#স্বপ্নছায়া
#১৬তম_পর্ব
এর মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। আহানা ছুটে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই আহানা যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহানাকে অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভ্র তার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– কি রে জমে গেলি নাকি? কে এসেছে?
– আহাশ ভাইয়া
আহানার মুখে নামটি শোনা মাত্র জমে গেলো ঐন্দ্রিলা। নামটি তার পরিচিত। ব্রেইনের নিউরণ গুলো কাজে জুটে যায়। আঠাশ দিন পূর্বের নির্মমতা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। হৃদয়ের এক পাশে ছাইছাপা আগুনটা যেনো দপ করে জ্বলে উঠে। ঠিক আঠাশ দিন পূর্বে, এই ছেলেটার জন্যই ভরা মজলিশে তাকে নিজের দূর্ভাগ্যের পরিণতি দেখছে হয়েছিলো। সেদিনের বিদ্রুপের স্বরে লেপ্টে থাকা সান্ত্বনাগুলো আজ ও মস্তিষ্ক ভুলে নি।
সেদিন বিয়ের আসরে না এসে আহাশ চলে যায় অজানা কোনো ঠিকানাতে। এ বাড়ির লোকেদের ও জানায় নি কোথায় আছে। শওকত সাহেব খানিকটা রেগেই ছিলেন। তাই খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কিন্তু শারমিন বেগম ছেলের খোঁজ রেখেছেন। ব্যাপারটা ঐন্দ্রিলা আন্দাজ করেছিলো। কিন্তু কখনো কিছু প্রকাশ করে নি। মা তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করবে, তাকে ফোন করবে এটা নিরন্তন সত্য। সেটাকে বদলানোর সাহস বা ইচ্ছে ঐন্দ্রিলার নেই। কারণ এই কষ্ট তার একান্তের, অন্যকে টেনে সমোবেদনা পাবার আশা তাই নেই। ঐন্দ্রিলা বিয়ের রাত থেকেই মনকে শক্ত করে রেখেছিলো। আহাশের সাথে না চাইতেও একটা পারিবারিক সম্পর্ক বাঁধা পড়েছে সে। ভাবী রুপে হয়তো আমরণ আহাশের সাথে এই সম্পর্কটা থেকে যাবে তার। শওকত সাহেব যতই হোক পরের মেয়ের জন্য নিজের রক্ত, মাংসকে আজীবন পরিত্যক্ত করবেন না। অভ্র তার অনুজকে কখনোই নিজের জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলবে না। এটা করলে ঐন্দ্রিলা সর্বদা একটি পরিবার ভাঙ্গার দায়ে দায়ী থেকে যাবে। তাই নিজের মনকে সর্বদা প্রস্তুত রেখেছিলো সে, যেদিন আহাশের মুখোমুখি হবে সেদিন ভেঙ্গে পড়বে না। ভুলে যাবে সেদিনের ঘটনা, ভুলে যাবে এই মানুষটা তার চামড়া রঙ্গের কারণে তাকে ভরা মজলিশে একা রেখে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু আজ যখন তার সামনে লোকটা বসে রয়েছে তখন সেলুলয়েডের রিলের মতো একের পর এক দৃশ্য গুলো তার চোখের সামনে ভাসছে। চোখের জমা স্রোত যেনো নিজেকে মুক্ত করতে ব্যাস্ত। হঠাৎ অনুভব করলো একটা উষ্ণ হাত তার হাত চেপে রেখেছে। পাশে ফিরতেই দেখলো, অভ্র চোয়াল শক্ত করে তার হাত চেপে বসে রয়েছে। দিশান এখনো তার গলা জড়িয়ে কাধে মাথা রেখে চুপটি করে বসে রয়েছে। এটাই তো তার পরিবার, তার নতুন পরিবার। তার বর্তমান, তার ভবিষ্যৎ। হৃদয়ের অতীতের কন্টকময় স্মৃতি গুলোর কালো মেঘ সরে যেতে লাগলো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো ঐন্দ্রিলা। নিজের মনকে শক্ত করতে হবে তার। ভেঙ্গে পড়লে সে তার পরিবারের জোরটাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে দিবে। এমনটা যে কখনোই হতে দিবে না ঐন্দ্রিলা। দিশানকে কোলে নিয়েই ভেতরের দিকে চলে যায় সে। অভ্র ও তার পেছন পেছন নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
আহাশকে নিয়ে খুব একটা আদিক্ষেতা দেখা গেল না। শওকত সাহেব কিংবা অভ্র ব্যাপারটায় নিজের খুশি প্রকাশ করলেন না। তবে শারমিন বেগম নিজের ছেলেকে পেয়ে অশ্রু ছেড়ে দিলেন। আহাশ আগের থেকে খানিকটা শুকিয়ে গেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়েছে। চোখ গুলো গর্তে চলে গেছে। এতোদিন সিলেটে বন্ধুর বাড়িতে ছিলো সে। সেদিন নিজের দায়িত্ব থেকে ভবিষ্যতের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো সে। চাইলে ভালো কোনো হোটেলে থাকতো পারতো। কিন্তু আহাশ সেটা সে করেনি। তার টাকার প্রচুর প্রয়োজন ছিলো। জার্মানীর প্রায় হয়ে যাওয়া ভিসাটা নিয়েই জার্মানী চলে যাবার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু একটা রাত সব কিছু পালটে দিলো। জার্মানীর ভিসাটা আটকে গেলো। তার কাছে টাকা না থাকায় বন্ধু নিজের কাছে আর রাখতে চাইলো না তাকে। এদিকে বাবার কাছেও টাকা চাইতে পারছিলো না। সে, দিনের পর দিন সিলেটের রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে। মা আশ্বাস না দিলে হয়তো ফেরা হতো না। আহাশের নিজের কাছেই নিজেকে খুব ছোট লাগছে, তার জন্য তার বাবা-মা, ভাইকে এতো অবমাননার ভেতর থেকে যেতে হয়েছে। একটা মেয়ের সবথেকে সুখময় সময়কে সবথেকে বিষাক্ত সময়ে পরিণত করেছিলো সে। তাকে সমাজের কাছে অপমানের জন্য একা ফেলে চলে গিয়েছিলো সে। অপরাধবোধের জন্য মার কাছে কখনো ঐন্দ্রিলার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় নি৷ লজ্জাবোধ হতো। সেদিন এমন একটা কাজ না করলে বোধহয় সে পরিবারের চোখে এতোটা নিচে নামতো না। এই যেমন বিগত দেড় ঘণ্টা যাবৎ সোফাতে একা বসে আসে আহাশ। মা ব্যাতীত কেউ তার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে নি। নিজের রুমে যেতে পারছে না, কারণ শওকত সাহেব কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছেন। তিনি কিছুই বলছেন না শুধু প্রখর দৃষ্টিপাতে ছেলে গিলে খাচ্ছেন। এদিকে অভ্রের দেখা এখনো মেলে নি। আহানা সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কথা বলছে না। শারমিন বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
– তুমি এতোদিন কেনো আসিস নি বাবা? কোনো শুকিয়ে গেছিস।
– মা আমি ফিরতাম না, কিন্তু বাঁচার ইচ্ছেটা ফিরতে বাধ্য করেছে। আমি ওখানে থাকলে হয়তো মরেই যেতাম।
শারমিন বেগম ছেলের কথা শুনে হু হু করে কেঁদে দিলেন। তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে। তাই অল্প কাঁদলেই হাঁপানির টান উঠে। আহাশ তাই মাকে সান্ত্বনা দিলো,
– মা, কেঁদো না প্লিজ। আমি যা করেছি, তাতে এমনটা আমার প্রাপ্য ছিলো।
– ঠিক বলেছো তুমি।
এতোক্ষণ পর মুখ খুললেন শওকত সাহেব। বেশ কঠোর স্বরেই বললেন,
– তুমি না ফিরলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। আজ তোমার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার শাস্তি আমাদের পেতে হয়েছে।
– বাবা, আমি ওকে ভালোবাসি না। হ্যা মানছি আমি বিয়েতে রাজী হয়েছিলাম কিন্তু আমি যাকে ঐন্দ্রিলা ভেবেছি, সে তো ঐন্দ্রিলা নয়। এই বিয়েতে কেউ সুখী হতাম না বাবা। তুমি চাইলে ঐন্দ্রিলার কাছে আমি নিজে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবো। ওর বিয়ে যেনো ভালো একটি জায়গায় হয় সেই ব্যাবস্তা ও আমি করবো।
– তার প্রয়োজন নেই আহাশ।
কন্ঠটা কানে আসতেই দরজার দিকে তাকায়। একটা কালো টি-শার্ট এবং ট্রাউজার পরিহিত কফি হাতে অভ্র বসার ঘরে প্রবেশ করে। আহাশের ঠিক সামনে তার মুখোমুখি বসে সে। আহাশ তার কথাটা শুনে খানিকটা থমকে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
– কেনো ভাই?
– কারণ ঐন্দ্রিলার বিয়ে হয়ে গেছে। ঐন্দ্রিলার হাসবেন্ড কখনোই চাইবে না তার স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে হোক।
– বিয়ে হয়ে গেছে?
– মা তোকে বলে নি?
আহাশ তার মার দিকে তাকায়। শারমিন বেগম মাথা নিচু করে ফেলে। তিনি ঐন্দ্রিলার ব্যাপারে কোনো কথাই আহাশকে জানাতে চান নি। জানালে ছেলেটা কখনোই ফিরতো না। হয়তো এভাবেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হতো তার ছেলেকে। আহাশের মুখ দেখে অভ্র কিছুক্ষণ ঠোঁট বিস্তারিত করে হাসে। তারপর শক্ত কন্ঠে বলে,
– ঐন্দ্রিলা এখন শুধু ঐন্দ্রিলা নয়। সে এখন ঐন্দ্রিলা অভ্র চৌধুরী। আমি নিশ্চয়ই চাইবো না আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় লবার বিয়ে হোক। তোর কাছে আমি সত্যি কৃতজ্ঞ। সেদিন তোর দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার জন্য আমার বিয়েটা এতোটা মোহনীয় নারীর সাথে হয়েছে। তোকে ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আছি ওর জন্য। তুই তোর কথা বল! জার্মানির ভিসা তো কেঁচে গেলো এখন কি ভাবছিস?
অভ্রের কথাটা হজম হতে একটু সময় লাগলো আহাশের। সে এখনো অবাক দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। ঐন্দ্রিলা তার ভাবী। কথাটা কেনো যেনো কাঁটার মতো গলায় বিধছে আহাশের। যে নারীকে ভরা মজলিশে একে ফেলে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিলো, সেই নারী এখন তার ই বাড়িতে তার সামনে ঘুরে বেড়াবে। কোন মুখে দাঁড়াবে সে মেয়েটির সামনে! কি বলবে! তার বদলে তার খালাতো বোনকে মনে ধরেছিলো তার। তাই বাবা যখন বিয়ের কথা বলেছে না ভেবে “হ্যা” করে দিয়েছিলো। তারপর যখন প্রথম মেয়েটির সাথে দেখা করতে যায় সে, কাঁচের মতো তার সব আশা, স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। বাবাকে বলতে চেয়েও সাহস করতে পারে নি তখন। কিন্তু বিয়ের দিন, ভয়ে যখন তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো, যখন শত ভেবেও ঐন্দ্রিলাকে ভালোবাসার একটা কারণ ও খুজে পায় নি তখন কাপুরুষের ন্যায় পালিয়ে গিয়েছিলো সে। এই সত্যটা কিভাবে বলবে মেয়েটাকে! আহাশের চিন্তায় আচ্ছন্ন মুখটা দেখে অভ্র আবার জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো বল, তোর নেক্সট প্লান কি?
– আমি একটু রুমে যাই ভাই? আমার মাথাটা ধরে আছে। মা এককাপ চা পাঠিয়ে দিবে?
– তুই রুমে যা আমি চা পাঠাচ্ছি।
আহাশ উঠে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলো। অভ্র তাকে আটকালো না। শওকত সাহেব চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
– সিদ্ধান্তটা কি ঠিক হচ্ছে অভ্র?
অভ্র উত্তর দিলো না। চিন্তা তার মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চিন্তার কারণটা খুব অদ্ভুত! চিন্তার সাথে ক্ষীণ ভয় ও মাথা চারা দিচ্ছে! আহাশ নতুন কোনো বিপদের সূত্রপাত ঘটাবে না তো!
নীলাদ্রির সামনে পিউ দাঁড়িয়ে আছে। তার পরণে আসমানী রঙ্গের শাড়ি। খোঁপা করেছে সে, তাতে বেলীফুলের মালাও গুজেছে। চোখে মোটা করে কাজলের বাহার, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, আর দু হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। তার সাজের বাহারের কারণটা নীলাদ্রির জানা নেই। তবে পিউ এর সাজসজ্জা নীলাদ্রির হৃদস্পন্দন তীব্র করে দিয়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মনের অবস্থা প্রকাশের উপায় নেই। কারণ তার সামনে বদরুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। সে পিউকে নিয়ে সকাল সকাল তাদের বাড়ি এসেছেন। নীলাদ্রি অফিসের জন্য বের ই হচ্ছিলো তখনই তাদের আগমণ। তার নাকি নীলাদ্রির সাথে কাজ, কিন্তু কখন থেকে শরীফ সাহেবের সাথে খাজুরে আলাপে লেগেছে সে। নীলাদ্রি ঘড়ির দিকে এক নজর দেখে বিনয়ী কন্ঠে বললো,
– খালু, আমার উঠতে হবে। অফিসে নয়তো দেরি হয়ে যাবে।
– অফিসে যাবার পথে পিউমা কে একটু হাসপাতালে ড্রপ করে দিবে…….
চলবে
#স্বপ্নছায়া
#১৭তম_পর্ব
নীলাদ্রির সামনে পিউ দাঁড়িয়ে আছে। তার পরণে আসমানী রঙ্গের শাড়ি। খোঁপা করেছে সে, তাতে বেলীফুলের মালাও গুজেছে। চোখে মোটা করে কাজলের বাহার, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, আর দু হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। তার সাজের বাহারের কারণটা নীলাদ্রির জানা নেই। তবে পিউ এর সাজসজ্জা নীলাদ্রির হৃদস্পন্দন তীব্র করে দিয়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মনের অবস্থা প্রকাশের উপায় নেই। কারণ তার সামনে বদরুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। সে পিউকে নিয়ে সকাল সকাল তাদের বাড়ি এসেছেন। নীলাদ্রি অফিসের জন্য বের ই হচ্ছিলো তখনই তাদের আগমণ। তার নাকি নীলাদ্রির সাথে কাজ, কিন্তু কখন থেকে শরীফ সাহেবের সাথে খাজুরে আলাপে লেগেছে সে। নীলাদ্রি ঘড়ির দিকে এক নজর দেখে বিনয়ী কন্ঠে বললো,
– খালু, আমার উঠতে হবে। অফিসে নয়তো দেরি হয়ে যাবে।
– অফিসে যাবার পথে পিউমা কে একটু হাসপাতালে ড্রপ করে দিবে। ইবনে সীনা হাসপাতালের সামনে ড্রপ করে দিলেই হবে। ওর পাশেই ওর বান্ধবীর বাসা। আজ তারা বাহিরে ঘুরতে যাবে।
ইবনে সীনা হাসপাতাল শুনতেই নীলাদ্রি চোখ কুচকে তাকায় পিউ এর দিকে। পিউ এর মুখোভাব তাতে বদলালো না। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে মামুর সামনে নীলাদ্রি তাকে কিছুই বলতে পারবে না। নীলাদ্রির অগ্নিদৃষ্টিকে তাই অগ্রাহ্য করা যেতেই পারে৷ নীলাদ্রির বুকে ত্রাশ তৈরি হয়। পিউ সেজেগুজে শিহাবের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে না তো৷ কারণ এই ইবনে সীনা হাসপাতালেই শিহাব ভর্তি রয়েছে। আজ হয়তো ডিসচার্জ করিয়ে দিবে। নীলাদ্রির মুখটা ভার হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই সেদিনের আচারণটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পিউ সেদিনের পর থেকে আজ ই তার সামনে এসেছে, তাও বদরুল সাহেবের সাথে। একা হলে হয়তো কখনোই তার সামনে আসতো না। যতই সে উচ্চগলায় দাবি করুক সে পিউকে ভালোবাসে, পিউ তার প্রেমনিবেদন গ্রহন না করলে সে সব বৃথা। তখন নীলাদ্রির পরিচয় হবে কেবল একজন ব্যার্থ প্রেমিক। তাকে সমাজ ব্যর্থ প্রেমিকের নজরেই দেখবে। থাকবে না পিউ এর উপর কোনো জোর, থাকবে না কোনো অধিকার। পিউ তখন মুক্ত। যতই হোক, ভদ্র ঘরের ছেলে যে, প্রেমিকা তাকে ফিরিয়ে দিলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করার মতো নিম্মমানসিকতা না নেই। নীলাদ্রির ভার মুখটা দেখে শরীফ সাহেব জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
– কি হলো নীল, তোর মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো? শরীর ভালো নেই?
– বাবা, শরীরের কি দোষ। মনটাই আজকাল নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। আমি আসছি। আমার দেরি হচ্ছে।
– পিউকে নিবি না?
– ওকে না নেবার কোনো কারণ তো নেই। খালু আদেশ করেছেন।
নীলাদ্রির কথার মর্মার্থ বদরুল সাহেব কিংবা শরীফ সাহেব বুঝলেন না। তারা হা করে শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পিউ তাদের ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখগুলোকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,
– মামু আসলাম। খালু আসি। তোমরা দুজন মনে করে ঔষধ খেয়ে নিবে। আমি দিশাকে বলে দিয়েছি যদিও। তাও তোমাদের ও বলে গেলাম৷ আসি
পিউ কথাটা বলে নীলাদ্রির পিছু পিছু ছটলো। পিউ যাবার পর বদরুল সাহেব হো হো করে হয়ে সে উঠলেন। আবেগপ্রবণ কন্ঠে বললেন,
– দেখেছেন দুলাভাই, মনে হয় মা শাসন করছে।
– একদম ঠিক বলেছো, ঐন্দ্রি মাও এভাবেই আমাকে শাসন করতো। যখন ওকে প্রথম কোলে নিয়ে ছিলাম আমার মনে হয়েছিলো আমার মা ছোট্ট রুপে আমার কোলে এসেছে। মেয়েটাকে দেখি না কতোদিন হয়ে গেছে। আসলে মেয়েরা হয় ই এমন। মায়ায় জড়িয়ে অন্য কারোর ঘরে চলে চায়। দেখবে পিউ আর দিশার বিয়ের পর ঘরটা একেবারেই ফাঁকা হয়ে যাবে। খা খা করবে ওদের খিলখিল হাসির জন্য। ওদের দুটো বুলির জন্য। ওদের নুপুরের গুঞ্জনের জন্য, ওদের গলার স্বরের জন্য।
শরীফ সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে। বদরুল সাহেবের মনটা ও বসে গেলো। পিউ এবং দিশাকে যদি নিজের কাছে রেখে দিতে পারতেন কি ভালোটাই না হতো___________
ইবনে সীনা হাসপাতালের করিডোরে হাটছে পিউ এবং নীলাদ্রি৷ পুরোটা রাস্তা লোকটা একটা টু শব্দ করে নি পিউ এর সাথে। শুধু মন মরা হয়ে এক দিকে চেয়ে ছিলো। নীলের এই রুপ পিউকে ভাবাচ্ছিলো। কিন্তু সাহস করে প্রশ্ন করে উঠতে পারে নি। বলা তো যায় না, শান্ত বাঘকে জাগালে না তার ই শিকার বনে যেতে হয়। নীলাদ্রি সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিউ এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শান্ত ভাবে তার কার্যক্রম দেখছে। সে রিসিপশনে শিহাবের রুমের নাম্বার যোগাড় করেছে। এখন ভিজিটিং আওয়ার হবার দরুন তাকে ভেতরে যাবার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। নীলাদ্রির হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে কিন্তু সে চুপটি করে দেখে যাচ্ছে মেয়েটির কাজ। বাসা থেকে মিথ্যে বলে, এতো সাজের বাহার দিয়ে শিহাবের সাথে দেখা করার যুক্তি খুজে বেড়াচ্ছে নীলাদ্রি৷ পিউ যখন শিহাবের রুমের বাহিরে দাঁড়ালো তখন ঘাড় ফিরিয়ে নীলাদ্রিকে জিজ্ঞেস করলো,
– আমাকে কেমন লাগছে?
– কিহ?
– বলছি আমাকে কেমন লাগছে? দেখে প্রেম প্রেম জাগছে না?
পিউ এর প্রশ্ন শুনে মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠলো নীলাদ্রির। আবার বুকের বা পাশটা হু হু করে উঠলো। পিউ কি বুঝে না, সে এমন একজনকে প্রশ্নটি করেছে যার মনে তার জন্য বাসার জামা পড়া অবস্থাতেও প্রেম প্রেম জাগে। পরীক্ষার প্রেসারে যখন তার চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, তার চুল গুলো কাকের আর বাবুই পাখির বাসার ন্যায় দেখায় তখন ও নীলাদ্রির প্রেম প্রেম জাগে। আর আজ তো সে নীলাদ্রির মতো করে সেজে রয়েছে। সুতরাং প্রেম প্রেম জাগবে এটা চিরন্তন সত্য। নীলাদ্রি ব্যাথিত কন্ঠে বললো,
– এতো সাজের বাহার কি তবে শিহাবের জন্য?
– আপনাকে বলবো কেনো? আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন, আমাকে দেখে কি প্রেম প্রেম জাগছে?
নীলাদ্রি মাথাটা নামিয়ে ফেললো। তার চোখ ছলছল করছে। সে পুরুষ মানুষ তাই পিউকে এই অশ্রু দেখতে দিবে না। নীলাদ্রি আহত কন্ঠে বললো,
– তুই ভেতরে যা, আমি বাহিরে আছি
– উত্তরটা দিলেন না তো!
– তুই ও তো দিলি না।
– বেশ তবে শুনুন, আমার এই সাজের ঘটা আমার প্রেমিকের জন্য।
পিউ কথাটা বলেই সোজা শিহাবের রুমের ভেতরে চলে গেলো৷ পিউ এর কথাটা শুনে নীলাদ্রির চোখ থেকে টপ করে অশ্রুর মুক্তোদানাটা গড়িয়ে পড়লো। সে অশ্রুসিক্ত চোখে তার হৃদয়ের মহারানীর যাবার পানে চেয়ে রইলো_________
ঐন্দ্রিলার দম বন্ধ লাগছে। মন অশান্ত হয়ে রয়েছে। কোনো কিছুতে মন বসতে চাইছে না। রান্নাটা কাজের মেয়ের রাতে দিয়েই নিজ রুমে চলে আসে সে। দিশান বিছানায় ঘুমোচ্ছে। ঐন্দ্রি তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণের বাতাস ছুটেছে, আজ আকাশে মেঘ করছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর ই বৃষ্টি নামবে। কিন্তু গরমের উম্মাদনা কমে নি। চুলের গোড়া থেকে ঘামের রেখে গড়িয়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রির ঘাড়ে৷ কিন্তু সেদিকে তার মোটেই খেয়াল নেই। সে চোখ বুঝে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে তার।
“তুমি আমার নওতো সুখ
তুমি সুখের বেদনা
সব স্বপ্নের রং হয় না তো
বেদনার মতো নয় রঙা ।
জীবনের সব কথা নয়
আমি জীবনটাকে বলতে চাই
হয়তো দুর্ভাগ্য নয়
সে তো ভালোবাসার কাব্য কয় ।।
আমি কবি নই
তবু কাব্যের ভাষায় বলবো আজ
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই ।
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই ।”
কিন্তু সেটা মনেই চেপে রেখে দিলো। কারণ দিশানের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ভাববে মাম্মাম বুঝি পাগল হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অনুভব করলো তার ঘাড়ের উপর কারোর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে। ঐন্দ্রি খানিকটা কেঁপে উঠলো। তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না মানুষটি কে! সে তার স্বামী। তাই ঐন্দ্রি পেছনে ফেরলো না। অভ্র ঐন্দ্রির সাঁড়া না পেয়ে তার কাঁধে থুতনিটা ঠেকিয়ে বললো,
– অতীত অতীত ই হয়। অতীতের মুখোমুখি হয়েছো বলে বর্তমান এলোমেলো হয়ে যাবে কথাটা ভুল…………
চলবে
[ ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি