#স্বপ্নছায়া
#১০ম_পর্ব
ঐন্দ্রির কথা শুনে বাঁকা হাসি হাসে অভ্র। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুট করেই ঐন্দ্রিলার কোমড় আকড়ে নিজের কাছে টেনে নেয়। অভ্রের এমন কাজে চোখগুলো বড় হয়ে যায় ঐন্দ্রিলায়। নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে টিটকারির স্বরে বলে,
– কেনো ভয় পাচ্ছো? একা আমার সাথে, তিন দিন৷ কেউ থাকবে না আমাদের মাঝে। শুধু তুমি আর আমি। বলা তো যায় না যদি কিছু হয়ে যায়, ভুল ত্রুটি।
অভ্র খানিকটা ঝুকে গেলো ঐন্দ্রিলার দিকে। তার গরম নিঃশ্বাস ঐন্দ্রিলার মুখে পড়ছে। অজানা কারণে তার বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়। হাত পা খানিকটা ঠান্ডা হয়ে যায়। অভ্র খানিকটা নেশাকাতর স্বরে বলে,
– আজকাল বাতাসেও প্রেম প্রেম গন্ধ বইছে। সেই সুযোগে তুমি আমাতে ডুবে গেলে আর আমি তোমাতে। কেউ থাকবে না আমাদের মাঝে।
বলেই ঐন্দ্রিলার কপালের চুল গুলো আলতো স্পর্শে কানের কাছে গুজে দেয়। অভ্রের স্পর্শে ঐন্দ্রিলার মনে অজানা শিহরণ জাগে। তার গালদুটো লাল হতে লাগলো। অভ্রের চোখ চোখ রাখতেও তার লজ্জা করছে। এতোটা লাজুক এর আগে কখনো ঐন্দ্রিলা হয়েছিলো কি না তার মনে নেই। ঐন্দ্রিলা চোখটা নামিয়ে নিলো। অভ্র আরেকটু ঝুকে এলো৷ তার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– লজ্জা পেলে বাঘিনীকেও রমনী লাগে।
বলেই ঐন্দ্রিলাকে ছেড়ে দেয় সে। আর হো হো করে হাসতে লাগে। ঐন্দ্রিলা এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অবাক নজরে অভ্রকে দেখছে সে। তার হৃদস্পন্দন এখনো তীব্র হয়ে আছে। তার কান যেনো অভ্রের উত্তাপিত নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছিলো। অভ্র কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলে,
– যাক তোমাকেও কিস্তিমাত করা যায়। আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি কেবল
– ডোন্ট ওয়ারি, আমি তোমার সাথে প্রেম করতে সেখানে যাচ্ছি না। কাজে যাচ্ছি, সেটা নিয়েই ব্যাস্ত থাকবো। আমি থেকেও থাকবো না।
-…….
– বাবাকে মানা করলে উনি আরোও জোর করতো। বুড়ো মানুষটাকে অহেতুক উত্তেজিত করতে চাই নি। প্যাকিং করে নাও, আমরা সন্ধ্যায় বের হবো।
কথাগুলো বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো অভ্র। তারপর নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। ঐন্দ্রিলা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনের মাঝে যেনো কালো মেঘ ছেয়ে গেলো। অজানা কারণে আজ কষ্ট হচ্ছে তার। এক মূহুর্তের জন্য আবেশে জড়িয়ে গিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো তাদের মাঝেও হয়তো আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো একটা মায়ার মোহনজাল তৈরি হবে। কিন্তু সে ভুল ছিলো। নিজের বোকামির উপর নিজের ই রাগ হচ্ছে তার। যে মানুষটা বিয়ের রাতে কিনা নবুবধুর সাথে ডিল ক্রাক করে তার কাছ থেকে এমন একটি ব্যাবহার খুব একটা আশ্চর্যজনক নয়। ঐন্দ্রিলা কোনো কথা বললো না। তার মনে বিষাধের কালো মেঘ ভর করেছে। বর্ষণ হবার পূর্বাভাস। ঐন্দ্রিলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টির ক্রন্দন থেমেছে কেবল। আকাশটা এখনো পরিষ্কার হয় নি। কালো মেঘেরা এখনো ঘুরছে দল বেঁধে। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে ঐন্দ্রিলার। নিজের ভেতরের ছাই চাঁপা লিকলিকে আগুনটা জ্বলছে। তাকে নেভানোর উপায় হয়তো এটাই। অনেক দিন যাবৎ তার কন্ঠে সুর তুলে না। তাই চোখ বুঝে গুনগুনিয়ে উঠলো,
“আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন সুখের ভাবনা।
তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন সুখের ভাবনা।
চেয়েছি পেতে যাকে চাইনা হারাতে তাকে
বৃষ্টি তোমাকে তাই ফিরে চাইনা।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম”___________________
অজান্তেই চোখজোড়া ভিজে এলো ঐন্দ্রিলার। কঠোর খোলসের ভেতরের কিশোরীটি আজ কাঁদছে, অনেক দিন বাদে সে আজ কাঁদছে।।
৬.
টেবিলের ল্যাম্প জ্বলছে। হাতে কলম হাতে বসে রয়েছে নীলাদ্রি। কিছু লিখছে আর কাঁটছে। নিচে গোল করে করে নষ্ট করা কাগজ গুলো পড়ে রয়েছে। বিকেল থেকে একটা চিঠি লেখার অদম্য প্রচেষ্টায় সে লিপ্ত। কিন্তু কিছুতেই লেখাটা মন মতো হচ্ছে না। সেদিনের পর থেকে পিউকে একদ্বন্দ ও একা পায় নি সে৷ হয় কাবাবে হাড্ডি দিশাটা আঠার মতো পিউ এর সাথে লেগেছিলো, নয় বদরুল সাহেব বা আসমা বেগমের কারণে কোনো না কোনো ভাবে বাঁধ সেধেছেই। তাই ব্যার্থ প্রেমিকের মতো চিঠিতেই প্রেমনিবেদন করাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে নীলাদ্রির। আজকাল মেয়েটা যেনো একটু বেশি এড়িয়ে চলছে তাকে। নীলাদ্রির ব্যাপারটায় মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই তার। মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু এসব কেবলই দিবাস্বপ্ন। এমন টা কি হতে পারে না, মেয়েটাও আড়ালে আবডালে তাকেই ভালোবাসবে। হতেই পারে! আশায় মানুষ বাঁচে। নীলাদ্রির ব্যাপারটাও সেইরকম। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে তড়িৎ গতিতে কাগজ গুলো ডেস্কের ভেতর লুকিয়ে ফেললো নীলাদ্রি। আজকাল দিশাটা বড্ড পাজি হয়ে গেছে। বাচ্চাদের হাতে এই চিঠি নামক ভয়ানক অস্ত্রটি পড়লে সেটা এট্যোম বোম্বের মতো কাজ করতে সময় লাগবে না। ফলাফলস্বরূপ দুই বাড়ি হিরোশিমা এবং নাগাসাকির মতো ক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। তার সকল চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে শরীফ সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন। নিজের বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো নীলাদ্রি। ঠোঁটের কোনে হাসি একে বললো,
– কিছু লাগবে বাবা?
শরীফ সাহেব কফির মগটা নীলের দিকে এগিয়ে দিলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন,
– দেখ তো বাপ, খাওয়া যাচ্ছে কি না? আমি নিজে বানিয়েছি।
শরীফ সাহেব নীলাদ্রির মুখ থেকে উত্তর জানার অপেক্ষায় আগ্রহী হয়ে আছেন। তার চোখ চকচক করছে। অনেকটা বাচ্চাদের মতো, যখন কোনো বাচ্চা প্রথম কোনো অংকের উত্তর নিজে নিজে মিলায় তখন যেভাবে তার প্রশংসা শুনার জন্য আগ্রহী থাকে; শরীফ সাহেবকেও তেমন লাগছে। নীল কফির কাপে চুমুক দিলো, খারাপ হয় নি। প্রথম এটেম্প এ দশে আট নিঃসন্দেহে দেওয়া যায়। নীলাদ্রি উৎসাহী কন্ঠে বললো,
– বাহ! বাবা এক কথায় দারুণ। তুমি অবসর নেবার পর আমরা বাপ ব্যাটা চাইলে কফি শপ খুলতে পারবো, “ক্যাফে গুনগুন”। একপাশে বই এর তাক থাকবে। মানুষ ধোঁয়া উড়ানো কফির সাথে বই পড়বে। আমি গিটারটা নিয়ে সেখানে গান গাইবো। শ্রীকান্তের গান, অনুপমের গান। আহা! দিনে দশটা কাপ বিক্রি করলে নিমিষেই চারশত টাকা ইনকাম হয়ে যাবে। মাসে বারো হাজার। আর কি লাগে?
শরীফ সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। ছেলের সাথে অনেক দিন পর তার এভাবে আড্ডা হচ্ছে। ঐন্দ্রিলার বিয়ের পর থেকে তাদের মাঝে এক অঘোষিত যুদ্ধ হচ্ছিলো। যাকে ইংলিশে বলা হয় “Cold war”. কোন কামান দাগা ব্যাতীত মানুষকে আহত করা। আজ নিজ হাতে কফি বানানোর প্রচেষ্টা এই যুদ্ধে শান্তির সাদা পতাকা উড়ানোর জন্যই৷ এবং তিনি খুব নিপুনহস্তে এই কার্যসাধন করেছেন। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে শরীফ সাহেব বললেন,
– তোর খালু তোকে খুজছিলেন।
– কেনো বলোতো?
– একটা ছেলের ব্যাপারে সকল ধরণের খোঁজ লাগানোর জন্য। অনেকটা স্পাই এর কাজ যাকে বলে।
– আর মানুষ পেলো না খালু, শেষ পর্যন্ত কিনা আমি?
– হ্যা, অবশ্যই। তুমি হলে তার বিশিষ্ট কমরেড। ছেলেটার নাম শিহাব আহমেদ। ছেলেটা তোমার অফিসেই কাজ করে। তাই তোমার থেকে ভালো খোঁজ কেউ নিতে পারবে না।
– হয়তো অন্য ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু কথা হলো, ছেলেটার খোঁজ নিয়ে খালুর কি কাজ?
– পিউ এর সাথে ছেলেটার বিয়ের কথা চলছে। ছেলের বাবা-মার আমাদের পিউরানীকে খুব পছন্দ৷ তাই এই খোঁজ নেওয়া। ছেলেটার সম্পর্কে সব জেনে বদরুল বিয়ে দিতে চায়। সবাই তো আমার মতো ব্যর্থ পিতা নয়।
শরীফ সাহেবের কন্ঠে আক্ষেপের ছাপ স্পষ্ট। এদিকে পিউ এর বিয়ের কথাটা শুনেই বুকে মোচর লাগে নীলাদ্রির। খুব দেরি করে ফেললো কি সে! পিউ কি তবে অন্যের মনের গৃহে পদার্পণ করবে! তাহলে তার কি হবে!
চট্রগ্রাম পৌছাতে পৌছাতে রাত বারোটা বেজে গেলো অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। অক্লান্ত বৃষ্টির জন্য ড্রাইভ করতে এতোটা দেরি হয়েছে অভ্রের। অভ্রদের ফার্ম হাউজের সামনে গাড়ি থামে। রাতের অন্ধকারে ফার্মহাউজটি যেনো ভূতুড়ে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই লাগছে না। বাগানে ঘেরা ছোট্ট একটা কাঠের দোতালা বাড়ি। বাড়ির সামনে বিরাট ফুলের বাগান। বেলি ফুলের গন্ধ নাকে আসছে ঐন্দ্রিলার। অভ্র বাড়ির কেয়ারটেকার কে খুঁজলো, হাঁক দিলো কিন্তু তার সারা পেলো না। হয়তো ঘুমোচ্ছে। কাছে কোনো ছাতাও নেই। গাড়ি থেকেই নামতেই খানিকটা ভিজে গেলও সে। খুব কষ্টে ব্যাগটা নামিয়েই ছুটলো বাড়ির ভেতরে৷ বাড়ির বাহিরের লাইটে আলো আধারের এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পেছনে ফিরতেই দেখলো ঐন্দ্রিলা দু হাত উজার করে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার সাদা শাড়িটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। তার ঢেউ খেলানো চুল গুলো ভিজে মুখের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। অভ্র অবাক নয়নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীকে দেখছে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে যেনো কোনো বর্ষায়৷ ভেজা শ্বেত কদম ফুল দুহাত ফেলে বর্ষাকে আলিঙ্গন করছে। অজান্তেই এই ফুলকে ছোয়ার আশায় এগিয়ে গেলো সে। বৃষ্টির শীতল পানিতে ভিজতে বেশ ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। তার খেয়াল ও নেই একটি মানুষ তাকে গভীর নয়নে দেখছে। হঠাৎ সে অনুভব করলো…………..
চলবে
[ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি