স্বপ্নছায়া,পর্ব:১৫

0
401

#স্বপ্নছায়া
#১৫তম_পর্ব

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো পিউ৷ সন্ধ্যে হতে চলেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না পিউ এর। তাই সে পা বাড়ালো দরজার দিকে। ঠিক তখনই হ্যাচকা টানে দেওয়ালের সাথে তাকে চেঁপে ধরলো নীলাদ্রি। নীলের এমন ধারা আচারণে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে পিউ। নীল তখন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– দরদ দেখছি উথলে উঠছে শিহাবের জন্য। দরদের কারণটা কি শুনি?

নীলাদ্রির চোখ লাল হয়ে রয়েছে। তার চোয়ালজোড়া শক্ত। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে পিউকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রয়েছে। সে পিউ এর দিকে খানিকটা ঝুকে দাঁড়িয়েছে। তার তপ্ত নিঃশ্বাস যেনো পুড়িয়ে দিচ্ছে পিউ কে। পিউ তার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এতোটা অদ্ভুত আচারণ নীলাদ্রি কখনোই করে নি। তার চোখে মুখে ক্ষুদ্ধতা স্পষ্ট। লোকটা এতোটা অদ্ভুত কেনো! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে পিউ। চাপা স্বরে বলে,
– ছাড়ুন, মানুষ দেখলে ভুল বুঝবে।
– যা বোঝার বুঝতে দে! তুই আমার কথার উত্তর দে? এতো ছটফট করছিস কেনো তুই ওই ছোকরাটার জন্য?
– আপনি এমন পাগলের মতো আচারণ কেনো করছেন? হাতটা ছাড়ুন নীল ভাই।

কথাটা শুনে যেনো নীলের মেজাজ আরোও খারাপ হয়ে গেলো। রাগের কারণে তার শরীর যেনো কাঁপছে। হিনহিনে গলায় বলে উঠলো,
– সবসময় আমাকেই তোর পাগল মনে হয় তাই না? কথা থেকে উড়ে আসা শিহাবের জন্য মন পুড়ছে তোর, আর আমি কিছু করলেই পাগলামি? কেনো? কেনো ওই দুদিনের ছেলের জন্য তুই এতোটা ব্যাস্ত হয়ে আছিস। কেনো ঐ ছেলেকে নিয়ে এতোটা চিন্তা করছিস?
– অদ্ভুত তো! সে আমার হবু হাসবেন্ড ছিলো।
– গো টু হেল উইদ ইউর হবু হাসবেন্ড। কথা বার্তা শুরু হওয়া মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া না। একটা লিকলিকে শরীরের ছোকরা। তার জন্য এতো মন পোড়ানোর কি আছে? হ্যা? খবরদার যদি ওখানে যাস, খুন করে রেখে দিবো তোকে।
– আজব, এমন ব্যাবহার করছেন কেনো? মানবতা বলেও একটা জিনিস আছে। মানুষটা অসুস্থ। আর সবথেকে বড় কথা, বেচারা আমার জন্য মার খেয়েছে। ওকে দেখতে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। উনি মার না খেলে হয়তো বিয়েটা কেঁচতো না। এটা বাস্তবতা। এতে এভাবে ব্যাবহার কেনো করছেন আমার সাথে? আমি আপনাকে আজ, এখন প্রশ্ন করছি।আপনি আমার উপর কিসের জোরে এতোটা অধিকার দেখান বলুন তো!

নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না পিউ৷ ক্ষুদ্ধ কন্ঠে কথাগুলো বলে সে৷ নীলাদ্রির চোখে চোখ রেখে স্পষ্টকন্ঠে প্রশ্নটি করে সে। নীলাদ্রির মাত্রা ছাড়া আচারণ তার সহ্য হচ্ছে না। নীলাদ্রি খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় পিউ এর আকস্মিক প্রশ্নে। সে খানিকটা চুপ হয়ে যায়। রাগের মাথায় নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে নি সে। নীলাদ্রিকে চুপ করে থাকতে থেকে পিউ তাকে আবারো প্রশ্ন করে উঠে,
– কি হলো বলছেন না কেনো? কিসের এতো জোর আপনার? আমাকে কিসের অধিকারে ওখানে যাওয়া থেকে আটকাচ্ছেন? উত্তর নেই বুঝি! কি হলো উত্তর দিন।
– ভালোবাসি
– জ্বী?
– আমি তোকে ভালোবাসি। কোনো ছেলে তোর দিকে চোখ তুলে তাকাক আমার সহ্য হয় না। হ্যা, পাগলামি করি আমি, রাগ করি আমি কিন্তু সেটা শুধু তোর উপর। আর অধিকারের কথা বলছিস। ভালোবাসি তাই অধিকার দেখাই। আমি না ওই লুতুপুতু মার্কা পোলাদের মতো না। ন্যাকামি ভালোবাসা আমার দ্বারা হয় না। তবে যাকে ভালোবাসি তাকে আগলাতে পারি। তুই কি সত্যি বুঝিস না? মেয়েরা তো বিশ মিটার দূর থেকে বুঝে যায় কোন ছেলে তাকে পছন্দ করে। এতোদিনে তুই বুঝিস না! এতোদিন ছোট ছিলি বলে আমি প্রকাশ করি নি, আজ করছি। ভালোবাসি তোকে। প্রচুর ভালোবাসি। কেনো? জানি না। কবে থেকে? জানি না। তবে ভালোবাসি। উত্তর পেয়েছিস? আরেকবার শিহাবের নাম উচ্চারণ করে দেখিস আমি কি করি!

বলেই পিউ কে ছেড়ে দেয় নীলাদ্রি। হনহন করে ছাদ থেকে নেমে যায়। পিউ এর উত্তর পাবার অপেক্ষা তার করতে ইচ্ছে করছে না। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। সেটা থামানো জরুরি। দেখা যাবে রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু করে বসলো সে পিউ এর সাথে। এতে তাদের মাঝে দূরুত্ব ছাড়া কিছুই তৈরি হবে না। পিউ সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কথাগুলো যেনো প্রজেকটাইলের মতো মাথার উপর থেকে গিয়েছে। নীলাদ্রি তাকে ভালোবাসে! এটা কি কোনো তামাশা ছিলো! নাকি লোকটা সত্যি ই তাকে ভালোবাসে! এর আগেও প্রেম নিবেদন পেয়েছে সে, কিন্তু এমন রুদ্র প্রেমনিবেদনটা এই প্রথম পেলো সে। নীলাদ্রির এরুপ প্রেম নিবেদনে তার খুশি হওয়া উচিত নাকি রাগ হওয়া উচিত ভেবে পাচ্ছে না সে। লোকটাকে ছোট বেলা থেকেই একজন অভিভাবকের রুপে দেখেছে সে, এমন একজন পুরুষ যাকে চোখ বুজে ভরসা করা যায়, যে বিপদে ঠায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার কখনো একজন জ্বালাতনকারী বিরক্তিকর লোক, যে কি না অহেতুক কারণে তার তাকে টিটকারি দেওয়া কথা বলে, বাজে ভাবে অপমান করে। এমন একজন পুরুষ তাকে প্রেম নিবেদন করেছে, তার কি সত্যি খুশি হওয়া উচিত নাকি কষ্ট পাওয়া উচিত। আর এই প্রেম নিবেদনের উত্তরটা কিভাবে দিবে সে!

রুমে এসেই ধরাম করে দরজা দিয়ে দিলো নীলাদ্রি। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। অত্যধিক মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। মেজাজটা নিজের উপর হচ্ছে। তার এই রাগটাই আজ তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিউ এর শিহাবের জন্য চিন্তাটা যেনো একেবারেই সহ্য হয় নি তার। মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো তার বুকে কেউ চুরিঘাত করছে। মাথায় যেনো আগুন জ্বলছিলো। কতো পরিকল্পনা ছিলো তার পিউ কে নানা ভাবে প্রেমনিবেদন করবে সে। কিন্তু তার সকল পরিকল্পনায় পানি পড়ে গেলো। রাগ কন্ট্রোল না করতে পারায় তার এতোটা আহম্মকের ন্যায় কাজ করে ফেলেছে সে। মাথাটা দু হাতে চেপে ধরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো নীলাদ্রি। পিউ এর সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে সে! পিউ কি আদৌ তার অনুভূতি গুলো বুঝতে পারবে! উফফ এতো কষ্ট কেনো ভালোবাসায়_____________

৯.
দুপুর বারোটা,
অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা বাসায় ফিরেছে দশ মিনিট হয়েছে। আজ সকাল সকাল ই তারা রওনা দিয়েছিলো চট্টগ্রাম থেকে। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় দুপুরের আগেই বাসায় পৌছে গিয়েছে। দিশানের খুশী দেখে কে! দৌড়ে এসে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরলো সে। ঐন্দ্রিলাও পরম আদরে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিলো। আদরে আদরে দিশানকে ভরিয়ে দিচ্ছিলো সে। দিশান ও চুপটি করে মায়ের আদর খাচ্ছিলো। শারমিন বেগম গর্বিত স্বরে বলে,
– আমার সোনা নাতিটা সেই কখন থেকে তোমাদের অপেক্ষা করছিলো৷ জানো তোমরা কালকে কতটা শান্ত বাচ্চা হয়ে ছিলো দিশান! একদম জ্বালায় নি আমাকে। ঠিক সময়ে খেয়েছে। ঠিক সময়ে গোসল করেছে।
– তাই বুঝি আব্বু? আমার সোনা আব্বু। আজকেই বাবা আর মাম্মাম মিলে আমার আব্বুটার জন্য একটা এত্ত বড় গাড়ি কিনে আনবো।

বলেই দিশানের গালে একটা চুমু একে দিলো ঐন্দ্রিলা। দিশান তার মায়ের গলা জড়িয়ে চুপ করে মায়ের আদর খাচ্ছে। অভ্র আবেগপ্রবণ দৃষ্টিতে ছেলে এবং মায়ের মিলন দেখছে। ঐন্দ্রিলাকে দিশানের সাথে এতো মিশে যেতে দেখে খুব ভালো লাগছে তার। গত দুদিন থেকে মেয়েটির সাথে যুদ্ধ চলছে তার, নিরব যুদ্ধ। কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ ভাবে এই যুদ্ধ পালন করছে তারা। জরুরি ব্যাতীত কোনো কথা বলে নি তারা দুজন। অভ্র ও ঐন্দ্রিলাকে বেশি ঘাটায় নি। দুদিন পর আজ ঐন্দ্রিলাকে হাসতে দেখে বেশ ভালো লাগছে তার। ঐন্দ্রিলা দিশানেএ পেটে কাতুকুতু দিচ্ছে আর দিশান খিলখিল করে হাসছে। কতটা মনোরম দৃশ্য! এর মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। আহানা ছুটে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই আহানা যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহানাকে অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভ্র তার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– কি রে জমে গেলি নাকি? কে এসেছে?
– আহাশ ভাইয়া……………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here