সৃজা পর্বঃ২৭

0
671

#সৃজা
পর্বঃ২৭
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

ভোরের আলো চোখে পরতে চোখ খুলল সৃজা।সামনে তাকাতেই দেখতে পেল টিউলিপ চোখ গোলগোল করে তার মামা আর মামীর দিকে তাকিয়ে আছে।সৃজা কিয়ৎক্ষণ বোঝার চেষ্টা করল টিউলিপের মনোভাব।পরক্ষণেই হরবরিয়ে উঠে সাফওয়ানের শক্ত বাধন ছাড়িয়ে নিল।সাফওয়ান ও ততক্ষণে উঠে পরেছে।মুদিত নয়নেই বুঝতে পারল কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।

হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো সাফওয়ান।যা দেখে সৃজা যারপরনাই বিরক্ত হল।সব এই লোকটার জন্য হয়েছে।কি দরকার ছিল জড়িয়ে ধরে শোয়ার।একটা রাত নিজেকে সামলাতে পারলনা।সৃজা ঘুম জড়ানো গলা পরিষ্কার করে টিউলিপকে বলল
“টিউলিপ কখন উঠেছে।মাম্মাকে ডাকেনি কেন?”
টিউলিপ সহসা উত্তর দিল
“তোমাকে যখন মামা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল তখন।” সৃজা লজ্জায় পরে গেল।কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলল
“সেটা তো ভুল করে ধরেছে।বুঝতে পারেনি না তোমার মামা।টিউলিপ সোনা তো জানে একজন ভুল করলে সেটা অন্যজনকে বলতে হয় না তাই না?তাই টিউলিপ এটা কাউকে বলবেনা।হুম?”

“আমি জানিতো,ঠিক আছে কাউকে বলবোনা।”
“ইয়ে, টিউলিপ গুড গার্ল।এখন চল ফ্রেশ হবে।”
“আমি মাম্মার কাছে যাবো।”
“ঠিক আছে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে যাবো সোনা।”
সাফওয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই টিউলিপ সাবধান করে দিল এভাবে ভুল করে পুতুল মাম্মাকে কষ্ট না দিতে।সৃজাতো মনে মনে হেসে কুটিকুটি।সাফওয়ান অবুঝের মতো হ্যা বোঝালো।

সৃজার পড়ার চাপটা রয়েই গেছে।তাছাড়া অনেকদিন হল গ্রামে আছে।ঢাকা যাওয়া দরকার নাহলে পিছিয়ে পরবে।সাফওয়ানেরও অফিসে কাজের চাপ প্রচুর।কর্মচারীর উপর ভার দিয়ে বেশিদিন থাকা যায়না।গোলমাল কিছুনা কিছু হবেই।তার উপর সানিয়ার কাজও এখন থেকে সাফওয়ানকে সামলাতে হবে।তাই আজ বিকেলেই ঢাকা চলে যাবে তারা।তবে রেখে যাবে টিউলিপ আর তার মাকে।নতুন জীবন শুরু হবে তাদের।তারাও বেশিদিন এখানে থাকবেনা চট্টগ্রাম চলে যাবে।

সাফওয়ান আর ইমরান চৌধুরী গাড়িতে বসে আছে প্রায় আধ-ঘন্টা।তারা দুজনেই এখন বিরক্ত।বউ শাশুড়ী দুজনেই বিদায় নিতে দেরি করছে।সাফওয়ান অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে আসল।বাসায় পা রাখতেই দেখল সৃজাকে জড়িয়ে ধরে নোভা আর নাতাশা কান্না করছে।অপরদিকে সাফিয়া চৌধুরী টিউলিপকে কোলে নিয়ে বসে আছে নানুর পাশে।সে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বলল
“মম এটা কি শুরু করলে, যেতে হবে তো।প্লিজ তাড়াতাড়ি করো।” সৃজার কাছে গিয়ে নোভা আর নাতাশাকে ধমক দিতে চেয়েও দিলনা।বিদায় বেলায় ধমক না দেয়াই শ্রেয়।সে সন্তর্পণে তাদের হাতগুলো সৃজার শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিল।সৃজার মন খারাপ হলেও সে ও যেন এটাই চাইছিল।সবার সাথেই মোটামোটি ভালো সম্পর্ক হয়েছিল এ-কদিনে।সবাইকে ছেড়ে যেতে তারও ভালো লাগছেনা।বিদায় বেলায় বড় মামী আসলেন না।তার রাগটা প্রগাঢ়।জানিনা সব ঠিক হবে কিনা।তবু আশা করতে তো দোষ নেই।

সানিয়া এসে একবার জড়িয়ে ধরল সৃজাকে।শেষবারের মতো আদর করে দিল আদরের ভাইয়ের বউটিকে।

সানিয়ার মধ্যেও এখন একটা বউ বউ ভাব এসে গেছে।টিউলিপের যত্ন এখন সে আর তানভীর মিলে করে।তানভীরের কড়া নির্দেশ তার মেয়েকে সার্ভেন্টের কাছে দেয়া যাবেনা।সানিয়াকে জড়িয়ে ধরে সৃজা কেঁদেই দিল

“এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেনো।চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে আমরা অবশ্যই ঢাকায় যাবো।আর সাফওয়ান যদি তোমার সাথে ঝগড়া করে শুধু আমাকে একবার বলবে।”

সাফওয়ান মনে মনে বলল কাছে ঘেষতে দিলে তো ঝগড়া করবো।কিন্তু বাইরে বলল
“আমি কদিন পর তোদের নিতে আসবো বুবু।টিউলিপের খেয়াল রেখো।সৃজা এবার চল।” একহাতে সৃজাকে ধরে মায়ের সামনে এগিয়ে গেল।হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল
“চলো মম।” সাফিয়া চৌধুরী টিউলিপকে শেষবারের মতো আদর করে তানভীরের কোলে দিল।তার কলিজার টুকরা আজ থেকে আর নানু বলে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করবেনা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।তবুও নিজেকে শক্ত করে বলল
“নানু আবার আসবো,আমার নানুটা দুষ্টমি করবেনা ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে, কেমন?”
টিউলিপ মাথা নাড়ালো। ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে তানভীরকে জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দিল।সৃজা আর সেখানে দাড়াতে পারলনা।টিউলিপের কপালে একটা গাঢ় চুম্বন একে দ্রূত পায়ে গাড়িতে গিয়ে বসল।তার চোখ ছলছল।যেকোনো মুহূর্তে অশ্রর কণা গড়িয়ে পরবে।শাড়ির আচল দিয়ে সন্তর্পণে তা মুছে নিল।শ্বশুরবাড়িতে আসার পর এই বাচ্চাটার সাথে তার আত্মার বন্ধন গড়ে উঠেছে।সৃজা এখনও মাতৃত্বের স্বাদ না পেলেও টিউলিপকে দিয়ে বুঝেছে মাতৃত্ব কাকে বলে।

সাফওয়ান এসে সৃজার পাশে বসল।সৃজা আর সাফওয়ান এক গাড়িতে অন্য গাড়িতে সৃজার শাশুড়ী আর শ্বশুর।সাফওয়ান একটু কাছ ঘেঁষে সৃজার হাতটা শক্ত করে ধরল।সৃজা চাইলেও তা ছাড়াতে পারবেনা।আজ সৃজার সে ইচ্ছেও নেই।উল্টো সাফওয়ানের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই পুরো জার্নি কমপ্লিট করল সৃজা।সাফওয়ান কথা বলতে চাইলেও পারলনা।তাই কাজেই মনোযোগ দিল।মাঝে মাঝে সৃজার দিকে তাকিয়ে কপালে কয়েকবার চুমুও খেল।তবে সৃজা তা টের পেল না।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই সৃজা স্টাডি রুমে চলে গেল।অগত্যা সাফওয়ানও অফিসের কাজে মনোযোগ দিল।প্রচুর কাজ জমে আছে।তার এখন মনে হচ্ছে কাজের চাপই তার প্রধান শত্রু।কোথায় রাতের বেলা বউকে কাছে টেনে আদর করবে তা না নিজে বসে আছে গাদা গাদা ফাইল নিয়ে আর সৃজা স্টাডি রুমে।

সৃজা কিছুতেই পড়ায় মন দিতে পারছেনা।এখন তার মন বিক্ষিপ্ত। নানা ধরনের চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে।তার মন বলছে সাফওয়ান যা করছে সৃজাকে ভালোবেসেই করছে আর সচেতন মস্তিষ্ক বলছে এসব তাকে কাছে রাখার জন্য করছে।তাছাড়া টিউলিপের জন্যও খারাপ লাগছে।বইগুলো নেড়েচেড়ে আগের জায়গায় রেখে দিল।তারপর ধীর পায়ে সাফওয়ানের রুমের দিকে পা বাড়াল।দরজার সামনে দাড়িয়ে রইল কতক্ষণ।সাফওয়ানের মনোযোগ তার কোলে রাখা ফাইলটায়।আরেক হাতে জলন্ত সিগারেট। সিগারেটটা দেখে নাক কুচকে ফেলল সৃজা।সরাসরি না বললেও নিজের কাজ দ্বারা কতবার বুঝিয়েছে সে সিগারেট পছন্দ করেনা।তারপরও সিগারেট ধরবেই ধরবে।

সৃজার সন্দিহান দৃষ্টির মাঝেই সাফওয়ান ফাইলে হাত রেখে বলল
“রুমে আসুন মিসেস।আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।”
সৃজা চোখগুলো ছোট করে ফেলল।বলল
“আমি কি আপনার ঘুম আটকে রেখেছি নাকি?ঘুমান আপনি আমি যাই।”বলেই পেছন ঘুরল।সাফওয়ান তড়িৎ গতিতে এসে সৃজার হাত ধরল।ফিসফিস করে বলল
” গতকালকের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিবেন।তারপর যেখানে ইচ্ছ সেখানে যেয়ো।নাও আই অনলি নিড ইউ।”
সৃজার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।সেতো এটাই চাইছিল সাফওয়ান তাকে আটকাক।তবে এখন শুনতে ইচ্ছে করছেনা কেন সাফওয়ানের কথা।

সৃজার মৌনতা লক্ষ করে সাফওয়ান কোলে তুলে নিল তাকে।তারপর দরজাটা লাগিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল।সৃজার দিকে তাকাতেই বুঝল ওর মন খারাপ।দুহাতের আজলায় সৃজার মুখটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“টিউলিপকে মিস করছো?”

“হুম,আচ্ছা ওকি আমাদের ভুলে যাবে?”

“উহু আমাকে ভুলে গেলেও ওর পুতুল মাম্মাকে ভুলবেনা।”

……………..

“আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় বলোতো?”

সৃজা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সাফওয়ানের দিকে।সাফওয়ান কিছুটা থেমে বলল

“আমরাও টিউলিপের মতো কাউকে আনার প্ল্যান করি চল।” সৃজা কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝল সে কি বলতে চায়।

“বেশি কথা বলছেন কেন?এই আপনার না ঘুম পেয়েছে ঘুমান।নাহলে আমি চলে যাই।” সাফওয়ান বুঝতে পারল সৃজা কথা ঘুরাচ্ছে।

ঘুমানোর জন্য সৃজার বুকে মাথা রাখতেই বলল
“আপনি সেভ করেন না কেন?দাড়ির খোচা লাগে।ব্যথা পাই তো।”
সাফওয়ান চকিত সৃজার দিকে তাকাল।সৃজা চিন্তিত মুখে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।সৃজাকে বলল
“তুমি বসো,আমি পাঁচ মিনিটেই এসে পরবো।”
সৃজা বসেই রইল।সাফওয়ান প্রায় আধা ঘন্টা পর বেরোলো।এসে দেখল তাকে ঘুম পাড়ানোর মানুষ নিজেই বসে বসে ঘুমিয়ে পরেছে।কাছে এসে বালিসটা ঠিক করে সৃজাকে শুইয়ে দিল।সৃজার ওড়নাটা পাশে খুলে রাখল।

সকালে আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই সৃজা খেয়াল করল সে সাফওয়ানের রুমে আছে।আর সাফওয়ানের দুই পা এবং হাত সবই সৃজাকে আকড়ে ধরে আছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here