#স্বপ্নছায়া
#৬ষ্ঠ_পর্ব
নীলাদ্রির সাথে চোখাচোখি হতেই সে হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে টেবিলের কাছে হাটা দেয়। তখন নীলাদ্রি ঝাঝাঁলো কন্ঠে বলে,
– কথা আছে, ছাঁদে যাওয়া যাক?
অভ্র নীলাদ্রির কথাটা অগ্রাহ্য করতে পারলো না। তাই পানিটা খেয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– চলো
ছাঁদের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে অভ্র এবং নীলাদ্রি। ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। তিন ঘন্টার একটানা ঝুম বৃষ্টি উত্তপ্ত ঢাকা শহরকে শীতল নগরীতে পরিণত করেছে। নীলাদ্রি সিগারেটটা অভ্রের এগিয়ে দিয়ে বললো,
– চলবে?
– হু, থ্যাংক্স।
– তোমার কৌতুহল হচ্ছে না? আমি কেনো তোমকে এখানে নিয়ে এসেছি?
– হচ্ছে না বললে ভুল হবে, তবে একটা অনুমান করতে পারছি। বোন তো আমার ও আছে।
– ঐন্দ্রি আমার শুধু বোন নয়, ও আমার কলিজার অংশ৷ আমার আয়ত্তে থাকলে আমি কখনোই এই বিয়েটা হতে দিতাম না। কারণ তুমি ওর যোগ্য নও। যার ছোট ভাই বিয়ের আসরে আমার বোনকে তার রুপের জন্য ছেড়ে যেতে পারে, সে কতোটা ভালো হতে পারে আমার জানা আছে। কিন্তু তখন আমি অপারগ ছিলাম বলে বিয়েটা আটকাতে পারি নি। তবে এটা ভাবার মোটেই ভুল করবে না যে, আমি একজন অকর্মণ্য ভাই। কখনো যদি তোমার জন্য আমার বোনের চোখ থেকে পানি পড়ে, সেদিন ওইবাড়িতে আমার বোনের শেষ দিন হবে। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো।
বেশ শান্ত কন্ঠে হুমকি দিচ্ছে সে অভ্রকে। নীলাদ্রির চোয়াল স্থির, তার কন্ঠে কোনো জড়তা নেই। ভাই বোন দুটো একই ধাঁচের। এক জন তাকে প্রতিনিয়ত নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, আরেকজন সিগারেট দিয়ে শান্ত কন্ঠে ওয়ার্নিং দিচ্ছে। অভ্র মনে মনে হাসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
– বিয়েটা আমার বা ঐন্দ্রিলার ইচ্ছেতে হয় নি। তবে এটাকে এগিয়ে নেবার ইচ্ছেটুকু উভয়ের ই আছে। দুটো আলাদা মানুষ হুট করেই তো একই রঙ্গে রাঙ্গতে পারে না, সময় লাগে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য। তবে আশাকরি, আমি জেনে কখনোই ঐন্দ্রিলাকে কষ্ট দিবো না। আফটার অল সি ইজ মাই ওয়াইফ। যদি কোনোদিন কথা না রাখতে পারি দেন দ্যা ডিসিশন উইল বি ইউরস।
নীলাদ্রি উত্তর দিলো না। সে নিঃশব্দে সিগারেটে সুখটান দিলো। তার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। অভ্রের অন্তরে সে উঁকি দিতে পারছে না, তাই তার মুখের কথাকেই আপাতত বিশ্বাস করতে হচ্ছে। তবুও মনে কোনে আশংকার প্রদীপ মিটিমিটি করে জ্বলছে। ঐন্দ্রিলা কি আদৌ সুখের হাতছানি পাবে!!
রুমে যেতেই অভ্র থমকে গেলো৷ বিছানায় ঐন্দ্রিলা দিশানকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে রয়েছে। দিশান ও ঐন্দ্রিলার বুকে মিশে রয়েছে। ছোট বেলা থেকে দিশান খুব ইন্ট্রোভার্ট। অপরিচিত মানুষ দেখলেই সে ভয়ে চুপসে যায়। অভ্র যখন তাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলো তখন কেবল অভ্রের কাছেই সে থাকতো। অভ্র ব্যাতীত প্রতিটি মানুষকে সে ভয় পেতো। দিশানের এই মানসিক রোগটা যাকে সাইকিয়াট্রিস্টরা “xenophobia” বলে, সেটা সম্পর্কে বেশ আগ থেকেই অভ্র জ্ঞাত ছিলো। বিভিন্ন চাইন্ড সাইকিয়াট্রিস্টের সাথেও সে কথা বলে। দিশানের প্রচুর সময় লাগে অভ্রের পুরো পরিবারের সাথে মিশতে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ছেলে ঐন্দ্রিলার সাথে কোনো কষ্ট ব্যাতীত ই মিশে গিয়েছে। নিজ থেকে তাকে “মাম্মাম” বলে, যেখানে অভ্রকে বাবা বলতে তার বছর খানিক সময় লেগেছে। অভ্রের ঠোঁটের কোনায় অজান্তেই হাসি ফুঁটে ওঠে। আজ বত্রিশ বছরের জীবনের সবথেকে সুন্দর এবং লাভবান ডিলটা সে করেছে। রোডের ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা ক্ষীন ভাবে রুমে প্রবেশ করছে। এই ক্ষীণ আলো আধারে ঐন্দ্রিলার ঘুমন্ত শান্ত মুখখানা চমৎকার লাগছে অভ্রের। মেয়েটি কৃষ্ণ বর্ণের, কিন্তু মুখখানা দেখলে মনে হয় কোনো ভাস্করের নিপুন হাতের শিল্পকর্ম, মোমের দলাতে আলতো হাতের ভাস্কর্য। এক বছর পর এতোটা খুতিয়ে কোনো নারীকে দেখছে অভ্র, হ্যা সে গভীর নয়নে ঐন্দ্রিকে দেখছে___________
৫.
বারান্দার এক কোনায় গোঁমড়া মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিউ। আকাশের কোনে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি হবে হবে করছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। দমকা গরম হাওয়া পিউ এর ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে দোল দিচ্ছে। ঐন্দ্রিলা ও বাড়ি চলে গিয়েছে। মন দিয়ে হয়তো সংসার করছে। আর এদিকে পিউ এর নিজেকে বড্ড একা লাগছে। ঐন্দ্রি থাকলে ওকে নিয়ে দিব্বি বাহিরে ঘুরতে যাওয়া যেতো। কিন্তু সে নেই। দিশাটা ও বাসায় নেই। কলেজে তার হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা চলে। পিউ এর একা একা একঘেঁয়েমি লাগছে। মাত্র ই সে তার ব্যাচেলর অর্থাৎ অনার্সটা কমপ্লিট করেছে। মাস্টার্সের ক্লাসটা ও শুরু হয় নি। নয়তো একটা না একটা কাজে মন টা লেগে থাকতো। আজ কিছুই কেনো যেনো ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে আমাদের সকলের ভালো না লাগা রোগে ধরে। পিউ ও এই রোগে আক্রান্ত৷ হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে তার। ফোনের স্ক্রিনে সাবার নামটা বড় বড় হরফে দেখা যাচ্ছে। সাবা মেয়েটি পিউ এর খুব ভালো বান্ধবী। তারা একই সাথে ভার্সিটিতে পড়তো। ফোন রিসিভ করতেই উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে সাবা বলে উঠে,
– শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নে, আমরা দিয়াবাড়ি যাবো।
– কিহ?
– রেডি হো ছেরি, সময় নেই। আমরা ৪টায় বের হবো।
– সে বুঝলাম। হুট করে এই প্লানের কি কোনো কারণ আছে?
– নাহ নেই। আরিফা ফোন দিয়ে বললো সে বোর হচ্ছে, তাই এই প্লান। শাড়ি পড়ার প্লান আমার।
– তুই কি জানিস তুই কতো ভালো!
– না জানি না, তুই রেডি হ। ওখানে যেয়ে ফুচকা খেতে খেতে শুনবো।
– যা আজকে তুই যত ফুচকা খাবি, আমি তোকে খাওয়াতে রাজী। আমার যে কি মন খারাপ লাগছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। আমি রেডি হয়ে ফোন করছি। বাই
বলেই ফোনটা কেটে দিলো পিউ। মনটা মূহুর্তের মধ্যেই ভালো হয়ে গেলো। যাক এই বদ্ধ ঘর থেকে বের তো হওয়া হবে।
আজ অফিসে যাওয়া হয় নি নীলাদ্রির। শরীরটা মেজমেজে লাগছে। দুদিন আগের বৃষ্টিতে ভেজার ফল, এটা তার বুঝতে বাকি নেই। মাথাটা এতো বেশি ধরেছে যে বিছানা থেকেও উঠতে ইচ্ছে করছিলো না তার। ঔষধের ডিব্বাতে টাফনিলের পাতাটাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। খালার বাসায় খোঁজ নিলে হয়তো পাওয়া যাবে। মোটেই এই অসুস্থ শরীরটা নিয়ে বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে বা নীলের। খুব কষ্টে নিচে গেলো সে। আসমা বেগম দরজা খুলতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলেন,
– নীল, তোর কি শরীর খারাপ?
– জ্বর জ্বর লাগছে, টাফনিল হবে খালা?
– বয়, আমি দেখছি।
ছোট্ট করে “হু” বলে ড্রয়িং রুমের সোফাতে গা এলিয়ে বসে নীলাদ্রি। ঠিক তখন পিউ এর কন্ঠ টি কানে আসে তার,
– মামী মা, আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি। আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে।
নজর তুলে নীলাদ্রি কিছুক্ষণ থ মেরে বসেছিলো। সাদা-গোলাপি মিশ্র শাড়িতে পিউকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগছে না। হলদেটে ফর্সা দেহে শাড়িটা যেনো মিশে আছে। ঠোঁটে কড়া করে লাল লিপ্সটিক, চোখে গাড় কাজল। ঢেউ খেলানো চুল গুলো কোমড় অবধি নেমে এসেছে। নীলাদ্রির মনে হল কয়েক মূহুর্তের জন্য তার হৃদস্পন্দন থেকে গেছে। তড়িৎ গতিতে চোখ সরিয়ে নিলো সে। এই মেয়েটা একদিন তাকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলবে। ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার আগেই তাদের কাহিনীর সমাপ্ত হবে। কে বলেছে মেয়েটা এতো সুন্দর করে সাজতে? খানিকটা রাগ হলো নীলাদ্রির। একেই বয়সের তফাতের জন্য মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে চৌদ্দ বার ভাবতে হয় তার। এখন যদি কোনো চ্যাংড়া ছেলে তাকে পটিয়ে ফেলে তবে শুরু হবার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। আসমা বেগম পিউ এর কাছে এসে বলেন,
– এখন এতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস রে তুই?
– দিয়াবাড়ি। সাবা আর আরিফাও যাচ্ছে।
– আচ্ছা শোন মা যাবার আগে একটু টাফনীলটা খুজে দে না। আমি পাচ্ছি না।
– তোমার মাথা ব্যথা করছে?
– আরে না, নীলের করছে। বেঁচারার মুখটা শুকিয়ে গেছে। খুঁজে ওর হাতে দিয়ে তারপর যা। আমার চুলার তরকারীটা পুড়ে যাবে।
নীলাদ্রি নামক ব্যাক্তিটির কথা শোনামাত্র পিউ বড় সড় ঢোক গিললো। এখন তাকে দেখলেই লোকটা কোনো না কোনো টিপ্পনী ঠিক কাঁটবে৷ কিন্তু মামী মার কথাও অগ্রাহ্য করতে পারছে না সে। তাই বাধ্য হয়ে ঔষধটা খুঁজে নিজেই নীলাদ্রির সামনে গেলো সে। লোকটাকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে যখন ই পিউ খুব সুন্দর করে সাজে কিছু না কিছু টিপ্পনী কাটেই। নীলের সামনে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
– নিন।
– কোনো কুকুর বেড়াল কে দিচ্ছিস নাকি! একটু ভালো ভাবে কি দেওয়া যায় না?
– যা বাবা আমি কি করলাম?
– থাক, থাক আর বুঝে কাজ নেই তোমার। তা এমন সং সেজে কোনো নাট্য কোম্পানিতে যাচ্ছিস শুনি? কুকুরের পাছার মতো লাল করে রেখেছিস কেনো ঠোঁটটা? নাগর জুটিয়েছিস বুঝি?
নীলাদ্রির কথায় প্রচন্ড রাগ হলো পিউ এর। অজান্তেই চোখে পানি জমতে লাগলো৷ এতোটা খারাপ কেনো লোকটা! সে মোটেই সং সাজে নি। সে সাধারণ বাঙ্গালী মেয়েদের মতোই সেজেছে। কিন্তু তার কোনো কাজ ই লোকটার পছন্দ নয়। আর এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো চোখের নোনা জল ছেঁড়েই দিবে সে৷ অভিমানী কন্ঠে বললো,
– আমি মোটেই নাগর জুটাই নি নীলাদ্রি ভাই। কথা না বলতে পারলে বলবেন না। তবে এভাবে অপমান করবেন না।
বলেই হনহনিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সে। পিউ এর অভিমানী কন্ঠের বলা কথাগুলো তীরের ন্যায় নীলের হৃদয়ে লাগলো। আজ একটু বেশিই বলে ফেলেছে সে। কিন্তু সে ভয় পায়, ভয় পায় মেয়েটাকে হয়তো হারিয়ে ফেলবে সে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে শুধু তার কাছেই রেখে দিবে। যেখানে কেউ তাকে দেখতে পারবে না। কিন্তু মেয়েটা সামনে আসলেই সব যেনো গুলিয়ে যায়। নিজেকে আটকে রাখার প্রচেষ্টায় সারাক্ষণ খিটখিটে মেজাজে কথা বলে মেয়েটার সাথে। মাথা ব্যাথাটা তীব্র হয়ে উঠেছে। নীলাদ্রি দু হাত দিয়ে মাথাটা চেপে বসে রইলো।
সন্ধ্যা ৭টা,
দিনের আলোর সমাপ্তি ঘটেছে। পাখিরা যে যার গৃহে ফেরার তাড়ায় রয়েছে। নীল ঘরে পায়চারি করছে। ক্ষণে ক্ষণে বারান্দায় উঁকি দিচ্ছে। না এখনো পিউ আসে নি। মেয়েটা বেরিয়েছে তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে নীলের মোবাইলে। ফোন রিসিভ করতেই কানে আসে,
– নীল ভাই………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি