্রেমে পড়েছি। হ্যা, আমি প্রেমে পড়েছি। প্রেম অনুভূতিটা এতোটা মধুর এটা আগে জানা ছিলো না। আমার মনে হচ্ছে আমি ধীরে ধীরে এই প্রেমের প্রতি আসক্ত হচ্ছি। কিন্তু এই প্রেমই যে আমার মৃত্যুর কারণ হবে এটা আমার জানা আছে। ও একজন মুসলিম পরিবার থেকে এসেছে। আর আমি ক্যাথেলিক। আমাদের সম্পর্কটা বাবা মেনে নিবে না। আমাদের নিয়তি ভেবে আমার খুব কষ্ট লাগছে। তবে জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষের প্রতি এতোটা আকর্ষিত হয়েছি। আমি বর্তমানে থাকতে চাই। বর্তমানে বাঁচতে চাই।
ঐন্দ্রিলা “কিন্তু এই প্রেমই যে আমার মৃত্যুর কারণ হবে এটা আমার জানা আছে।”___ লাইনটি দুবার পড়লো। লাইনটি জ্যানিফার কেনো লিখেছে তার উত্তর খুজে পাচ্ছে না সে। ঐন্দ্রিলা ব্যাস্ত হাতে ডাইরির পাতা গুলো উল্টাতে লাগলো। যত পাতা উল্টাচ্ছে যতই তার হৃদস্পন্দন তীব্র হচ্ছে।
৫ সেপ্টেমবর, ২০১৭,
মানুষটা আজ আমাকে রমনা পার্কে নিয়ে গিয়েছে। আমি আজ প্রথম শাড়ি পড়েছি। শাড়িতে কোনো নারীকে এতোটা চমৎকার লাগে আমার জানা ছিলো না। আশ্চর্য হলাম মানুষটার জন্য আজ আমি আমার পোশাক ছেড়ে শাড়ি পড়েছি। প্রেম মানুষকে কতোটা বদলে দেয় তাই না। অভ্র আমার জন্য একটা বেলীফুলের মালা নিয়ে আসবে। ও বলেছে, ও নিজ হাতে আমার চুলে খোপা করে দিবে।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
এখন রাত ১০টা বাজে, কিছুক্ষণ আগে লোকটা আমার জন্য মুড়িমাখা, ফুচকা এবং দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে এসেছে। কারণ আমি তাকে মিটিং এর সময় বলেছিলাম, আমার কদিন ধরে মুড়িমাখা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কাজের চাপে সময় ই হচ্ছে না। আমার পাগল প্রেমিক তাই আজ এমন একটা কান্ড ঘটিয়েছে। আমার খুব হাসি পাচ্ছে, আবার বুকের মাঝে এক তৃপ্তির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
অভ্র তার বাসায় আমাকে নিয়ে গিয়েছে আজ। তার মা আমাকে চা বানিয়ে খাওয়িছেন। আমরা ঘন্টা খানেক গল্প ও করেছি। আহানা মেয়েটা অনেক কিউট। আমার প্রচন্ড ভালো লেগেছে তাদের৷ কিন্তু তাদের আমাকে কেমন লেগেছে আমার জানা নেই।
১ অক্টোবর, ২০১৭,
আগামী ৭তারিখ, আমি কানাডা ব্যাক করবো। বাংলাদেশে আমার কাজ শেষ। এখন থাকার কোনো মানে নেই। অবাককর ব্যাপার হলো আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমার বিরক্ত লাগছে। অভ্রকে ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গতকাল অভ্র আমাকে একটা বই দিয়েছে, “Notebook” বই টা আমার খুব ই পছন্দের। এর আগেও বইটা আমার বেশ কয়েকবার পড়া হয়েছে। তবুও গতকালের পর থেকে এই পর্যন্ত মোট চারবার আমি বইটা পড়েছে। হয়তো আমাকে মানুষ পাগল ভাববে। তবে এতে আমার কিছুই যায় আসে না। মাঝে মাঝে পাগলামি করতেও ভালো লাগে। এই সাতটা দিন আমি খুব পাগলামী করবো। এই সাতদিনের পাগলামী হবে আমার ভবিষ্যতের পুঁজি। এতে করে অভ্র ব্যাতীত
জীবন কাটানো সহজতর হবে। আমি জানি আমি একবার এখান থেকে চলে গেলে আর ফিরবো না। যদিও অভ্র আমাকে কথা দিয়েছে, আমি যেখানেই থাকি না কেনো সে আমাকে খুজে বের করবে। আমাকে সারাটাজীবন সে ভালোবেসে যাবে। যদি আমাদের গল্পের পরিণতি মন্দ ও হয় সে আমাদের গল্পটাকে সুখময় সমাপ্তিতে পরিণত করবে। দেখা যাক ও ওর কথাটা রাখে কিনা।
ঐন্দ্রিলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কেনো তার জানা নেই। ঈর্ষা নাকি আফসোস! জ্যানিফারের আবেগগুলো এলোমেলো ভাষায় ডাইরিতে লেখা। আবেগগুলো তার স্বামীকে নিয়ে লেখা। প্রতিটা পাতায় ছোট করে হলেও তার স্বামীর উপস্থিতি রয়েছে। যদি অভ্রকে মন না দিয়ে বসতো তাহলে হয়তো ব্যাপারটা এতোটা বুকে ফুটতো না। প্রতিটা পাতা সুই এর মতো বুকে ফুটছে। কিন্তু ডাইরিটা রেখেও দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। ঐন্দ্রিলা চোখটা মুছে নিলো। কাঁপা হাতে আবার পৃষ্ঠা পাল্টাতে লাগলো৷
৭ অক্টোবর, ২০১৭,
আজ ভোর ৪টায় আমার ফ্লাইট। অভ্র আজ সারাটা দিন আমার সাথেই ছিলো। বোকা ছেলেটা আমার হাত ধরে বসেছিলো। আমার খারাপ লাগছিলো খুব। কিন্তু আমি অপারগ। ও যখন আমার কোমড় আকড়ে না যাওয়ার জিদ করছিলো আমিও নিজেকে আটকাতে পাড়ি নি। একটা ভুল করেই বসেছি। অবশ্য এই ভুলে আমার কোনো আফসোস নেই। যখন নিজেকে অভ্রের বুকে আবিষ্কার করেছিলাম লজ্জায় আমার মুখ চুপসে গিয়েছিলো। আমরা আজ নিজেকে নিজের মাঝে উজার করে দিয়েছি। দুজন ব্যাস্ত হয়ে সুখ কুড়িয়েছি। ক্ষণিকের এই সুখটা আমার সারাজীবনের কালবিষ হয়ে দাঁড়াবে আমি জানি তবুও অভ্রের স্মৃতিটুকু আমার ভেতরে আকড়ে ধরেই আমি আমার শেষ দিনগুলো পাড় করবো। অভ্রের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকালেই বুকটা ছটফট করে উঠে। এই পাগল ছেলেটাকে ফেলে কিভাবে যাবো আমি!
পাতাটা পড়েই থমকে গেলো ঐন্দ্রিলা। তার মাথাটা ভনভন করছে। আর পড়তে পারছে না সে। কোনো স্ত্রী এতোটা ও সাহসী হয় না যে সে তার স্বামীর প্রাক্তনের সাথে কাটানো আবেগপ্রবণ মূহুর্ত গুলোর সাক্ষী হবে। সত্য তিক্ত হয় সেটা ঐন্দ্রিলার জানা ছিলো কিন্তু এতোটা তিক্ত হয় সেটা আজ বুঝতে পারছে সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। ডাইরিটা বন্ধ করে দিলো ঐন্দ্রিলা। ডাইরিগুলো গুছিয়ে নিজের আলমারির এক কোনায় রেখে দিলো সে। শেলফটা গুছাতে যাবে তখনই রুমে অভ্র প্রবেশ করে। ঐন্দ্রিলাকে ধুলোর মধ্যে বসে থাকতে দেখে ছুটে তার কাছে যায়। হাটু গেড়ে বসে শান্ত কন্ঠে বলে,
– এগুলো কি করছো তুমি?
– বই গুলো রাখা জায়গা করছিলাম।
– শরীফাকে বলতে। ও করে দিতো।
– আজ শরীফা আসে নি।
– তুমি কাঁদছিলে?
অভ্রের এমন প্রশ্নে সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় ঐন্দ্রিলা। সে ভালোভাবেই চোখ মুছেছে। তাহলে অভ্র কিভাবে বুঝলো সে কেঁদেছিলো! ঐন্দ্রিলা গলা খাকারি দিয়ে বললো,
– না তো! আসলে ডাস্ট এলার্জির কারণে হাছি হচ্ছিলো।
– তবুও তুমি এখানে বসে আসো?
– হু, কাজটা তো শেষ করতে হবে। আচ্ছা এখান থেকে অনেক পুরোনো এবং অকেজো জিনিস পেয়েছি। ধুলোর আস্তরণ জমেছে। দেখুন তো যদি আপনার প্রয়োজন হয়!
– যেখানে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে সেটা ফেলে দেওয়াটাই শ্রেয়। অবহেলায় পড়ে থেকে জায়গা নষ্ট করার চেয়ে সেখানে নতুন জিনিসের আবির্ভাব ঘটানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
– জ্যানিফারের স্মৃতি গুলো কি তবে জায়গা নষ্ট করছে?
– অনেকটা তাই। যেগুলোকে তুমি স্মৃতি বলছো সেগুলো জড় পদার্থ৷ সেটা থাকা বা না থাকায় আমার কিছু যায় আসে না। ওর জীবন্ত স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়ায়৷ এবং এখনো সেটায় ধুলো জমে নি। প্রতিনিয়ত এখনো সেই স্মৃতি আমার মন-মস্তিস্কে বিচরণ করে।
ঐন্দ্রিলা খানিকটা রোশের সাথে বললো,
– ঈর্ষা অত্যন্ত খারাপ জানেন তো, অনেকটা স্লো পয়জনের মতো। ভেতর থেকে আপনাকে প্রতিনিয়ত জ্বালাবে, পুড়াবে। একটা সময় আপনাকে শেষ করে দিবে।
– আমার বাঘিনী ঈর্ষাকেও হার মানাবে, আমি জানি। আমি চাই তুমি আমাকে সব কিছু জেনে তারপর ভালোবাসো। জ্যানিফারের ডাইরিগুলো আমাদের সম্পর্কের পান্ডুলিপি, আর আমার অতীতের ভুলের গননাখাতা। তুমি সময় নাও। হয়তো ডাইরির শেষপাতায় এসে আমাকে অসহ্য লাগবে তোমার। তোমার প্রেম আমার প্রতি উবে যাবে। আমাকে বিরক্ত লাগবে। তবে আমাকে একবার বলো
– বললে কি করবেন?
ঐন্দ্রিলার কন্ঠের রোষ বাড়ছে। অভ্রের ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসি। স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,
– তাহলে মুক্তি দেবো…..
অভ্রের কথাটা শেষ হবার পূর্বেই ঐন্দ্রিলা তার সামনে। তার চোখ যেনো কোনো অগ্নিকুন্ডু। এরপর যা করলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না অভ্র। অভ্রের শার্টের কলার টেনে নিজের পাতলা ঠোঁট জোড়া তার ঠোঁটে ডুবিয়ে দিলো ঐন্দ্রি। অভ্রের চোখ বিস্ফোরিত আকার নিলো। ঐন্দ্রি এরুপ কাজ করবে সেটা কল্পনাতেও ভাবে নি সে। মেরুদন্ড বেয়ে যেনো রক্ত ছলকে উঠলো। আবেশে হাতটা ঐন্দ্রির কোমড় আকড়ে ধরলো। এভাবে কতো মূহুর্ত কেটে গেলো সেদিকে খেয়াল নেই তার। ঐন্দ্রিলা কিছুক্ষণ বাদে নিজেকে তার থেকে সরিয়ে নিলো। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– বড্ড বেশি বকেন কি না। এটাই তো সমস্যা।
ঐন্দ্রির কথায় ফিক করে হেসে ফেলে অভ্র। ধীর কন্ঠে বলে,
– এটা কি আমার বকবকানো কমানোর উপায়?
– যা ভাববেন তাই! তবে আরেকবার যদি এই মুক্তির ব্যাপারটা শুনি তো দেখেন আমি কি করি!
– এর থেকেও খারাপ কিছু করবে নাকি?
– জানি না।
– তাই বুঝি!
অভ্র চোখ বুঝে ঐন্দ্রিলার নাকে নাক ঘষে। ঐন্দ্রিলা তখন ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– দিশান, আপনার এবং জ্যানিফারের ছেলে। তাই না?
অভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার মাথাটা নিচু হয়ে যায়। ধীর কন্ঠে ছোট্ট করে বলে,
– হ্যা।
অভ্রের মুখে “হ্যা” শুনেই ঐন্দ্রিলা চুপ হয়ে গিয়েছিলো। এই সত্যটা অনেক আগ থেকে আন্দাজ করেছিলো সে। দিশানের চোখের সাথে অভ্রের চোখের অসম্ভব মিল। সে ভেবেছিলো অভ্রের মুখে সত্যটা জানলে এতোও কষ্ট লাগবে না। কিন্তু সে ভুল ছিলো। তার মনে হচ্ছে অসংখ্য সুচ তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে। এটাকেই হয়তো বিষাক্ত ভালোবাসা বলে। ঐন্দ্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে অভ্র প্রশ্ন করে,
– কি হলো? রাগ করলে? ঘৃণা হচ্ছে আমার প্রতি? সত্যিটা কি দিশানের প্রতি তোমার ভালোবাসাটাকে ম্লান করে দিলো?
ঐন্দ্রিলা অভ্রের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সে এখনো অভ্রের বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
………………
চলবে
[ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট দিবো। অনুগ্রহ পূর্বক কার্টেসী ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি