#স্বপ্নছায়া
#২২তম_পর্ব
৩০ নভেম্বর, ২০১৭
বাবাকে আজ সত্যটা খুলে বলেছি। বাবা প্রথমে হেসেছেন। তারপর আমাকে চড় মারলেন। উনার দোষ নেই, যেকোনো পিতাই এই কাজটি করবেন। মেয়ে অপরাধ করেছে। শুধু অন্যধর্মী ছেলেকে ভালোই বাসে নি, তার বাচ্চার মা হতে চলেছে সে। আমার ভয় হচ্ছে। উনি হয়তো আমার বেবিকে বাঁচতে দিবেন না। আমার খুব ভয় হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে আমার এবোর্শন করাবেন তারপর বিয়ে দিবেন, কথাটা শোনার পর থেকেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। সে রাতে আমি অভ্রকে না বলেই বাংলাদেশ ত্যাগ করি। অনেকে বলবে, আমি কেনো তার সাথে থাকি নি। সত্যি বলতে, ইচ্ছে তো ছিলো। ছেলেটাও আমাকে হয়তো নিজের কাছে আটকে রাখতো। কিন্তু আমি ই চাই নি। কারণ আমি ওর দূর্বলতা হতে চাই নি। যে মানুষটাকে ভালোবেসেছি সেই মানুষটাকে প্রতি নিয়ত লড়তে দেখতে চাই নি। এলকোহল জিনিসটা একবার সেবন করলে সেটা এক অন্য অনুভূতির জন্ম দেয়। ভালো এবং খারাপের মিশ্রণে মানুষের হৃদয় পুলকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু একটা মানুষ যখন প্রতিনিয়ত সেই এলকোহলে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় তখন সেই এলকোহল তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমি অভ্রের জীবনের কাল হতে চাই নি। কয়েক মাসের আন্তরিকতাটা বা মোহ তার সারা জীবনটাকে এলোমেলো করে দেবে। ওর একটা ভবিষ্যৎ আছে। সেও সুখী হবার দাবীদার। আমি চাই, ও আমাকে ভুলে যাক। বিষাধের সুধা নাহয় আমি ই পান করি।
৭ ডিসেম্বর, ২০১৭,
আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। আগামীকাল যখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে তখন আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাবো। হ্যান্ড ব্যাগে একটা জামা আর এই ডাইরিটা নিয়েছি। এই ডাইরিতে অভ্রের স্মৃতি। ওর সাথে কাটানো মূহুর্তের প্রমাণ রয়েছে। আমি চাই না সেটাকে হারাতে। যখন দূরের কোনো গৃহে একাকীত্বে জীবনের নির্বাহ করবো তখন এই ডাইরিটাই আমার জমাপুঞ্জি হবে, আমার চেতনা হবে। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একজন মা হিসেবে এটা যে আমার কর্তব্য। আমি কখনো বিয়ে করবো না। একা হাতে আমার সন্তানকে মানুষ করবো। আমি জানি আমার কষ্ট হবে, আমি হারবো, পড়বো, ব্যাথা পাবো, ছিন্নভিন্ন হবো কিন্তু থামবো না। ঈশ্বর আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিবেন, আমি তা পেতে নিবো। কিন্তু আমার সন্তানকে আমি ছাড়বো না। পাপি আমি, আমার সন্তান নয়।
এর পরের পাতাগুলো খালি৷ ২০১৭ সালের ডাইরিটা বন্ধ করলো ঐন্দ্রিলা। জ্যানিফারের জীবনের বাকি দুটো বছর পড়ার কৌতুহল তাকে দম নিতে দিচ্ছে না৷ সে কোনো গল্প পড়ছে না৷ একটি নারীর জীবন পড়ছে। যে নারী তার সর্বস্ব হারিয়ে নিজের সন্তানকে নিয়ে বাঁচার কথা ভাবছে৷ আচ্ছা অভ্র কেনো এই কয় মাসে জ্যানিকে খুজলো না? কেনো মেয়েটিকে সকল বাঞ্চনা একাই সহ্য করতে দিলো? মনে মনে অভ্রের উপর প্রচন্ড রাগ হলো ঐন্দ্রির। একটা পুরুষ এতোটা কাপুরুষ হয়? কামনার জন্যই কি সে ভালোবেসেছিলো জ্যানিকে? ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ব্যাতীত কিছুই করার নেই। কারণ জ্যানিফার এই দুনিয়াতে নেই।
ঐন্দ্রিলা ২০১৮ সালের ডাইরিটার তালা ভাঙ্গলো। ডাইরিটা খুলতেই একটা ছবি তার সামনে আসলো। তিনজনের পারিবারিক ছবি, দুজন মানব মানবী তার সদ্য জন্মানো বাচ্চাটিকে আগলে ছবি তুলেছে। তাদের মুখে কি চমৎকার হাসি। অদ্ভুত ব্যাপার এই তিনজনের দুজন জ্যানিফার এবং অভ্র। ঐন্দ্রিলা আন্দাজ করলো বাচ্চাটি হয়তো দিশান। কিন্তু তাকে ভাবাচ্ছে একটাই প্রশ্ন! দিশানের জন্মের সময় অভ্র কি সেখানে উপস্থিত ছিলো? উত্তর খুজতে পাতা উল্টালো ঐন্দ্রিলা। চোখ আটকালো ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে।
৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮,
আজ নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম। এই তিনটা মাস খুব কষ্ট গিয়েছে। সেদিন হাসপাতালে নেবার পথ থেকেই পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। বাবার নজরের আড়াল হতে কম ঝুঁকি নিতে হয় নি। পালানোর সময় বাবার অসহায় মুখখানা খুব মনে পড়ছিলো। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারি নি। কারণ আমি এখন একজন মা, মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য সকল বাধাকে হার মানায়, নিজের সর্বস্ব কে ত্যাগ করে। আমিও তাই করেছি, আমার পরিবারের মায়া ছেড়েছি, বাবার অঢেল ঐশ্বর্যকে ত্যাগ করেছি। চাইলে আমি এবোর্শন করে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারতাম, কিন্তু সেটা আমাকে ভেতর থেকে হারিয়ে দিতো৷ হয়তো আমি বিলাসীতা পেতাম, স্বচ্ছল জীবন পেতাম কিন্তু আমার ভেতরের মা, নারী হেরে যেতো। আমি তা হতে দিতে পারি না। এই তিনমাস ঠিক মতো তিনবেলা খাবার জুটাতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। বান্ধবীর সাহায্যে এই চাকরিটা পেয়েছি। এখন হয়তো আমার সন্তানের গ্রোথটা ঠিক মতো হবে। তিনমাসে তার গ্রোথ নেই বললেই চলে৷ খুব চিন্তায় থাকি, বাঁচাতে পারবো তো বাবুকে?
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮,
প্রতিদিন লিখতে ভালো লাগে না আমার। তাই আজকাল লেখা হয়ে উঠে না। আমার জীবনে স্মরণীয় মূহুর্ত ও চলছে না যে আমার না ডাইরিতে টুকতে হবে। তবে আজ লেখার কারণটা হলো বাবু। আমার বাবুটা তার উপস্থিতি আমাকে জানাচ্ছে। প্রতি নিয়ত মর্নিং সিক, মাথা ঘুরানো আমাকে অনুভব করায় সে আছে। তবে অভ্রকে খুব মিস করি। ক্যানাডাতে সিঙ্গেল মম এর কমতি নেই। তাই ব্যাপার গুলো ততোটা ম্যাটার করে না। তবুও এই মূহুর্তে ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকাটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা একমাত্র গর্ভবতী নারী ই বলতে পারে। আমি ক্ষণে ক্ষণে কাঁদি, আমার খুব ইচ্ছে করে টক জাতীয় সব খাবার খেতে, খুব ইচ্ছে হয় ক্যারেমেল ডোনাট খেতে, আমার রাগ হয়, হাসি পায়, অভিমান হয়। কিন্তু আফসোস সেগুলোকে দেখার কেউ নেই। নিজের পিঠে নিজেই চাপড়িয়ে মন কে শান্ত করি।অভ্র, তুমি যদি পাশে থাকতে! এই চাওয়াটা কি খুব বেশি কিছু?
১৯ এপ্রিল, ২০১৮,
আমি স্তব্ধ। আমি পুলকিত। আমি আশংকিত। যে অতীতকে সাত মাস পূর্বে বাংলাদেশে ছেড়ে এসেছি সে আমার সামনে। ঈশ্বর আমাকে এতোটা পরীক্ষার মুখোমুখি কেনো করছেন! হ্যা, অভ্র ক্যানাডাতে। আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এটা অনেকটাই সিনেমেটিক, গভীর বিচ্ছেদ বাদে নায়ক নায়িকা মুখোমুখি। কিন্তু বাস্তবটা সিনেমা নয়। আমি পারি নি, পারি নি “প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস” এর এলিজাবেথের মতো অভ্রকে জড়িয়ে ধরতে। বরং কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছি। আমার বাড়তি পেটটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অভ্র। তার চুপসে থাকা অসহায় মুখখানা আমার ভেতরে লাভার জন্ম৷ দিচ্ছিলো। আমি ভেতরটা পুড়ছিলো। আমি সত্যি জানি না ও কি ভাবছে। তবে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি নি।
৩০ এপ্রিল, ২০১৮,
আর পালাতে পারলাম না। ভালোবাসার মায়াজালে আমাকে জড়াতেই হলো। অভ্রকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ছেলেটা সত্যি পাগল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস পরেছিলাম, “দেবদাস”। আজ যেন তাকে সচোখে দেখলাম। এই সাতমাসে কতোটা পালটে গেছে সে। তার যৌবনের এই ঝলকানি আর নেই। এখন সে কোনো একজন যুবক থেকে পুরুষে রুপান্তরিত হয়েছে। তার মাঝে যেনো কোনো শান্ত নদী ভর করেছে। একটা পুরুষ কোনো নারীকে কতোটা ভালোবাসতে পারে যে সেই নারীর অস্তিত্ব মুছে গেলেও সে তাকে হৃদয়ে আগলে রেখেছে। সে আমাকে জড়িয়ে হু হু করে উঠেছিলো। তার তপ্ত অশ্রু আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছিলো। অবাক হলাম এটা জেনে অভ্র মানসিকভাবে এতোটা আসক্ত হয়ে গিয়েছে যে চিকিৎসা করাতে কানাডা এসেছে। এই পাগল ছেলেটাকে নিয়ে সত্যি আর পারলাম না। তাই শত চেষ্টার পর ও আমি তাকে ফিরালাম না। একটু স্বার্থপর হওয়া কি অন্যায় হবে!
৭ মে, ২০১৮,
আমার বাবু আজ প্রথম লাথি মেরেছে। বাবার স্নেহ অনুভব করে সেও বাড়ছে। সে কতোটা খুশি তার বেড়ে ওঠাই তার প্রমাণ। অভ্র অনেকটা স্টেবল, এখন আর পাগলামি করে না বললে ভুল হবে৷ কারণ তার সকল পাগলামি আমাকে নিয়ে। সে ঠিক করেছে আমাকে বিয়ে করে বাংলাদেশে নিয়ে যাবে। আমাদের বাবু হবার পর আমরা বিয়েটা করবো। তবে আমাকে না বললেও আমি জানি সেটা হবে না। কারণ অভ্রের মা-বাবা সন্তানকে মেনে নিলেও আমাকে মানতে পারবেন না। সমাজ নামক গন্ডির কাছে নতুন চিন্তাধারা রাখলে সেটা জুতোর তলে দাবিয়ে দেওয়া হয়। তারা তো সমাজেই থাকেন। তাই এই গন্ডি তারা পার হবেন না। অভ্র আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে, আমাদের ও একটা পরিবার হবে। কিন্তু আমার হৃদয় যে সায় দেয় না। জানি না পরিনাম কি হবে!
৭ জুন,২০১৮,
আমার কোলে ঈশ্বর একটা ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন। হ্যা, আমার কাছে ফেরেস্তা। কারণ কোনো মা ই তার সন্তানকে অবৈধ বলতে পারে না। এটা সমাজের একটা শব্দ। আমার কাছে আমার সন্তান অবৈধ নয়, সে কেবল ই আমার সন্তান। আমার সন্তান দেখতে একেবারে আমার মতো হয়েছে। শুধু চুল আর চোখ গুলো অভ্রের। তিনদিন আগে দুপুরে আমার লেবার উঠে, অভ্র পাগল হয়ে যায়। পাগলামী করতে দেখে ভালো লাগছিলো। সিজারে প্রিম্যাচ্যুর বেবি হয়েছে আমাদের। আমার যতক্ষণ জ্ঞান ছিলো আমি অবাক নয়নে তাকে দেখছিলাম। বাবুকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো কাঁদছিলো। এই নিয়ে দু দফা আমার পাগল লোকটা কাঁদলো। তবে আমি জানি সে কতোটা খুশি। আমাকে নিয়েও যে সে চিন্তায় ছিলো না তা কিন্তু নয়। কিন্তু অশ্রুমুক্তি সন্তানকে কোলে নিতেই হয়েছে। আজ লেখার আরেকটা কারণ আছে। আমরা৷ আজ বিয়ে করেছি। আমি আমার ধর্ম বদলে ইসলাম অনুযায়ী বিয়ে করেছি। কারণ যে মানুষটাকে ভালোবাসি তার ধর্মকে ভালোবাসবো না তা কি হয়! যে মানুষটা কখনো আমার ধর্মের অসম্মান করে নি, সেই মানুষটার জন্য কি তার ধর্মকে আপন করতে পারবো না। আর ঈশ্বর তো এক জন ই! যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। সুতরাং তাকে জিজাস ক্রাইস্ট বলি বা আল্লাহ একই তো হবে। আমি জানি আমি ভুল করি নি। আমার মনে কোনো আফসোস নেই।
৪ অক্টোবর, ২০১৮,
সুখ জিনিসটা একটা নেশার মতো। যত পাই আরোও চাই। এই কয় মাস এতোটা সুখ কুড়িয়েছি যে এখন সেটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই ভাগ্যের নির্মমতাকে মেনে নিতে পারছি না। পারছি না আল্লাহ এর শাস্তিকে মাথা পেতে নিতে। আমি পাপি, শাস্তি যে আমাকে পেতে হবে আমি জানতাম। কিন্তু ইহজীবনে পেতে হবে মানতে পারি নি। জীবনে অভ্রের পুনরায় আগমনের পর আমার জীবনের মানেটাই যেনো বদলে গিয়েছিলো। জীবন যে কতোটা সুখময় হতে পারে সেটার অনুভূতি অভ্রের সাথে কাটানো মূহুর্তে পেয়েছি। তিনজনের ছোট পরিবার টরেন্টো তে একটা ছোট দুনিয়া বানিয়ে ফেলেছিলাম। অভ্রের মা-বাবার অমতে বাংলাদেশে ফেরাটা আমাদের হয় নি। তাই আমরা আমাদের অতীতকে ছেড়ে ভবিষ্যতের দিকে পা রেখেছিলাম। এই খানে ছিলাম মাত্র তিনজন। আমি, দিশান এবং অভ্র। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেলো। পাপ কখনোই ব্যাক্তিকে ছাড়ে না। তাই তো আমার শাস্তিটাও আমাকে পেতে হচ্ছে। আমার লাঙ ক্যান্সার ধরা পরেছে। আমি তো সিগারেট খাই নি, এলকোহল ছুই নি। তবে কেনো এমন টা হলো। আমার দিশানকে দুধ খাওয়াতে পারছি না। ছেলেটা দুধের শিশু। আমার কিছু হয়ে গেলে কিভাবে বাঁচবে সে? আর অভ্র! ও পাগল হয়ে যাবে। যেমনটা আগে হয়েছিলো। এই দুজন তো অন্ধকারে ঢুবে যাবে। ঈশ্বর, আল্লাহ আমার পাপের শাস্তি এদের দিও না। দিও না।
৯ নভেম্বর, ২০১৮,
আমি লিখছি, হ্যা আমি লিখছি। কারণ এ ব্যাতীত কাজ নেই। টরেন্টোর ভালো ভালো ডাক্তার আমাকে হয়তো বাঁচাতে পারবে না। কারণ আমার শরীরে যে উইপোকা ধরেছে তা আমাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিবে। অভ্র তার সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছে আমাকে বাঁচাতে। সে একা হাতে বাবুকে সামলাচ্ছে, আমাকে সামলাচ্ছে। পানির মতো অর্থ ঢালছে। কিন্তু আমি জানি তাতে লাভ নেই। ছেলেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটা সময় ঠিক বুঝতে পারবে যখন আমি আর থাকবো না। আমার শ্বাসকষ্ট হয় খুব। তাই আজ আর লিখবো না।
২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮,
বাইরে স্নো পড়ছে। চেরি গাছটাতে প্রচুর স্নো জমেছে। আমি হাসপাতালের জানালার ধারে বসে আছি। নিজেকে কবি কবি মনে হচ্ছে। নাকে নোজাল ক্যানোলা, পাশে অক্সিজেনের সিলিন্ডার। হাতে কলম আর ডাইরি। বছরটা শেষ হতে যাচ্ছে। আমার জীবনের দিনগুলোও শেষ হতে যাচ্ছে। ডাক্তার জানিয়েছে আমি নাকি আর কিছুদিনের মেহমান। অভ্র বিশ্বাস করে নি। তার ধারণা ডাক্তার জানে না কিছু। খুব কষ্ট লাগে। বাবুকে কোলে নিতে পারছি না তাই। ছোট্ট দিশানটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। ভাবে তার মা কতোটা স্বার্থপর। আমি কি সত্যি স্বার্থপর!
১ জানুয়ারি, ২০১৯,
অভ্রের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। তুমুল ঝগড়া। ছেলেটা পানির মতো টাকা খরচ করছে। পাগলের মতো আচারণ করছে। বারবার বুঝালাম, আমি মৃত্যুর দিকে আগাচ্ছি। অযথা এসব করো না। যতদিন আছি থাকি না, স্বাভাবিক মানুষের মতো। কেনো ক্যামো দিতে হবে। ক্যামো দিলে সুস্থ হবো না আমি। বরং আরো তাড়াতাড়ি মারা যাবো। আমার ছেলেটাকে বড় হতে দেখা হলো না। আচ্ছা আমার অবৈধ ছেলেকে কি কেউ ভালোবাসবে? তাতে নাক সিটকাবে? কেউ কি আমার মতো ওকে বুকে জড়িয়ে নিবে?
৮ মে, ২০১৯,
লিখাটা এলোমেলো হচ্ছে। কলম ধরতে পারছি না। তবুও আমি লিখবো। আমি জানি এর পরের পাতা গুলো ফাঁকা থাকবে। আমাকে ক্যামো দেওয়া হচ্ছে, অহেতুক পার্থিব শরীরটাকে অত্যাচার করা হচ্ছে। অভ্রকে দোষ দিবো না, সে তো তার কথা রাখার চেষ্টা করছে। আমাদের কাহিনীর পূর্নতার দেবার চেষ্টা। ছেলেটা রোজ আমার পাশে বসে থাকে, ক্লান্ত শরীর, ভেজা চোখ, হাতে “নোটবুক” উপন্যাস। আমার কষ্ট হয় ওকে এভাবে দেখতে। আমি শেষ পর্যন্ত ওর কাল হয়ে গেলাম। আমাকে ভালোবাসাটা ওর জীবনের অভিশাপ হয়ে গেলো। ঈশ্বর আমাদের এই অবৈধ ভালোবাসার শাস্তি দিচ্ছেন। আমার শাস্তি তো কিছুদিনে অন্ত হবে কিন্তু অভ্র ও সারাটা জীবন এই গ্লানি বয়ে নিবে। আমাকে জরিয়ে ধরে কাঁধে। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেই। কিন্তু কিছু বলতে পারি না। আমার অসুন্দর মুখে ঠোঁট ছুয়ে বলে,
“জ্যানি, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমার খুব কষ্ট হবে। সাত মাস তোমাকে ছাড়া আমি পাগল হয়ে ছিলাম। তুমি ব্যতীত আমি যে অসহায়।”
কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারি না। কারণ আমি কথা বলা শক্তি আমার নেই। ঈশ্বর আমার অভ্রকে তুমি আর কষ্ট দিও না। ও যে একটা সামান্য মানু্ষ। প্রিয়জন হারানোর বেদনা যে ওকে নিঃস্ব করে দিবে। কাউকে ভালোবাসতে গেলে ভয় পাবে। ও যে ওর কথা রেখেছে। আমি ই শুধু স্বার্থপরতা দেখিয়েছি। আমাকে আরেকটু বাঁচতে দাও এই পুরুষের জন্য, আমার সন্তানের জন্য। আর যদি আমাকে নিয়েও যাও তবে কাউকে পাঠিও যে ওদেরকে বুঝবে। ওদেরকে আগলাবে।
ডাইরির পরের পাতাগুলো ফাঁকা৷ শেষ লেখাটা পড়তে খুব কষ্ট হয়েছে ঐন্দ্রির। লেখাগুলো অস্পষ্ট ছিলো। বোঝাই যাচ্ছে জ্যানিফারের কতোটা কষ্ট হয়েছে। তবুও সে লিখেছে। ঐন্দ্রি খেয়াল করলো তার গাল ভিজে আছে। ডাইরিটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ হু হু করে কাঁদলো সে। এখন ভোর চারটা। দিশান গভীর ঘুম। ওর পাশে বসে ওর কপালে হামি দিলো সে। এরপর মোবাইলটা হাতে নিলো। ফোন করলো একটা নাম্বারে। তিনবার বাজার পর ফোনটা রিসিভ হলো। কাঁপা স্বরে ঐন্দ্রি বললো,
– অভ্র………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি