স্বপ্নছায়া,পর্ব:১১

0
538

#স্বপ্নছায়া
#১১ম_পর্ব

অভ্র অবাক নয়নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীকে দেখছে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে যেনো কোনো বর্ষায়৷ ভেজা শ্বেত কদম ফুল দুহাত ফেলে বর্ষাকে আলিঙ্গন করছে। অজান্তেই এই ফুলকে ছোয়ার আশায় এগিয়ে গেলো সে। বৃষ্টির শীতল পানিতে ভিজতে বেশ ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। তার খেয়াল ও নেই একটি মানুষ তাকে গভীর নয়নে দেখছে। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার ঘাড়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে। একজোড়া শীত হাত তার কোমড় আকড়ে ধরেছে। একজোড়া উষ্ণ ঠোঁট তার ঘাড় স্পর্শ করছে। এক মূহুর্তের জন্য ঐন্দ্রিলা স্থির হয়ে গেলো। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে গেলো। ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো সে। এই স্পর্শটা মন্দ লাগছে না তো! সে কি তবে প্রতীক্ষায় ছিলো। তার হৃদয় কি তবে স্পর্শ কাতর হয়ে ছিলো। অভ্র তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রয়েছে। প্রকৃতির উম্মাদনায় আজ তারও উম্মাদ হতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে এই রমনীতে বিলীন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঐন্দ্রিলা নিজেকে ছাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সকালের অপমানটা এখনো ভুলে নি সে। আবারো কারোর হাসির খোরাক হতে চায় না সে। অহেতুক মায়ায় জড়িয়ে কি লাভ! যেখানে দুটিই মনের মাঝে কোনো হাজারো ক্রোশের দূরত্ব সেখানে শুধু শারীরিক মিলনটা অহেতুক। ঐন্দ্রিলাকে ছটপট করতে দেখে খানিকটা বিরক্ত হলো অভ্র। মৃদু ধমকের স্বরে বললো,
– নড়ছো কেনো এতো?
– ছাড়ুন আমাকে।

কাঁপা কন্ঠে ঐন্দ্রিলা বলে উঠলো। অভ্র আরোও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো এবং ধীর স্বরে বললো,
– একটু শান্ত থাক না। শুধু এই মূহুর্ত টা আমাকে তোমাতে বিলীন হতে দাও।
– তারপর? মূহুর্তটা কেটে গেলে আমাকে আবারো দূরে সরিয়ে দিবেন তাই না?

ঐন্দ্রিলার শান্ত গলার প্রশ্নে অভ্র থমকে যায়। অভ্রকে স্তব্ধ থাকতে দেখে ঐন্দ্রিলা আবারো বলতে থাকে,
– আমি কারোর কয়েক মূহুর্তের মোহ হতে চাই না, সারাটা জীবনের অভ্যাস হতে চাই। আপনার বিলাসিতা নয় প্রয়োজন হতে চাই। শুধু শারিরীক নয়, মানসিক সঙ্গী হতে চাই; যার বিস্তার আপনার হৃদয়ে হবে। অবশ্য যে হৃদয়ে জ্যানিফারের রাজত্ব সে হৃদয়ে আমার মতো হতদরিদ্রেরর ঠায় হবে না। আমি কেবল ই একজন বহিরাগত, যার প্রবেশ আপনার ঘরে থাকলেও হৃদয়ে নেই। আমি বরাবর ই নাকউঁচু ধাঁচের। হৃদয়ের যন্ত্রণা নিবারণের জন্য নিজের আত্নসম্মানের জ্বলাঞ্জলি দেবার পক্ষপাতী আমি নই। আমি বলবো না, আমাকে ব্যাতীত কাউকে ভালোবাসা যাবে না; আমি বলবো না জ্যানিফারকে ভুলে যেতে হবে। তবে আমি শুধু শরীরের খোরাক হতে চাই না। যদি কখনো আপনার মনের খোরাক হতে পারি তবে একবার বলবেন; নিজেকে উজার করে দিবো। বলুন, আমি কি আপনার মনের কুঠিরে নিজের জন্য একটু হলেও জায়গা করতে পেরেছি?

অভ্র চুপ করে আছে। তার কাছে উত্তর নেই। তার হাত জোড়া আলগা করে দিলো সে৷ ধীর পায়ে সরে আসলো সে। ঐন্দ্রিলার বুকে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অভ্র সেখান থেকে সরে যেতে নিলে ঐন্দ্রিলা ঘুরে কলারটা টেনে ধরে। অভ্রের চোখে চোখ রেখে এক রাশ অভিমান নিয়ে বলে,
– এতোটা কাপুরুষ কেনো আপনি? আপনার ভাই আমাকে বিয়ের আগে ভরা মশলিশে অপমান করে চলে গিয়েছিলো। আর আপনি প্রতিটাক্ষণ আমাকে অপমাণ করছেন। যদি ভালোবাসতেই না পারেন তবে কেনো মিথ্যে আশার হাতছানি দেন? যদি দূরে ঠেলেই দেবার থাকে তবে কেনো কাছে আসেন? কেনো আমার মনে আশার আলো জাগান? কেনো? যে মারা গিয়েছে তাকে আকড়ে আর কতদিন থাকবেন? কতোদিন নিজের মনের দরজায় তালা লাগিয়ে রাখবেন? বলুন

অভ্র চুপ করে আছে। উত্তরটা হয়তো তার কাছে আছে কিন্তু উত্তরটা শোনার মতো সাহস ঐন্দ্রিলা কেনো কোনো মেয়ের ই নেই। সম্পর্কের ভিত্তি কখনোই মিথ্যে হয় না। যেকোনো সম্পর্কের সূচনা তিক্ত হলেও সত্য দিয়ে করতে হয়। নয়তো একটা সময় সেটায় ফাটল ধরবেই। অভ্র শীতল কন্ঠে বললো,
– তুমি সত্যটা মেনে নিতে পারবে না ঐন্দ্রিলা। সত্য যে খুব তিক্ত। উত্তর গুলো সহ্য করতে পারবে তো? আমার সত্যগুলো মেনে আমাকে ভালোবাসতে পারবে? পারবে না। এর চেয়ে এই ভালোবাসার চ্যাপ্টারটা না হয় আমাদের সম্পর্কে নাই বা থাকলো। ভালোবাসা আমাকে নিঃস্ব করেছে। আমি দ্বিতীয়বার নিঃস্ব হতে চাই না ঐন্দ্রি। আমি ধ্বংস হতে চাই না। আমি তো বলেই দিয়েছিলাম, আমার কাছে ভালোবাসার দাবি করবে না। আমি এই অহেতুক অনুভূতিতে জড়াতে চাই না।
– আমাকে এতোটা দূর্বল ভেবেছেন আপনি? সব জেনেও আমি যদি দিশানকে মেনে নিতে পারি; তবে আমি আপনার বিক্ষিত ধ্বংসাবশেষগুলো কেনো কুড়িয়ে নিতে পারবো না! আফসোস আপনি আমাকে এতোটা দূর্বল ভাবেন!

ঐন্দ্রিলা অভ্রের কলার দিলো। দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো সে। বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু অভ্র সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেজা শার্ট থেকে পানি পড়ছে, ঠান্ডা বাতাসে শরীর কাঁপছে। কিন্তু অভ্র নড়ছে না। সে কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
– একজন খুনীকে কি ভালোবাসা যায় ঐন্দ্রি

পরিবেশ শান্ত, ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাগানের ভেজা ঘাসের উপর ভেজা শরীরে অভ্র দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চাহনীতে শূন্যতা___________

দুপুর ১.৩০টা,
ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে রয়েছে শিহাব এবং নীলাদ্রি। শিহাব এইচ.আর ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। লম্বা, ফর্সা, লিকলিকে শরীরের ছাব্বিশ বয়সের ছোকড়া সে। চুল গুলো বেশ কায়দা করে জেল দেওয়া, চোখে চশমা। ছেলেটার মধ্যে কোনো ক্ষুদ নেই। ছয় মাস হয়েছে ছেলেটা জয়েন করেছে। তাই নীলাদ্রির সাথে তার পরিচিতি পর্বের সুযোগ হয়ে উঠে নি। নীলাদ্রি সবার থেকে শুনেছে, ছেলেটা নাকি অতিরিক্ত ভদ্র। কারোর সাথে মন্দ ব্যাবহারের এই অবধি কোনো রেকর্ড নেই। সিগারেট খায় না, মদ নেশায় সে একেবারেই নেই। মারপিট থেকে চারশ গজ দূরে থাকে। ছেলেটাকে এক দেখাতেই খালুর পছন্দ হয়ে যাবে। তাই এখন অন্য পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অনেকটা রিভার্স সাইকোলজি যাকে বলে। বদরুল সাহেব না করুক বা শিহাব কথাটা তো একই। পিউ এর বিয়ে টা ভাঙ্গাই মূল উদ্দেশ্য। শিহাব খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছে। অপরিচিত সিনিয়র কলিগের সাথে বসে খেতে তার খানিকটা ইতস্ততবোধ ও হচ্ছে। নীলাদ্রি খানিকটা উৎসাহের সাথে বললো,
– তা গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড আছে নাকি?

একে বেঁচারা ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে যাচ্ছে, উপরে এমন অদ্ভুত প্রশ্নে তার বিষম খাবার জোগাড়। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে বললো,
– না ভাই, ছিলো গার্লফ্রেন্ড কিন্তু ব্রেকাপ হয়ে গেছে।
– কেনো?

নীলাদ্রির প্রশ্নে শিহাব আরোও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অচেনা একজনকে নিজের ব্যাক্তিগত ব্যাপার বলাটা ভালো হবে কিনা সে বুঝতে পারছে না। তবুও সিনিয়র কলিগ তাই কিছু বলতেও পারছে না। আমতা আমতা করে বললো,
– ছিলো কিছু ইস্যু। আসলে আমার বাবা-মা আমার বিয়ের কথা চালাচ্ছে। তাই এখন আর প্রেম করবো না ঠিক করেছি।
– ওহ! তা মেয়ে দেখেছো?
– না ভাই! দেখি নি। তবে মা বলেছে অনেক সুন্দরী। সামনের সপ্তাহে দেখতে যাবো।

একটু লাজুক স্বরেই কথাটা বললো শিহাব। নীলাদ্রির ইচ্ছে করছিলো শিহাবকে তুলে আছাড় মারতে। কিন্তু অফিসে শুধু শুধু সিন ক্রিয়েট হবে। তাই সে কিছু করলো না। কিন্তু শিহাবের স্বপ্নে ব্যাঘাত তো ঘটাতেই হবে। তাই উদাস কন্ঠে বললো,
– আসলে কি জানো তো! আমার ও বিয়েটা এরেঞ্জ ই ঠিক হয়েছিলো। মেয়েও দারুণ সুন্দরী ছিলো। বাবা-মা এর কথায় মেয়ের সাথে দেখা করতে রাজী হয়ে গেলাম। আমি তো সুন্দরী বউ এর স্বপ্নে বিভোড় ছিলাম। আমি মেয়ের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম তখন একদল গুন্ডা এসে ওরে মার, ওরে মার মারলো। পড়ে জানতে পারলাম ওটা নাকি মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ছিলো। এখনো সেই মারের কথা মনে আছে। তুমিও খোঁজ নিও, সুন্দরী মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিকরা খুব ডেঞ্জারাস হয়। যখন ক্যালায় না হাড় ভেঙ্গে দেয়। ক্যারাটে পারো তো?
– আজ্ঞে না?
– তাহলে আর কি! আল্লাহ ভরসা। সাবধানে থেকো। আমার খাওয়া শেষ

বলেই নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ালো। মুখে শয়তানি হাসি এঁকে হাটা দিলো নিজের রুমের দিকে। পেছনে তাকালে শিহাবের চিন্তিত মুখখানা দেখতে পেতো। বেঁচারা এখনো কপাল কুঁচকে বসে রয়েছে। সুন্দরী বউ স্বপ্নটা খানিকটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে। এদিকে নীলাদ্রি তার আগামী পরিকল্পনার ছক কষতে কষতে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো।

৭.
ভিলার পেছনের পুকুরে পা ঢুবিয়ে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। ঠান্ডা পানিতে পা ঢুবিয়ে থাকার মজাই আলাদা৷ পুকুরটি সাদা শাপলায় ঘেরা। সাদা শাপলা খুব একটা দেখা যায় না এখন। ঢাকার মতো ইট পাথরের শহরে এই ফুলটি বেশ বিরল। এখানে না আসলে প্রকৃতির এতোটা কাছে আসা যেতো না। দিনের বেলায় ভিলার সৌন্দর্য যেনো দ্বিগুন বেড়ে যায়। এক পাশে কদম, বেলীর উম্মাদনা তো অন্য পাশে কৃষ্ণচূড়ার মেলা। ঐন্দ্রিলা আজ অনেক কদম ফুল ছিড়েছে। তার কদম ফুল খুব ভালো লাগে। ফুলটি দেখলেই বর্ষাকালের অনুভূতি পাওয়া যায়। এখানে থাকতে খুব ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। কিন্তু আগামীকাল ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। সেই রাতের পর থেকে অভ্র তার সামনে আসে নি। নিজেকে যেনো আড়াল করে ফেলেছে সে। ঐন্দ্রিও তাকে খুঁজতে যায় নি। যে নিজেই হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এর মাঝেই বাড়ির কেয়ারটেকার লতিফ ছুটে আসে ঐন্দ্রিলার কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– ভাবীজান, একটু ভেতরে আসেন।
– কি হয়েছে লতিফ ভাই?
– ভাইজানের শরীরটা ভালা নাই………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here