#সেই_আদুরে_দিন
#পর্বঃ১২
#Arshi_Ayat
আরমান সাহরীফকে অনেক খুঁজেও বের করা যায় নি।নিক্স,আনা আর ভিকি আলাদা আলাদা খুঁজতে বেরিয়েছে আর রিভান সিনাতকে পাহারা দেওয়ার জন্য রয়ে গেছে।
একটা চেয়ারে বাধা অবস্থায় আর কতক্ষণ থাকা যায়?মাজা কোমরের ব্যাথায় অবস্থা খারাপ সিনাতের তারওপর চোখের সামনে একটা লোককে এভাবে মাছির মতো হাটাহাটি করতে দেখলে আরো রাগ লাগলো সিনাতের।সেই কখন থেকে হাঁটছে বোবার মতো একটা কথাও নেই।সিনাতের ইচ্ছা করলো কথা বলতে তাই সাহস জুগিয়ে বলল,’এক্সকিউজ মি!’
রিভান সিনাতের গলার আওয়াজ শুনে ওর দিকে তাকিয়েও কিছু বলল না।
‘আপনার নাম কি?’
সিনাতের কথার কোনো জবাব দিলো না রিভান।নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়েও দমে গেলো না সিনাত পুনরায় প্রশ্ন করলো,’আপনি কি কথা বলতে পারেন না?’
রিভান সিনাতের প্রশ্নের হাত থেকে বাচার জন্য ‘না’ বোধক মাথা নেড়ে জানালো সে কথা বলতে পারে না।সিনাত ভাবলো আসলেই এই ছেলেটা কথা বলতে পারে না তাই একটু মন খারাপ হলো ওর।আবার মনে হলো শুনতে তো পারে।ইশারায় কথা বলা যাবে!এটা মনে করে সিনাত আবার বলল,’আচ্ছা আমরা ইশারায় কথা তো বলতেই পারি।আমি বলবো আপনি সেটা শুনে ইশারায় জবাব দিবেন আমার।’
রিভান দাঁত কিড়মিড় করে মনে মনে বলল,’মেয়েটা দু’চারটা কষে চড় মারতে পারলে ভাল্লাগতো!বাঁচাল একটা।বোবা বললাম তবুও ছাড়া দিবে না কথা বলতেই হবে!’
‘আপনার মুখের মাস্কটা সরান না!কি মেয়েদের মতো মুখ ঢেকে রেখেছেন!সরান ওটা একটু দেখি আপনাকে।’
রিভান অগ্নিচোখে সিনাতের দিকে চাইতেই ও চুপ হয়ে গেলো।একটু পর আবারও বলল,’আচ্ছা আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?’
এবার প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে রিভান ধমকে বলল,’চুপ!একদম চুপ আর একটা কথাও না।’
থেকে রাম ধমক খেয়ে সিনাত এবার ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেলো।আর রিভান ওর দিকে একটা ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাইরে চলে গেলো।এখানে থাকলেই মেয়েটা কথা বলতে চাইবে এটা ভেবেই রিভান বাইরে চলে গেলো।এমনিতেও মেয়েদের সাথে কথা বলতে ওর ভালো লাগে না।আনা’র সাথেও কাজের বাইরে কথা হয় না।
—————–
জায়গাটায় অনেক মানুষের ভিড়!সবাই উৎসুক হয়ে একজন মানুষের কান্না দেখছে।মানুষটা সামনে শোয়ানো লাশটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদছে।পোড়া,দগ্ধ লাশটা বোধহয় তার কান্না শুনছে না যদি শুনতো তাহলে হয়তো একটা বার কথা বলতো!চোখ মুছে দিতো ভালোবাসার মানুষটার কিন্তু না আজ সে অন্ধ!বোবা!বধির!মৃত!জাগতিক কোনো বার্তাই তার কাছে আর পৌঁছাচ্ছে না।
হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো রৌদ্রুপ!সারা শরীর ঘেমে গেছে।সবচেয়ে আশ্চর্য এটাই ওর চোখ দিয়েই পানি পড়ছে।এটা কি ছিলো!আদৌ কোনো দুঃস্বপ্ন নাকি বাস্তব!তাড়াতাড়ি পাশে তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা খালি পড়ে আছে শুদ্ধতা নেই!বুকের ধড়ফড়টা যেনো আরো একধাপ বেড়ে গেলো।দ্রুত বিছানা থেকে নেমেই ড্রয়িং রুমে চলে এলো।রুম পুরো ফাঁকা!বাড়ির প্রত্যেকটা রুম খুঁজেও পেলো না!তারপর কিচেনে যারা কাজ করছে তাদের জিগ্যেস করতেই জানতে পারলো শুদ্ধতা একটু আগেই বাইরে গেছে।জানতে পেরেই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো বাইরের দিকে!
আজ সারাদিন রৌদ্রুপ শুদ্ধতাকে জ্বালানোর জন্য কিছু না কিছু করেছেই।এতে শুদ্ধতা কখনো রাগ করেছে তো কখনো বিরক্ত হয়ে আবার কখনো লজ্জাও পেয়েছে!সবই রৌদ্রুপের কাছে প্রকাশ্যমান!তারপর দুপুরে খেয়ে ক্যারাম খেলতে বসেছিলো দু’জনে।অনেক্ক্ষণ খেলার পর রৌদ্রুপের ঘুম পাচ্ছিলো বলে শুদ্ধতাকে জোর করে নিজের পাশে শুইয়ে রাখলো।যদিও শুদ্ধতার মোটেও ঘুম পাচ্ছিলো না।ও অপেক্ষা করছিলো কখন রৌদ্রুপ ঘুমাবে।যখন নিশ্চিত হলো রৌদ্রুপ ঘুমিয়ে গেছে তখন সন্তপর্ণে উঠে বাইরে চলে গেলো জায়গাটা ঘুরে দেখার জন্য।
আশেপাশে পাগলের মতে হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে অনেকটাদূর যাওয়ার পর দেখলো শুদ্ধতা পা ধরে বসে আছে।বোধহয় ব্যাথা পেয়েছে!রৌদ্রুপ দৌড়ে গেলো।দূর থেকে তেমন না বুঝলেও সামনে গিয়ে দেখলো ওর পা কেটে গেছে সেটাই হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে আছে।তবুও রক্ত গড়াচ্ছে।রৌদ্রুপ তৎক্ষনাৎ হাঁটু গেড়ে বসে ওর শার্ট খুলে শুদ্ধতার পায়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে বিনাবাক্যে কোলে তুলে নিলো।এতক্ষণ ব্যাথা নিয়ে কাতরালেও এখন ভয় হচ্ছে রৌদ্রুপের চেহারা দেখে।মুখের আদলই বলে দিচ্ছে ভয়ংকর রকমের রেগে আছে সে।আর এমন চুপচাপ থাকা হলো ঝড়ের লক্ষণ।শুদ্ধতা ভেতরে ভেতরে ঢোক গিলেছে আর বলছে আল্লাহ এইবারের মতো বাচায় দাও কানে ধরছি আর জীবনেও একা বাইর হবো না!
ঘরে এনে সাবধানে শুদ্ধতাকে খাটের ওপর বসিয়ে ফাস্ট এইডের বক্সটা এনে সুন্দর করে ড্রেসিং করে গজ দিয়ে বেঁধে দিলো।তারপর চুপচাপ উঠে গিয়ে কোথা থেকে যেনো একটা ঔষধ আর একগ্লাসপানি এনে শুদ্ধতার হাতে ধরিয়ে দিলো।যদিও এটা কিসের ঔষধ এটা জিগ্যেস করার ইচ্ছা ছিলো ওর কিন্তু কথা বলে বিপদ টেনে আনার কোনো মানেই হয় না।এটা বিষ হলেও সে নির্দ্বিধায় খাবে!তাই বিনাবাক্যে শুদ্ধতা ঔষধটা খেয়ে নিলো।ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে রৌদ্রুপ সেই যে বেরিয়ে গেলো সন্ধ্যা হতে চলল এখনো এলো না।এদিকে দারোয়ান চাবি দিয়ে গেছে আর রাধুনি দুজন সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে কিন্তু তার আসার খবর নেই।শুদ্ধতা মন খারাপ করে ফেললো।এতোটা রেগে যাবে ভাবতেই পারে নি।এখন মনে হচ্ছে রাগ গুলো ওর ওপর ঝাড়লেই ভালো হতো!মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে শুদ্ধতা প্রচন্ড মিস করছে রৌদ্রুপকে।একসময় অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েও পড়েছে।
রৌদ্রুপ এলো রাত আট’টায়।ঘরে এসে দেখলো শুদ্ধতা ঘুমিয়ে গেছে।কাছে এসে কিছুক্ষণ ওর দিকে চেয়ে কপালে আলতো একটা চুমু খেয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো শুদ্ধতা উঠে গেছে।আড়চোখে একবার সেদিকে চেয়ে এমন ভাবে বারান্দায় চলে গেলো যেনো ঘরে কেউই নেই একমাত্র সে ছাড়া!ওকে এভাবে এড়িয়ে যেতে দেখে শুদ্ধতা জোর গলায় বলল,’সরি!’
বারান্দা থেকে আওয়াজ শুনলেও রৌদ্রুপ কিছু বলল না।শুদ্ধতা আবারও বলল,’এই যে এদিকে আসুন না।আমি তো বললাম সরি!আর জীবনেও এমন হবে না।’
এরপরেও কিছু বলল না রৌদ্রুপ।এভাবেই কিছুক্ষণ শুদ্ধতা একা একাই কথা বলল রৌদ্রুপ সেটাতে বিন্দুমাত্র প্রতিত্তোর করলো না।তাই না পেরে কাটা পা নিয়েই খাট থেকে নেমে পড়লো শুদ্ধতা।কিন্তু এক কদমও ফেলতে পারে নি!ব্যাথায় ‘আহ!’ করে চিৎকার দিয়ে বসে পড়লো মেঝেতে।বারান্দা থেকে শুদ্ধতার আর্তনাদের আওয়াজ শুনেই রৌদ্রুপ দ্রুত চলে এলো।এসেই শুদ্ধতাকে আবারও কোলে নিয়ে বিছানায় বসালো আর একটা ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যেতে চাইলেও যেতে পারলো না কারণ শুদ্ধতা গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে।রৌদ্রুপ গম্ভীর গলায় বলল,’শুদ্ধতা ছাড়ো।’
ভিষণ মন খারাপ হলো শুদ্ধতার।অজানা কারণেই রৌদ্রুপের মুখ থেকে ‘শুদ্ধ’ নামটা শুনতে ভালোবাসে সে কিন্তু আজ প্রথমবারে মতো শুদ্ধতা বলল!কেনো জানি ভালো লাগছে না রৌদ্রুপের মুখ থেকে শুদ্ধতা শুনতে!তাই কাতর গলায় বলল,’সরি!প্লিজ কথা বলুন।আপনি কথা না বললে ভালো লাগে না।আমি আর কখনোই এমন করবো না।’
কাজ হলো না!রৌদ্রুপ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।কোনোকিছুতেই যখন কাজ হলো না তখন শেষ একটা ট্রাই করলো শুদ্ধতা!চট করে একটা চুমু খেয়ে নিলো ওর গালে।রৌদ্রুপ চকিতেই ওর দিকে তাকালো!কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে খাট থেকে ওকে তুলে নিয়ে বারন্দায় ডিভানের ওপর নিয়ে বসালো।নিজেও পাশে বসলো।একটা হাত দিয়ে ওর হাত শক্ত করে ধরে বলল,’জানি না কেনো তোমাকে এতো ভালোবাসি।আজ দুপুরে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি তোমাকে নিয়ে তারপর উঠে যখন তোমায় পেলাম না আমার বোধহয় নিঃশ্বাসটা গলার কাছে চলে এসেছিলো।পাগলের মতো খুঁজেছি তোমায়।তারপর যখন তোমায় পেলাম তখন দেখলাম তুমি ব্যাথা পেয়েছো বিশ্বাস করো তখন প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো আমার।তবুও আমি রাগকে কাবু করে তোমাকে ঘরে নিয়ে আসলাম।বেন্ডেজ করে বেরিয়ে গেলাম কারণ থাকলেই রেগে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবো যা আমি চাই না তাই বাইরে চলে গিয়েছিলাম।এখন রাগ না থাকলেও ভয় আছে!প্রচন্ড ভয়!তোমাকে হারানোর ভয়!আজ তোমাকে আমার মিশন!আমার পরিচয় সবকিছু বলবো।সবশুনে তুমি যদি থাকতে না চাও আমার সাথে আমি তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিবো আর যদি থাকতে চাও তবে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে চাই!
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)