সে
পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
রেষ্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি।আদিব বারবার বলছে,’আপু ভেতরে যাবে না? ভেতরে চলো।’
ওর কথা আমার কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। বুক কেমন ধুকপুক করছে। হার্টবিট খুব দ্রুত চলছে। আমি নিজেও জানি না, ভেতরে যাওয়ার পর কোন পরিস্থিতির সাথে আমায় নতুন করে পরিচিত হতে হবে।
বড়ো করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলাম। আদিবকে নিয়ে রেষ্টুরেন্টে যেতেই সবার আগে লিমা আমায় দেখে। হাত নাড়িয়ে বলে,’নবনী এইযে আমি। আয়।’
লিমা আমায় ডাকার সাথে সাথে আশেপাশের টেবিলে বসে থাকা কয়েকজন আমার দিকে তাকায়। তাদের সঙ্গে আরও একজোড়া হাস্যজ্জ্বল চক্ষু আমার দিকে নিবদ্ধ হয়। সম্ভবত আমার নামটি উচ্চারিত হয়েছে বলেই রুদ্র তাকিয়েছে। আমি ওর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে লিমা যেই টেবিলে বসেছে সেই টেবিলে গিয়ে বসলাম। রাগে আমার শরীর কাঁপছে। আমি কোনোভাবেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। আদিবকে খাবার দিয়ে আমি রুদ্রর কাছে যাই। রুদ্র এতক্ষণ সবার সাথে হেসে হেসেই কথা বলছিল। আমায় দেখার পর হাসিটা আরও প্রশস্ত হয়। আমি অবাক হয়েছি এটা ভেবে যে, আমায় দেখে রুদ্রর কোনো ভাব পরিলক্ষিত হলো না। একটু অবাকও তাকে হতে দেখা গেল না। যেন আমার আসাটা খুব স্বাভাবিক।
রুদ্র হেসে বলল,’আরে নবনী! বসো। আমি এখনই তোমায় এই টেবিলে আসতে বলতাম।’
আমি কিছু না বলে শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রুদ্রর দুই পাশে দুই মেয়ে বসা। অন্য পাশে আরও একটি মেয়ে এবং একটা ছেলে। রুদ্র ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমায়। এখানে একজন শুধু স্বামী-স্ত্রী। বাকি দুইটা মেয়েকে কাজিন বলে পরিচয় দিল। যদিও সত্যিটা আমার জানা নেই। কাজিন না হয়ে বন্ধুও হতে পারে। তবে গার্লফ্রেন্ড মনে হলো না। আমি সরাসরি রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলাম,’এটাই কি আপনার ব্যস্ততা?’
আমার এই প্রশ্নে রুদ্রের সঙ্গে বাকিরাও যেন একটু ঘাবড়ে গেল। কারণ আমার কথায় কোনো ফর্মালিটি নেই। এমনকি আমি তাদের সাথেও হাসিমুখে দুটো বাক্যব্যয় করিনি। আসলে আমি পারিনি। এই মুহূর্তে আমার মাথায় অন্যকিছু আসছে না। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার দারুণ ক্ষমতা রুদ্রর রয়েছে বুঝতে পারলাম; যখন আমার কথার উত্তরে সে হেসে বলল,’আর বোলো না! সবগুলা মিলে জোর করে নিয়ে আসলো। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো। বসে আড্ডা দিই।’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’সরি। সময় নেই আমার। এসেছিলাম একটা বিশেষ কাজে। কাজ শেষ আমার। আজ যদি আপনার একটু সময় হয় তাহলে বাড়ি ফিরে দেখা কইরেন। আর যদি ব্যস্ত থাকেন, সময় না হয় তাহলে কোনো দরকার নেই।’
এরপর উপস্থিত বাকিদের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললাম,’আসসালামু আলাইকুম আপুরা এবং ভাইয়া। অন্য একদিন আপনাদের সঙ্গে আড্ডা দেবো।’
উত্তরে তারা ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো। নিজেদের টেবিলে ফিরে এসে লিমাকে বললাম,’বাড়িতে গিয়ে কল করব।’
আর খাবার পার্সেল করে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। বেচারা ছোটো ভাই আদিবের খাওয়ার হক তো আর তার জন্য নষ্ট করতে পারি না।
বাড়িতে এসেও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছিলাম না। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এখানে এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে? রুদ্র তো আর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরতে যায়নি। হ্যাঁ, আপনাদের ধারণা ঠিক ধরে নিলাম। কিন্তু এই চিন্তা-ভাবনার আগে একবার আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখুন তো! আপনি পারবেন এতো মিথ্যে সহ্য করতে? আমি জানিনা আপনি বা আপনারা পারবেন কী-না। তবে আমি পারছি না। সত্যি কথা বলতে তার কোথায় এত আপত্তি? আমি তো তাকে কখনো কোনো কিছুতে বাঁধা দেই না! তবে সমস্যাটা কোথায়?
যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। আমার অনুভূতি ভুল কোনো মানুষের প্রতি অনুভব হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নইলে কেন আমায় এমন কষ্ট পেতে হবে? মাথা ঠান্ডা করতে এবং রাগ কমাতে শাওয়ারের নিচে গিয়ে কতক্ষণ বসে রইলাম। অজানা কারণে কেঁদেও ফেললাম।
.
.
রাত পর্যন্ত আমায় অপেক্ষা করতে হয়নি। গোসল শেষ করে চুপচাপ শুয়েছিলাম। একটু আগে রুদ্র ফোন করে বলল নিচে যেতে। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে মাথাটা কেমন জানি চক্কর দিয়ে উঠছে। ঝিমঝিমও করছে। অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে ছিলাম বলেই হয়তো! বাড়িতে না বলেই নিচে নামলাম। প্লে-গ্রাউন্ডের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। রুদ্র অসহায় ভঙ্গিতে বলল,’তুমি কি কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছ নবনী?’
আমি অবাক হয়েছি। সত্যিই আমি অবাক হয়েছি তার এই প্রশ্নে। মানে সে জানেই না আমি রাগ করেছি কিংবা কোন কারণে রাগ করেছি সেটাও জানে না। তাচ্ছিল্য করে হেসে বললাম,’আপনি জানেন না?’
‘না বললে জানব কীভাবে? কেউ কি আমার নামে তোমায় কিছু বলেছে যেই কারণে তুমি আপসেট?’
‘আমি শোনা কথায় কান দিই না।’
‘তাহলে কী সমস্যা বলো? আমায় না বললে তো আমি বুঝব না।’
‘আপনি আমায় মিথ্যা কেন বলেন?’
‘কী মিথ্যা বলেছি?’
‘কী মিথ্যা বলেননি? শুরু থেকেই আপনার একটার পর একটা মিথ্যা শুনে যাচ্ছি আমি। সব বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে যাচ্ছি। আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবেই চলছি। আপনি যাতে বিরক্ত না হোন এজন্য একটা কথা বলতে গেলে আগে দশবার ভাবি। আপনি সারা দিন ব্যস্ত থাকেন। রাতে তো অল্প সময়ের জন্য হলেও ফ্রি থাকার কথা। এখন আপনি বলবেন আপনি ফ্রি থাকেন না? থাকেন! আপনি রাত জেগে গেম খেলেন, মুভি দেখেন। এসব কথা আমি আরও আগেই রিশানের কাছে জেনেছি। তবুও কোনোদিন অভিযোগ করে বলিনি, আমায় সময় না দিয়ে আপনি কেন গেম খেলেন, কেন মুভি দেখেন! আপনার পার্সোনাল একটা জীবন আছে। আমার কোনো অধিকার নেই আপনার পার্সোনাল জীবনে ইন্টারফেয়ার করার। ঠিক এ কারণেই আমি কোনো অভিযোগ করি না।
আপনি আমার সাথে কথা বলার জন্য আপনার ফ্রি সময়টা বেছে নেন। আর আমি? আমি আপনার জন্য ব্যস্ততাকে এক সাইডে সরিয়ে রাখি। আপনার কি ধারণা আমার ব্যস্ততা নেই? সারাদিন কত পড়ার চাপ থাকে আমার জানেন? তবুও ক্লাসে প্রতি ঘণ্টায় লুকিয়ে ফোন চেক করি আপনি একটা টেক্সট করেছেন কীনা! নিজে থেকে টেক্সট করা তো দূরের কথা, আমি যে ম্যাসেজ করতাম তারই তো রিপ্লাই দিতেন না। সীন করারই সময় হতো না আপনার হাহ্!’
এইটুকু বলে থামলাম আমি। তার দিকে তাকিয়ে দেখি নিষ্পলকভাবে সে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম,’ব্যস্ততা আমারও রয়েছে। এক্সাক্টলি সময় দেওয়াটা নির্ভর করে নিজের ওপর। ইচ্ছে থাকলে ব্যস্ততার মাঝেও একটুখানি সময় খুঁজে বের করা যায়। আর এই ইচ্ছেশক্তিটা আমার রয়েছে। আপনার নেই।’
‘আ’ম সরি নবনী। আর এমন হবে না। আমি তোমাকে এখন থেকে সময় দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করব।’
‘প্লিজ! দরকার নেই কোনো। আমি কারো বিরক্তের কারণ হতে রাজি নই। আপনার কি ধারণা আমি ফেলনা? আমার কোনো দাম নেই? আপনাকে বেশি প্রায়োরিটি দেই বলে আমি ভেল্যুলেস?’
‘এমন কিছু নয় নবনী। আমি কখনো তোমায় এমন ভাবি না। অবশ্যই তোমার প্রায়োরিটি রয়েছে। ভেল্যু রয়েছে।’
‘হ্যাঁ, আছে। কিন্তু আপনার কাছে নেই। আপনার কাছে বিরক্তের আরেক নাম হলো নবনী। এজন্যই তো বিরক্ত দূরে রাখতে সবসময় কাজের বাহানা দেখান, ব্যস্ততা দেখান। ওকে ফাইন, আজ থেকে আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত। আর বিরক্ত করব না আপনাকে। আপনি আপনার মতো করে ভালো থাকেন। শান্তিতে থাকেন। আল্লাহ্ হাফেজ।’
রুদ্র কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই আমি বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করি। রুদ্র অনেকবার পিছু ডাকে। আমি দাঁড়াইনি। দৌঁড়ে ভেতরে চলে এসেছি। কথাগুলো বলা এতটা সহজ আমার জন্য ছিল না। কিন্তু কী করব বলুন? এতদিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট, অভিমানগুলো যে আর চাপিয়ে রাখতে পারিনি। আমাকে ছাড়া রুদ্রর কতটা কষ্ট হবে জানিনা। কিন্তু তাকে ছাড়া থাকতে, কথা না বলে আমি ভালো থাকতে পারব না। প্রয়োজন নেই ভালো থাকার। তবুও আর তার বিরক্তের কারণ হতে রাজি নই আমি।
বাড়িতে আসার পর রুদ্রর অনেকগুলো ম্যাসেজ এবং কল পাই। কল রিসিভ করিনি। ম্যাসেজের বেশিরভাগ এমন ছিল,’আর এমন হবে না। সরি। ফোন রিসিভ করো।’
আমি রেসপন্স করিনি। তিথি আর লিমাকে ফোন করে সব বললাম। তিথি বলল,’দেখ এবার কী করে। গুরুত্ব দিলে এবার থেকেই দেওয়া শুরু করবে। নয়তো সে আর ঠিক হবে না।’
আমিও চুপচাপ দেখতে লাগলাম সে কী করে। প্রতিদিন ক্লাস, কোচিং এর ফাঁকে এখনও ফোন চেক করার অভ্যাস রয়ে গেছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এখন আর আমায় নিরাশ হতে হয় না। রুদ্রর ম্যাসেজ পাই আমি। অবসর সময়ে প্রায়ই তার আইডি ঘাটাঘাটি করি। কমেন্ট চেক করি। কোনো মেয়ের কমেন্ট সন্দেহকর মনে হলে সেই মেয়ের আইডিও ঘুরি। নিজের মন খারাপের কারণ আমি নিজেই। নয়তো কেন খুঁটে খুঁটে সব বের করতে হবে আমার?
এর মাঝে আমার পরীক্ষা শুরু হয়। মা ফোন নিয়ে গেছে। ল্যাপটপও মায়ের কাছে। অতিরিক্ত স্বাধীনতা থাকলেও পরীক্ষার সময় মা ভীষণ কঠোর হয়ে যান। এটা অবশ্য আমার ভালোর জন্যই করে। তবুও রুদ্রর আইডি ঘুরাঘুরি করে যেই শান্তি পাই, তৃপ্তি পাই সেটা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছিলাম। এখনও মা পরীক্ষার সময় আমার স্কুলে গিয়ে বসে থাকে। সেই ছোটোবেলার মতো। পরীক্ষা শেষ হলে আবার সঙ্গে করে নিয়ে আসে। রাতে পড়ার সময় পাশে বসে থাকে। আমি রাত পর্যন্ত পড়ি। একসময় মা জেগে থাকতে থাকতে ঘুমিয়েও যায়। একটু পরপর আবার হুট করে জেগে বলে,’পানি লাগবে তোর? চা খাবি? কফি বানিয়ে দেবো?’
মায়ের এত অস্থিরতা দেখে হাসি পায় আমার। মনে মনে ভীষণ খুশিও হই। মায়ের সঙ্গই মনটা অনেক হালকা করে আমার। অযথা চিন্তা-ভাবনা করার সময় হয় না। এর মাঝে কয়েকদিন স্কুলে যাওয়ার পথে রুদ্রর সঙ্গে দেখা হলেও কথা হয়নি। তার কথা হয়েছে মায়ের সাথে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মাঝে মাঝে তাকে দেখতে পেতাম। যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না। সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক হয়েছে রাগ-অভিমান। এবার সমঝোতা করা প্রয়োজন। কালই লাস্ট পরীক্ষা। এরপর তো মা ফোন দিয়ে দেবে। তখন সব অভিমান মিটিয়ে নেব। আর এবার মনের কথাও জানিয়ে দেবো।
__________
অপেক্ষা করতে করতে সকাল হয়। আমার আর তর সইছে না। মন কেমন যেন আকুপাকু করছে। কখন পরীক্ষা শুরু হবে, কখন শেষ হবে আর কখন ফোন হাতে পাব সেই অপেক্ষায় আছি এখন। সকালে কিছুক্ষণ পড়ার পর গোসল করে রেডি হয়ে নিলাম। তারপর নাস্তা করে মায়ের সঙ্গে স্কুলে চলে গেলাম।
সবগুলো পরীক্ষার চেয়ে শেষ পরীক্ষাই আমার বেশি ভালো হয়েছে। কথায় আছে শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। আজ আমারও সব ভালো হওয়ার সময়। তিথি আর লিমাকে কথাটি শেয়ার করার পর ওরাও বলল, এবার আর মনের কথা মনে যেন না রাখি। সরাসরি দেখা করে বলে দিই। আমিও এমনটাই ভেবে রেখেছি। বাড়ি ফেরার পর মা বলল খেয়ে একটা ঘুম দিতে। এই কয়দিনে বেশ রাত জাগা হয়েছে। ফোন চাইলে পাছে মা সন্দেহ করে তাই ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে নিই তাহলে। এক ঘুম দিয়ে উঠলাম পাঁচটায়। হেলতে-দুলতে ফ্রেশ হয়ে এসে ফোন নিজের বিছানাতেই পেলাম।
সময় নষ্ট না করে গেলাম অনলাইনে। রুদ্রর ভয়েস ম্যাসেজ। ওপেন করার পর শুনতে পেলাম ওর কণ্ঠে গান।
‘তোমাকে আজ প্রয়োজন ভীষণ
ভেতর-বাহিরজুড়ে সত্য এটাই,
হারিয়ে ফেলেছি আমাকেই আমি;
মন যা চায়, তুমি ঠিক তাই!
যায় না ফেরানো নিজেকে
মন বলে থেকে যাও না আরও,
তোমারও কি বলো হচ্ছে এমন!
চোখের ভাষায় অভিমান হাজারও…
অভিমান হাজারও…!
রূপকথার গল্পরা খেলছে
তোমার চোখে,
তুমি আড়াল রাখছ কেন মন
পথভুলো মেঘেরা কী যেন কী ভেবে,
থেমে গেছে, দেখো অকারণ!
মন বলে থেকে যাও না আরও,
তোমারও কি বলো হচ্ছে এমন…’
পুরো গানটা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। একবার নয়, বেশ কয়েকবার শুনেছি। এই গানটা আগে কখনো আমি শুনিনি। কার গান তাও জানিনা। তবে রুদ্রর কণ্ঠে এই গান শুনে আমি মুগ্ধ। ভীষণ মুগ্ধ। মনে হচ্ছে, প্রতিটা লাইন রুদ্র শুধু আমাকেই উৎসর্গ করেছে। ম্যাসেজ দিলাম,’গান দ্বারা কী বুঝালেন?’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার রিপ্লাই আসে।
‘নবনী! এতদিন পর তুমি অনলাইনে আসলে। তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন?’
‘পরীক্ষার জন্য।’
‘পরীক্ষা শেষ?’
‘আজ শেষ হলো।’
‘কেমন হয়েছে?’
‘ভালো।’
‘নবনী।’
‘কী?’
‘এখনও রাগ করে আছো?’
‘মিস করেছেন?’
‘করেছি।’
‘সত্যিই? বিশ্বাস হয় না।’
রুদ্র এবার সেন্টি ইমুজি দেয়। হেসে ফেলি আমি। রুদ্রকে বললাম,’কোথায় আছেন এখন?’
‘কাজে।’
‘সাতটার দিকে একটু দেখা করতে পারবেন? নাকি ব্যস্ত বেশি।’
‘পারব। সমস্যা নেই। কোথায় আসব?’
‘মাঠে। এসে আমায় ফোন দিয়েন।’
‘আচ্ছা।’
যা বলার সরাসরি বলব বলে এই টপিকে আর কোনো কথা বলিনি। এমনিতেই দুজনের স্বাভাবিক কথাবার্তা হচ্ছিল।
সন্ধ্যায় নাস্তা করার জন্য ফোন রেখে ড্রয়িংরুমে যাই। আজ আমার অন্যরকম খুশি লাগছে। মনে মনে ভাবছি কী করে তাকে মনের কথা বলব। আমায় অন্যমনস্ক দেখে আদিব বলে,’কী ভাবো আপু?’
‘কিছু না। তুই খা।’
আদিবের চুলে হাত বুলিয়ে বললাম আমি। তখন দেখলাম বাবা রুম থেকে বের হচ্ছে। বিস্ময় নিয়ে বললাম,’আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছ?’
‘আসছি আরও আগেই। তুই তখন ঘুমিয়েছিলি। শরীরটা ভালো লাগছিল না। তাই চলে এসেছিলাম।’
‘এখন ঠিক আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্। একদম চাঙ্গা।’
বাবা পাশের সোফায় বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,’একটা গুড নিউজ আছে।’
‘কার জন্য?’ জিজ্ঞেস করে আদিব। বাবা বললেন,’নবনীর জন্য।’
আমি আরও বিস্মিত হয়ে বললাম,’সত্যিই বাবা?’
‘হ্যাঁ, মা। তুই না ঢাকায় পড়তে চেয়েছিলি? সবসময় তো বলতি, এত জায়গায় ট্রান্সফার হয়; ঢাকায় হয় না কেন! এবার আমি নিজে থেকেই ঢাকায় ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছিলাম। আবেদন গ্রান্টেড। তোর এস.এস.সি শেষ হলেই আমরা ঢাকায় চলে যাব।’
আমি নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম বাবার কথায়। এটা যে আমার জন্য গুড নিউজ নয় তা আমি কী করে বোঝাব বাবাকে? ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,’ঢাকায় পড়ার ইচ্ছে আগে ছিল। অনেক আগে বলেছিলাম তোমায়। রিসেন্ট তো আমি এমনকিছু বলিনি বাবা।’
‘জানি মা। ঐ ঘটনার পর তোর সিকিউরিটি নিয়ে আমায় খুব চিন্তায় থাকতে হয়। এজন্যই ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছিলাম।’
আমি কী বলব, কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমার পরীক্ষার বাকি কয়েক মাস। যদি ঢাকায় চলে যাই তাহলে রুদ্রর সঙ্গে কী করে দেখা হবে? কীভাবে সব ঠিক রাখব! আমি থাকব কী করে। আর দেরি করা চলবে না। রুদ্রকে অতি দ্রুতই জানাতে হবে। নাস্তা করে বাবা ঘরে যাওয়ার পর আদিবকে নিয়ে আমি বের হই। মাকে বলেছি রোজের কাছে যাচ্ছি। ওর কাছে গিয়েছিও। আদিবকে ওর কাছে রেখে আমি নিচে এসেছি। মাঠে যাওয়ার পর দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি রুদ্র আসছে। দুশ্চিন্তায় আমার হাত-পা কাঁপছে।
গণেশ আরও বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলছিল। আমায় দেখে জিজ্ঞেস করে,’দিদি খেলবে?’
আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বললাম। রুদ্র প্রায় আমার কাছাকাছি চলে এসেছে। মুখ সম্পূর্ণ স্পষ্ট হতেই ওর স্বভাবসুলভ হাসিটা প্রদান করে। প্রচণ্ড চিন্তার মধ্যে থেকেও ওর হাসি দেখে আমার ওষ্ঠদ্বয়ও কিঞ্চিৎ প্রসারিত হয়। রুদ্র হেসে জিজ্ঞেস করে,’কী অবস্থা মহারাণী? হঠাৎ এত জরুরী তলব?’
আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছি। এক হাত দিয়ে আরেক হাতের নখ খোঁচাচ্ছি। কীভাবে কথা শুরু করব সেটাও বুঝতে পারছি না। রুদ্র সেদিনের মতো আজও আমার কপাল স্পর্শ করে,’সুস্থ আছো তুমি?’
আমি মাথা নাড়লাম। আমতা আমতা করেও কিছু বলতে পারছি না। রুদ্র নিজেই বলল,’এখনও কি রেগে আছো? আর রাগ করে থেকো না প্লিজ! নিজেদের মাঝে আর কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং রেখো না।’
‘আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।’
‘আমিও তো শুনতে চাই। বলো।’
রুদ্রর কণ্ঠে রসিকতা। এবারও আমি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে অন্য কথা বলে ফেললাম। বললাম,’বাবা বলেছে আমার এস.এস.সি শেষ হলে ঢাকায় চলে যাবে। একেবারে।’
‘কী! কেন?’ অবাক হয়ে বলল সে।
‘ঐযে রিমি আপুর বিয়েতে ঐ ঘটনার পর আব্বু খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। তাই নিজে থেকেই ট্রান্সফারের আবেদন করেছিল।’
‘এটা কোনো কথা? এ কারণে তোমরা কেন সিলেট থেকে চলে যাবে? প্রয়োজনে আমি নিজে তোমার সেফ্টির দায়িত্ব নিতাম। শোনো নবনী, তুমি আঙ্কেলকে বোঝাও।’
আমি চুপ করে রইলাম। আমায় চুপ থাকতে দেখে রুদ্র গলারস্বর চওড়া করে বলল,’কী হলো? চুপ করে আছো কেন তুমি? তোমার বাবাকে বলে বোঝাও।’
‘আই লাভ ইউ!’
রুদ্র অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড চুপ থেকে বলে,’কী?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’আ…আমি আপনা…কে আমি আপনাকে ভালোবাসি!’
এরপর রুদ্র যেটা বলল আমি বুঝতে পারলাম না তার এই কথা বলার রিজন কী! এটা কেমন উত্তর হতে পারে? উত্তর তো নয়ই বরং প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। সে আমায় বলল,’আর ইউ ক্রেজি নবনী?’
ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়ে যায় আমার। কপালে ভাঁজ পড়ে। হৃদস্পন্দন দ্রুত চলছে।তাহলে কি সে আমায় ভালোবাসে না?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]