সে ২.

0
1032

সে ২.
#লেখনীঃসাইমা_ইসলাম_প্রীতি

এলার্মের শব্দে চোখ মেলে তাকাতেই চারপাশ ঝলমলে পরিষ্কার মনে হলো মৌনতার কাছে। মাথার পেছনের দিকে ব্যাথা করছে মৃদু। চোখে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না সব তবে মৌনতা ঠিক বুঝতে পারছে সে তার রুমের বেডে শুয়ে রয়েছে। মৌনতা চমকায়‌। মনে করার চেষ্টা করে আসলে রাতে কি হয়েছিল তার সাথে? সে ছাদ থেকে নিচে চলে এসেছিল, তখন কারেন্ট ছিল না মোম জ্বালাতে গিয়ে কাউকে দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এটাই তো! তাহলে সে তার রুমে এলো কি করে? তার বাবা কি চলে এসেছেন? তার বাড়িতে কি রাতে কেউ ঢুকেছিল? কোনো চোর বা ডাকাত! হতেও তো পারে। মৌনতা দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে বাবার রুমের দিকে গেলো। তারপর এক এক পুরো বাড়িটাই চেক করলো। নাহ, কেই নেই। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিল নাকি ঘুমিয়ে? এটাও কি সম্ভব! মৌনতা ছুটে স্টাডি রুমের সেই জায়গাটাতে আসে যেখানে সে কাল রাতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ভালো করে খুঁজে দেখে সেখানে মোম, লাইটার কিছু নেই। তার টেবিলে মোমের স্টান্ডে নতুন মোম রাখা। তার পাশে লাইটার। সবকিছু নিজস্ব স্থানে আছে দেখে বড় একটা শ্বাস ফেলে মৌনতা। হয়তো সে স্বপ্নই দেখেছে। কিন্তু স্বপ্ন এতোটা বাস্তবিক হয় নাকি ! সে সকল বিষয়ে মাথা ঘাঁটায় না মৌনতা। ব্রেকফাস্ট সেরে চলে আসে ভার্সিটিতে।

ভার্সিটি পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানে গরম প্লাস্টিকের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ব্যাপক চিন্তায় মগ্ন আছে পূর্ণি। মৌনতা তার চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। রাগী স্বরে বলে,

‘ তুই কি যাচ্ছিস আমার সাথে নাকি না? এতো ঢং করার মানে কি? ‘

পূর্ণি আড়চোখে দেখে মৌনতাকে। তেড়ে এসে বলে,

‘ তুই কেন খুললি ওই ঘরটা সবার মানা করা শর্তেও? ‘

‘ আরে আজব তো! এলাকার কয়েকটা মানুষ বললো ওই ঘরটা ভূতুড়ে আর আমি মেনে নেব? কই কিছুই তো হল না আমার? একদম ঠিক আছি, দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি। ‘

‘ আমার ভয় করছে। কাল হয়নি তোর ভাগ্য ভালো। ভূত কি সবসময় এসে গলা চেপে ধরবে নাকি ? হুট করে যখন আসবে তখন বুঝবি। ‘

‘ ধুর বাবা তোর সাথে কথা বললেই টাইম নষ্ট। তোর আসতে হবে না। আমি গেলাম। ‘

এই বলে মৌনতা বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ির কাছে গেলেই পেছন থেকে ছুটে আসে পূর্ণি। দৌড়ে এসে মৌনতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ ওফ এতো চেতোস কেন তুই? আজ আমার সাথে চল না? ‘

‘ না, আমি আমার রুম ছাড়া অন্য কোথায় পড়ে শান্তি পাই না। ‘

পূর্ণি আর কোন উপায় খুঁজে পায় না মৌনতাকে রাজি করার। এই মেয়েকে হাড়ে হাড়ে চিনে সে। একবার যখন বলেছে যাবে না তখন আর কিছুতেই তাকে রাজি করানো যাবে না। বাদাম হয়ে মৌনতার সাথে আসে পূর্ণি। বাড়িটা তার বেশ ভালোলাগে। খুব সুন্দর ডুপ্লেক্স বাড়ি। এরকম বাড়ি সাধারণত সিনেমা ছাড়া সচরাচর দেখা যায় না। এসেই ফ্রেশ হয়ে মৌনতার একটা ড্রেস পড়ে নেয় পূর্ণি। মৌনতা গোসল করে কোমর অবধি লম্বা চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে পিঠ জুড়ে। রান্নাঘরে সবজি কাটতে কাটতে রাগে জ্বলছে তার শরীর। এই কাজের মেয়েটা হলো এক নম্বর ফাঁকিবাজ। সবসময় কাজ করতে আসতে টালবাহানা। আজকেও সব রান্নাবান্না তাকেই করতে হচ্ছে।

মনোযোগ দিয়ে সবজি কাটাতে কাটতে হঠাৎই হাত থেমে যায় মৌনতার। হঠাৎ মনে হয় তার কাঁধে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। কালক্ষণ নিজেকে স্থির রেখে বুঝার চেষ্টা করে সত্যিই তার কাঁধে কারো নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। মৌনতা এবার স্পষ্ট অনুভব করে তার পেছনে কেউ একজন‌ আছে। তার খুব কাছে। হয়তো একদম গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে তার। কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু পানি। মনে হাজারটা উল্টা পাল্টা চিন্তারা বাসা বাঁধে। মৌনতা কাঁপা কাঁপা হাতেই শক্ত করে ধরে ছুরিটা। জোর করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে মৌনতা, কিন্তু পারে না। ধীরে ধীরে একটা শীতল হাত মৌনতার হাত স্পর্শ করে। শিউরে মৌনতা। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকে। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে। বেশ কিছুক্ষণ পর আপনাআপনি সেই শীতল স্পর্শ মিলিয়ে যায়। কাঁপতে কাঁপতেই চিৎকার করে পূর্ণিকে ডাকাডাকি শুরু করে। মৌনতার চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে পূর্ণি। এসে দেখে রান্নাঘরের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে মৌনতা। পূর্ণি দ্রুত গিয়ে জাপটে ধরে তাকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

‘ আর ইউ ওকে মৌন? কি হয়েছে তোর? এভাবে কাঁপছিস কেনো? ‘

মৌনতা পূর্ণির দিকে তাকিয়ে কিছুটা ধাতস্থ করে নিজেকে। ঘাবড়ে বসে যাওয়া গলায় বলে,

‘ আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দে। ‘

মৌনতাকে ড্রইং রুমে এনে ডিভানের উপর বসিয়ে পানি দেয় পূর্ণি। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কি হয়েছে। বারংবার জিজ্ঞেস করার পরও যৌনতা কিছু বলছে না। ভয় করে পূর্ণির। আবার ভূত টূত দেখেনি তো! মৌনতার গাঁ ঘেঁষে বসে থাকে পূর্ণি। মৌনতা মুখে দুই হাত চেপে ধরে কিছু সময় বসে থাকে। তারপর হঠাৎ-ই উঠে খপ করে পূর্ণির হাত ধরে বলে,

‘ চল। ‘

‘ কোথায়? ‘

‘ চিলেকোঠায়। ‘

হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে পূর্ণি। তার সাহস নেই সেই ঘরে যাওয়ার মতো। তবে মৌনতার জোরাজুরিতে বাধ্য হয় আসতে। চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা খুলতেই কেমন গাঁ ছমছম করে পূর্ণির। মৌন ভিতরে গেলেও ও বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে। মৌন চোখ বুলিয়ে ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করে নেয় ঘরটা। বালির স্তুপ পরে আছে সেখানে। দক্ষিণা জানালার ধারে একটা ছোটখাটো চৌকি। তার উপর তোশকটা এখনো বিছানো। খাটের ঠিক সামন বরাবর একটা পড়ার টেবিল, টেবিলের সুসজ্জিত বইগুলোর উপর মোটা আস্তরনের ময়লা পরে আছে। ছাদে ছোট সিলিং ফ্যান। ঘরের একপাশে একটা চুলাও আছে আর কতো গুলো ভাঙ্গা পুরোনো হাঁড়িপাতিল। কাপড় রাখার আলনা আছে একটা। চোখ বুলাতে বুলাতে খাটের ঠিক পাশে রাখা পুরনো কিন্তু আকর্ষণীয় একটা গিটারের দিকে চোখ যায় মৌনতার। ঠোঁট দুটো মৃদু প্রসারিত হয়‌। ত্রস্ত পায়ে গিয়ে গিটারটা হাতে তুলে নেয় সে। গিটারে তেমন একটা ধুলোবালি ছিল না। মৌনতা গিটার আর টেবিল থেকে একটা ময়লা বই হাতে নিয়ে ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে দেখে একবার। খুব সম্ভবত এর আগে যে থাকতো এখানে সে খুব সৌখিন ছিল। অল্প জিনিসেই মাধুর্য্যতার ছাপ। তবে গোছালো কিভাবে আছে এতোটা সময় পর? মৌনতা ঘর থেকে বের হয়ে নিচে চলে আসে। খুব যত্ন সহকারে বইটা মুছে পরিষ্কার করে দেখে উল্টেপাল্টে দেখে। বইটা দেখে মৌন পুরোপুরি শিউর হয়ে যায় যে এই ঘরটিতে ছিল সে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছিল। বইটা পাশে রেখে গিটারটাও খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেয় মৌনতা। পূর্ণি ভয়ে তার ঘরেই আসে না। তার কথা মতে এসব জিনিস এনে খুব ভুল করেছে মৌনতা।

মৌনতা পূর্ণির কথায় পাত্তা না দিয়ে গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করে। গিটার শিখার ইচ্ছা থাকলেও ব্যস্ততার মাঝে কখনো হয়ে উঠেনি। গিটার নিয়ে অযথাই উল্টাপাল্টা শব্দ তোলার মাঝেই আবার মৌনতা কাঁধের কাছে সেই নিঃশ্বাসটা অনুভব করে। তার পিছনে কি কেউ রয়েছে? পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস তার নেই। অসাড় হয়ে এসেছে শরীর। মৌনতা ভূতে বিশ্বাসী নয়। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি সে কখনোই হতে চায় না। চোখ বুঁজে রাখে মৌন।

ফিসফিসে স্বরে কেউ যেন তার কানের কাছে খুব বিদঘুটে সুরে বলে,

‘ আমার ধারে কাছে ঘেঁষতে যেয়ো না। থামো এবার। খুব হিংস্র আমি ।’

কথাটা শুনেই চোখ বড়বড় হয়ে যায় মৌনতার। তার সামনের ড্রেসিং টেবিলের বড় মিররে দেখতে পায় তার পেছনের অবয়বকে। পুরো শরীর চাদরে মোড়া, সোনালী চোখগুলো কেবল জ্বলজ্বল করছে জ্বলছে‌। হিংস্রতার প্রগাঢ় ছাপ সে চোখে।

চলবে.

আগের পর্ব-
https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3126478830914181/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here