#স্বপ্নছায়া
#২৩তম_পর্ব
ডাইরির পরের পাতাগুলো ফাঁকা৷ শেষ লেখাটা পড়তে খুব কষ্ট হয়েছে ঐন্দ্রির। লেখাগুলো অস্পষ্ট ছিলো। বোঝাই যাচ্ছে জ্যানিফারের কতোটা কষ্ট হয়েছে। তবুও সে লিখেছে। ঐন্দ্রি খেয়াল করলো তার গাল ভিজে আছে। ডাইরিটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ হু হু করে কাঁদলো সে। এখন ভোর চারটা। দিশান গভীর ঘুম। ওর পাশে বসে ওর কপালে হামি দিলো সে। এরপর মোবাইলটা হাতে নিলো। ফোন করলো একটা নাম্বারে। তিনবার বাজার পর ফোনটা রিসিভ হলো। কাঁপা স্বরে ঐন্দ্রি বললো,
– অভ্র?
– এতো রাতে ফোন করলে? সব ঠিক আছে তো?
-……..
– হ্যালো ঐন্দ্রি, কথা বলছো না কেনো? সব ঠিক আছে? দিশান? ও ভালো আছে? কথা বলছো না যে? আমার দম আটকে আসছে ঐন্দ্রি, কিছু তো বলো?
অভ্রের ঘুম ঘুম কন্ঠ হুট করে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার কন্ঠে উদ্বিগ্নতার পরিচয় পাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। ব্যাপারটা একটু উপভোগ ও করলো সে। রাত চারটার সময় কাউকে ঘুম থেকে তুলে চুপ করে বসে থাকলে অপর ব্যাক্তির মনে কি চলে তা আন্দাজ করাটা খুব একটা কঠিন নয় তার পক্ষে। তবুও এই ভয়ংকর কাজটা সে করছে। সে জানে একটু পর অভ্র প্রচন্ড রেগে যাবে। তার কন্ঠে রোশের উদ্ভব হবে। ফোনের এপাশ থেকে ও তার রাগের ছিটা বুঝতে পারবে ঐন্দ্রি। ঐন্দ্রি কন্ঠ যথাযথ শান্ত রেখে বললো,
– পরশুদিন দেখা করতে পারবেন?
– খুব সিরিয়াস কিছু? আমি চলে আসবো এখন?
– আহা! কিছু হয় নি। কি হবে? আমি তো আপনার সময় জিজ্ঞেস করতে ফোন করছে! বলুন না পরশু সময় আছে? দেখা করতাম
– তুমি এই জন্য ফোন দিয়েছো?
– হু
– রাত চারটায়?
– হ্যা
– তুমি কি পাগল?
বেশ রুদ্র কন্ঠেই কথাটা বললো অভ্র।৷ তার মাথায় যেনো আগুন জ্বলছে। একটা মেয়ে ভোর চারটায় ফোন করে তাকে জিজ্ঞেস করছে পরশু দেখা করা যাবে কি না! সেটার জন্য পুরো দিন পড়েছিলো। কিন্তু মেয়েটি তা করে নি। বরং ভোর চারটায় অভ্রের সদ্য কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করছে। এটাকে পাগলামী ব্যাতীত অন্য কি বলা হয়৷ সেটা অভ্রের জানা নেই। ঐন্দ্রিলা বেশ ভাবলেশহীন ভাবেই বললো,
– আমার অনেক প্রশ্ন জমেছে। উত্তর গুলো আপনাকেই দিতে হবে। আমার ঘুম হারাম করে আপনাকে শান্তির ঘুম তো আমি ঘুমাতে দিতে পারি না। তাই এখন ফোন করলাম।
ঐন্দ্রির জড়তাহীন ভাষ্যতে অভ্রের বুঝতে বাকি রইলো না এই ভোররাতে মেয়েটি কেনো তাকে ফোন করেছে। নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার ডাইরি পড়া শেষ?
– হু, শেষ। এবার নাহয় উচ্ছিষ্ট প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাক!
– বেশ তবে তাই হোক। পরশু বিকেলে তৈরি থেকো।
– কোনো শান্ত নিরিবিলি জায়গা বাঁছবেন। লোক লোকালয়ের ভিড় যেনো কম থাকে।
– তাই হবে।
– রাখছি
– ঐন্দ্রিলা
– কিছু বলবেন?
– কেমন আছো? বললে না যে?
– আছি, যেমনটা ছিলাম। যেমনটা রেখে গেছেন। আছি। রাখছি।
ঐন্দ্রিলা ফোন রেখে দিলো। অভ্র ফোন কাঁটার পর দীর্ঘসময় ফোনের দিকে চেয়ে রইলো। হয়তো আর কিছুসময় ঐন্দ্রিলার কন্ঠ শুনতে পাবার ক্ষীণ আশা মনে জন্ম নিয়েছে। তিন বাদে মেয়েটির কন্ঠ শুনতে পেয়েছে সে। মনের ভেতর নীল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। আরো ও কিছুক্ষণ তার কন্ঠ শুনতে পেলে খুব মন্দ হতো কি!
বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকালো ঐন্দ্রিলা। কিছুক্ষণ বাদে আধারের বিষন্নতা ভেদ করে পূবের আকাশে লাল রেখা দেখা যাবে। শান্ত আকাশ কালো মেঘের দল হয়তো ঘুমিয়ে আছে। শীতল ঝিরঝিরি বাতাসে ঐন্দ্রিলার খোলা চুল গুলো দোল খাচ্ছে। গ্রিলে ঝোলানো নীলকন্ঠ ফুলটায় হাত বুলিয়ে নিচু গলায় বললো,
” সখী আমি কি ভুল করছি?
সমাজ তাকে অপবাদ দিচ্ছে
ভালোবাসা কি সত্যি অপরাধ?
আমি কেনো তাকে ঘৃণা করতে পারি না
পারি না তাকে হেও করতে!
পারছি না তাকে শাস্তি দিতে
যার শাস্তি স্রষ্টা ঠিক করেছেন
যেখানে কি মানবীর শাস্তি মানায়!
হ্যা সখী, আমি কি ভুল করছি?”________
১২.
বিকেল চারটা,
ছাঁদ জুড়ে নিগূঢ় নিস্তব্ধতা। প্রকৃতি শান্ত, থমথমে বাতাস বইছে। পথঘাটে হাটু অবধি পানি, ময়লা পানি। ড্রেইন খোঁদাই এর কাজ হবার পর ও লাভ হয় নি। পানি পানির জায়গায় আছে। গলির মুখের চায়ের দোকানে কাক ও ভিড়ছে না। প্রতিটা দোকানে শাটার দেওয়া। যে গলিতে বৃষ্টি হলেই বাচ্চাগুলো হুরহুর করে হাতে ব্যাট আর বল নিয়ে নেমে পড়ে সেই গলি আজ শান্ত। কফির মগ হাতে গাঢ় নজরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে পিউ। ময়লা পানির স্রোত দেখতে বেশ লাগছে। ছোট বেলায় এই স্রোতে কাগজের নৌকো ভাসাতো। যদিও তার এবং ঐন্দ্রিলার নৌকা সর্বদা ঢুবে যেতো। নীলাদ্রি বেশ সুন্দর করে নৌকা ভাসাতো। কিন্তু শহরের তুমুল ব্যাস্ততায় আজ সেই শৈশবটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। এখনের বাচ্চাদের শৈশব ইট পাথরের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে আছে। ছোট বাচ্চাগুলো এখন আর কিতকিত খেলে না, তারা মাংস চুরি বা টোকাটুকি খেলাগুলোর নাম ও হয়তো শুনে নি। তাদেরকে খেলার নাম জিজ্ঞেস করলে তারা পাব-জি, ফ্রি ফায়ার কিংবা কল অফ ডিউটির কথাই বলবে। সময়ের সাথে সাথে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের দুনিয়াকে হাত খুলে বরণ করছে। আর হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের নিস্পাপ মূহুর্তগুলো। পিউ অনুভব করলো তার ঘাড়ে কেউ উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখলো, মুখে হাসি টেনে নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। মামুর সাথে কথা বলে লোকটা যেনো বেমালুম হয়ে গিয়েছিলো। না ফোন, না ম্যাসেজ, না চিঠি, না সাক্ষাত। লোকটা যেনো ঘাপটি মেরে কোথাও পালিয়ে গিয়েছিলো। তাই পিউ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অভিমানী কন্ঠে বললো,
– তা মহারাজ কোন রাজকার্যে ব্যাস্ত ছিলেন শুনি! একেবারে তো আমাবস্যার চাঁদ বনে গিয়েছিলেন৷
– মহারানীর বুঝি গোসা হয়েছে?
আদুরে গলায় প্রশ্ন করলো নীলাদ্রি। পিউ মুখটা ভেংচি কেটে বললো,
– নাহ! আমি ফাউ লোকের উপর গোসা টোসা করি না।
– আহা! রাগ করো না প্রিয়। তোমার কার্যেই ব্যাস্ত ছিলাম। তোমার ভুড়িয়াল মামু আমাকে যাহা কার্য দিয়েছিলো….
– খবরদার আমার মামুকে নিয়ে উলটাপালটা কথা বলবেন না। রেগে যাবো কিন্তু।
চোখ রাঙ্গিয়ে কথাটা বললো পিউ। নীলাদ্রি হাসতে হাসতে বললো,
– তা কি করবো বলতো? তোর মামু আমাকে যে মহান কাজ দিয়েছে তা শুনলে তোর মাথা ঘুরাবে।
– কি এমন কাজ দিয়েছে শুনি!
– তোর প্রেমিক খোঁজার কাজ
– কিহ!
– আজ্ঞে জ্বী। তার ধারণা তুই প্রেম করছিস, তাই আমাকে তোর স্পাই হতে বলেছে। একারণে আমি একটু আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলাম এই কদিন। তোর মামু পারে ও
– আচ্ছা আমরা মামুকে সত্যটা বলে দেই। তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যাবে।
– জ্বী না, তখন ঝামেলা মিটবে না৷ আরো বাড়বে। আমি বাবাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছিলাম। এও বলেছিলাম আমার আর তোর বিয়ের কথাটা যেনো খালুকে বলা হয়। বাবা সাফ মানা করে দিলেন। খালু আত্নীয়ের মাঝে সম্পর্ক পছন্দ করেন না। তিনি কখনোই তোর আর আমার সম্পর্ক মেনে নিবেন না। উলটো বাবার সাথেই সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলবেন। একারণে
– আমরা কি তবে আলাদা হয়ে যাবো?
কাঁপা স্বরে কথাটা বললো পিউ। তার মনে বিষাদের কালো ঢেউ সব উথাল পাথাল করে দিচ্ছে। ঝাঝালো যন্ত্রণাতে বুক জ্বলছে। নীলাদ্রি মেয়েটার চুপসে যাওয়া উদাস মুখটা আলতো হাতে তুলে ধরলো। ম্লান গলায় বললো,
– দরকার হলে পালিয়ে যাবো। কিন্তু বিয়ে তো তোকেই করবো। তুই চিন্তা করিস না৷ একটু আঙ্গুল বাঁকাতে হবে। তবে ঘি বের হবেই।
নীলাদ্রির আশ্বস্ত কন্ঠে পিউ এর মনটা খানিকটা হলেও শান্ত হলো। অজান্তেই লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে। আবার মামার সম্মানের কথাটাও তাকে ভাবাচ্ছে। নীলাদ্রি কি করবে পিউ এর জানা নেই। তবে অজানা কারণে তাকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে পিউ এর। মনে মনে আশ্বস্ত হচ্ছে তাদের কাহিনীর সমাপ্তিটা সুখময় হবে_________
পরদিন
সূর্য পশ্চিমে ঢেলে পড়ছে। স্নিগ্ধ কমলা আলো ঐন্দ্রিলার গায়ে আছড়ে পড়ছে। গাড়ি আপন গতিতে চলছে। গাড়ির গ্লাসটা নামানো। ঐন্দ্রিলা নামানো অংশটার উপর হাত রেখে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। ফলে তার চুল উড়ছে। তার দৃষ্টি বাহিরের সবুজ শ্যামলতায় ঘেরা প্রকৃতিতে আটকে রয়েছে। পাশে তার বর বসে রয়েছে অভ্র ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রিলার জানা নেই। তবে মনে সামান্য আশংকাটুকু নেই। সে জানে অভ্র কখনোই তার ক্ষতি করবে না। তার উত্তরের সন্ধ্যানে আসা। উত্তরগুলো তাদের সম্পর্কটাকে ভেঙ্গে দিতে পারে আবার চিরকালের জন্য জুড়ে৷ দিতে পারে। ঐন্দ্রিলা কোনো বাড়তি আশা নিয়ে আসে নি। আশা বাড়িয়ে হতাশ হতে চায় না সে। গাড়িটা থামলো। অভ্র গাড়ি থেকে নেমে ঐন্দ্রিলার পাশের দরজা খুলে দিলো। ঐন্দ্রিলা ও গাড়ি থেকে নামলো। জায়গাটা কোনো নদীর পাড়। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। ঐন্দ্রিলা খেয়াল করলো সেখানে একটা চায়ের টং আর ডাবের ঠেলা ব্যাতীত কিছু নেই। অভ্র ঐন্দ্রিলাকে ঘাসের দিকে ইশারা করে বসতে বললো। তার মিনিট বিশেক বাদে দুটো ডাব কিনে আনলো সে। ঐন্দ্রিলার হাতে ধরিয়ে বললো,
– এই ডাবগুলো বেশ মিষ্টি হয়। পানিটা খাও ভালো লাগবে।
ঐন্দ্রিলা স্ট্র তে ঠোঁট লাগালো। সত্যি দারুণ পানিটা। একেবারে ঠান্ডা, মিষ্টি৷ নদীর পাড়ে বসে ডাব খাবার আনন্দ সে অনুভব করতে পারছে। শীতল বাতাসে, কোনো দূষিত কনা নেই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে কোনো বাঁধা নেই। ঐন্দ্রিলা যখন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো অভ্র তখন সুগাঢ় দৃষ্টিতে ঐন্দ্রিলাকেই দেখে যাচ্ছিলো। তার পিপাসু নজর পাঁচদিনের পিপাসা মিটাচ্ছে। ধীর কন্ঠে বললো,
– কোনো প্রশ্ন করবে না?
– করবো তো! কতো প্রশ্ন জমেছে জানেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বলে ঐন্দ্রিলা। তখন ঠোঁটের কোনে হাসি একে অভ্র বলে,
– আন্দাজ করতে পারছি। জানো এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। কিন্তু জায়গাটার খোঁজ আমি লাগাই নি। এই জায়গায় আমাকে জ্যানি প্রথম নিয়ে এসেছিলো……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি