#স্বপ্নছায়া
#১২ম_পর্ব
ঐন্দ্রিলা আজ অনেক কদম ফুল ছিড়েছে। তার কদম ফুল খুব ভালো লাগে। ফুলটি দেখলেই বর্ষাকালের অনুভূতি পাওয়া যায়। এখানে থাকতে খুব ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। কিন্তু আগামীকাল ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। সেই রাতের পর থেকে অভ্র তার সামনে আসে নি। নিজেকে যেনো আড়াল করে ফেলেছে সে। ঐন্দ্রিও তাকে খুঁজতে যায় নি। যে নিজেই হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এর মাঝেই বাড়ির কেয়ারটেকার লতিফ ছুটে আসে ঐন্দ্রিলার কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– ভাবীজান, একটু ভেতরে আসেন।
– কি হয়েছে লতিফ ভাই?
– ভাইজানের শরীরটা ভালা নাই, অফিসের লোকেরা তারে ধরাধরি কইরা লইয়া আইছে। আপনে একটু ভেতরে আসেন।
লতিফের কথা শুনে কলিজায় কামড় পড়ে ঐন্দ্রিলার। লোকটাকে তিনদিন দেখে নি সে। কখন বাসায় আসে, কখন বাসা থেকে বেরিয়ে যায় তার টেরটি অবধি পায় না ঐন্দ্রিলা। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে ঘর খুজেও মানুষটিকে পায় না। লতিফকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় তার ভাইজান বেড়িয়ে গেছে। রাত দুটো অবধি সজাগ থেকে অপেক্ষা করে লোকটির জন্য কিন্তু লোকটির আসার নাম থাকে না। অভ্রের উদাসীনতা ঐন্দ্রিলাকে পীড়া তো দেয় কিন্তু সে তার বহিঃপ্রকাশ করে না। কিন্তু আজ যখন অভ্রের অসুস্থতার কথা শুনলো তখন বুকের ভেতর উথাল-পাতাল হওয়া শুরু করলো। ঐন্দ্রিলা পানি থেকে উঠে দাঁড়ালো, জুতো ছাড়াই খালি পায়ে ছুটলো বাড়ির দিকে। ভেজা শাড়িটাতে মাটি লেগে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই।
অভ্রের রুমে খাটের উপর আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে রয়েছে অভ্র। তার অফিসের পাঁচজন কর্মচারী তার সামনে দাঁড়ানো। তার মধ্যে অভ্রের পি.এস ঈদ্রিশ ও রয়েছে। ঈদ্রিশ অভ্রের এই আর ডিপার্টমেন্টের অন্যতম পোস্টে রয়েছে। অভ্রের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়তো সে। সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। অভ্র কে কখনো “স্যার” সম্বোধন সে করে নি। সর্বদা “ভাই” বলেই সম্বোধন করে সে। অভ্রের ভালো কিংবা মন্দ সকল সময়ের সাক্ষী এই মানুষটা ছিলো। তাই আজ যখন অর্ধেক মিটিং মাথা ঘুরে অভ্র পড়ে যায় তখন সবার আগেই এই মানুষটি ই রিয়েক্ট করেছিলো। অভ্র এখনো চোখ বুঝে শুয়ে রয়েছে। ঈদ্রিশ বাকিদের উদ্দেশ্য করে বললো,
– ভাই এর রেস্টের দরকার। এক কাজ করো তোমরা অফিসে ফিরে যাও। আমি এখানে আছি। কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করো।
– জ্বী স্যার, তাহলে আমরা আসি। আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম সালাম
ঈদ্রিশ বাদে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এর মধ্যেই ঐন্দ্রিলা রুমে উপস্থিত হলো। অভ্রকে শোয়া অবস্থায় দেখে ছুটে গেলো তার কাছে। অভ্রকে ব্যাথিত নয়নে দেখতে লাগলো সে। লোকটা তিনদিনে অনেক বদলে গেছে। চোখের নিচটা কালো হয়ে গিয়েছে, হয়তো তিনদিনে ছ ঘন্টা ঘুমিয়েছে কি না সন্দেহ। মুখটা শুকিয়ে গেছে তার হয়তো খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হয় নি। লোকটা এমন কেনো তা বুঝে পায় না ঐন্দ্রি। নাহয় দুটো কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তাই বলে ঐন্দ্রিকে জব্দ করতে বাসায় আসবে না? হপ্তে পারে সে খুব বড় ব্যাবসায়ী তাই বলে নিজেকে এতোটা অযত্ন করবে? কাজ কি তার জন্য এতোটাই জরুরি? ঈদ্রিশকে ধীর কন্ঠে বললো,
– কি হয়েছে উনার? হুট করে এমন কেনো হলো?
– ভাইয়ের সুগার আর বিপি টা কমে গিয়েছিলো। এই কন্ট্র্যাক্টটা পাবার জন্য কম ধকল উঠায় নি সে। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হয় নি। ঔষধ ঠিক মতো খায় নি। ঘুমটাকেও অবহেলা করেছে। সেটার ফল ই এটা।
– উনার ডায়াবেটিস আছে?
– হ্যা, বিগত চার বছর ধরে ভাইয়ের ডায়াবেটিস আছে। আপনি জানেন না ভাবি?
– নাহ
– ওহ, একটু খেয়াল রেখেন। আসলে সুগারের ক্ষেত্রে হাইপো হওয়াটা ভালো নয়৷
– জ্বী
ঐন্দ্রিলার মনটা হুট করে মিয়ে গেলো। স্ত্রী হওয়া স্বত্তেও সে জানে না তার স্বামীর কি রোগ ব্যাধি আছে। যদিও মানুষ বছরের পর সাথে থেকেও অপর মানুষটিকে জানতে পারে না, সেখানে তাদের বিয়ের তো মাত্র পঁচিশ দিন হয়েছে। তবুও ঐন্দ্রির খারাপ লাগছে। ঐন্দ্রিলার অনুতাপের মুখখানা দেখে ঈদ্রিশ বললো,
– এটা কোনো পাপ নয় কিন্তু ভাবি, আপনি নাই জানতে পারেন এই ব্যাপারটা। সব সময় সবার সব কিছু জানতে হবে এটা কিন্তু ঠিক নয়। আপনি মন খারাপ করবেন না। এর পর থেকে একটু খেয়াল রাখবেন
ঈদ্রিশ লোকটা বরাবর ই বেশ স্পষ্টভাষী। তার কথা বলার ধরণ ও অনেক চমৎকার। ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি রইলো না ঈদ্রিশের কথার মর্মার্থ। সে ঐন্দ্রিলার অপরাধবোধটিকে যুক্তির মাধ্যমে দমন করলো। এবং তার সাথে তার দায়িত্ব জ্ঞানের স্বরণটিও করিয়ে দিলো। ঐন্দ্রিলা বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাইয়া আপনি চা খাবেন তো?
– চায়ের ব্যাপারে আমি কখনোই মানা করি না, শুধু চিনি টা বেশি দিতে বলবেন।
এর মাঝেই অভ্র চোখ খুললো। অভ্রকে উঠতে দেখে ঐন্দ্রিলা ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু খাবেন? আমি স্যুপ করে আনি?
অভ্র উঠে বসলো। মাথাটা তার এখনো খানিকটা ঝিম ধরে আছে। শরীরে বল নেই বললেই চলে। একটু সময় লাগলো এটা বোঝার জন্য যে সে কোথায় আছে। ঈদ্রিশকে দেখেই ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
– মিটিং টা কি হলো?
– ভাই আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সামলে নিয়েছি। আমাদের ডিলটা ফাইনাল হয়ে গেছে।
– যাক বাঁচালে। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? উনাদের স্যাম্পল গুলো রিচেক করতে হবে। নতুন প্রোডাকশন দ্রুত শুরু করতে হবে। আমি একটু পড়ে আসছি অফিসে। কালকে ঢাকা ফিরবো, তার আগে কাজগুলো শেষ করতে হবে।
এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। বাজখাই কন্ঠে বলে উঠলো,
– আপনার মাথার ঠিক কয়টা তার ছেঁড়া একটু বলুন তো আমাকে?
– সরি?
ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অভ্র। এবার ঐন্দ্রিলা ঈদ্রিশের উদ্দেশ্যে বলে,
– ভাইয়া, আমরা আগামীকাল ঢাকা যাবো না। সুতরাং আমি চিন্তা করবেন না। ফাইল গুলো কাউকে দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েন। উনি বাসা থেকেই সব৷ দেখে দেবেন। নড়ার শক্তি নেই, উনি যাবে অফিস। কথাটা যেনো মাথায় থাকে।
এবার অভ্রের দিকে কড়া কন্ঠে বলে,
– আর অফিস যাবেন মানে কি? একটু আগে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আপনার কোনো আইডিয়া আছে আজ কি হয়েছিলো? ভাগ্যিস ভালো ঈদ্রিস ভাই ওখানে ছিলো। রোগ বাধিয়ে তো সুন্দর বসে আছেন। তা বলি সেদিকে তো খেয়াল রাখবেন না? একদিন কাজ না করলে কি মহাভারত ধ্বংস হয়ে যাবে? এসব কাজের ঢং আমার বাড়িতে করবেন না। আজ থেকে পুরো চব্বিশ ঘন্টা বাসা থেকে এক কদম বের হবেন না। আর এখন স্যুপ দিচ্ছি। কোনো টু শব্দ ছাড়া খাবেন। যা কাজ বাসা থেকেই করবেন। ভাইয়া আপনি বসুন আমি আসছি।
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র এখনো হা করে তাকিয়ে রইলো। তার শান্ত বাঘিনী আবার জেগে উঠেছে। ঈদ্রিশ হাসতে হাসতে বলে,
– যাক কেউ তো তোমাকে থামাতে পারে। আমি তো ভেবেছি তুমি ই সবার উপর হুকুম চালাও। তোমার উপরে হুকুম চালানোর মতো এখনো কেউ জন্মায় নি। কিন্তু ভাবী তো তোমার উপরের পিস। হিটলার বউ জুটিয়েছো একেবারে।
– তোর কি ওভারটাইম করার শখ জেগেছে?
– মাফ চাই, ভাই। ভুল হয়ে গেছে।
অভ্রের ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। তিনদিন পর ঐন্দ্রিলার ধমক শুনছে সে। আজকাল মেয়েটার শাসন অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মেয়েটার শাসন না থাকলে যেনো সবকিছু লবণ বাদে খাবারের মতো লাগে।
ঈদ্রিশকে এগিয়ে দিতে গেট অবধি আসলো ঐন্দ্রিলা। অভ্রকে উঠতে দেয় নি। ধমক দিয়ে শুইয়ে রেখেছে। ঈদ্রিশ গেটে কাছে এসে বললো,
– ভাবি আসছি, আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। তবে চা টা দারুণ ছিলো।
– ধন্যবাদ
– কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?
– জ্বী বলুন?
– ভাইয়া মানুষটা খারাপ নয়। একটু অন্যরকম। তার কাছে জীবনটা সূত্রের বাহিরে পরে না। সব কিছু ক্যালকুলেশন অনুযায়ী করার চেষ্টা করে সে। তবে মানুষটা কিন্তু মন্দ নয়। আর সে আপনাকে আর পাঁচ জনের কাতারে ফেলে না। যে লোকের সামনে কেউ উচু গলায় কথা বলে না। সে মাথা নত করে আপনার ধমক শুনে। বুঝতেই পারছেন তাহলে আপনি তার লাইফে কতটুকু ঘিরে আছেন। কিন্তু এগুলো সে কখনোই নিজ থেকে বলবে না। কারণ তার অতীতটা এতোটাই কন্টকময়, যে বর্তমানেও তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নিজেকে আজ ও জ্যানিফারের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে এসেছে সে। তার গ্লানিবোধটুকু এতোটাই যে তাকে চোরাবালির মতো প্রতিনিয়ত গিলে খাচ্ছে। আমি জানি আমার কথাগুলো অহেতুক লাগছে। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি চাইলে তাকে এই চোরাবালি থেকে মুক্ত করতে পারেন। একটু চেষ্টা করেই দেখুন না। আজ আসি তবে।
ঈদ্রিশের কথাগুলো চুপ করে শুনলো ঐন্দ্রিলা। এই জ্যানিফার নামক ব্যাক্তিটির সাথে অভ্রের অতীত তাকে প্রচুর ভাবাচ্ছে। জ্যানিফার নামক মেয়েটি অভ্রের এমন এক অধ্যায় যা শেষ হয়ে৷ যাবার পর ও প্রতিনিয়ত তার বর্তমানে হানা দিচ্ছে। এই রহস্যের সমাধানটা করতেই হবে ঐন্দ্রির।
পিউকে সাজিয়ে দিচ্ছে আসমা বেগম।৷ আজ শিহাবের বাবা-মা তাকে দেখতে আসছে। বদরুল সাহেব যখন পিউকে তার পছন্দ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন তখন কোনো উত্তর ছিলো না তার কাছে। কারণ আজ অবধি তার কারোর সাথে প্রেমের কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি। তাই কোনো আপত্তি করে নি সে এই বিয়েতে। পিউ এর সম্মতি পেয়ে বেশ খুশি হন বদরুল সাহেব। অবশ্য পিউ এর মাঝে এই বিয়ে নিয়ে বিন্দু মাত্র উৎসাহ নেই। তার মোটেই সাজতে ভালো লাগছে না। কিন্তু কাউকে তা বলতে পারছে না। কারণ এই কারণটা নিজেও জানে না সে। এর মাঝেই বদরুল সাহেব উপস্থিত হয় সেখানে। তার মুখের অবস্থা বেজার। আসমা বেগম বললেন,
– কি গো উনারা কখন আসবেন?
– উনারা আসবে না আসমা। শিহাব কে আমার ভাগ্নীর প্রেমিক মেরে হাসপাতালে পৌছে দিয়েছে…………
চলবে
[ আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। লেখাটায় রিচেক করা হয় নি বিধায় একটা বড় ভুল ছিলো পরবর্তী পর্বের সময়ের দিকে। হয়তো অনেকেই বিকেল ধরে ওয়েট করে বসে ছিলেন। আই এম সো সরি ফর দ্যা মিসটেক। তাই ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল বিকেলে পোস্ট করবো। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ দুটো পর্ব পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি