স্বপ্নছায়া,পর্ব:৮

0
566

#স্বপ্নছায়া
#৮ম_পর্ব

বাড়ির সামনে সিএনজি থামলে পিউ আগে নামে। ভাড়া মিটিয়ে হঠাৎ পেছন থেকে নীলাদ্রি বলে উঠে,
– পিউ, একটু দাঁড়া।
– হু বলুন
– আমি তোকে কিছু বলতে চাই।
– বলুন
– আসলে আমি তোকে অনেকদিন থেকেই কিছু বলার চেষ্টা করছি! কিন্তু যখন ই তোর সামনে আসি, সব কেমন যেনো গুবলেট হয়ে যায়।

নীলাদ্রি বেশ গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বললো। ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি এবং পিউ। নীলাদ্রির মুখের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে পিউ। সে বোঝার চেষ্টা করছে নীলের মনে কি চলছে। নীলাদ্রি দু কদম এগিয়ে ঠিক পিউ এর সামনে এসে দাঁড়ালো৷ ঝিরিঝিরি বাতাসে পিউ এর চুলগুলো উড়ছে। নীল তার বা হাত দিয়ে আলতো করে মুখের সামনে আসা চুলগুলো পিউ এর কানের পিছে গুজে দেয়। তার এমন অস্বাভাবিক আচারণে চোখ বিস্ফোরিত আকার ধারণ করে পিউ এর। গালগুলো লাল হতে থাকে। শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। নীলাদ্রির গভীর চোখে দেখতেও তার ভয় হচ্ছে। তাই চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকায় সে। পিউ এর থেকে নীলের দূরত্ব কয়েক ইঞ্চি হবে। পিউ হৃদস্পন্দন তীব্র হচ্ছে। অজানা কারণেই তার বুকে যেনো কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। নীল গভীর কন্ঠে বললো,
– আমি তোর সাথে সব সময় খিটখিট করি, তোকে বকি; কেনো জানিস?

পিউ এর মুখে কোনো কথা নেই, সে শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নীল ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাঁড়ে। তারপর বলে,
– তুই যখন আমাকে ফোন দিয়েছিলি, তোর কাঁপা স্বর শুনে মূহুর্তের জন্য আমার দম আটকে এসেছিলো। আমি ই জানি কিভাবে সেখানে আমি পৌছেছি। পুরোটা রাস্তা পাগলের মতো লাগছিলো। যখন শুনেছি তোর সাথে কি হয়েছে, রাগ সামলাতে পারি নি তোর উপর চিৎকার করেছি। তোর যদি কিছু হয়ে যেতো সত্যি বলছি আমি কি করতাম আমি জানি না। আমি অনেকবার এই কথাগুলো তোকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু প্রতিবার ই তোর বয়সের কথা ভেবে আমার বলা হয় নি। পিউ আমি তোকে…..

নীলাদ্রি কথাটা শেষ হবার আগেই পাশ থেকে একটা কন্ঠে ভেসে উঠে,
– এ কি! তোমরা বাহিরে কি করছো?

কন্ঠটি শোনা মাত্র নীলাদ্রি খানিকটা দূরে সরে যায় পিউ থেকে৷ পিউ এর বুকের ধুকপুকানি যেনো দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কারণ সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি তার মামা বদরুল সাহেব। বদরুল সাহেব ভ্রু কুচকে নীলাদ্রি এবং পিউ এর দিকে তাকিয়ে আছেন। নীলাদ্রির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বদরুল সাহেব মানুষটাকে সচারচর রাগতে দেখা যায় না। বেশ হাসি ঠাট্টায় মানুষকে জমিয়ে রাখতে তার ভালো লাগে। কিন্তু কখনো রাগ উঠলে তাকে শান্ত করা খুব কঠিন। পিউ এর মামু হলেও সর্বদা বাবার মতো আগলে রেখেছে পিউকে। বাবারা যেমন প্রতিটাক্ষণ তার মেয়েকে আগলে রাখেন ঠিক তেমন ই বদরুল সাহেব পিউ কে আগলে রাখেন। নীলাদ্রির মনে আছে, পিউ যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন একটা ছেলে তাকে প্রতিনিয়ত রাস্তায় ফলো করতো। বদরুল সাহেবের কানে কথাটা পৌছাতেই তিনি সেই ছেলেকে হাতে নাতে রাস্তায় ধরেন। শুধু তাই নয়, রাস্তার মাঝে তিনি ছেলেটাকে কান ধরে উঠবস করিয়ে ছিলেন। এর পর থেকে কোনো পাড়ার ছেলে পিউ এর দিকে চোখ তুলেও তাকায় না। এতে অবশ্য নীলাদ্রির লাভটাই বেশি হয়েছে। কিন্তু বদরুল সাহেব যদি নীলাদ্রিকে ভুল বুঝে তবে তাদের কাহিনীর এখানেই ইতি টানতে হবে। বদরুল সাহেবের চাহনীতে নীলাদ্রি ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। এবার বদরুল সাহেব কিছুটা এগিয়ে এসে বলেন,
– কি হলো? তোমরা এখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
– আ..আসলে মামু
– আসলে পিউ ভয় পাচ্ছিলো খালু, কিভাবে ভেতরে যাবে?

পিউ কিছু বলার আগেই নীলাদ্রি কথাটা বলে উঠে। পিউ অবাক নয়নে নীলাদ্রির দিকে তাকায়। লোকটা কি সুন্দর চোখে মুখে মিথ্যে কথা বলছে! তার গলাও কাঁপছে না। সে মোটেই ভয়ের জন্য বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো না। লোকটার কথা গুলো শুনবে বিধায় দাঁড়িয়েছিলো। বদরুল সাহবে ভ্রু আরো কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন?
– পিউ ভয় পাচ্ছিস কেনো? কি হয়েছে?

এবার নীলাদ্রি দিয়াবাড়িতে ঘটে যাওয়া কথাগুলো বলতে লাগলো। বদরুল সাহেব খুতিয়ে খুতিয়ে পিউকে দেখতে লাগলেন। পিউ এর শাড়ির আচল কাঁধের থেকে পুরোটা ছেড়া। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে৷ তিনি পিউ এর কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,
– তুই কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস?
– না
– তাহলে ঠিক আছে। আগামীকাল নীলাদ্রির সাথে যেয়ে নতুন একটা মোবাইল কিনে নিস। আর এই সামান্য ব্যাপারে ভয় পেতে আছে? আয় ভেতরে চল। বৃষ্টি নামবে। মেঘ করে এসেছে।

বলেই পিউকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন বদরুল সাহেব। নীলাদ্রি ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতোক্ষণ পর যেনো জানে পানি এলো তার৷ আত্নাটা যেনো এতোক্ষণ গলায় আটকে ছিলো তার। অনেক সাহস নিয়ে পিউ কে মনের কথাগুলো বলতে চেয়েছিলো নীলাদ্রি কিন্তু আবারো সবকিছু গুবলেট হয়ে গেলো। ল্যাম্পপোস্টের পাশের পড়ে থাকা ফাঁকা কোকাকোলার বোতলে সজোরে লাথি মারলো সে। তাতেও বুকের অস্থিরতাটা কমছে না নীলাদ্রির। ভালোবাসার পাটাতনে প্রতিনিয়ত পিসছে সে। কিন্তু বোঝার মানুষটাই অবুঝ। হতাশ চোখে আকাশের দিকে তাকায় সে। মেঘ জমেছে আকাশে। ঠান্ডা বাতাস হইছে, এই হয়তো বৃষ্টি নামবে!!!!!!

৫.
জ্যানিফারের পাশে বসে রয়েছে অভ্র। জ্যানির মুখে অক্সিজেন লাগানো। চোখ বুঝে অভ্রের কন্ঠ শুনছে। অভ্র তার সুগভীর কন্ঠে নিকোলাস স্পার্ক্স এর “নোটবুক” বইটি তাকে পড়ে শুনাচ্ছে। সেখানের একটি বেশ বিখ্যাত লাইন রয়েছে,
“The best love is the kind that awakens the soul and makes us reach for more, that plants a fire in our hearts and brings peace to our minds. And that’s what you’ve given me. That’s what I’d hoped to give you forever. I love u”

অভ্র লাইনটা পড়ার সময় কন্ঠ কাঁপছিলো। অজান্তেই চোখের কোনায় পানি জমতে লাগে তার। বইটা বন্ধ করে ফেলে অভ্র। একরাশ চাঁপা কষ্ট নিয়ে জ্যানির দিকে তাকায়। জ্যানি এখনো চোখ বুঝে রয়েছে। জ্যানির ক্যান্সার শেষ স্তরে পৌছে গেছে। প্রতি সপ্তাহে তাকে ক্যামো দিতে হচ্ছে। কিন্তু তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ডাক্তার ও হাত তুলে দিয়েছেন। মেয়েটাকে দেখলে অভ্রের বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়। ধবধবে ফর্সা, গোলগাল চেহারার মেয়েটি দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে। চোয়ালের হাড় বেড়িয়ে এসেছে, মাথার ব্রাউন কালারের চুল গুলো সব পড়ে গেছে। লোম অবধি নেই মেয়েটির গায়ে। চোখের নিচে কালো গাড় ছোপ হয়ে যাচ্ছে। তবুও অভ্রের এই মেয়েটাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎ করেই জ্যানি ছটপট করতে লাগে। তার প্রচুর শ্বাসকষ্ট উঠেছে। রীতিমতো বুকে হাত দিয়ে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। জ্যানিকে এভাবে ছটফট করতে দেখে অভ্র ছুটে বাহিরে যায়৷ জোরে জোরে ডাক্তারকে ডাকতে থাকে। কিন্তু কেউ জেনো তার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে না। সে আকুল কন্ঠে বলে,
– জ্যানি, কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার? জ্যানি আমার কন্ঠ কানে যাচ্ছে? জ্যানি? ডক্টর হেল্প, ডক্টর। প্লিজ হেল্প মাই ওয়াইফ। ডক্টর।

হুট করে অভ্রের মনে হতে লাগলো জ্যানি যেনো হাওয়ায় মিলে যাচ্ছে। তার হাতের মুঠোতে থাকা জ্যানির হাতটা যেনো ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। অভ্রের দম বন্ধ লাগছে। সে চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু কন্ঠ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। তখন তার কানে আসলো,
“অভ্র তুমি তোমার প্রমিস রাখো নি। তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো। তুমি মিথ্যে বলেছো। ”

সাথে সাথে ধরফরিয়ে উঠে বসে অভ্র। সে রীতিমতো হাপাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গেছে। যার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পাশের সাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো সে। কিন্তু এখনো পানি পিপাসা কমে নি। অনেকদিন পর জ্যানিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে সে। জ্যানির সাথে কাটানো সেই অন্তিম মূহুর্ত গুলো তাকে আজ ও তাড়া করে বেরায়। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে দেয় অভ্র। পাশে তাকাতেই দেখে ঐন্দ্রিলা গভীর ঘুমে মগ্ন। এসির তাপমাত্রা বেশি, বাহিরের বৃষ্টির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ বৃষ্টি হচ্ছে। ঐন্দ্রিলা কুঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে। অভ্র এসি টা বন্ধ করে দিলো৷ তারপর ঐন্দ্রির গায়ে কম্বলটা টেনে দিলো। ঘড়িতে এখন তিনটা বাজে। অভ্র তার সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি তার মুখে ছিটকে পড়ছে। সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে তাতে সুখটান দেয় সে! স্বপ্নের কন্ঠটি এখনো কানে বাজছে। তবে কি সে আসলেই জ্যানিকে দেওয়া প্রমিস ভাঙ্গছে?

সকাল ৯টা,
ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। কাল রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। তাই আবহাওয়াটা বেশ স্যাতস্যাতে। পিটপিট করে চোখ খুলে ঐন্দ্রিলা। চোখ খুলতেই দেখলো………….

চলবে

[ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here