স্বপ্নছায়া,পর্ব:১৯

0
404

#স্বপ্নছায়া
#১৯তম_পর্ব

বিকেল ৪টা,
খা খা রোদে ঢাকা শহর ঝাঝরা হয়ে যাচ্ছে। আকাশে একদল কালো মেঘ ভিড় করেছে কিন্তু তাদের মতিগতি আজ ভালো না। তারা শুধু দল বেধে ঘুরে বেড়াবার মতলব ই এটেছে। ক্ষণে ক্ষণে গরম বাতাস বইছে। তাতে গরম কমার বদলে আরোও বেশি গরম লাগছে। এই উত্তপ্ত গরমে রাস্তার ধার দিয়ে হেটে যাচ্ছে নীলাদ্রি এবং পিউ৷ পিউ শাড়ির কুঁচিটা বেশ সুন্দর করে ধরে হাটছে৷ গরম লাগছে কিন্তু হাটতে বিরক্ত লাগছে না পিউ এর। পিউ এর হাতটা এখনো নীলের হাতের মুঠোয় রয়েছে৷ নীলাদ্রি খুব আগলে আগলে হাটছে। হাটতে হাটতে হঠাৎ পিউ হাতটা ছাঁড়িয়ে নিলো নীলাদ্রির হাত থেকে। পিউ এর এরুপ কাজে কিছুটা নীলাদ্রি বেশ অবাক হলো৷ পাশে তাকাতেই দেখলো পিউ পাশে নেই। নীলাদ্রি হন্যে হয়ে পিউ কে খুজতে লাগলো৷ পাগলের ন্যায় রাস্তায় ছুটতে লাগলো। তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো। একটু আগেও তো মেয়েটা তার পাশেই ছিলো। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে হাত ছাড়িয়ে মেয়েটা কোথায় চলে গেলো। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ পা জোড়া আটকে গেলো তার। রাস্তার অপজিটে একটা ফুচকা ওয়ালা ফুসকা বেঁচছে। তার ঠিক সামনে একটা নীল শাড়ি পড়া নারী মোহনীয় ভাবে ফুসকা খাচ্ছে। ফুসকার ঝালে তার ফর্সা নাক এবং মুখ লাল হয়ে উঠছে। চোখ থেকে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে তবুও তার খাওয়া থামছে না। হৃষ্টচিত্তে মুখে পুড়ছে ঝাল ঝাল ফুসকা। পিউকে দেখে যেনো জানে পানি এলো নীলাদ্রির। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো৷ হাটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগলো সে। এক ছুটে পিউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ হুট করেই একজন আখাম্বার মতো মানুষ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আতকে উঠে পিউ৷ হাতে থাকা ফুচকা টা টুপ করে প্লেটে পড়ে যায়। মাথা তুলে নীলাদ্রি লাল হয়ে থাকা চোখ দেখে গলা শুকিয়ে যায় পিউ এর৷ শুকনা ঢোক গিলে বোকা হাসি হেসে বলে,
– খাবেন?
– হু, খাবো তো! তোকে আস্তো চিবিয়ে খাবো। আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো আমার। কিন্তু ম্যাডামের কি সেই খেয়াল আছে, তার তো পেটপুজো করতে হবে।

নীলাদ্রির হুংকারে খানিকটা চুপসে গেলো পিউ। মাথা নিচু করে বললো,
– আসলে ফুচকা দেখে লোভ সামলাতে পারি নি। আপনাকে বলতাম, কিন্তু ফুচকা মামা চলে যাচ্ছিলেন। তাই বলার সুযোগ পাই নি। সরি।

নীলাদ্রি চুপ করে আছে। কোনো সারা না পেয়ে মাথাটা তুলে পিউ। তখন নীলাদ্রি যা করলো তার চিন্তার বাহিরে৷ রাস্তার মাঝে, শত লোকের ভিড়ে সে আচমকা পিউ কে জড়িয়ে ধরলো। পিউ এর কাধে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
– ভয় পেয়েছিলাম, ভেবেছি তোকে বুঝি হারিয়ে ফেললাম! আমার দম বন্ধ লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি মরে গেলাম। তুই এতোটা অবুঝ কেনো! কেনো বুঝিস না আমাকে! ভালোবাসি তো, তাই হারয়ে ফেলার ভয় ও পাই!

পিউ তাকে বাঁধা দিলো না। লোকটা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে, পিউ এর মনে হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তার নীলাদ্রিকে বাধা দিতে ইচ্ছে করছে না। যতই হোক এই পাগল লোকটাকেই অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছে সে। যতই হোক এই পাগল লোকটাই তার প্রেমিক৷ এই পাগল লোকটার এই পাগলামি ই তাকে বিভোর করে রাখে। পিউ প্লেট টা এক হাতে রেখে অন্য হাতে নীলাদ্রির পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে লাগলো সে আছে, সে ঠিক আছে। মুচকি হেসে মনে মনে বললো,
“বুঝি তো! তাই তো এই খচ্চর, রাগী, অসহ্যকর, পাগল লোকের প্রেমে পড়ে গেছি। এই প্রেমজাল থেকে যে আমার মুক্তি নেই” ___________

১০.
মাথার উপর ফ্যানটা ভনভন করে ঘুরছে। আহাশের দৃষ্টি ফ্যানের দিকে। গা টা খাটের উপর এলিয়ে রেখেছে। হাতটা বিছানার বাহিরে। তার দু আঙ্গুলের মাঝে একটি জ্বলন্ত সিগারেট জ্বলছে। ধীরে ধীরে এই সিগারেটের লাল আভাটা সিগারেটটিকে ছাই এ পরিণত করছে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে তার চিন্তায় মগ্ন। চিন্তাগুলো বেশ এলোমেলো।যেকোনো এক চিন্তাতে স্থির হতে পারছে না সে। অবশ্য তার জীবনটাও এলোমেলো হয়ে আছে। বাসায় ফিরেছে আজ দশ দিন হয়ে গেছে। ভেবেছিলো বাসায় আসার পর জীবনটা আগের মতোই থেকে যাবে। কিন্তু তেমনটা হয় নি। রুম থেকে বের হলেই ঐন্দ্রিলার সাথে তার দেখা হয়। ঐন্দ্রিলা তার দিকে চেয়ে বিনয়ের হাসি দেয়। তার হাসিমুখটা দেখে গ্লানিতে মাথা নত হয়ে যায় আহাশের। ঐন্দ্রিলার সাথে দু-তিনবার কথা বলার ও চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ঐন্দ্রিলা একবারো সেই সুযোগ তাকে দেয় নি। প্রতিবার এড়িয়ে গেছে। শওকত সাহেব এখনো তার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন না। কথায় কথায় তার অপারগতার খোঁটা খেতে হয় আহাশকে। আহাশের পরিণতি এমন যে, সে কারোর সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারে না। একটা সময় সে যে কাউকে পছন্দ করেছিলো বা কাউকে নিজের মনোমন্দিরে জায়গা দিয়েছিলো সেটাই সে ভুলতে বসেছে। হাতে গরম অনুভুতি হতেই চিন্তার ঘোর কাটে তার। সিগারেট টা এশ ট্রে তে ফেলে দিলো। নতুন একটা নিকোটিনের দলায় আগুন জ্বালালো সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অপদার্থ মনে হচ্ছে। ছাব্বিশ বছরের জীবনে তার হাতে গোনা তিনটি এচিভমেন্ট আনলোক হয়েছে তার, এক. সে তার পড়াশোনা শেষ করে জার্মানীতে ভিসা পেয়েছে। দুই. সে বিয়ের দিন সন্ধ্যায় বিয়ের ভয়ে পালিয়ে গেছে। তিন. একজন প্রতারক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে নিজের সর্বোচ্চ খুইয়ে এখন বাবা এবং ভাইয়ের উপর খাচ্ছে। আহাশের চিৎকার৷ করে নিজের ভেতরের আগুনটাকে বার করছে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সেটা করলে সবাই তাকে পাগল ভাববে। তাই চরম অপারগতার প্রমাণ দিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের ফুসফুস জ্বালাতে লাগলো।

মেঝেতে বই এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। বই এর শেলফটা আজ পরিষ্কার করেই দম নিবে ওন্দ্রিলা। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হয়েছে। বই কিনতে হচ্ছে অসংখ্য। এবার এম.বি তে ভর্তি হয়েছে ঐন্দ্রি। লক্ষ্য খুব ভালো রেজাল্ট করে যে কোনো ব্যাংকে জবের জন্য এপ্লাও করা। বর্তমানে মেয়েদের জন্য ব্যাংকিং এবং টিচিং এরিয়াটা প্রফেশন হিসেবে সর্বোত্তম। সেখানে নিজের যোগ্যতা অনুসারে তারা নিজেকে এগিয়ে নিতে পারে, শুধু তাই নয় সেফটির ব্যাপারটা ও যথেষ্ট ভালো থাকে। ঐন্দ্রির ও ইচ্ছে একটা ভালো সরকারি ব্যাংকের জব পাওয়া। সে শুধু মিসেস অভ্র চৌধুরী হিসেবে থাকতে চায় না। আত্ননির্ভরশীল হওয়াটাই তার লক্ষ্য। তাই পড়াশোনার গতি প্রথম থেকেই বাড়িয়ে রেখেছে। অভ্রের শেলফটাতে বিয়ের পর থেকে কখনো হাত দেওয়া হয় নি ঐন্দ্রিলার। এই প্রথম নিজের বইগুলোর জন্য জায়গা করতেই এই কান্ড। অভ্রের যখন বই, ফাইল এক এক করে নামাচ্ছে সে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস থাকলে সেটার স্থান হবে একটা লেক্সাসের কার্টুন৷ আসন গেড়ে মাটিতে বসলো ঐন্দ্রিলা। এই এক মাসে অভ্রের অভ্যাস এবং স্বভাব ভালোভাবেই রটা হয়ে গেছে ঐন্দ্রিলার। অভ্র কোন বই গুলো পড়ে এবং কোন বই গুলো অহেতুক পড়ে পড়ে ধুলো খায় তা ঐন্দ্রিলার জানা। একে একে সকল বই পত্র গুলো দেখতে শুরু করলো সে। হঠাৎ তিনটি খয়েরি মলাটের ডাইরি হাতে পড়লো ঐন্দ্রির। ডাইরিটি খুব চমৎকার দেখতে। মোটা খয়েরি কালারের মলাট, উপরে গোল্ডেন ইটালিয়ান ফন্টে “2017”, ” 2018″, “2019” লেখা। ঐন্দ্রি পাতলা কাপড়টা দিয়ে ডাইরিগুলোর উপরের ধুলো সরিয়ে দিলো। ধুলো সরালেই সেখানে ছোট করে সোনালি রঙের ইটালিয়ান ফন্টে “Do not look” লেখাটা দেখতে পেলো। ডাইরিগুলো লক সিস্টেম। খুব চমৎকার খয়েরি রঙ্গের তালা ঝুলছে ডাইরিটিগুলোর গায়ে। যেহেতু এটা অভ্রের বই ফাইলের ভেতর পাওয়া গেছে তাই বলা যেতেই পারে ডাইরিটি অভ্রের। কিন্তু অভ্রের চরিত্রের সাথে ডাইরি লেখার ব্যাপারটা ঠিক যায় না। ডাইরিটাকে উলটে পালটে খুলে দেখার পৈশাচিক সুপ্ত লালসা ঐন্দ্রির মনে উঁকি দিতে লাগলো। মানুষের সর্বদাই “না” শব্দের প্রতি আকর্ষণ বেশি। বারণ করা যেকোনো কাজ করার ইচ্ছে যেনো প্রবল হয়ে যায়। কোথাও যেতে বারণ করলে মানুষ সেটা আরোও বেশি করবে।কোনো কাজ করতে মানা করলে সেটা আরোও বেশি করে করলে। ঐন্দ্রিলার ক্ষেত্রেও তাই হল। ডাইরির “Do not look” এবং তালাটি৷ তাকে নিজের দিকে বেশি আকর্ষণ করছে। তাই একটা পেপার ওয়েট দিকে প্রথম ডাইরিটির তালাটা সে ভেঙ্গে ফেললো। ডাইরিটি খুলতেই একটা ছবি তার সামনে আসলো। ছবিতে তিনজনকে দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়েকে পেছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে একটি ছেলে। ছবির ছেলেটিকে ঐন্দ্রিলা চিনে। কারণ এই ছেলেটি তার স্বামী। কিন্তু তার পাশের মেয়েটিকে সে চিনে না। তবে আন্দাজ করতে খুব একটি কষ্ট হলো না তার। শ্বেত বর্ণের গোলগাল চেহারা মেয়েটির। অনেকটাই দিশানের মতো। চুল গুলো ব্রাউন কালার। অনেকটা ডায়েরির রঙ্গের। মেয়েটির সবথেকে সুন্দর তার মনোমুগ্ধকর হাসি। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব খুশি। ঐন্দ্রিলা বুঝতে পেরেছে এই ডাইরিটা কার। এটা জ্যানিফারের ডাইরি। তাইতো, অভ্র শেলফে গুছিয়ে রেখেছে ডাইরিগুলো। কিন্তু এতোটা অযত্নে কেনো রেখেছে সেই উত্তরটা ঐন্দ্রি পাচ্ছে না। ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি তো সযত্নে রাখে মানুষ। তবে জ্যানির ডাইরিগুলো এভাবে ধুলো লেপ্টানো কেনো। ঐন্দ্রিলা পাতা উল্টায় ডাইরির। পাতা উল্টিয়ে বেশ অবাক হলো ঐন্দ্রিলা। ডাইরির প্রতিটা পেজে কিছু না কিছু লেখা। ইটালিয়ান ফন্টে ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখা। সকল লেখা ইংরেজি তে। লেখা গুলো বাংলা করলে যা দাঁড়ায়,

৮ জানুয়ারি, ২০১৭
আজ আমি বাংলাদেশে ল্যান্ড করেছি। বাংলাদেশ খুব ঘনবসতি দেশ, এখানে ঠান্ডা ও ততোটা নয়। তবে এখানের মানুষেরা অনেক অদ্ভুত।

৯জানুয়ারি, ২০১৭
আজ আমি সকালে এখানের বিখ্যাত মালাই দেওয়া চা খেয়েছি। আমার শরীরটা পুরো চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। ভেতর থেকে এক অদ্ভুত শিহরণ হয়েছে চা টা খেয়ে।

ঐন্দ্রিলা খেয়াল করলো প্রতি পেজেই দু-তিনটা লাইন করে লেখা। ঐন্দ্রিলা একের পর এক পেজ উল্টাতে লাগলো। হঠাৎ একটা পেজে আটকে গেলো।

৩১শে আগষ্ট, ২০১৭
আজ আমি প্রেমে পড়েছি। হ্যা, আমি প্রেমে পড়েছি। প্রেম অনুভূতিটা এতোটা মধুর এটা আগে জানা ছিলো না। আমার মনে হচ্ছে আমি ধীরে ধীরে এই প্রেমের প্রতি আসক্ত হচ্ছি। কিন্তু এই প্রেমই যে আমার মৃত্যুর কারণ হবে এটা আমার জানা আছে………………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here