#স্বপ্নছায়া
#১২ম_পর্ব
ঐন্দ্রিলা আজ অনেক কদম ফুল ছিড়েছে। তার কদম ফুল খুব ভালো লাগে। ফুলটি দেখলেই বর্ষাকালের অনুভূতি পাওয়া যায়। এখানে থাকতে খুব ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। কিন্তু আগামীকাল ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। সেই রাতের পর থেকে অভ্র তার সামনে আসে নি। নিজেকে যেনো আড়াল করে ফেলেছে সে। ঐন্দ্রিও তাকে খুঁজতে যায় নি। যে নিজেই হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এর মাঝেই বাড়ির কেয়ারটেকার লতিফ ছুটে আসে ঐন্দ্রিলার কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– ভাবীজান, একটু ভেতরে আসেন।
– কি হয়েছে লতিফ ভাই?
– ভাইজানের শরীরটা ভালা নাই, অফিসের লোকেরা তারে ধরাধরি কইরা লইয়া আইছে। আপনে একটু ভেতরে আসেন।
লতিফের কথা শুনে কলিজায় কামড় পড়ে ঐন্দ্রিলার। লোকটাকে তিনদিন দেখে নি সে। কখন বাসায় আসে, কখন বাসা থেকে বেরিয়ে যায় তার টেরটি অবধি পায় না ঐন্দ্রিলা। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে ঘর খুজেও মানুষটিকে পায় না। লতিফকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় তার ভাইজান বেড়িয়ে গেছে। রাত দুটো অবধি সজাগ থেকে অপেক্ষা করে লোকটির জন্য কিন্তু লোকটির আসার নাম থাকে না। অভ্রের উদাসীনতা ঐন্দ্রিলাকে পীড়া তো দেয় কিন্তু সে তার বহিঃপ্রকাশ করে না। কিন্তু আজ যখন অভ্রের অসুস্থতার কথা শুনলো তখন বুকের ভেতর উথাল-পাতাল হওয়া শুরু করলো। ঐন্দ্রিলা পানি থেকে উঠে দাঁড়ালো, জুতো ছাড়াই খালি পায়ে ছুটলো বাড়ির দিকে। ভেজা শাড়িটাতে মাটি লেগে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই।
অভ্রের রুমে খাটের উপর আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে রয়েছে অভ্র। তার অফিসের পাঁচজন কর্মচারী তার সামনে দাঁড়ানো। তার মধ্যে অভ্রের পি.এস ঈদ্রিশ ও রয়েছে। ঈদ্রিশ অভ্রের এই আর ডিপার্টমেন্টের অন্যতম পোস্টে রয়েছে। অভ্রের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়তো সে। সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। অভ্র কে কখনো “স্যার” সম্বোধন সে করে নি। সর্বদা “ভাই” বলেই সম্বোধন করে সে। অভ্রের ভালো কিংবা মন্দ সকল সময়ের সাক্ষী এই মানুষটা ছিলো। তাই আজ যখন অর্ধেক মিটিং মাথা ঘুরে অভ্র পড়ে যায় তখন সবার আগেই এই মানুষটি ই রিয়েক্ট করেছিলো। অভ্র এখনো চোখ বুঝে শুয়ে রয়েছে। ঈদ্রিশ বাকিদের উদ্দেশ্য করে বললো,
– ভাই এর রেস্টের দরকার। এক কাজ করো তোমরা অফিসে ফিরে যাও। আমি এখানে আছি। কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করো।
– জ্বী স্যার, তাহলে আমরা আসি। আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম সালাম
ঈদ্রিশ বাদে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এর মধ্যেই ঐন্দ্রিলা রুমে উপস্থিত হলো। অভ্রকে শোয়া অবস্থায় দেখে ছুটে গেলো তার কাছে। অভ্রকে ব্যাথিত নয়নে দেখতে লাগলো সে। লোকটা তিনদিনে অনেক বদলে গেছে। চোখের নিচটা কালো হয়ে গিয়েছে, হয়তো তিনদিনে ছ ঘন্টা ঘুমিয়েছে কি না সন্দেহ। মুখটা শুকিয়ে গেছে তার হয়তো খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হয় নি। লোকটা এমন কেনো তা বুঝে পায় না ঐন্দ্রি। নাহয় দুটো কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তাই বলে ঐন্দ্রিকে জব্দ করতে বাসায় আসবে না? হপ্তে পারে সে খুব বড় ব্যাবসায়ী তাই বলে নিজেকে এতোটা অযত্ন করবে? কাজ কি তার জন্য এতোটাই জরুরি? ঈদ্রিশকে ধীর কন্ঠে বললো,
– কি হয়েছে উনার? হুট করে এমন কেনো হলো?
– ভাইয়ের সুগার আর বিপি টা কমে গিয়েছিলো। এই কন্ট্র্যাক্টটা পাবার জন্য কম ধকল উঠায় নি সে। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হয় নি। ঔষধ ঠিক মতো খায় নি। ঘুমটাকেও অবহেলা করেছে। সেটার ফল ই এটা।
– উনার ডায়াবেটিস আছে?
– হ্যা, বিগত চার বছর ধরে ভাইয়ের ডায়াবেটিস আছে। আপনি জানেন না ভাবি?
– নাহ
– ওহ, একটু খেয়াল রেখেন। আসলে সুগারের ক্ষেত্রে হাইপো হওয়াটা ভালো নয়৷
– জ্বী
ঐন্দ্রিলার মনটা হুট করে মিয়ে গেলো। স্ত্রী হওয়া স্বত্তেও সে জানে না তার স্বামীর কি রোগ ব্যাধি আছে। যদিও মানুষ বছরের পর সাথে থেকেও অপর মানুষটিকে জানতে পারে না, সেখানে তাদের বিয়ের তো মাত্র পঁচিশ দিন হয়েছে। তবুও ঐন্দ্রির খারাপ লাগছে। ঐন্দ্রিলার অনুতাপের মুখখানা দেখে ঈদ্রিশ বললো,
– এটা কোনো পাপ নয় কিন্তু ভাবি, আপনি নাই জানতে পারেন এই ব্যাপারটা। সব সময় সবার সব কিছু জানতে হবে এটা কিন্তু ঠিক নয়। আপনি মন খারাপ করবেন না। এর পর থেকে একটু খেয়াল রাখবেন
ঈদ্রিশ লোকটা বরাবর ই বেশ স্পষ্টভাষী। তার কথা বলার ধরণ ও অনেক চমৎকার। ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি রইলো না ঈদ্রিশের কথার মর্মার্থ। সে ঐন্দ্রিলার অপরাধবোধটিকে যুক্তির মাধ্যমে দমন করলো। এবং তার সাথে তার দায়িত্ব জ্ঞানের স্বরণটিও করিয়ে দিলো। ঐন্দ্রিলা বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাইয়া আপনি চা খাবেন তো?
– চায়ের ব্যাপারে আমি কখনোই মানা করি না, শুধু চিনি টা বেশি দিতে বলবেন।
এর মাঝেই অভ্র চোখ খুললো। অভ্রকে উঠতে দেখে ঐন্দ্রিলা ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু খাবেন? আমি স্যুপ করে আনি?
অভ্র উঠে বসলো। মাথাটা তার এখনো খানিকটা ঝিম ধরে আছে। শরীরে বল নেই বললেই চলে। একটু সময় লাগলো এটা বোঝার জন্য যে সে কোথায় আছে। ঈদ্রিশকে দেখেই ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
– মিটিং টা কি হলো?
– ভাই আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সামলে নিয়েছি। আমাদের ডিলটা ফাইনাল হয়ে গেছে।
– যাক বাঁচালে। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? উনাদের স্যাম্পল গুলো রিচেক করতে হবে। নতুন প্রোডাকশন দ্রুত শুরু করতে হবে। আমি একটু পড়ে আসছি অফিসে। কালকে ঢাকা ফিরবো, তার আগে কাজগুলো শেষ করতে হবে।
এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। বাজখাই কন্ঠে বলে উঠলো,
– আপনার মাথার ঠিক কয়টা তার ছেঁড়া একটু বলুন তো আমাকে?
– সরি?
ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অভ্র। এবার ঐন্দ্রিলা ঈদ্রিশের উদ্দেশ্যে বলে,
– ভাইয়া, আমরা আগামীকাল ঢাকা যাবো না। সুতরাং আমি চিন্তা করবেন না। ফাইল গুলো কাউকে দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েন। উনি বাসা থেকেই সব৷ দেখে দেবেন। নড়ার শক্তি নেই, উনি যাবে অফিস। কথাটা যেনো মাথায় থাকে।
এবার অভ্রের দিকে কড়া কন্ঠে বলে,
– আর অফিস যাবেন মানে কি? একটু আগে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আপনার কোনো আইডিয়া আছে আজ কি হয়েছিলো? ভাগ্যিস ভালো ঈদ্রিস ভাই ওখানে ছিলো। রোগ বাধিয়ে তো সুন্দর বসে আছেন। তা বলি সেদিকে তো খেয়াল রাখবেন না? একদিন কাজ না করলে কি মহাভারত ধ্বংস হয়ে যাবে? এসব কাজের ঢং আমার বাড়িতে করবেন না। আজ থেকে পুরো চব্বিশ ঘন্টা বাসা থেকে এক কদম বের হবেন না। আর এখন স্যুপ দিচ্ছি। কোনো টু শব্দ ছাড়া খাবেন। যা কাজ বাসা থেকেই করবেন। ভাইয়া আপনি বসুন আমি আসছি।
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র এখনো হা করে তাকিয়ে রইলো। তার শান্ত বাঘিনী আবার জেগে উঠেছে। ঈদ্রিশ হাসতে হাসতে বলে,
– যাক কেউ তো তোমাকে থামাতে পারে। আমি তো ভেবেছি তুমি ই সবার উপর হুকুম চালাও। তোমার উপরে হুকুম চালানোর মতো এখনো কেউ জন্মায় নি। কিন্তু ভাবী তো তোমার উপরের পিস। হিটলার বউ জুটিয়েছো একেবারে।
– তোর কি ওভারটাইম করার শখ জেগেছে?
– মাফ চাই, ভাই। ভুল হয়ে গেছে।
অভ্রের ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। তিনদিন পর ঐন্দ্রিলার ধমক শুনছে সে। আজকাল মেয়েটার শাসন অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মেয়েটার শাসন না থাকলে যেনো সবকিছু লবণ বাদে খাবারের মতো লাগে।
ঈদ্রিশকে এগিয়ে দিতে গেট অবধি আসলো ঐন্দ্রিলা। অভ্রকে উঠতে দেয় নি। ধমক দিয়ে শুইয়ে রেখেছে। ঈদ্রিশ গেটে কাছে এসে বললো,
– ভাবি আসছি, আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। তবে চা টা দারুণ ছিলো।
– ধন্যবাদ
– কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?
– জ্বী বলুন?
– ভাইয়া মানুষটা খারাপ নয়। একটু অন্যরকম। তার কাছে জীবনটা সূত্রের বাহিরে পরে না। সব কিছু ক্যালকুলেশন অনুযায়ী করার চেষ্টা করে সে। তবে মানুষটা কিন্তু মন্দ নয়। আর সে আপনাকে আর পাঁচ জনের কাতারে ফেলে না। যে লোকের সামনে কেউ উচু গলায় কথা বলে না। সে মাথা নত করে আপনার ধমক শুনে। বুঝতেই পারছেন তাহলে আপনি তার লাইফে কতটুকু ঘিরে আছেন। কিন্তু এগুলো সে কখনোই নিজ থেকে বলবে না। কারণ তার অতীতটা এতোটাই কন্টকময়, যে বর্তমানেও তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নিজেকে আজ ও জ্যানিফারের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে এসেছে সে। তার গ্লানিবোধটুকু এতোটাই যে তাকে চোরাবালির মতো প্রতিনিয়ত গিলে খাচ্ছে। আমি জানি আমার কথাগুলো অহেতুক লাগছে। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি চাইলে তাকে এই চোরাবালি থেকে মুক্ত করতে পারেন। একটু চেষ্টা করেই দেখুন না। আজ আসি তবে।
ঈদ্রিশের কথাগুলো চুপ করে শুনলো ঐন্দ্রিলা। এই জ্যানিফার নামক ব্যাক্তিটির সাথে অভ্রের অতীত তাকে প্রচুর ভাবাচ্ছে। জ্যানিফার নামক মেয়েটি অভ্রের এমন এক অধ্যায় যা শেষ হয়ে৷ যাবার পর ও প্রতিনিয়ত তার বর্তমানে হানা দিচ্ছে। এই রহস্যের সমাধানটা করতেই হবে ঐন্দ্রির।
পিউকে সাজিয়ে দিচ্ছে আসমা বেগম।৷ আজ শিহাবের বাবা-মা তাকে দেখতে আসছে। বদরুল সাহেব যখন পিউকে তার পছন্দ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন তখন কোনো উত্তর ছিলো না তার কাছে। কারণ আজ অবধি তার কারোর সাথে প্রেমের কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি। তাই কোনো আপত্তি করে নি সে এই বিয়েতে। পিউ এর সম্মতি পেয়ে বেশ খুশি হন বদরুল সাহেব। অবশ্য পিউ এর মাঝে এই বিয়ে নিয়ে বিন্দু মাত্র উৎসাহ নেই। তার মোটেই সাজতে ভালো লাগছে না। কিন্তু কাউকে তা বলতে পারছে না। কারণ এই কারণটা নিজেও জানে না সে। এর মাঝেই বদরুল সাহেব উপস্থিত হয় সেখানে। তার মুখের অবস্থা বেজার। আসমা বেগম বললেন,
– কি গো উনারা কখন আসবেন?
– উনারা আসবে না আসমা। শিহাব কে আমার ভাগ্নীর প্রেমিক মেরে হাসপাতালে পৌছে দিয়েছে…………
চলবে
#স্বপ্নছায়া
#১৩ম_পর্ব
পিউকে সাজিয়ে দিচ্ছে আসমা বেগম।৷ আজ শিহাবের বাবা-মা তাকে দেখতে আসছে। বদরুল সাহেব যখন পিউকে তার পছন্দ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন তখন কোনো উত্তর ছিলো না তার কাছে। কারণ আজ অবধি তার কারোর সাথে প্রেমের কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি। তাই কোনো আপত্তি করে নি সে এই বিয়েতে। পিউ এর সম্মতি পেয়ে বেশ খুশি হন বদরুল সাহেব। অবশ্য পিউ এর মাঝে এই বিয়ে নিয়ে বিন্দু মাত্র উৎসাহ নেই। তার মোটেই সাজতে ভালো লাগছে না। কিন্তু কাউকে তা বলতে পারছে না। কারণ এই কারণটা নিজেও জানে না সে। এর মাঝেই বদরুল সাহেব উপস্থিত হয় সেখানে। তার মুখের অবস্থা বেজার। আসমা বেগম বললেন,
– কি গো উনারা কখন আসবেন?
– উনারা আসবে না আসমা। শিহাব কে আমার ভাগ্নীর প্রেমিক মেরে হাসপাতালে পৌছে দিয়েছে। ছেলেটার বা হাতে ফ্রাকচার হয়েছে।
বদরুল সাহেব বরফ শীতল কন্ঠে কথাটা বললেন। কথাটা তিনি আসমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেও তার দৃষ্টি পিউ এর দিকে স্থির। বদরুল সাহেবের প্রথম লাইনটি শুনে হুট করেই পিউ এর মনে শিহরণ জেগে উঠলো। উদাস মনটা হুট করেই প্রফুল্লতায় ভরে উঠলো। অন্য সময় হলে সে হয়তো নেচেই উঠতো। কিন্তু তার শেষ দুটো কথা শুনে তার হৃদ্দয় থমকে গেলো। এজন্য নয় যে শিহাব হাসপাতালে হাত ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে। বরং এজন্য যে ব্যাক্তি শিহাবকে মেরেছে সে নিজেকে তার “প্রেমিক” হিসেবে দ্দাবি করেছে। প্রেমিক শব্দটি পিউ এর মাথায় পেন্ডুলামের মতো পর্যাবৃত্ত গতিতে ঘুরছে। আজ পর্যন্ত তার জীবনে এই শব্দটির অস্তিত্ব ছিলো না। অথচ আজ বলা নেই কয়া নেই কোথা থেকে প্রেমিক নামক শব্দটি তার জীবনে এসে টপকালো। অজানা কারণেই লোকটাকে সামনা-সামনি দেখতে খুব ইচ্ছে করছে পিউ এর। হয়তো এটা বয়সের দোষ। বিজ্ঞানীরা বলে ১৫-২৫ বছরের মেয়েদের আবেগ সর্বোচ্চ নাকে। তাই তো অজানা, অদেখা লোকটাকে দেখার প্রবল বাসনা মনে উকি দিচ্ছে পিউ এর। আসমা বেগম ধপ করে খাটে বসে পড়লেন। মাথায় হাত দিয়ে বলেন,
– সে কি কথা? আমার তো মাথা ঘুরাচ্ছে! কি বলছো তুমি? শিহাব হাসপাতালে?
– শুধু তাই নয়। ইকবাল সাহেব আমাকে ফোন দিয়েছেন। ভাগ্নের এমন দূর্দশায় তার মাথাটা বিগড়ে গেছে। অকথ্য বাসায় আমাকে কথা শুনিয়েছেন। তার ভাষ্য মতে আমার ভাগ্নী চরিত্রহীন। সে তার এই বিয়েতে অমত ছিলো বলেই এমন একটি ঘৃণ্য কাজ করেছে। আমিও তাকে দুকথা শুনিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি তো আমার ভাগ্নীকে চিনি। তাই আমি নিজ থেকে বিয়ের সম্বন্ধটা ফিরিয়ে দিয়েছি। ঠিক করেছি না পিউ মা?
বদরুল সাহেব হুট করেই প্রশ্নটা করলেন। পিউ তখন ও “প্রমিক” সম্বোধন করা লোকটির চিন্তার গোলকধাধায় ছিলো। তাই বদরুল সাহেবের প্রশ্নটি শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সে। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– হ্যা?
– বললাম, আমি বলেছি আমার ভাগ্নী কখনো এমন কারোর সাথে প্রেম করতেই পারে না। তার রুচিতে বাঁধে। আর যে শিহাবকে মেরেছে তার সাথে পিউ এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ যদি তার কাউকে পছন্দ হতো, তবে সে নিজ থেকেই আমাকে বলতো। আমার ভাগ্নী আমাকে মিথ্যে বলতে পারে না। ঠিক বলেছি না?
বদরুল সাহেব পিউ এর পরখ করছেন। পিউ তার মামুর এমনধারা কাজের সাথে বেশ আগ থেকেই পরিচিত। তিনি তাকে সন্দেহ করছেন। করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। বদরুল সাহেব তাকে দুটো ব্যাপারে সাবধান করে দিলেন; এক- পিউ যেনো এমন বখাটে কাউকে বেঁছে না নেয়; দুই- পিউ যাতে ব্যাপারটা তার কাছ থেকে এই প্রেমের ব্যাপারে তাকে মিথ্যে না বলে। এটাকে এমোশনাল ব্লাকমেইলের একটা অংশ ও বলা যায়। পিউ এর মামুর কাজে বেশ হাসি পেলো। কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করলো না। ধীর কন্ঠ বললো,
– মামু, তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে কখনো মিথ্যে বলি নি, বলবো ও না। যদি কাউকে কোনোদিন ভালোবেসেও থাকি, নির্ভীক হয়ে তোমাকে বলবো। তুমি শুধু আমার মামু নও, আমার অনেক প্রিয় বন্ধুও। বন্ধুকে আর যাই হোক মিথ্যে বলা যায় না।
পিউ এর কথায় স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বদরুল সাহেব। তার ভেতর অনন্য গর্ববোধ হচ্ছে। তার ভাগ্নী তাকে ঠকায় নি। আসমা বেগম পিউ এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আফসোসের কন্ঠে বললেন,
– তুই মন খারাপ করিস না মা? যে তোর নাম বদনাম করেছে সে মোটেই সুখী হবে না দেখিস! বেয়াদব! হারামী!
– মামী, কারোর খারাপ চাওয়া উচিত না। তুমি তাকে বদদোয়া দিও না। আল্লাহ তাআলা যা করেন, ভালোর জন্য করেন। এতে আমার হিত নেই বিধায় ই বিয়েটা ভেঙ্গেছে। এভাবে চিন্তা করো, মানুষটা এখন আমার চরিত্র নিয়ে আজেবাজে কথা শুনেই বিশ্বাস করে নিয়েছে। এই ঘটনাটা বিয়ের পর হলে কি হতো? নিশ্চয়ই কোনো মঙ্গল রয়েছে। আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ঠিক আছি, শুধু একটু ঘুমাতে চাই। আযান দিলে ডেকে দিও। এখন আমি ঘুমাবো।
পিউ এর শান্ত কন্ঠে কথাটা শুনে আসমা বেগম খানিকটা স্বস্তি পেলেন। মেয়েটা যে ভেঙ্গে পড়েনি এটাই অনেক। তার কাছে পিউ নিজের মেয়ের চেয়েও আদরের। যখন তিনি বিয়ে করে এই পরিবারে আসেন। তখন পিউ এর বয়স মাত্র কয়েক মাস। বিয়ের সাত বছর পরও যখন মাতৃত্বের স্বাদ তিনি পান নি তখন এই পিউটিকে বুকে জড়িয়েই তার মাতৃত্বের যন্ত্রণা নিবারণ হতো। সাত বছর পর তিনি দিশাকে গর্ভে ধারণ করেন। কিন্তু তখন ও তার জন্য পিউ ই তার বড়মেয়ের স্থানটি দখল করেছিলো। তাই মেয়েটির ব্যাপারে সর্বদাই আসমা বেগম অতিরিক্ত সংবেদনশীল। একসময় তো ভাবতেন, নিজের কাছেই পিউ কে রেখে দিবেন। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মানোর মানেই সে এক না এক সময় অন্যের ঘরে যাবে। তাই তার খুব ইচ্ছে ছিলো নীলাদ্রির সাথে মেয়েটার বিয়ে দিবেন। কিন্তু সে ইচ্ছের গুড়েবালি; বদরুল সাহেব আত্নীয়ের মাঝে বিয়ের ঘোর বিরোধী। তার ধারণা এই বিয়েতে সম্পর্ক নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হয় না। কারণ বদরুল সাহবের খালাতো দুই ভাইয়ের ছেলে এবং মেয়ের বিয়ে হবার পর থেকেই সেই ভাই দুজনের মাঝে ছত্রিশের আকড়া হয়ে গিয়েছে। তাই সাহস করে কখনো সেই কথাটা বলতে পারেন নি আসমা বেগম। স্বামীর রাগ সম্পর্কে ভালো ধারণাই তার আছে। অহেতুক ঝুঁকি নিতে চান না তিনি। তবে পিউ এর জন্য তার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। এই চাঁদের মতো মেয়ের গায়ে কি না এক বাঁদর কালীমা একে দিলো!!
৮.
দিশানের কান্নামাখা মুখটা দেখতে একেবারেই ভালো লাগছে না ঐন্দ্রিলার। সকাল থেকে ছেলেটা কেঁদেই যাচ্ছে। আজ তাদের ঢাকা ফেরার কথা ছিলো। অধীর আগ্রহে দিশান বসে ছিলো আজ তার মাম্মাম ফিরবে৷ কিন্তু যখন তার দাদী জানালো আজ তার মাম্মাম ফিরছে না, অমনি কান্নার প্রলয় এলো। এই দূর্যোগ সামলানো অন্তত শারমিন বেগমের দ্বারা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে ঐন্দ্রিলাকে ফোন করেছে তিনি। ভিডিও কলের সুবিধাটা আজকের দিনের সবচেয়ে অন্যতম আবিষ্কার। এই ভিডিও কল আছে বলেই হয়তো দূরের মানুষ গুলোকে খুব একটা দূর মনে হয় না। ঐন্দ্রিলাকে দেখতে পেয়ে বাচ্চাটা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো। এই কয়দিনে ঐন্দ্রিলার মনে দিশানের জন্য মাতৃস্নেহ তৈরি হয়েছে। ছেলেটা কাঁদলে তার মনটা কাঁদে। দিশানকে নিয়ে আসলে হয়তো ভালো হতো। কিন্তু কে জানতো এখানে অভ্র অসুস্থ হয়ে যাবে। আজকের ড্রাইভিং এর ধকল টা সে নিতে পারতো না। ঐন্দ্রিলা ব্যাথিত স্বরে বললো,
– কাঁদে না বাচ্চা। আমি আগামীকাল ই চলে আসবো। আমার আব্বু তো স্ট্রং বেবি। স্ট্রং বেবিরা কাঁদে না সোনা।
– মাম্মাম আমাকে নিয়ে যাও। আমি তোমাল কাচে যাবো।
– বাবু আর একটা দিন। তুমি এভাবে কাঁদলে মাম্মাম ও কেঁদে দিবে। সোনা, তুমি কান্না থামাও। নয়তো দাদীর কষ্ট হবে। আহানা তোমাকে কিভাবে সামলাবে?
– আহানা পচা, ও আমাকে বকে। তুমি আসো।
দিশানের কান্নার জোর বাড়তে লাগলো। সে হিচকি দিয়ে কাঁদছে। তখন ই ঐন্দ্রিলার পেছনে এসে অভ্র দাঁড়ালো। অভ্র গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– দিশান তুমি যদি আজ সারাদিন না কেঁদে থাকো তবে বাড়ি ফিরে আমি তোমাকে তোমার পছন্দের কার কিনে দিবো। এটা তোমার জন্য টাস্ক। তুমি যদি টাস্ক কমপ্লিট করতে পারো তবে কার পাবে তুমি। আর না পারলে তোমার একটা প্রিয় খেলনা তোমার থেকে কেঁড়ে নিবো। এখন তোমার ডিসিশন। ভালো বেবির মতো থাকবে নাকি কাঁদবে।
অভ্রের কথা শুনে ঐন্দ্রিলা হা হয়ে যায়। একটা তিন বছরের বাচ্চার সাথে এভাবে কে কথা বলে! ঐন্দ্রিলা আরো ও অবাক হয় এটা দেখে যে দিশান চুপ হয়ে গেছে। সে ফুপাচ্ছে কিন্তু শব্দ করছে না। ঐন্দ্রিলা দিশান বললো,
– বাবু তুমি তোমার বাবাকে দেখিয়ে দিও তুমি কতো ভালো বাচ্চা ওকে?
– অকে
– তাহলে আমি ফোনটা রাখি?
– হুম
– টাটা
শারমিন বেগম এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেল। অবশেষে তার নাতী কাঁদা নামিয়েছে। এদিকে ফোনটা কেঁটেই ঐন্দ্রিলা কড়া দৃষ্টি৷ প্রয়োগ করলো৷ অভ্রের উপর। অভ্র কিছু না বুঝার ভাব৷ নিয়ে বললো,
– কি হলো? চোখ দিয়ে গিলে খাবে নাকি?
– আপনাকে আসলেই গিলে খাওয়া উচিত। এভাবে কোনোবাচ্চার সাথে কেউ বিহেব করে?
বলেই হাটু গেড়ে বিছানায় বসে ঐন্দ্রিলা। অভ্র নির্লিপ্ততার সাথে বলে,
– বাচ্চাটা আটার দলা হয়, তুমি তাদের যেভাবে মানুষ করবে তারা ঠিক যেভাবেই মানুষ হবে। এখন দেখো তুমি ওকে আহ্লাদ দিলে ও আহ্লাদি ই হবে। ফলে মা বা আহানা কষ্ট হবে ওকে সামলাতে। আমরা তো এখন তার কাছে নেই। যে ছুটে তাকে থামাতে পারবো। তাই আমাদের বাচ্চাদের এমন ভাবে মানুষ করা উচিত যাতে তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। সবসময় কি তুমি ওর কান্না থামাতে ছুটে যাবে? না, তুমি যাবে না। তাই ওকে নিজের উপর নির্ভর থাকতে হবে। আমি সেটার জন্য একটু অন্যভাবে ওকে তৈরি করছি। আজ যদি সে সত্যি আর না কাদে, তবে আমি তাকে গাড়ি কিনে দিবো। ফলে ও বুঝতে পারবে কোন কাজটা প্রশংসাযোগ্য। ফলে ও কিছু পাওয়ার আশাতেও সেই কাজটা করবে। আর ওর পানিস্মেন্টের কথা সেটাও জরুরি। এখন থেকেই ওকে হারানোর ভয় থাকতে হবে। ভয় মানুষ কে পেতে হবে এটা জরুরি নয়, তবে পরিস্থিতিকে ভয় পাওয়া দরকার। এতে করে ও বুঝতে পারবে, কোন কাজ তার জন্য ক্ষতিকর। কোন কাজ করলে সে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলবে। বুঝলে, দিশানের মাম্মাম?
ঐন্দ্রিলা হা করে অভ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটার মধ্যে একজন আদর্শ বাবার সকল ধরণের গুন রয়েছে। সে দিশানকে আদর করে আবার শাসন ও করে। কিন্তু তার শাসনটা বেতাঘাতের মতো নয়। যত দিন যাচ্ছে ততই যেনো অভ্রকে নতুন করে আবিষ্কার করছে ঐন্দ্রিলা। লোকটার কত আবরণ! একটার পর একটা আবরণ খুলছে আর মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে তার হৃদয়হীন বরকে। অভ্রের মাথায় খানিকটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে। সে ঐন্দ্রিলার কাছে এসে ফু দিয়ে তার কপালের চুল গুলো সরিয়ে দেয়। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,
– কি দেখছেন দিশানের মাম্মাম? আমি কি সুন্দর হয়ে উঠেছি? এভাবে দেখতে থাকলে তো প্রেমে পড়ে যাবেন।
– পড়ার তো কিছু নেই, অলরেডি প্রেমে পড়ে সাঁতার কাটছি। ডুবেও যেতে পারি……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি