সে
পর্ব_২_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
বন-জঙ্গলের বিটপীর ন্যায় আমিও সেই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া-বাতাসে কিংবা মৃদু বাতাসে পাতাগুলো যেমন নড়েচড়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় আমার অবস্থাও এখন তেমনই। শুধু পার্থক্য এইটুকুই যে পাতারা মনের আনন্দে নড়ে আর আমি নড়ছি ভয়ে। নড়ছি না বলে কাঁপছি বলাটাই মানানসই। হ্যাঁ, রুদ্রের ভয়েই আমি কাঁপছি। কিন্তু তার দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সাহস কিছুতেই সঞ্চয় করতে পারছি না। আমি জানি, আপনারা এখন আমায় ভীতু ভাবছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি মোটেও ভীতু নই; উপরন্তু বড্ড সাহসী। সেটা অবশ্য আস্তে আস্তে আপনারাও জেনে যাবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে এখন যে আমার কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারছি না। তবে এতটুকু শিওর যে, আমায় দেখতে এখন চুপসে যাওয়া বেলুনের মতোই দেখাচ্ছে।
আমি তো আমার জায়গা থেকে নড়লাম না ঠিক আছে; কিন্তু রুদ্র নিজেই এসে আমার সামনে দাঁড়াল। এবার আমার হাত-পায়ের সাথে সাথে দাঁত, ঠোঁটও কাঁপতে শুরু করেছে। যে কেউ দেখলেই ভাববে গরমের মধ্যে মাঘ মাসের শীত বোধ হয় আমার উপরেই হামলে পড়েছে।
‘ডাকলাম যে শুনতে পাওনি?’ রুদ্রের গলায় বিরক্তের আভাস। আমি এবারও কিছু বলতে পারলাম না। তবে এটাই বুঝতে পারছি না উনি আজ আমায় তুমি করে বলছে কেন? সেদিন তো আপনি করে বলেছিল! মাস্ক পরার কারণে উনি আমার পুরো মুখ দেখতে না পারলেও চোখ দেখে নার্ভাসনেস ঠিক বুঝে ফেলল। এবার তার কুঁচকে যাওয়া কপালখানা আগের ন্যায় বিস্তৃত হলো। আমায় অবাক করে দিয়েই সে আমার কপালে হাত রাখল। এবার আর আমায় কেউ আটকাতে পারবে না। আমি শেষ! আপনারা কি ভাবছেন আমি মরে যাওয়ার কথা বলছি? একদম নয়। আমি বরফ হওয়ার কথা বলছি।’
‘শরীরের তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে।’ কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল সে।
আমায় চুপ থাকতে দেখে আবার বলল,’কথা বলছ না কেন? তুমি কি বোবা?’
এই লোকটার সমস্যা কী আমি বুঝি না। প্রথমদিন আমায় কাজের বুয়া বানিয়ে দিল আর আজ বোবা! আমি বড়ো করে শ্বাস নিতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। তবুও মাস্ক খুললাম না। আমায় কথা বলতেই হবে এখন।
‘না, আমি বোবা নই। অসুস্থও নই।’ বললাম আমি।
‘তাহলে এতক্ষণ চুপ করে ছিলে কেন? যাই হোক, তোমার হাতের পানির বোতলটা দাও। পানি ভালো তো?’
নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। স্কুল থেকে ফেরার পথে পানির বোতল বের করে যে পানি খেয়েছিলাম এখনও হাতেই রয়েছে। তার মানে উনি তখন পানির জন্যই আমায় ডেকেছিল? হায়রে নবনী! আর কত কী-ই না তুই ভেবে নিলি।
সব ভয় কাটিয়ে আমি পানির বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে ঢকঢক করে এক চুমুকে পুরো বোতল ফাঁকা করে ফেলল। আমি পলকহীনভাবে শুধু চেয়েই রইলাম। বোতলটা আমার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,’থ্যাঙ্কিউ পিচ্চি।’
এরপর সে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করল। আমি আহাম্মক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কী বলে গেল আমায়? পিচ্চি!
রুদ্র চলে যাওয়ার পর তিথিরা আমার কাছে আসে।
‘কাহিনী কী হলো বল তো?’ জিজ্ঞেস করল তিথী। এখন আমি কী করে বলি আমি যে ভয়ে কাবু হয়ে গেছি? পুরো ঘটনা না শুনে আমায় ছাড়বে বলেও মনে হচ্ছে না। সংক্ষেপেই আমি বিবৃতি দিলাম। সব শুনে ওরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আগেই বলেছিলাম একেকটা কী পরিমাণ বজ্জাতের হাড্ডি! আমায় মনমরা থাকতে দেখে তিথি বলল,’আহারে! থাক মন খারাপ করিস না। ডেয়ারে যখন জিততে পারিসনি তখন কালকের ট্রিট যেন মিস না যায়। আর হ্যাঁ, পিচ্চি বলেছে বলে এত ভাউ খাইস না। স্কুল ড্রেস পরা থাকলে বাচ্চাই তো মনে হবে। তোর ভাগ্য ভালো যে আপু না ডেকে পিচ্চি ডেকেছে।’
তিথির শেষ কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলাম। যাক বান্ধবীগুলা হারামি হলেও সান্ত্বনা তো দিতে পারে! ট্রিট দেবো বলে ফাইনাল করে ফেললাম ডিসিশন। এরজন্য অবশ্য এখন আমায় বাবার পকেট কাটতে হবে।
.
বাবার বাড়ি ফিরতে রাত নয়টার মতো বাজবে। এখন বাজে আটটা পঁয়তাল্লিশ। এখনো আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে টম এন্ড জেরী কার্টুন দেখছিলাম। টিভি আছে আমাদের। ড্রয়িংরুমে সেটা। এখন টিভি মায়ের দখলে। সন্ধ্যে হলেই তিনি সিরিয়াল দেখতে বসেন। এমনকি এড আসলেও একই চ্যানেলে রেখে দেন। চ্যানেল পাল্টে দিলে যদি নাটকের কোনো সীন মিস হয়ে যায়? তাই অযথা টাইম ওয়েস্ট করে আমিও যাই না টিভি দেখতে। তাছাড়া নেট থাকতে সবকিছুই যখন হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় তখন টিভির আর কী দরকার?
শুয়ে বসে কার্টুন দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম গলাটা কেমন যেন খুসখুস করছে। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে পান করলাম। তাতেও কোনো কাজ হলো না। মায়ের হাতে এখন লেবু চা খেলেই ম্যাজিকের মতো গলা খুসখুস করা সেরে যাবে। আমি তো ভয় পাচ্ছি এটা ভেবে, সিরিয়াল দেখার সময় ডাকার ফল আবার ভয়ানক না হয়! যা হয় হবে। একটু বকলে বকতে পারে। কিন্তু বারণ করবে না।
ড্রয়িংরুমে গিয়ে মাকে বললাম,’মা এক কাপ লেবু চা করে দাও তো। গলাটা ভীষণ খুসখুস করছে।’
মা এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে বলল,’একটু পরই এড দিবে। যা বলার তখন বলবি।’
বুঝলাম সিরিয়ালে হয়তো টান টান উত্তেজনা চলছে। কী আর করার? এড আসার আশায় সোফায় বসে রইলাম। মায়ের একটু পর শেষ হয়েছে পাক্কা ছয় মিনিট পর। অর্থাৎ ঠিকঠাক ছয় মিনিট পর এড এসেছে। এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কী করে বললাম সেটাই তো ভাবছেন? আমার গায়েবি কোনো গুণ নেই। দেয়াল ঘড়িতে বসে বসে সময় গুণেছি। এড আসার পর মা বলল,’বল এখন কী বলবি।’
‘বলছিলাম যে গলাটা কেমন জানি খুসখুস করছে। এক কাপ লেবু চা বানিয়ে দাও।’
‘আমি সিরিয়াল দেখতে বসলেই তোর গলা খুসখুস করে, মাথা ব্যথা করে, পেট ব্যথা করে। কাহিনী কী বলতো?’
‘এখানে কাহিনীর কী হলো মা? আমি কি ইচ্ছে করে সমস্যাগুলো আননি?’
‘এক্সাক্টলি! আমার মনে হয় তুই ইচ্ছে করেই সমস্যাগুলি আনিস। নয়তো মিথ্যে বাহানা করিস।’
‘শুধু শুধু এতগুলো কথা শোনাচ্ছ মা। বিরক্ত লাগলে রেসিপি বলে দাও। আমিই বানিয়ে নিচ্ছি।’
‘তার আর কোনো প্রয়োজন নেই! রান্নার তো ‘র’-ও জানিস না। পরে হাত-পা পুড়িয়ে তোর বাবার বকুনি খাওয়াবি।’ কথাগুলো বলতে বলতে মা রান্নাঘরের দিকে গেল। আমিও পিছু যেতে যেতে বললাম,
‘বাবাকে দোষ দিচ্ছ কেন? রান্না শেখানোর দায়িত্ব সবসময় মায়েদের হয়। বাবার নয়। তুমি রান্না শেখাওনি, এমনকি এখনও শেখাচ্ছ না। বাবার সাথে সাথে তুমিও আমায় বেশি আহ্লাদ দিয়ে ফেলছ।’
মা তখন খুন্তি হাতে নিয়ে বলল,’বেশি বকবক করবি না নবনী। যা এখান থেকে।’
আমি রান্নাঘরের দরজার বাইরেই ছিলাম। কথা বাড়ালাম না আর। ফিরে আসার পথে কলিংবেলের আওয়াজ শুনলাম। বাবা এসেছে। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম আমি। আমায় দেখে বাবা মিষ্টি করে হাসল। একটা প্যাকেট আমার হাতে দিল। মুখ আলগা করে দেখলাম কচকচে পেয়ারা। বাবা জুতা খুলতে খুলতে বলল,’তোর মা কোথায়?’
‘চা বানাচ্ছে।’
পেয়ারাগুলো টেবিলের ওপর রেখে আমি সোফায় বসে পড়লাম। বাবা ঘরে যাওয়ার আগে শব্দ করে মাকে বলল,’আমার জন্য এক কাপ চা বানিও তো।’
টুং করে জোড়ে একটা শব্দ এলো রান্নাঘর থেকে। এরপর ঝনঝন করা শব্দ শুনতে পেলাম। মা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এসে বলল,’বাপ-মেয়ে মিলে একটার পর একটা বায়না করেই যাচ্ছ। তোমাদের জন্য একটু শান্তিতে টিভিও দেখতে পারি না। পেয়েছ তো কলুদ বলদ। যেভাবে পারছ খাটাচ্ছ!’
মা রাগে ফোঁসফোঁস করছে। বুঝলাম রান্নাঘরে থালা-বাসনগুলো মা ইচ্ছে করেই ফেলেছে। বাবা অসহায়ের মতো মুখ করে বলল,’মাত্র একটা আবদারই তো করলাম নয়না। এজন্য তুমি এতগুলো কথা শোনালে?’
বাবার এভাবে কথা বলায় আমার ভীষণ হাসি পেল। হাসলামও মুখ চেপে। কারণ মা দেখতে পেলে একদম রক্ষে নেই। মা কিন্তু হাসল না। সে আবার রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল,’এই বয়সেও তার ঢং-এর শেষ নেই।’
বাবা এবার বিচার দেওয়ার ভঙ্গিতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমায় বলল,’নবনী তুই-ই বলতো আমার এমন কী আর বয়স হয়েছে? তোর মা কথায় কথায় আমায় বুড়ো বলে। এটা কি ঠিক?’
‘না। একদম না। এটা তো ঘোর অন্যায়।’ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ধরে বললাম আমি।
মা দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এল। আমার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,’বাপের চামচ একদম বাপের মতোই হয়েছে।’
‘মা ওটা চামচি হবে।’
‘তুই চুপ কর।’
‘করলাম।’
বাবা তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,’আহ্! চা তো নয় যেন অমৃত। নয়না তুমি আর রাগ করে থেকো না। কাল শুক্রবার। কালই আমি একটা কাজের লোক নিয়ে আসব। সে সব কাজে তোমায় সাহায্য করবে।’
‘দেখব নে। এখন চুপ করে থাকো। সিরিয়াল শুরু হয়েছে।’
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে গেল। এখন সে গোসল করবে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম বাবার গোসল শেষ হওয়ার। বাবা-মায়ের ঘরেই বসে রইলাম। গোসল শেষ করে আমায় দেখে বলল,’কী ব্যাপার? কিছু বলবি?’
‘বলব তো।’
‘তাহলে বলে ফেল।’
‘আমার কিছু টাকা লাগবে।’
‘নিবি। বারণ করল কে?’
‘তাহলে দাও।’
‘কত দেবো?’
‘এক হাজার হলেই হবে। কাল বান্ধবীদের ট্রিট দেবো।’
‘কীসের ট্রিট? পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে নাকি প্রেম-ট্রেম কিছু করিস?’
‘উফফ! বাবা। কোনোটাই না। একটা ডেয়ার নিয়েছিলাম। কিন্তু হেরে গিয়েছি। তাই ওদের ট্রিট দিতে হবে।’
‘তুই আমার মেয়ে হয়ে হেরে গেলি? ছিঃ, ছিঃ! ভেরি ব্যাড।’
‘তুমি আর কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিও না তো বাবা।’
‘আচ্ছা যা দেবো না। টাকা কাল সকালে নিয়ে যাস।’
‘পাক্কা তো?’
‘একদম পাক্কা।’
আমি বাবার গালে চুমু খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আপনারা হয়তো বাবার সাথে আমার এমন কথোপকথন শুনে অবাক হয়েছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাবা আমার প্রথম বেষ্টফ্রেন্ড। আমি প্রায় সব কথাই বাবাকে শেয়ার করি; যে কথা হয়তো মাকে বলতেও ভয় পাই।
ঘরে এসে আমি শুয়ে পড়লাম। রাত আটটার মধ্যেই আমি রাতের খাবার খেয়ে ফেলি। বাবা অফিস থেকে আসলে মা আর বাবা একসঙ্গে খায়।
___________
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুম থেকে হৈচৈ শুনতে পেলাম। হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি ১০/১১ বছরের এক ছেলের সাথে বাবা কথা বলছে। তার মানে সত্যি সত্যি বাবা সকাল হতে না হতেই কাজের জন্য এই ছেলেকে ধরে এনেছে।
বাবা ছেলেটিকে প্রশ্ন করছে,’বল তো ওয়াই(Y) এর আগের অক্ষর কী?’
ছেলেটি বলল,’জানিনা।’
বাবা আবার প্রশ্ন করলেন,’তাহলে বল তো ৫০ এর আগের সংখ্যা কত?’
ছেলেটি এবারও বলল,’জানিনা।’
বাবা হতাশ হয়ে বলল,’তুই তো দেখি কিছুই পারিস না। ওকে, নো প্রবলেম! আমি তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো।’
আমি এবার এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম,’এই ছেলে কে বাবা?’
‘ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। আয় তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ওর নাম হচ্ছে রাজ্জাক।
আর রাজ্জাক, এইযে সামনে দাঁড়ানো পরীর মতো সুন্দরী মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছিস ও হচ্ছে আমার একমাত্র রাজকন্যা। ওর নাম নবনী। তুই ওকে আপা বলে ডাকবি।’
‘আচ্ছা।’ মাথা নাড়িয়ে বলল রাজ্জাক।
আমি বেশ ভালো করেই জানি, বাবা এই ছেলেকে কাজ করার জন্য আনলেও কাজ করাবে না। বাবা ওর সম্পর্কে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়া দিয়ে বললাম,’সময় নেই বাবা। গোসল করে রেডি হতে হবে। বাহির থেকে ফিরে এসে তোমার গরীবের রাজ্জাকের সম্পর্কে সব শুনব।’
‘গরীবের রাজ্জাক! বেশ ইন্টারেস্টিং নাম তো!’ বিড়বিড় করে বলল বাবা।
ঘরে যাওয়ার আগে শুনতে পেলাম বাবা আবারও রাজ্জাককে প্রশ্ন করছে,’আচ্ছা এইটা বলতো ‘ঋ’ এর পরের অক্ষরটি কী?’
রাজ্জাক কী উত্তর দিয়েছে শুনতে পাইনি। তার আগেই দরজা লাগিয়ে দিয়েছি। আমার ধারণা এবারও রাজ্জাক বলবে,’জানিনা।’
.
গোসল সেরে একদম রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হলাম। বাবা তখন টেবিলে রাজ্জাককে নিয়ে নাস্তা খাচ্ছিলও। মা-ও সেখানে উপস্থিত। আমায় রেডি দেখে মা বলল,’এত সকালে কোথায় যাস?’
‘রেস্টুরেন্টে যাই মা। বান্ধবীদের ট্রিট দেবো।’ বললাম আমি।
‘দুইদিন একদিন পরপর শুধু ট্রিট। টাকা কি গাছে ধরে?’
বাবা কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,’সেকি নয়না! তুমি জানো না? আমার একটা টাকার গাছ আছে। গোপন গাছ। ঐখান থেকেই তো আমি টাকা পাই।’
মা কটমট করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। বাবা সেদিকে লক্ষ্য না করে আমায় বলল,’আমার ঘরে বালিশের নিচে দেখ পনেরো’শ টাকা আছে। সব টাকা আবার ভাঙিস না। আসার সময় নবরত্ন তেলের বোতল কিনে আনবি তোর মায়ের জন্য। নবরত্ন তেল মাথা ঠান্ডা করার জন্য বেশ উপকারী। আর বাকি সব টাকা তোর।’
মা টেবিলের ওপর জোরে থাপ্পড় দিয়ে বলল,’সবকিছুতেই তোমার বাড়াবাড়ি।’
আমার বাবা ভীষণ রসিক মানুষ। বাড়িতে থাকলে তার প্রথম এবং প্রধান কাজই হচ্ছে মাকে রাগানো। মানতেই হবে বাবা এই কাজটা খুব ভালো পারে। মা রেগে গেলেও প্রতিবার বাবার রসিকতায় আমি হেসে কুটিকুটি হয়ে যাই। মা রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকায়। কিন্তু হাসি থামে না কী করব বলুন! টাকা নিয়ে আমি দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বের হলাম। বলা যায় না কখন আবার মা হুংকার দিয়ে বলে বসে,’নবনী তুই এখন বাড়ি থেকে বের হবি না। খবরদার! আর এক পা-ও আগাবি না।’
মেইনগেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলালাম। আশ্চর্য! একটা ফাঁকা রিকশা-ও নেই। এদিকে একটু পরপর তিথি ফোন করছে। ওরা রেস্টুরেন্টে এসে কখন থেকে নাকি বসে আছে। রাক্ষসের দল পেটুক একেকটা! কিছু্ক্ষণ অপেক্ষা করেও রিকশা পেলাম না। তাই এগিয়ে গিয়ে ভাবলাম সিএনজি নিয়েই যাই। টাকা তো আছেই। ভাগ্য ভালো থাকায় একটা সিএনজি পেয়েও গেলাম। ভেতরে ঢুকতে যাব তখনই ওপাশ থেকে আরেকটি ছেলে আমার সঙ্গে সিএনজিতে বসল। ছেলেটি অন্য কেউ নয়। রুদ্র! কালো জিন্সের সাথে সাদা একটা টি-শার্ট পরেছে। চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। অটোমেটিক আমার হাত বুকের বামপাশে চলে গেল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। আমায় অবাক করে দিয়ে রুদ্র হেসে ফেলল। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,’সরি। আপনি যান।’
আমি তড়িঘড়ি করে বললাম,’শুনুন, শুনুন। সমস্যা নেই। আমি সামনেই নামব। আপনি আসতে পারেন।’
‘আমিও সামনেই নামব। আমি সাথে গেলে সমস্যা হবে না তো?’
‘একদম না।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
রুদ্র আমার পাশে এসে বসল। মাঝখানে যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্ব। রুদ্র আপনমনে ফোন চাপছে। সিএনজি চলা শুরু করেছে। আমি চোরের মতো আড়চোখে বারবার রুদ্রকে দেখছি। কেমন ছেলেরে বাবা! কথা বলা তো দূরে থাক; ফিরেও তাকাচ্ছে না! না তাকাক! দুজনে যে একসঙ্গে একই সিএনজিতে যাচ্ছি এটা মনে করেই তো আমি মহাখুশি। কিন্তু অবাধ্য মনটা এরচেয়েও বেশি কিছু আবদার করছে। রুদ্রের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। আমি নিজেই নিজেকে বিদ্রুপ করে মনে মনে বললাম,’কাল তো খুব ভয় পেলি। আর আজ কথা বলার জন্য এত উতলা হয়ে পড়েছিস কেন?’
মনকে বকেও বলে বুঝাতে ব্যর্থ হলাম। কাল রুদ্র রেগে ছিল। কিন্তু আজ তো রেগে নেই। চোখের সামনে বারবার মিষ্টি হাসিটা ভেসে উঠছে। বলি কথা! গলাটা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করলাম,’আপনি কি আমায় চিনতে পেরেছেন?’
রুদ্র এবার ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। যাক বাবা! তাও তো তাকাল। তারপর আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,’না তো! তবে একটু একটু চেনা মনে হচ্ছে। মানে চোখদুটো আরকী!’
আমি হেসে ফেললাম। প্রথমদিনের কথা তার মনে নেই তাহলে।
‘কাল যে আমার থেকে পানি খেলেন। মনে নেই?’ বললাম আমি। রুদ্র মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ওহ আচ্ছা! আচ্ছা! মনে পড়েছে এবার। স্কুল ড্রেস ছাড়া কিন্তু তোমায় বেশ বড়ো মনে হয়।’
‘এজন্যই বোধ হয় প্রথমদিন আমায় কাজের বুয়া ভেবেছিলেন?’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। হয়তো সেদিনের কথাটাই! রুদ্র নিজেই এবার শব্দ করে হেসে বলল,’আল্লাহ্!
তার মানে ঐ মেয়ে তুমি? সেদিনের জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত। আমি একদম বুঝতে পারিনি। আর সরি বলার সুযোগও দাওনি।’
‘ইট’স ওকে। ব্যাপার না। আমার লুকটাই তখন ওমন ছিল।’
‘তুমি রাগ করোনি তো?’
‘প্রথমে রাগ হয়েছিল। এরপর আয়নার সামনে গিয়ে ভালো করে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম আপনার দোষ নেই।’
রুদ্র এবারও হাসল। এই ছেলে হেসেই আমায় মেরে ফেলবে নাকি বুঝি না!
‘সেদিনের পর তো তোমায় আর দেখলাম না। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার নাম কী?’
‘কিন্তু আমি আপনাকে প্রতিদিনই দেখতাম। আমার নাম নবনী।’
‘সুন্দর নাম। কোন ক্লাসে পড়ো?’
‘টেনে।’
‘গুড।’
সিএনজি এসে রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। আমার সঙ্গে রুদ্রও নামে। আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনি এখানে নামলেন যে?’
‘আমিও তো রেস্টুরেন্টেই যাব।’
কত মিল আমাদের! মনে মনে ময়ূর পেখম তুলে নাচছে। রুদ্র জোর করেই আমার ভাড়া-ও দিয়ে দিল। দুজনে রেস্টুরেন্টের গেটের সামনে যাওয়ার পর একটা মেয়ে হাওয়ার বেগে উড়ে এসে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে। এই দৃশ্য দেখে আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ইশরে! কেউ মনে হয় বুকের বাম পাশটায় তীর ঢুকিয়ে দিল। এই মেয়েটা আবার কে? রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড? এই মেয়ে যদি রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড হয় তাহলে সত্যি বলছি এখানে বসেই হাত-পা ছড়িয়ে আমি কাঁদব। আমার সান্ত্বনা দেওয়ার বাক্সগুলা যে কোথায়! প্লিজ রুদ্র প্লিজ এই মেয়েকে এক ধাক্কায় পঁচা নর্দমায় ফেলে দাও। আচ্ছা ঐ মেয়ে যদি সত্যিই রুদ্রর গার্লফ্রেন্ড হয় তাহলে আমার এখন কী করা উচিত?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আপনাদের রেসপন্সের ওপরেই নির্ভর করে গল্পটা প্রতিদিন দেবো কী-না।]
#সে
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
রুদ্র আমার মনের কথা বুঝেছিল কী-না জানিনা তবে ঠিক ঠিক মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আমার ধারণা পাশে যদি কোনো নর্দমা থাকত তাহলে মেয়েটির জায়গা এখন সেই নর্দমাতেই হতো। রুদ্র রাগী রাগী গলায় মেয়েটিকে বলল,’তোর এই স্বভাব আমি বাদ দিতে বলেছি না? দেখলেই একদম বান্দরের মতো গলায় ঝুলে পড়িস। বিরক্তিকর! গায়ে পড়া স্বভাব আমার একদম ভাল্লাগে না শিরিন। নেক্সট টাইম তোর এমন ব্যবহার দেখলে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো।’
এই প্রথম রুদ্রের রাগ দেখে ভয় পাওয়ার বদলে আমার খুশি খুশি লাগছে। বেশ হয়েছে একদম! হতচ্ছাড়ি আরও ধর জড়িয়ে। রুদ্র ওর বাকি বন্ধুদের নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর চলে যায়। শিরিন মেয়েটি কাচুমুচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত মানুষের সামনে এভাবে অপমান করবে রুদ্র এটা হয়তো একদম প্রত্যাশার বাহিরে ছিল মেয়েটির। সবাই চলে গেলেও একটি মেয়ে রয়ে গেছে। সে শিরিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,’মন খারাপ করিস না। ভেতরে চল।’
‘রুদ্র সবসময় আমার সাথে এমন করে কেন?’ জিজ্ঞেস করল শিরিন। পাশের মেয়েটি বলল,’জানিসই তো রুদ্র কেমন। তবুও ওর সাথে আঠার মতো লাগতে যাস কেন?’
‘বিকজ আই লাভ হিম।’
‘তোর এই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে কবে জানি বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যায়। এর আগে কতগুলারে ভালোবাসছিস? কতগুলা রিলেশনও করছিস। রুদ্র সব জানেও। তাছাড়া তোর প্রতি রুদ্রের রিলেশন করার মতো কোনো ইন্টেনশন নাই। এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবি ততই তোর জন্য ভালো।’
কথার শেষে শিরিনের মাথায় গাট্টা মেরে মেয়েটিও ভেতরে চলে গেল। বিরক্ত নিয়ে সঙ্গে গেল শিরিনও। এতক্ষণ আমি ফোন টেপার ভং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নয়তো ওদের কথোপকথনগুলো তো আর শুনতে পারতাম না। এই শাঁকচুন্নি তাহলে রুদ্রের বান্ধবী। এমন খাইস্টা মাইয়া ওর মতো ছেলের বান্ধবী হয় কেমনে আমি তো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। থাক বাবা, আমার অত ভাবাভাবির কাজ নাই। এইটুকু তো শিওর হলাম যে, রুদ্র শিরিনকে পাত্তা দেয় না। দেওয়া উচিতও নয়। একদম নয়। হুহ!
রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে দেখলাম আমার বান্ধবীগুলা খাবার খাচ্ছে। মানে বুঝলাম না। আমি আসার আগেই ওরা খাবার অর্ডার দিয়ে ফেলেছে? আমি এক সাইডে বসে জিজ্ঞেস করলাম,’আমি আসার আগেই তোরা খাবার অর্ডার দিয়ে ফেললি? আবার আমায় রেখেই খাচ্ছিস।’
লিমা খাওয়ার ফাঁকে একটু ব্রেক নিয়ে বলল,’তোর জন্য আর কতক্ষণ ওয়েট করে থাকব? ট্রিট দিবি বলে সকালে আমরা কেউ নাস্তা করিনি।’
‘বাহ্! বাহ্! আমি যদি না আসতাম? বিল কে দিতি?’
‘তুই যে আসবি আমরা সেটা জানি। ফাজিল হলেও কথা দিয়ে কথা রাখিস তুই।’ বলল তিথি।
আমি উদাস হব নাকি ওদের চিবিয়ে খাব বুঝতে পারছিলাম না। আমার ভালো মানুষীর সুযোগ নিচ্ছে ওরা। এজন্য তথাকথিত একটা কথা আছে, ‘আজকাল ভালো মানুষের দাম নেই।’
মনের দুঃখে বড়ো শ্বাস নিয়ে ওয়েটারকে ডাকতে যাব তখন আমাদের অপজিটে এক টেবিল এগিয়ে বসা রুদ্র ও ওর বন্ধুদের দেখতে পেলাম। আমার এখান থেকে রুদ্রকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। কী সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে ছেলেটা! তিথি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,’ঐ সিটে আগে আমি বসা ছিলাম। দেখলাম ঐখান থেকে রুদ্র ভাইয়াকে দেখা যায়। তাই তোর জন্য ঐ সিট রেখে এখানে এসে বসেছি।’
তিথির এ কথায় আমি খুশি হয়ে গেলাম। ওর গাল ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বললাম,’ওলে আমাল লাল গুড্ডু গুড্ডু বান্ধবী!’
‘হুস যা! ঢং করা লাগবে না আর। আমার জন্য আরেকটা বার্গার অর্ডার দে।’
‘দিচ্ছি।’
তিথির জন্য বার্গার অর্ডার দিয়ে আমি চুপি চুপি রুদ্রকে দেখছিলাম। লুকিয়ে কয়েকটা ছবিও তুলে নিয়েছি। এত্ত সুন্দর করে হাসে ছেলেটা!
আমি আসার আগেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছিল ওদের। বাকি অর্ধেকও শেষ। আমি ট্রিট দিলাম অথচ একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস ছাড়া আমি আর কিছুই খাইনি। খাব কী করে? আমার পেট তো ভরে আছে খুশিতে। সব জায়গায় রুদ্রকে পাই। ওকে দেখলেই আমার খুশি খুশি লাগে। আর পেট ভরে যায়। কী অদ্ভুত কথা না?
তিথিরা ঢেকুর তুলে বলে,
‘নবনী বিলটা তাড়াতাড়ি দিয়ে বাড়ি চল। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’
‘আরে রুদ্র তো এখনও আছে।’ নাকমুখ কুঁচকে বললাম আমি। লিমা আমার হাতে চিমটি কেটে বলল,’সে কখন যাবে তার কোনো ঠিক আছে? তার আশায় বসে থাকলে বৃষ্টির কবলে পড়তে হবে। থাকিস তো পাশাপাশি এপার্টমেন্টে। মন চাইবে চলে যাবি।’
‘ধুর!’
রুদ্রকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আর বেশিক্ষণ থাকাও যাবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে বাড়িতে মা কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেবে। আকাশের অবস্থাও ভালো না। একবার বৃষ্টি শুরু হলে কখন থামবে তারও কোনো নিশ্চয়ত্তা নেই। তাই রুদ্রকে রেখেই বিল দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এলাম।
.
আমি বাদে বাকিদের বাড়ি অপজিটে। অর্থাৎ আমায় একাই এখন বাড়ি ফিরতে হবে। ওরা একটা সিএনজি নিয়ে চলে যায়। আর আমি রিকশায় উঠে বসি। ভাগ্য এত খারাপ হবে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়ে উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার। এমনিতেও যা ওজন আমার! সবাই বলে আমি নাকি বাতাসের আগে আগে চলি।
‘আপা! রিকশা তো চলে না। হাওয়া শ্যাষ।’
রিকশাওয়ালার কথা শুনে মনে হচ্ছে বিশাল আকাশ এখন আমায় মাথায় পড়ে ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। আমি অসহায় ভঙ্গিতে বললাম,’মামা ট্রাই করে দেখেন আবার।’
‘টেরাই কইরা লাভ হইব না আপা। আমার ভাড়া লাগব না। আপনে তাড়াতাড়ি কইরা বাড়িতে যানগা।’
আমার অবস্থা এখন ‘চিৎকার করিয়া কাঁদিতে চাহিয়াও আমি করিতে পারিনি চিৎকার।’ বেচারা রিকশাওয়ালার-ই বা দোষ কী! ভাগ্যে ছিল এমন বিপদে পড়ব। পড়েছি। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই আমি হাঁটতে শুরু করি। বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি; অথচ এতেই প্রায় রাস্তা ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে চায়ের টং দোকান যখন পাস করে গেলাম পেছন থেকে কতগুলো ছেলের উস্কানিমূলক কথা শুনতে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম চারজন ছেলেকে। বাজে বাজে কথা বলে যাচ্ছে আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে। ভয়ের চেয়ে রাগ বেশি হচ্ছিল আমার। যদি পারতাম এখনই সবকয়টাকে পিটিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতাম। একা পেয়ে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে! আশেপাশে কোথাও যে দাঁড়াব তারও কোনো উপায় নেই। আর একটা রিকশা-ও চোখে পড়ল না।
একটা রিকশা অবশ্য এলো। কিন্তু ফাঁকা নয়। রিকশাটি আমার সামনেই থামল। আরও বেশি অবাক হলাম রুদ্রকে দেখে। সেদিনের সেই রণমূর্তির আবির্ভাব ওর চোখেমুখে। সঙ্গে আরেকজন ছেলে ছিল। দু’জন মিলে ঐ ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে দিল গালে থাপ্পড়। বাকি দুইটা ভয়েই দৌঁড়। রুদ্র একটার কলার চেপে ধরে বলল,’আবার এই এলাকায় মেয়েদের বিরক্ত করা শুরু করছিস?’
‘মাফ চাই ভাই। আর হইব না।’
আরেকটি থাপ্পড় দিয়ে তবেই রুদ্র ছেলেটিকে ছাড়ল। বিষয়টা আমার কাছে সিনেমাটকই লাগল। না, না মীরাক্কেল বলা যায়!
রুদ্র কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,’বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছ কেন? একটা রিকশা তো নিতে পারতে।’
‘নিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় চাকার হাওয়া ফুঁশ!’ মাথা নত করে বললাম আমি। তখন রুদ্রর হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। হয়তো আমার শেষ কথাটি শুনেই হেসেছে। ওর হাসি দেখে আমিও মুচকি হাসলাম। রুদ্র হাসতে হাসতে বলল,’আচ্ছা যাও রিকশায় উঠো।’
খুশির উত্তেজনায় ইচ্ছে করছিল এখানেই নাচানাচি শুরু করি। রুদ্র আর আমি এক রিকশায়! ওর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে অবশ্য একটুখানি খুশি কমে গেল। থাক ব্যাপার না। আমাদের মাঝে সে দুধভাত। আমি আগে আগে গিয়ে রিকশায় বসলাম। রুদ্রও এগিয়ে এসে রিকশাওয়াকে বলল,’মামা একদম বাড়ির সামনে নামিয়ে দিবেন।’
‘আইচ্ছা।’ বলল রিকশাওয়ালা।
রুদ্র এটা কী বলল? আমি যে খুশিতে মনে মনে নাচলাম এগুলো সব বৃথা গেল?
‘আপনারা যাবেন না?’ সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। রুদ্র বলল,
‘হ্যাঁ। আমরা হেঁটেই যেতে পারব। তুমি সাবধানে যাও।’
রিকশা চলা শুরু করে। এদিকে রাগে গজগজ করি আমি। বৃষ্টিও মনে হয় মাথার আগুন নেভাতে পারবে না। স্বগতোক্তি করে বলে ফেললাম,’ধ্যাত!’
পুরো কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফেরার দরুণ ইচ্ছেমতো মায়ের বকুনি খেলাম কতক্ষণ। ব্যাপার না। বকবে তিনি আদরও করবে তিনি। আমি জামা-কাপড় পাল্টে ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম। বাবা আর রাজ্জাকও ড্রয়িংরুমেই বসে ছিল। মা এখন রান্নাঘরে। আমি শিওর সে আমার জন্য এখন গরম দুধ নিয়ে আসবে। এই খাদ্যটা অপছন্দ হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র বকা খাওয়ার ভয়ে গিলতে হবে। দুধের গ্লাসটা আমার সামনে রেখে বলল,’কোনোরকম বাহানা না করে দুধটুখু খেয়ে নাপা-এক্সট্রা খেয়ে নিবি। তারপর একটা ঘুম দিবি।’
আমি কিছু বললাম না। বাবা বললেন,’তোকে যে নবরত্ন তেল আনতে বলেছিলাম। আনিসনি?’
‘না। মনে ছিল না।’
‘ভুল করে ফেললি রে। এখন তোর মায়ের মাথা ঠান্ডা করব কী করে বল তো?’
‘তুমি চুপ করে থাকো। সবসময় শুধু রসিকতা।’ ধমক দিয়ে বলল মা। বাবা ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে বলল,’এইযে আমি চুপ হলাম।’
দুধটুকু খেয়ে ওষুধ মুখে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসি। জানালা দিয়ে ওষুধটা ফেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আসলেই এখন প্রচুর ঘুম আসছে।
___________
ঘুম ভেঙেছে ঠিক তিনটায়। আকাশ এখনও থম মেরে রয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। ভাবলাম যাই গিয়ে একটু ছাদ থেকে হেঁটে আসি। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম রাজ্জাক চুপচাপ বসে আছে। আমি বললাম,’এই রাজ্জাক ছাদে যাবি?’
‘যামু।’
‘চল তাহলে।’
রাজ্জাককে নিয়ে ছাদে এসে দেখলাম পরিবেশটা অনেক বেশি সুন্দর। ছাদের একেক কোনায় পানি জমে রয়েছে। জুতা খুলে পানির ওপর পা রেখে হাঁটছিলাম। ভালো লাগছিল খুব। ছাদে অনেকগুলো।গাছ লাগানো রাখা। কারা লাগিয়েছে জানিনা। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাওয়া গাছগুলোকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। গাছের পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিলাম আমি। পেছনে ঘুরে রাজ্জাককে ডাকতে গিয়ে দেখলাম আমাদের থেকে কিছুটা দূরে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন গিলে খেয়ে ফেলবে। ছেলেটা রাজ্জাকের বয়সীই হবে।
কোমরে হাত রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,’কী পিচ্চি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?’
ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে এসে নিজের চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলে,’মোটেও আমি কোনো পিচ্চি নই। তুমি যেই গাছের পাতা ধরলে ঐটা আমার গাছ।’
‘হ্যাঁ, তো?’
‘আমার গাছ কেউ ধরুক এইটা আমি পছন্দ করি না।’
এইটুকু ছেলের কথা শুনেছেন আপনারা? বাপ্রে বাপ! কী এটিটিউড! এই বয়সে আমরা মায়ের আঁচল ধরে ঘুরতাম। খেলনাপাতি খেলতাম। বড়োদের সঙ্গে কথা বলা তো দূরে থাক; ঠিকমতো চোখের দিকেও তাকাতাম না ভয়ে। ছেলেটি মুচকি হেসে বলে,’আমি রিশান। তোমার নাম কী?’
‘নবনী।’
‘ওয়াও! অনেক সুন্দর নাম তো। আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে। ব্যাপক সুন্দরী। ওর নাম হলো অবনী। তোমার নামের সঙ্গে কিন্তু মিল আছে।’
এই ছেলের কথাবার্তার স্টাইল শুনে মনে চাচ্ছিল ঠাস করে গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই। বেয়াদব ছেলে! মনে মনে বকলেও মুখে কিছু বললাম না। ছেলেটা গুলুমুলু আছে। গাল দুইটা চটকায় দিতে মনে চাচ্ছে। আমি হেসে বললাম,’এই বয়সে এত যে ঢং তোমার বাড়ির কেউ কিছু বলে না?’
‘কী বলবে? কারো সাহস আছে নাকি আমায় কিছু বলার?’
‘ও বাবা! রংবাজ নাকি তুমি?’
‘আমি না। তবে আমার ভাইয়া। সবাই ভাইয়াকে অনেক ভয় পায়। তুমি কি আমার ভাইয়াকে চেনো?’
‘জি না। আমি কী করে চিনব? আমরা এই বাসায় নতুন এসেছি।’
‘ও। সমস্যা নাই চিনে যাবা। এই এপার্টমেন্টের সবাই আমার ভাইয়াকে চিনে। বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েরা। আমার ভাইয়া কিন্তু কাউকে পাত্তা দেয় না।’
‘ও তাই? শুনো তোমার ভাইয়াকে এক কিকে দূরে ফেলে দেবে এমন একজনকে আমি চিনি।’
‘ছিঃ! এমন কথা মুখেও এনো না। আমার ভাইয়া একবার শুনলে তোমার খবর আছে।’
‘হুস! নবনী কাউকে ভয় পায় না।’
‘আচ্ছা বেশ! যার কথা বলছ সে তোমার কে হয়?’
পড়লাম তো এবার বিপাকে! আমি তো বলছিলাম রুদ্রর কথা। এখন কী করে বলি সে আমার কী হয়? এখন যদি বানিয়ে কোনো কথা বলি আর সেটা যদি রুদ্রর কানে যায় তাহলে থাপ্রিয়ে আমার গাল লাল করে ফেলবে শিওর। তাই মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে বললাম,’এই রে! কত সময় পার হয়ে গেল। যাই এখন। পরে তার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দেবো।’
এরপর রাজ্জাককে নিয়ে হাঁটা ধরলাম। সিঁড়িঘরের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে আচমকা প্লাজুতে পাড়া লেগে যায়। টাল সামলাতে না পেরে আমিও একদম উপুর হয়ে পড়ি। তখন কোন বেচারা যে উপরে আসছিল আমি জানিনা। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে সঙ্গে কষ্ট পোহাতে হলো সেই বেচারাকেও! একদম সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে ফ্লোরে এসে ঠেকলাম। বিশ্বাস করেন, যেই ব্যক্তি একবার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়েছে সেই ব্যক্তি কখনো মুভিতে এই সীন দেখলে সেটাকে রোমান্টিক সীন বলবে না। ভাববেন না যে নায়ক-নায়িকার মতো একসাথে গড়িয়ে পড়েছি। শুধু এতটুকুই বুঝতে পেরেছি আমার জন্য আরেকজনকেও পড়তে হয়েছে। হাড়-হাড্ডি বোধ হয় সব এক হয়ে গেল আমার! সিঁড়ি দিয়ে দপাদপ কারোর নামার শব্দ পেলাম। হয়তো সেটা রাজ্জাক হবে। আর একটু দূর থেকে রিশানের কণ্ঠ শুনলাম,’ভাইয়া রে!’
ওর ভাইয়াটা কে এটা দেখার জন্যই সকল ব্যথা ভুলে গিয়ে চোখ মেলে তাকালাম… এই ছেলে আবার কে!
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]