ইদানিং একাকী বিশাল বড় বাড়িটাতে থাকতে ভয়ে বুক কাঁপে মৌনতার। যদিও কখনো হয়নি এর আগে এমনটা। তবে চার-পাঁচ দিন যাবৎ ভয় করছে। কারণটা ঠিক গুরুত্ব দেয়ার মতো না আবার ছেড়ে দেয়ার মতোন ও না। কিছুটা অদ্ভুত।
অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে আছে বিশাল বড় বাড়িটা। দু’একটা রুমে রুমে জ্বলছে লাল ড্রিম লাইট। বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে দু-চারটে নেড়ি কুকুরের ডাক। শহরের পাশে একদম নিরিবিলি স্তব্দ অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল বড় বাংলো। শহরের যান্ত্রিকতা এখানে তেমন একটা চলে না। যতো দূরে তাকাও কেবলমাত্র গাছপালা আর খালি মাঠ। কোনো হট্টগোল নেই। পাখিদের কিচিরমিচির আর সামান্য দূরেই বড় নদীর স্রোতধারার শব্দ ছাড়া আর কোনো কোলাহল কলরব নেই। গাঁ ছমছমে এমন পরিবেশে যে কারোর কাছেই ভয়াবহ মনে হতে পারে বাড়িটা। তবে মৌনতার ভয় করে না। বাবার ব্যস্ততায় মা মরা মৌনতার একা থাকতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ছোটবেলা কেউ তাকে কখনো ভূতের গল্প বলে ভয় দেখায়নি তাই তার সাহস একটু বেশিই। বাড়ি থেকে দূরে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মৌনতা। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সকলের চোখে খুব মেরিটরিয়াস স্টুডেন্ট মৌনতা।
মৌনতার ঘরের লাইট অফ। ল্যাপটের স্কিনে ব্যস্ত চোখ দুটি তার। এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার শেষ দিন কাল। তার এসাইনমেন্ট এখনো ঢেঢ় বাকি। সবসময়ই এমনটা হয়, এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার আগের পুরোটা রাত জেগে কমপ্লিট করে সেটা। তবে অন্যান্য বার মারিয়া থাকে, এবার নেই। এই তা পার্থক্য। একটানা ল্যাপটপের স্কিনে চেয়ে থাকাতে মাথা ধরে আসে তার। এই মুহূর্তে এক মগ কফির খুব প্রয়োজন। কাজ ফেলে রান্নাঘরে এসে প্যানে পানি নিয়ে চুলায় বসাতে গিয়ে সচকিত হয় সে। চুলার এক পাশে তার প্রিয় মগটা ভেঙে পড়ে আছে। চোখ মুখ কুঁচকে আসে মৌনতার। এটা কখন ভাঙ্গলো! আজ তাদের কাজের মেয়ে ময়না আসেনি। মৌনতার বাবা মিস্টার সৌকত রহমান বাড়ি নেই। মোটকথা রান্নাঘরে সে ছাড়া আর কেউই আসেনি। কপালে দুই আঙ্গুল ঠেকিয়ে মৌনতা মনে করার চেষ্টা করে কোনোভাবে কি সে করেছে এই কাজ! না তার হাত লেগে ভাঙ্গেনি। মৌনতার মন ভীষণ বাজে ভাবে বিগড়ে যায়। মগের ভাঙ্গা টুকরোগুলো একত্র করে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মগটা নাকি তার মায়ের ছিল। বেশ পুরনো। বাবা খুব যত্ন করে রেখেছিলেন। তারপর এটা মৌনতার হলো। মৌনতাও খুব আগলে রাখতো মায়ের স্মৃতিটা। কিন্তু আজ ভেঙে গেল। মন খারাপ করে কফি না বানিয়েই ছাদের উঠে এলো মৌনতা।
পূর্ণিমার রাতে চাঁদের স্বচ্ছ আলোয় ঝলমল করছে আকাশ। চাঁদের আলো গলে মৌনতার চেহারায় মাখামাখি হতেই সৌন্দর্য পরতে পরতে বেয়ে পড়ে মেয়েটার। শ্যামকায় মেয়েটার মুখে অজস্র মায়া! ছোট্ট কমলার কোয়ার ন্যায় আকর্ষণীয় ঠোঁট। গভীর চোখে যেন নদী বয়ে গেছে। মৌনতার শরীরে এক ঝাপটা মৃদু শীতল বাতাস মৌনতার চুলগুলো উড়ালে কানের নিচের তিলটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। কেঁপে উঠে মৌনতা। বুক ধড়ফড় করে। মনে হয় কেউ তাকে দেখছে। চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে তাকে। মৌনতা ভয়ে কাঁপুনি ধরা পায়েই ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যায় ছাদের রেলিংয়ের কাছে। আড়চোখে একবার দেখে নেয় চিলেকোঠার ঘরটা। মৌনতার ছোট থেকে খুব করে ইচ্ছে ছিল তার বাড়িতে একটা চিলেকোঠার ঘর থাকবে। যেখানে বসে রাতে একাকী আকাশ দেখবে সে। তিন বছর আগে যখন এই বাড়ি দেখতে আসে মৌনতা, শুধুমাত্র এই সুন্দর চিলেকোঠার ঘরটা বাহির থেকে দেখেই পছন্দ করে বায়না ধরে এ বাড়িতেই সে থাকবে। তার বাবার অফিস থেকে দূরবর্তী স্থান হওয়ার পরও তিনি মেনে নেন একমাত্র মেয়ের আবদার বলে কথা!
তবে এই বাড়িতে একবছর থাকার পরও চিলেকোঠার ঘরটাতে যাওয়া হয়নি কোনো দিন। মৌনতা যাওয়ার চেষ্টা করেনি ঠিক তেমন না। মি. সৌকত তাকে সেই ঘরের কাছে যেতেও একদম নিষেধ করে দিয়েছেন। তারপরও মৌনতা দু’একবার বারণ না শুনে ট্রাই করতে গিয়ে বাবার সামনে পড়ে যায়। তার জন্য অবশ্য বকুনি খেতে হয়েছিল খুব। চঞ্চল মৌনতার খুব করে ইচ্ছে করে ঘরটা একবার খুলে দেখবে সে। তবে ভয়ও করে। ঘরটা কেন নিষিদ্ধ তা জানা নেই তার। একদৃষ্টে চিলেকোঠার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে মৌনতা। ছাদে এলেই ঘরটা তাকে বড্ড বেশি আকৃষ্ট করে। মনে হয়…।
মোবাইলে ফোন আসতেই চমকে উঠে সে। পূর্ণি কল দিচ্ছে। রাত দেড়টায় আবার কি দরকার পড়লো! মৌনতা কল রিসিভ করে বিরক্ত হয়েই বললো,
‘ তুই সব অসময়ে কল দিস। ‘
অপর পাশ থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘ কেনো? বিয়ে তো করিসনি যে জামাইয়ের সাথে আছিস বলে ডিস্টার্ব হবি! তাহলে আবার কি সমস্যা? ‘
‘ কি জন্য ফোন দিচ্ছিস বল। ‘
‘ এসাইনমেন্টের ডেট একদিন পিছাইছে। ম্যাম কাল ভার্সিটিতে যাবেন না তাই। ‘
‘ বাঁচা গেল। আমার সারা রাতে কমপ্লিট হতো বলে মনে হয় না। ‘
‘ আঙ্কেল আছেন বাড়িতে? না থাকলে আমি কাল তোর বাসায় থাকবো, তোর সাথে শেষ করবো যতটুকু বাকি আছে। ‘
‘ ওকে ডেয়ার। ‘
‘ এই তোর ভয় করে না রাতে এতো বড় বাড়িতে থাকতে, তাও আবার একা? ‘
‘ না করে না। নিজের বাড়ি ভয় কিসের? ‘
‘ কিসের মানে! তুই মুভিতে দেখোস না এতো বড় বড় বাড়িতে কিছু না কিছু সমস্যা তো থাকেই! ‘
মৌনতার পেট ফেটে হাসি পায় পূর্ণির কথায়। হেঁসে কুটিকুটি হয়ে বলে,
‘ ইউ নো আ’ম স্টিল সিটিং অন দ্যা রুফ। অ্যালোন। নাথিং ইজ হ্যাপেনিং টু মি, সো হোয়াই সুড আই বি এফ্রেড? ‘
‘ এটা তোর দ্বারাই সম্ভব। ‘
‘ হাহা। জানিস আমার না ইচ্ছা করছে চিলেকোঠার ঘরটা একবার খুলে দেখি। ‘
ঘরটার দিকে তাকিয়ে বলে মৌনতা।
‘ মানে কি? এই মৌনতা মাথা ঠিক আছে তো তোর? নাকি পাগল টাগল হয়ে গেলি? তোকে আঙ্কেল অনেক আগেই নিষেধ করছে কিন্তু ওই ঘরে না যেতে। ‘
‘ কিন্তু আব্বু তো এখন বাড়ি নেই! আচ্ছা তুই রাগ আমি তোকে পরে ফোন দিব। ‘
‘ এই মৌনতা এমন কিছু করবি না তুই বলে দিলাম আমি। তুই কি…। ‘
পূর্ণির পুরো কথাটা না শুনেই কল কেটে দেয় মৌনতা। এতো কিছু ভাবতে গেলে ঘরটা খোলার সাহসই হারিয়ে ফেলবে সে। এতো সব কিছু ভাবা যাবে না। অবশ অনুভূতির মাঝে থেকেই কাজটা করে ফেলতে হবে। মৌনতা নিচে গিয়ে চাবি নিয়ে এসে ধীর পায়ে ঘরটার কাছে যেতেই কেমন একটা শীতল অনুভব হয়। ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে সেখানে। মৌনতা মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে ঘরটার দরজার হ্যান্ডেলে হাত রাখে। সঙ্গে সঙ্গে শরীর শিউরে উঠে তার। অজানা ভয়ে হাত সরিয়ে নেয় দ্রুত।
কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মনে মনে বলে,
‘ তুই এতো ভয় পেতে শুরু করেছিস কবে থেকে মৌন? ভয় তোর সাথে যায় নাকি? একদম ভয় পাবি না। লেটস ডু ইট। এই সুবর্ণ সুযোগ। ‘
নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ বুজেই দ্রুত তালাটা খুলে ফেলে। তার সজোরে ধাক্কা দেয় দরজার। খটমট আওয়াজ করে দরজাটা খুলে যেতেই ভেতর থেকে কোনো এক নিশাচর ডানা ঝাপটে উড়ে যায় দ্রুত। ভয়ে চমকে উঠে নিচে বসেই চিৎকার করে উঠে মৌনতা। চোখ বুঁজে দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরেছে। অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও কিছু হচ্ছে না বুঝে চোখ পিটপিট করে মেলে মৌনতা। সবকিছু স্তব্ধ, ঠিকঠাক। ঘরটার ভেতর চাঁদের আলো পড়ে হালকা আলোকিত হয়ে রয়েছে। মৌনতা অবাক হয়ে বাহিরে দাঁড়িয়েই একবার উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ভিতরে। অন্ধকারে বোঝা যায় না তেমন একটা। ভেতরে যেতে নিয়েও কেমন মন খচখচ করে তার। দ্রুত দরজাটা চাপিয়ে দিয়েই নিচে চলে আসে মৌনতা।
নিচে এসে দেখে কারেন্ট চলে গিয়েছে। কি একটা বাজে অবস্থা। লোডশেডিং সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর লাগে মৌনতার কাছে। মোবাইলে লাইট জ্বালিয়ে নিজের রুমে যাওয়ার পর হঠাৎই মোবাইলটাও বন্ধ হয়ে যায়। মোবাইল অন করার চেষ্টা করে দেখে চার্জ শেষ। অবাক কান্ড! যতসব ঝামেলা একসাথে হওয়া লাগে নাকি! অন্ধকার হাতড়ে নিজের টেবিল থেকে একটা মোম নিয়ে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে মৌনতার থেকে এক হাত দূরত্বে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আঁধারে তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। কেবল চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে।
সে ১
#লেখনী_সাইমা_ইসলাম_প্রীতি
.
চলবে.
(সবাই কমেন্ট করে জানাবেন কেমন হয়েছে।)