#স্বপ্নছায়া
#২৬তম_পর্ব
নাক টেনে কথাটা বলে ঐন্দ্রিলা। কথাটা শুনে অভ্রের দৃষ্টি সরু হয়ে গেলো। আজ চটপটি মামা একটু ঝাল টা বেশি ই দিয়ে৷ ফেলেছেন। ঠোঁট জোড়া একেবারে লাল হয়ে রয়েছে ঐন্দ্রিলার। হুট করেই অভ্রের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি জেকে বসলো। ঐন্দ্রিলা কিছু বোঝার আগেই অনুভব করলো এক জোড়া উষ্ণ ঠোঁট তার ঠোঁট আকড়ে ধরেছে। অভ্রের এরুপ আচারণে ঐন্দ্রিলা যেনো জমে গেলো। তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠলো। আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে। ব্যাপারটা খানিকটা সিনেমেটিক, অভ্র এরুপ কিছুও করতে পারে কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করে নি ঐন্দ্রি। কয়েক মূহুর্ত বাদে ঐন্দ্রির পাতলা ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দিলো অভ্র। নির্বিকার ভাব নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট দিলো সে। গাড়ির শব্দে স্বম্বিত ফুরলো ঐন্দ্রিলার। এতোক্ষন তারা চটপটি৷ ওয়ালার ঠেলার পাশেই ছিলো। লজ্জায় ঐন্দ্রিলার গাল দুটো লাল-বেগুনী হচ্ছিলো। আর অভ্রের ভাবটা এমন যেনো কিছুই হয় নি। অভ্রের এমন স্বাভাবিকতায় ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলার। চটে গিয়ে বললো,
– এটা কি হলো?
– কি হবে?
স্বাভাবিক ভঙিতে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিলো অভ্র। এতে ঐন্দ্রির মেজাজ তুঙ্গে উঠলো। হিনহিনে স্বরে বললো,
– ন্যাকা, বুঝছেন না বুঝি? ফ্রি তে মামাকে শো দেখালেন সেটার কথা বলছি
– অদ্ভুত নিজের বিয়ে করা বউকে চুমু খেয়েছি। কি মহাভারত অশুদ্ধ করলাম আমি?
– আপনি একটা অসহ্য, অসভ্য, অভদ্র সেটা জানেন?
– এতোদিন জানতাম না, আজ জানলাম। ধন্যবাদ এতোসুন্দর চারিত্রিক কমপ্লিমেন্টের জন্য।
– ধুর! ভালো লাগে না।
ঐন্দ্রিলা মুখ সরিয়ে গ্লাসের দিকে তাকায়। রাগ এবং লজ্জা মিলেমিশে যেনো আরো ও মোহনীয় করে তুলেছে তাকে। অভ্র আড়চোখে তার বাঘিনীকে দেখে নিলো। তারপর ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি একে গাড়ি ছোটালো। আধারের নগরীর হলুদেটে রাস্তায় কাঁটানো মূহুর্তগুলো ব্যস্ত জীবনটাকে যেনো আরোও জীবন্ত৷ করে৷ তোলে। এই গোটা কয়েক মূহুর্তগুলোই মাঝে মাঝে “চেরী অন দ্যা কেক” এর ন্যায় নীল ভালোবাসাকে আরোও আবেগঘন করে তোলে। ঐন্দ্রিলা গাড়ির গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে আধার কালো আকাশের পানে তাকিয়ে রয়েছে। ভালোবাসার স্বপ্নছায়াগুলো যেনো বাস্তব মনে হচ্ছে। নিজেকে আবারো কিশোরী ভাবতে ইচ্ছে করছে। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের নায়ক নায়িকার মতো প্রেম করতে ইচ্ছে করছে তার। আচ্ছা অভ্র কি পারবে তার পছন্দের সেই প্রেমিক পুরুষটি হতে! খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার।
১৩.
ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ, কুকুর মরা গরম পরেছে বললে ভুল হবে না। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে, তবুও বদরুল সাহেব তরতর করে ঘামছেন। তার সাদা পাঞ্জাবি গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। আসমা বেগম একটা গ্লাস এগিয়ে দিলেন তার দিকে। তিনি অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলেন,
– এটা কি?
– লেবু পানি। বিটলবণ আর হালকা চিনি ও দিয়েছি। খাও ভালো লাগবে।
তিনি নিঃশব্দে গ্লাসটা হাতে নিলেন। তার এখন লেবুর শরবত খাওয়া জরুরী। মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা তার উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। শরবত খেলে মাথাটা একটু শান্ত হবে বলে তার ধারণা। নীলাদ্রি বদরুল সাহেবের ঠিক বিপরীতে বসে রয়েছে। মনে মনে সূরা পাঠ করছে সে। আজ নাটকের প্রথম দিন। তার উপর নাটকের ফল নির্ভর করছে। নীলাদ্রি কখনো ভয় পায় না। তবে আজ তার ভয় হচ্ছে। ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে প্লান ব্যাকফায়ার করলে কি করবে সে? ফিফটি ফিফটি চান্স, একটা ভুল স্টেপ আর প্লান এর চৌদ্দটা বেজে যেতে পারে।
বদরুল সাহেব শরবতটা শেষ করে নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকালেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
– কেসের কি অবস্থা?
– খালু কেস কিন্তু জন্ডিস। আপনি যা ধারণা করেছেন সেটাই ঠিক। পিউ প্রেমে পড়েছে। এখন সেই গাড়ি কতদূর গিয়েছে তা সঠিক না জানলেও গতি সুবিধার না।
– ছেলে কি করে?
– আস্তো একটা রাম ছাগল। ম্যা ম্যা করে না, তবে পিউ পিউ করে। পিউ এর কলেজের ই। পিউ কে বহু আগ থেকে সে পছন্দ করে। কলেজে বেশ নাম ডাক আছে শুনেছি। পলিটিক্স ও করে, মারপিট, দাঙ্গা। বুঝলেন খালু, আমাদের নিস্পাপ মেয়েটা একটা রামছাগলের পাল্লায় পড়েছে। শুধু তাই নয়, শিহাবকে ও এই রামছাগল ই মেরেছিলো। সে নাকি বলেই দিয়েছে, পিউ কে যে বিয়ে করতে আসবে তার হাড় ভেঙ্গে দিবে।
নীলাদ্রির কথা শুনে বদরুল সাহেবের মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়। রীতিমতো আরোও বেগে ঘামছেন তিনি। নীলাদ্রি টিস্যুর বক্স টা এগিয়ে দিলো তার দিকে। খালুর সামনে নিজেকে পিউ এর যোগ্য প্রমাণ করার তালে নিজের নামেই দূর্নাম রটাচ্ছে নীলাদ্রি। দিশার প্লান অনুযায়ী, সে খালুর উপর রিভার্স সাইকোলজি প্রয়োগ করছে। খালুর সামনে পিউ এর প্রেমিকের বদনাম করে খালুর বিশ্বাসী হয়ে উঠার প্রথম ধাপ এটা। মাথার ঘাম মুছে চিন্তিত কন্ঠে বদরুল সাহেব বললেন,
– এটা কি মামদোবাজি নাকি? আমার ভাগ্নী যেখানে ইচ্ছে সেখানে বিয়ে দিবো। ও গুন্ডামি করবে আর আমরা মেনে নিবো নাকি? আমি থানায় যাবো
– এ ভুল করবেন না খালু। হিতে বিপরীত হতে পারে। পিউ এখন নতুন নতুন প্রেমের হাওয়া খাচ্ছে। কিশোরী মন, উলটা পালটা করে বসলে? আর ওই ছেলের উপর তিনটা কেস আছে অলরেডি৷ ওকে জেলে দিলে কিচ্ছু হবে না। ওর চেলা দিয়ে বর পেটাবে। ও তো নিজে পেটায় না। চেলা দিয়ে পেটায়। মাঝখানে আমাদের মেয়ের নাম খারাপ হবে। একটু ভেবে দেখুন খালু।
– তাহলে কি করবো?
– অতি শীঘ্রই ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিবো পিউ এর। যে ছেলে এই রামছাগলকে ভয় পাবে না। আমরা বলে নিবো এই ব্যাপারটা। যে ছেলে রাজী হবে সেই ছেলের সাথেই বিয়ে দিবো। “ধরো তক্তা, মারো পেরেক”
– এতো তাড়াতাড়ি ভালো ছেলে পাবো কোথায়?
– সেটা আমি কিভাবে বলি খালু? আপনারা দেখুন না। পাবেন ইনশাআল্লাহ। আজ উঠি৷
বলেই উঠে দাঁড়ালো নীলাদ্রি। খালার দিকে তাকিয়ে বাকি নাটক চালিয়ে যাবার ইশারা করলো সে। আসমা বেগম ও তাকে চোখের ইশারা আশ্বস্ত করলেন। নীলাদ্রি পিউদের বাসা থেকে বেরিয়ে৷ আসলো। তার বুক এখনো কাঁপছে। শ খানেক মিথ্যে সাজানো লেগেছে শুধু একটা বিয়ের জন্য। বদরুল সাহেবকে মিথ্যে বলায় তার খানিকটা খারাপ ও লাগছে। কিন্তু কিছুই করার নেই৷ পিউ কে বিয়ে করার জন্য মিথ্যে বলতেও রাজী সে। বাসা থেকে বের হতেই পিউ এর দেখা হয় নীলাদ্রির। নীলাদ্রির চুপসে যাওয়া চেহারা দেখে পিউ ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে আপনার? মুখটা পাংশুটে হয়ে আছে যে?
– নিজের মুখে নিজের বদনাম করে এসেছি, মুখ পাংশু হবে না তো কি উজ্জ্বল হবে? জানিস, রামছাগল অবধি বলেছি নিজেকে।
নীলাদ্রির অসহায় কন্ঠের বক্তব্যে হেসে উঠে পিউ। বিরবির করে বলে,
– ভালো তো মাঝে মাঝে নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা ভালো।
– খুব হাসি পাচ্ছে না, যা ভেতরে। দেখ তোমার মামু কি করে তোর!
– নীলাদ্রি ভাই, কাজ হবে তো?
– জানি না। তবে টেনশন করিস না। কাজ না হলে পালিয়ে যাবো। চিটাগাং পালাবো। পাহারের মধ্যে একটা ঘর নিবো। ব্যাস আর লাগে।
নীলাদ্রির কথায় ম্লান হাসি হাসলো পিউ। এই হাসির মাঝে নিজের দোটানার চিত্র ফুটে উঠছে। মামুকে কষ্ট দিতে চায় না পিউ। লোকটা তার জীবনে তার পাবার ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু নীলাদ্রিকেও পাগলের মতো ভালোবাসে সে। তাদের প্রণয়ের ঠিক কি পরিণতি হবে তা একমাত্র বিধাতাই বলতে পারেন!!
রাত আটটা,
বারান্দার এক কোনায় কফি হাতের শরতের আকাশ দেখতে ব্যাস্ত ঐন্দ্রিলা। বাসায় প্রচন্ড উত্তেজনা চলছে। ঐন্দ্রিলাও এই উত্তেজনার অংশ। অভ্রের বাড়িতে সেই রাতে ফেরা হয় নি তার। সেদিনের পর থেকে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। অভ্র সেই দিনের পর দিন ই অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে গেছে। যোগাযোগ হয় নি মোটেই। যাওয়ার দিন সকালে দু-তিনটা ফোন এসেছিলো। ঐন্দ্রিলা ঘুমিয়ে থাকার কারণে ফোন ধরতে পারে নি সে। ঘুম যখন ভেঙ্গেছিলো, তখন অভ্রকে ফোন করে কিন্তু ফোনটা বন্ধ পায় ঐন্দ্রিলা। মোবাইল চেক করে একটা ম্যাসেজ পায়, সেটা হলো,
” সকাল সকাল ফোন করে ঘুম ভাঙ্গানোর ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু বান্দা অপারগ। একটা কাজে ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি। দশ দিন সেখানেই থাকা হবে। যদি ফোনে না পাও রাগ করো না। এখানে নেটওয়ার্কের অবস্থা ভালো না। ইনশাআল্লাহ দশদিন পর ই কথা হবে। ভালো থেকো।”
ম্যাসেজটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো ঐন্দ্রিলার। মনের ভেতর অসংখ্য বিষাদেরা ভর করেছিলো। রাগ হয়েছিলো ঘুমের উপর। এতোটা গাঢ় না হলে হয়তো লোকটার কন্ঠ শোনা যেতো। তারপর একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। অভ্রের ফোনে ফোন একেবারেই যে ঢুকে না তা নয়। মাঝে মাঝে নেটে কল যায় কিন্তু অভ্র কেটে দেয়। দু -তিনবার এমন হবার কারণে ঐন্দ্রিও অভিমানে ফোন দেয় নি। মানছে ব্যাস্ততা আছে, তাই বলে এতোটা ব্যাস্ততা! অভ্রের না ফোন, না ম্যাসেজ। একটা সপ্তাহ এভাবেই কেটেছে তার। মুখে মুখে বললেই প্রেমিকপুরুষ হওয়া যায় না। কাজেও করতে হয়। হঠাৎ ডোরবেলটা বেজে উঠে। নীলাদ্রি এবং দিশান বাসায় নেই। মামা, ভাগ্নে কোথায় গেছে সে জানে না। আর শরীফ সাহেব নামাজে। তাই ঐন্দ্রিলাই গেটটা খুলে। গেটে একটা ছেলে দাঁড়ানো। ছেলেটাকে দেখে ডেলিভারি বয় মনে হলো ঐন্দ্রিলার। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– জ্বী বলুন, কাকে চাই?
ছেলেটা বিনয়ের সাথে বলে,
– এখানে কি মিসেসঐন্দ্রিলা অভ্র চৌধুরী থাকেন?
– জ্বী, আমি ই ঐন্দ্রিলা অভ্র চৌধুরী। কেনো বলুন তো?
– আপনার জন্য একটা পার্সেল আছে ম্যাডাম। এখানে একটু সাইন করে দিবেন
ঐন্দ্রিলা খানিকটা অবাক হলো। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কে পাঠিয়েছে?
– জানি না ম্যাডাম। আমি তো ডেলিভারি বয়। উনার নাম দেওয়া নেই।
– আচ্ছা দিন কাগজটা।
কাগজে সাইন করার পর একটা বেগুনী বাক্স ঐন্দ্রিলার হাতে ধরিয়ে দেয় ছেলেটা। বাক্সটা মিডিয়াম সাইজের। ঐন্দ্রিলা দরজাটা দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে। বাক্সটা খুব যত্নের সাথে খুলে ঐন্দ্রিলা। বাক্স খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার। হরেক রঙ্গের রেসমি চুড়ির দুটো থোকা, এক জোড়া রুপোর নুপুর এবং একটি বেগুনী খাম। বেগুনী খামের উপর লেখা,
“প্রিয় বাঘিনী”
ঐন্দ্রিলা খামটা যত্নের সাথে খুলে। খামের ভেতরে সাদা কাগজে লেখা একটি চিঠি। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে ঐন্দ্রিলা। চিঠির লেখা গুলো ঠিক এরুপ..………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি