#সূর্যোদয়
#পর্ব_৪২
#কারিমা_দিলশাদ
১৩৫.
আজকে ঐশীর বিয়ে। সাধারণত এসময় সব মেয়েদের খারাপ লাগে। কিন্তু ঐশীর কিছুই অনুভব হচ্ছে না। কষ্ট তো একদমই অনুভব হচ্ছে না, তবে খুশিও অনুভব হচ্ছে না। প্রতিদিনের মতো আজকেও সে ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠেছে। ফোনের স্ক্রিন অন করে সময়টা দেখে নেয়। এখন ভোর ৫ টা ২২ বাজে। সে শোয়া থেকে উঠে বসে। বিছানার ডান পাশে তাকিয়ে দেখে আশা আর প্রীতি এখনও ঘুমে। ওদের দেখে ঐশী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ থেকে তার একা একা শোয়ার দিন শেষ। এখন থেকে তাকে অন্য একজনের সাথে বেড শেয়ার করতে হবে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ঐশীর। তবে এটা বেড শেয়ার করতে হবে এটা ভেবে না অন্য কোনো কারণে তা তার নিজেরও জানা নেই।
আশা আর প্রীতি ঐশীর বিয়ে উপলক্ষে কালকে এসেছে ওদের বাসায়। কবিতাও এসেছিল, কিন্তু সে থাকে নি চলে গেছে। আজকে আবার আসবে। ঐশী আর কিছু না ভেবে চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায়। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নামাজটা পড়ে নেয়। এরপর আস্তে আস্তে গিয়ে রুমের দরজাটা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে কেউ আছে নাকি। নাহ্ কেউ নেই। এখনও কেউ উঠে নি দেখে ঐশী একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তারপর গুটিগুটি পায়ে কিচেনে চলে যায় চা বানাতে। নিজের পছন্দসই চা বানিয়ে নিয়ে আবার রুমে ফিরে আসে। চুপিচুপি বারান্দার দরজাটা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সব কাজই সে বিনা শব্দে করছে যেন কারো ঘুম না ভাঙে। সে একটু একা থাকতে চায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিগত দিনগুলোর কথা চিন্তা করতে করতে চা টা শেষ করে। তারমাঝে খারাপ ভালো কোনো অনুভুতিই কাজ করছে না। জয়দের বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে সেদিন তার অনেক রাত হয়ে যায়৷ রাত ১১টায় সেদিন বাসায় আসে। জয়ই তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছে। লাইফে কোনদিন সে সন্ধ্যার পর বাসায় আসে নি। কেবল যেইদিন এতিমখানায় গিয়েছিল সেদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছিল। তাই সেদিন কত্তো বকা শুনতে হয়েছে আর সে সেদিন অতো রাতে ফিরেছে তাতে তাকে কি করা হবে সে তা ধারণা করেই এসেছিল। আর হলোও তাই। বাসায় এসে কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। তার মা বাবা তার জন্য জেগেই ছিল। সে রুমে ঢুকার সাথে সাথে তার বাবা এসে তার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ঐশী চুপ করেই থাকে। সে জানে বিষয়টা মোটেও ভালো হয় নি। কিন্তু সেই বা কি করতো? সে তো আর জোর করে চলে আসতে পারে না। আর তার ইচ্ছেও হয় নি। ইলোরা ইয়াসমিন প্রথমেই বলে দিয়েছিল তার বাবা মা’কে সেদিন লেইট হবে, তবুও আবার সন্ধ্যার দিকে ফোন দিয়ে পারমিশন নিয়েছেন। তার বাবাও তখন মুখে মধু নিয়ে হ্যা হ্যা করে গেছে। এখন এমন ব্যবহার করার কোনো মানেই হয় না। এমন হলে আগেই না করতো। তবুও সে চুপ করেই ছিল। আসলে তখন আর সে কোনো ঝামেলা করতে চায় নি। কিন্তু সে না চাইলে কি হবে। তার বাবাও সেদিন তাকে বাজারি মেয়ে, নষ্টা মাগি আরও অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে। তখন আর ঐশী চুপ থাকে নি। সেও কথার পিঠে কথার জবাব দিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিল।
যেদিন ঐশী সাদামাটাভাবে বিয়ের ইচ্ছেটা জানায়, এর পরেরদিন থেকে জয় সবাইকে বোঝানোর মিশনে নেমে পড়ে। বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সবাইকে রাজি করাতে। কেউ তো মানতেই চাইছিল না কিন্তু জয় আর ঐশীর যৌক্তিক কথার কাছে সবাই হার মেনে নেয়। এক মাস পরের বিয়েটা এগিয়ে পনেরদিন পরে হওয়ার কথা ছিল আর সেটা এখন সাতদিনের মাথায় হয়ে যাচ্ছে।
“ কি রে কহন উঠছস?” – হঠাৎ আওয়াজে চমকে পিছনে তাকায় ঐশী। আশা দাঁড়িয়ে আছে। ঐশী আশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“ অনেকক্ষণ হলো। ঘুম হইছে রাতে?”
“ হুমম। তোর ঘুম হয় নাই রাতরে তাই না?”
“ নাহ্। খুব ঘুম হইছে। তোদের আগেই তো শুয়ে পড়ছিলাম। তোরা কহন আসছস তাও বলতে পারমু না।”
“ হুমম। আইসা দেখি কানের নিচে ফোন রাইখা ঘুম। ভাইয়া ফোন দিছিল?” – ঐশী কেবল হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়।
এই কয়দিনের ব্যস্ততায় দুজনের মাঝে কথায় হয় নি। সবাই অনেক ব্যস্ত ছিল। জয় তো দম ফেলারও সময়টা পায় নি। হাসপাতালের ডিউটি, ছুটি ম্যানেজ করা, বিয়ের কেনাকাটা করা। আবার বাসাটাও রি-ডেকোর করা, সব একসাথে। ঐশী বলেছিল আস্তে ধীরে সব করতে, কিন্তু জয় সেই কথা কানে নেয় নি। জয় কালকে রাতে কল করেছিল, কিন্তু ঐশীর তখন এত্তো বেশি ঘুম পেয়েছিল যে ঘুমের ঘোরে জয়কে কি বলেছে কিচ্ছু মনে নেই।
ঐশী একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। আর আশা ঐশীকে দেখছে। আশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে ঐশী ইশারা করে জানতে চায় কি হয়েছে। আশা হালকা হেসে বলে,
“ মানুষে কয় না বিয়ার বাতাস লাগলে মেয়ে মানুষের রুপ খুলে। তোরে দেইখা তার প্রমাণ পাইলাম দোস্ত। তুই জানস তোরে এহন কত্তটা সুন্দর লাগতাছে? হায় মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ।” – আশার কথায় ঐশী হেসে দেয়। হঠাৎ করে আশা ঐশীকে জড়িয়ে ধরে।
ঐশী প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে নিজেও আশাকে জড়িয়ে ধরে। ঐশী প্রশ্ন করে,
“ কি হইলো?”
“ জানি না। কেমন জানি লাগতাছে দোস্ত। কয়েকদিন আগেই না আমরা একসাথে কলেজে ভর্তি হইলাম। তোরে তো চিনতামও না তহন। কি পাগলা ছিলি তুই। এই তিরিবিরিং করতি, আবার এই গম্ভীর হইয়া থাকতি। গম্ভীর হইয়াই এমন এমন সব কথা কইতি হাসতে হাসতে পেটে খিল ধইরা যাইতো। কেমনে কেমনে জানি তোর সাথে ফ্রেন্ডশিপও হইলো। কতো দুষ্টামি করতি। সেই তুই’ই এহন এতোবড়ো একটা ডান্স ক্লাস চালাস, এত টাকা ইনকাম করস। আইজ তোর বিয়াও হইয়া যাইতাছে দোস্ত। আমার বিশ্বাসই হইতাছে না। এতো বড় কেমনে হইলি দোস্ত? ” – কান্নামিশ্রিত গলায় বলে আশা।
ঐশীর গলায়ও কি যেন আঁটকে আছে। চোখটাও জ্বালা করছে। সে চুপচাপ আশাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর আশা ঐশীকে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের জল ফেলছে। এরমধ্যেই প্রীতির ডাকশুনে দুজন দুজনকে ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে নেয়। প্রীতি এসে আশাকে চোখ মুছতে দেখে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। ঐশী হেসে বলে,
“ আরে কিছু না৷ ব্যক্তি একটু ইমোশনাল হইয়া গেছে আরকি।”
প্রীতি বলে,
“ হ দোস্ত। আমরার ভিতরে সবার আগে তোরই বিয়া হইয়া যাইতাছে। আমারও কেমন জানি লাগতাছে। ”
“ আরে ভাই চিল। একদিন না একদিন তো বিয়া সবাই করবি। এইটা নিয়ে আনন্দিত হওয়ারও কিছু নাই মন খারাপেরও কিছু নাই। আচ্ছা শোন তোরা একটু বাইরে যা। আমার মাথা ব্যাথা করতাছে। একটু রেস্ট নিমু। কেউ যাতে আমারে ডিস্টার্ব না করে দেহিস।”
দুজনে আর কিছু না বলে ঐশীকে একা থাকতে দিয়ে চলে যায়। ওরা চলে গেলে ঐশী এসে রুমের দরজাটা লাগিয়ে দেয়। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সাদা কুর্তি আর প্লাজো পড়া ঐশী। খোলা চুলগুলো এক সাইডে এনে রাখা। নিজেকে নিজের কাছেই সুন্দর লাগছে। সত্যিই ঐশীকে সুন্দর লাগছে নাকি এটা আশার কথার প্রভাব। কালকে গোসলের আগে সবাই মিলে জোর করে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিল। মুখে এখনও হলুদ হলুদ ভাব আছে। ঐশী হাতদুটো সামনে তুলে দেখে। মেহেদী গাঢ় রং ধারণ করেছে।
রাতে প্রীতি ওর দুইহাতে মেহেদী দিয়ে দিয়েছিল। ঐশী কখনো মেহেদী দেয় না। লাস্ট কবে দিয়েছিল মনে নেই। কালকে প্রীতি কিসের জানি অর্গানিক মেহেদী দিয়ে দিল। দুইহাতের তালু আর উপরিভাগে গোল করে দিয়েছে আর আঙুলের এক গিট পর্যন্ত মেহেদী লেপে দিয়েছে। কোনো ডিজাইন করে দেওয়া না। ঐশী মেহেদী দেওয়ার জন্য এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না। একটা না একটা সমস্যা হবেই হবে। ঘুমিয়ে পড়েছিল দেখে সারারাত হাতে ছিল। নাহলে একঘন্টা রাখারও ধৈর্য্য হতো না তার। সকালে উঠে যতটুকু রং দেখেছিল এখন তার থেকেও গাঢ় কালার হয়েছে। আস্তে আস্তে আরও হবে। ঐশী মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আশার কথাগুলো মনে পড়ে চোখে পানি নিয়ে হেসে দেয়। আর বলে উঠে,
“ মানুষ পরিবর্তনশীল দোস্ত। মানুষের জীবন কখনো স্থির থাকে না। সব আস্তে আস্তে বদলে যায়, যাবেও।”
১৩৬.
ঐশী গোসল সেরে এসে চুল শুকাচ্ছে। জোহরের নামাজের পর বিয়ে পড়ানো হবে। অলরেডি সাড়ে ১১টা বেজে গেছে। ঐশী বিয়ের শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখছে। টকটকে সিঁদুররাঙা জামদানী শাড়ি। জয় ঢাকা থেকে পছন্দ করে কিনেছে। ঐশীর শাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছে। জয়ের পছন্দ বেশ দারুণ, তবে সবই দামী দামী হয়। এই শাড়িটার প্রাইসও তুলনামূলক বেশিই হবে হয়তো। ঐশী বসে বসে সব শাড়ি গয়নাগুলো দেখছিল।
এরমধ্যেই ঐশীর মা খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে আসে। পিছে পিছে বড় খালাও আসে। ঐশীর মা এসে ঐশীর পাশে বসে। ঐশী বলে,
“ দাঁড়াও হাত ধুয়ে আসি।”
তিনি ঐশীর হাত ধরে বলে,
“ হাত ধোয়া লাগবে না। আয় আমি খাওয়ায় দিতেছি।” – ঐশী উনার কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসে। বিষয়টা কেমন হাস্যকর হয়ে গেল না? এতদিন যে খেলো কি না খেলো, বেঁচে আছে না মরে গেছে তার কোনো খবর নেয় নি। সারাজীবন যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান, অবহেলা করে গেছে তাকে আজ এইটুকু আদর করলেই কি সবকিছু মিটে যাবে? ঐশী ভাবলো একবার কথাগুলো ওনাকে বলুক। পরে আবার ভাবে না থাক। সে যাই বলুক এই মহিলা সেই কথাগুলো এমনভাবে ঘুরিয়ে দিবে যেন মনে হবে সব দোষ তারই। ইনাকে ঐশীর থেকে ভালো আর কেউ চেনে না। এখন এসব করার মুড নেই তার। সে বলে,
“ না আমি নিজের হাতেই খাবো।”
এরমধ্যেই তার বড় খালা বলে,
“ পরের বাড়িত যাবি গা তাও মায়ের সাথে এমন করতেছস?”
এবার আর ঐশী না বলে পারে না।
“ এতদিন যখন কারো কোনো দরদ ছিল না এখনও করার দরকার নাই। কি হবে এইটুকু করে? আমি আমার নিজের হাতেই খাবো। হইলে দেও না হয় যাও এখন। আমি রেডি হবো। ওরা এসে পড়বে।”
কেউ আর কিছু বলে না। ও হাত ধুয়ে এসে প্লেট নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। ওখানেই বসে বসে খাওয়া শেষ করে।
১৩৭.
বরযাত্রী এসে পড়েছে। বরযাত্রী বলতে জয়ের দুই মামা, স্মৃতি, সিয়াম, ফয়সাল, রুপা আর ওর হাজব্যান্ড। ছেলেরা এসেই সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে নামাজ পড়তে মসজিদে চলে যায়। স্মৃতি আর রুপা এসেই ঐশীর সাথে দেখা করতে এসেছে।
ঐশীর সাজ তখন প্রায় কমপ্লিট। একদম হালকা একটু মেক-আপ, চোখে সুন্দর করে আইলাইনার আর কাজল আঁকা, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। ব্যাস এতটুকুই। একদম ন্যাচারাল সাজ মনে হচ্ছে। সিঁদুর লালরঙা সিম্পল তবে অসম্ভব সুন্দর একটা শাড়ি, হালকা স্বর্ণের গহনায় ঐশীকে অপ্সরীর মতো লাগছে।
স্মৃতি এসে মুগ্ধ হয়ে বলে,
“ ওয়াও ভাবি!! কি সুন্দর লাগছে তোমাকে!”
“ মাশাল্লাহ বল স্মৃতি মাশাল্লাহ বল। আমার বন্ধু তো এমনেই পাগল তোমার জন্য, আজকে তো ওকে একদম শেষ করে দিবে দেখছি।” – রুপা বলে উঠে। রুপার কথায় বাকিরা হেসে উঠে। ঐশী একটু লজ্জা পায় ওদের এমন কথায়। রুপা এগিয়ে এসে মাথায় উড়না পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“ পার্লারে না গিয়েই ভালো করছো। পার্লারের সাজের থেকে এই সাজেই তোমাকে বেশি ভালো লাগছে। তোমার আসল সৌন্দর্যটা ফুটে উঠেছে। মাশাল্লাহ কারো নজর না লাগুক। খুব সুখী হও বোন, খুব সুখী হও।”
১৩৮.
সবাই নামাজ পড়ে চলে এসেছে। উকিল এবং কাজিও চলে এসেছে। জয় সোফায় বসে আছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী আর মাথায় টুপি পড়া। তাকে দেখতে ভীষণ স্নিগ্ধ, শুদ্ধ লাগছে। সাদা রং মানেই যেন স্নিগ্ধতা।
জয়ের হাসফাস লাগছে। গত তিনদিন ধরে সে ঐশীকে দেখে না। এই কয়দিন কথাও হয় নি ভালো করে। তার থেকেও বড় কথা তার এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না ঐশী তার হতে চলেছে। আজকে তাদের বিয়ে। সত্যি সত্যি তার প্রেয়সীকে সে নিজের করে পাবে? আজকেই সেই দিন? এটা সত্যি তো? মাথা ঘুরছে তার। সে পাশে বসা ফয়সালের দিকে হেলে আস্তে আস্তে বলে,
“ দোস্ত আমার মাথা ঘুরতেছে, গরম লাগতেছে। সব সত্যি তো? ওকে নিয়ে আসছে না কেন?”
“ আরে বেটা চুপ থাক। কোনো গড়বড় করিস না। পাগলা হয়ে যাইতেছস। তোর আজকে বিয়া জামাই জামাই ভাব নিয়া থাক। তোর রুমাল কই? মুখে রুমাল দিয়া থাক। বাইর কর।”
জয় বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে নেয়। এরমধ্যেই কাজির
কাবিননামা লেখা হয়ে গেছে। আগে ধর্মীয়মতে বিয়ে হবে। জয়কে কবুল বলতে বললে, জয় সময় নষ্ট না করেই কবুল বলে দেয়। এরপর কাজি যায় পাত্রীর কাছে। ঐশীকে কবুল বলতে বললে ঐশী চুপ করে থাকে। হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিক গতিতে ধুকপুক করছে। এতক্ষণ তার কিছুই অনুভব হয় নি। কিন্তু এখন তারমনে এতদিনের সব ভয়, দ্বিধা একসাথে জেঁকে বসেছে। সবঠিক থাকবে তো? নাকি তারও বাকিদের মতো পরিণতি হবে? সে ঠকে যাবে না তো?
ওদিক থেকে বারবার সবাই ঐশীকে কবুল বলতে বলছে। পাত্রী কবুল বলছে না কথাটা ড্রয়িংরুমে বসা জয়ের কানে পৌঁছাতেও সময় লাগে না। যা শুনে জয়ের বুকটা কেউ যেন খামচে ধরে। ঐশী কবুল কেন বলছে না? বিয়েটা কি হবে না? সে তার ভালোবাসাকে কি পেয়েও পাবে না? জয় ভয়ে পাশে বসা সিয়ামের হাত ধরে ফেলে। সিয়ামও বন্ধুর হাতে হাত রেখে ভরসা দেয়।
জয়ের ভয় অস্থিরতা দূর হয় যখন ঐশীর রুম থেকে সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ আওয়াজ ভেসে আসে। জয়ের ভিতর থেকে যেন গরম হাওয়া বেরিয়ে যায়। বেশ সময় নিয়ে ঐশী কবুল বলেছে। তার এখন কেমন যেন খালি খালি লাগছে। সবাই চলে গেলে আশা তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সে যেন ঐশীকে ভরসা দিতে চায়। একটুপর ঐশীকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন রেজিষ্ট্রেশন হবে।
ঐশীকে নিয়ে জয়ের পাশে বসানো হয়। জয় এতক্ষণ যাকে দেখার জন্য ছটফট করছিল। অথচ সে আসতেই জয় মাথা নিচু করে নেয়। জয়কে সাইন করতে দিলে জয় ফটাফট সাইন করে দেয়। ঐশীকে যখন দেওয়া হয় তখন ঐশী আবারও ফ্রিজ হয়ে যায়। ঐশীর দ্বিধা বুঝে জয় এবার ঐশীর হাতে হাত রাখে। ঐশী সেই হাতের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সাইন করে দেয়।
সবশেষে যখন দোয়া পড়ানো হয়। মোনাজাতে বর-কনে দুজনের চোখ থেকে দুফোঁটা করে পানি গড়িয়ে পড়ে। একজনের চোখে প্রাপ্তির জল, আরেকজনের চোখে কি? হয়তো দ্বিধা, হয়তো নতুন জীবনের জন্য ভয়।
১৩৯.
বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই খাওয়া দাওয়ার পর্বও শেষ করে। সব খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনা হয়েছে। এবার বিদায়ের পালা।
বিদায় বেলায় সবাই কাঁদলেও ঐশী একফোঁটাও কাঁদে নি। ঐশীর মা হাউমাউ করে কাঁদছে, ঐশীর বাবাও কাঁদছে। ঐশীর কাছে এই কান্না ভীষণ বিরক্ত লাগছে। ঐশী সবার কাছ থেকে স্বাভাবিকভাবে বিদায় নেয়। কথাটা যদিও অস্বাভাবিক হবে, কারণ পৃথিবীতে এমন মেয়ে পাওয়া দুষ্কর যেই মেয়ে বিদায়ের সময় না কাঁদে। ঐশী পরিবার ও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। ঐশীর পর জয়ও গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।
গাড়িতে কেবল ফয়সাল, স্মৃতি, জয় আর ঐশী। ফয়সাল গাড়ি স্টার্ট করে ঐশীদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে আসতেই ঐশী একটা শ্বাস ছেড়ে পিছনে গা এলিয়ে দেয়। জয় ঐশীর হাতে হাত রেখে বলে,
“ ঐশী তুমি ঠিক আছো?” – ঐশী চোখ না খুলেই মাথা নেড়ে হ্যা বলে। তার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।
জয় ঐশীর হাতটা ধরেই থাকে। জয়ের মাঝে এখন কি হচ্ছে তা সে কাউকে কি করে বুঝাবে? এই মেয়েটা এখন তার বউ। তার প্রেয়সী এখন তার বউ। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। জয়ের মুখে হাসি লেগেই আছে। সে ঐশীর হাতটা এখনও ধরে আছে। এখন তো আর হাত ধরতে বাঁধা নেই। এখন সে যখন ইচ্ছা তখন এই হাতটা ধরতে পারে। খালি হাত কেন চুমুও খেতে পারে। এখন যদিও তার চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। কয়েকটা চুমু খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তার বউটা তো এখন চোখ বন্ধ করে আছে। চুমু খেলে নিশ্চয়ই এখন বিরক্ত হবে। আর যা রাগী বউ তার, চিল্লাচিল্লিও করতে পারে। গাড়িতে ছোট বোনও আছে। এসময় এটা করা ঠিক হবে না। নতুন নতুন তো আপাতত এখন একটু ছাড় দেওয়া যায়। কিন্তু পরে কোনো ছাড়াছাড়ি নেই হু।
জয়’রা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখতে পায় ইলোরা ইয়াসমিন তাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ঐশীর চোখটা লেগে এসেছিল। জয়ের ডাকে সে চমকে উঠে। দেখে জয় গাড়ি থেকে নেমে তারদিকের ডোর খুলে ওকে ডাকছে। জয় বলে,
“ সরি। আসলে বাসায় এসে পড়েছি তো। বাসায় চলো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
ঐশী মাথা নেড়ে নেমে পড়ে। ঐশী নামতেই ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর ঐশী কপালে চুমু এঁকে তাকে ঘরে নিয়ে যায়। নিতুকে বলে ঐশীকে স্মৃতির রুমে নিয়ে যেতে।
নিতু ঐশীকে স্মৃতির রুমে নিয়ে যায়। ঐশী নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ আপু আপনি যাননি ওই বাসায়?”
“ না রে বোন। আমি এখানে মাত্রই এলাম। ছুটি পায় নি আমি।”
ওদের কথাবার্তার মাঝেই ইলোরা ইয়াসমিন ঐশী জন্য শরবত নিয়ে আসে।
“ এটা খেয়ে নাও ভালো লাগবে। তারপর ফ্রেশ হয়ে কমফোর্টেবল কিছু পড়ে নাও। কেমন?”
ঐশী মাথা নেড়ে শরবতটা খেয়ে নেয়। ইলোরা ইয়াসমিন গ্লাস নিয়ে চলে যায়। এরমধ্যেই স্মৃতি ঐশীর স্যুটকেসটাও দিয়ে যায়। এরপর ফ্রেশ হতে বলে দুজনেই বেড়িয়ে যায়। ঐশী উঠে মাথা থেকে উড়নাটা খুলে রাখে। এরপর গায়ের গয়নাগুলোও খুলে রাখে। স্যুটকেস থেকে একটা সুতির শাড়ি নিয়ে গোসল করতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করে বেরিয়ে আসে ঐশী। বের হতেই দেখতে পায় ইলোরা ইয়াসমিন তারজন্য খাবার নিয়ে বসে আছে। ঐশী বলে,
“ সরি আন্টি। আসলে মাথা ব্যাথা করছিল তো। তাই একটু সময় নিয়ে গোসল করেছি।”
তিনি কিছু না বলে ঐশীকে তার পাশে বসতে ইশারা করে। ঐশী বসতে বসতেই খাবারগুলো দেখে নেয়। ভাত, পোলাও, সবজি, চিকেন রোস্ট, গরুর মাংস আবার অল্প করে কয়েক রকমের ভর্তা, শাকের তরকারি। তিনি ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“ কি খাবে? রিচফুড নাকি বাঙালি খাবার?”
ঐশী মৃদু হেসে বলে,
“ একটা হলেই হলো।”
তিনি গম্ভীর মুখে জবাব দেন,
“ হুম হলেই হলো। শরীর স্বাস্থ্য দেখে তো মনে হয় একদম খাও না। এখন থেকে বেশি করে খেতে হবে। আমি কিন্তু খুব রাগী। সারাদিনের ক্লান্তিতে একটু ঝালভর্তার খাবারগুলোই বেশি ভালো লাগে। তাও দুইরকমের খাবারই নিয়ে এসেছি। আমি শুনলাম তুমি রিচফুড খেতে খুব পছন্দ করো।” – বলতে বলতে ভাত নিয়ে ভর্তা দিয়ে মেখে ঐশীর মুখের সামনে খাবার ধরে। ঐশীও বিনাবাক্য তা খেয়ে নেয়। ঐশী সাধারণত কারো হাতে খায় না, কেমন জানি লাগে তার। হাত ধুয়েছে কিনা তা নিয়ে মন খচখচ করে। মায়ের হাতে খাবার ইচ্ছে থাকলেও তার মা তাকে কখনো খাইয়ে দেয় নি। আজ যদিও দিয়েছিল কিন্তু ঐশীর মন টানে নি।
কিন্তু এখন ইলোরা ইয়াসমিনের হাতে খাওয়ার সময় তার অন্য কোনো চিন্তা মাথায় আসছে না। বরং তার খুব ভালো লাগছে। এই যে শাসনের সুরে কথাগুলো বলছে এটাও তার ভালো লাগছে। ইলোরা ইয়াসমিন তাকে খায়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“ শোনো বৌমা। এই সংসার যতটা আমার, ততটা তোমারও। এটাকে যত তাড়াতাড়ি নিজের বলে মেনে নিতে পারবে তত তারাতাড়ি স্বস্তি পাবে। এটা তোমার নিজের বাড়ি। তুমি এখানে যেভাবে চাও সেভাবেই চলতে পারবে, যেভাবে তোমার স্বস্তি হয় সেভাবেই চলবে। গোসল করতে দেরি হয়েছে বলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় নি। এই সময়টা আমিও পার করেছি। এই সময় কেমন লাগে তা আমি জানি। যতই আয়োজন না করে বিয়ে হোক এই সময় একটা মেয়ের উপর দিয়ে কি যায় তা আমার ভালো করে জানা আছে। আমাকে পর ভাববে না, আপন ভাববে তাহলেই আমার সামনে সংকোচ হবে না।
জানি আমাদের সবাইকে আপন করে নিতে তোমার একটু সময় লাগবে। কিন্তু জেনে রাখো আমরা তোমাকে আপন করে নিয়েছি। বলতে পারো নিজেদের স্বার্থেই। মানুষ বড়ই স্বার্থপর। তোমাকেও আমি আমার স্বার্থেই আপন করে নিয়েছি। তোমাকে একবার দেখেই আমার মনে হয়েছে আমার ছেলের জন্য তোমাকে চাই। আবার আমার ছেলে যখন তোমাকে ভালোবেসে ফেললো তখনও আমার ছেলের ভালো থাকার জন্য, ছেলের ভালোর জন্য তোমাকে চাই। আমার ছেলের ভালো থাকার স্বার্থে আমি বা আমরা তোমাকে আপন করে নিয়েছি। এরমানে এই না কেবল ছেলেই সব। তুমি আমার ছেলের ভালো থাকা। তুমি ভালো থাকলে আমার ছেলেও ভালো থাকবে। তাহলে বুঝো তোমার স্থান কোথায়? আমাদের শাশুড়ী বৌমার সম্পর্কটা কেমন হবে তা আমাদের উপর ডিপেন্ড করে। বুঝলে? আমরা অশান্তি করলে আমার ছেলে আর তোমার স্বামী নিজেও অশান্তিতে ভুগবে।
আর শোনো আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে মা বলে ডাকে। বাকিটা তুমি বুঝে নাও।”
ঐশীর চোখে পানি টলমল করছে। ইলোরা ইয়াসমিনের কথায় মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতেই টপ করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তিনি কথায় কথায় ঐশীকে সবকিছু দিয়ে অল্প অল্প করে খাইয়ে দিয়েছে। এবার হাতটা ধুয়ে আচঁল দিয়ে ঐশীর চোখ মুখ মুছে দেয়। এরপর বলে,
“ এখানেই আপাতত রেস্ট নাও। আমি স্মৃতিকে বলছি। ও তোমাকে তোমার রুমে দিয়ে আসবে।” – বলে তিনি চলে যান। ঐশী চুপচাপ ওভাবেই বসে থাকে। একসময় শুয়ে পড়ে।
কারো ডাকে চোখ খুলে দেখে স্মৃতি ডাকছে। ঐশী উঠে বসতেই স্মৃতি বলে,
“ সরি ভাবি। ডিস্টার্ব করলাম। চলো তোমাকে রুমে দিয়ে আসি।”
“ হুমম চলো।” – ঐশী আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে।
১৪০.
রুমটায় বেশ পরিবর্তন করা হয়েছে। আগের বেডটা ছোট ছিল, দুজন থাকা যেত না এখন ডাবল বেড আনা হয়েছে। ঐশীর পছন্দে। আরও বেশকিছু জিনিস নতুন কেনা হয়েছে। সবই ঐশীর পছন্দেই কেনা হয়েছে। বলতে গেলে এখন রুমের সবকিছুই ঐশীর পছন্দের। তবে সেট করাটা ঠিকঠাক মতো হয় নি। রুমটায় নতুন রং-ও করা হয়েছে। এতকিছু এই কয়দিনে এত তারাতাড়ি এরা করলো কি করে?!
বাসর রাতের জন্য সচরাচর যেভাবে রুম সাজানো হয় তেমন হাবিজাবি করে সাজানো না। কেবল বেডের উপর এক গাদা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ আঁকা। ঐশী একটা ছোট সিটিং সাইড এ্যারেঞ্জ করতে বলেছিল। সেই অনুযায়ী ছোট্ট একটা টেবিল আর দুটো বেতের সোফা কেনা হয়েছে। সেই টেবিলেই কিছু মোমবাতি আর ফুল দিয়ে সাজানো। এই জিনিসটা তার ভালো লাগলো। এছাড়া রুমে আর কোনো সাজসজ্জা নেই। সিম্পল বাট সুন্দর করে সাজানো।
তার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। ঘুমোতে পারলে ভালো হতো, মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। তার উপর আবার দু দুবার ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় আরও ব্যাথা করছে। কিন্তু শুতে পারছে না। ঐশী গিয়ে সোফাটায় বসে। নামাজ পড়া বাকি। জয় এখনও আসে নি। চাইলেই তো আর সবসময় নিজের মনমর্জি করা যায় না। বেচারারও তো কিছু শখ আহ্লাদ থাকতে পারে এই রাত নিয়ে। বসে বসে নিজেই নিজের কপালটা টিপছে।
কিছুক্ষণ বসে থাকতে থাকতেই বাইরে থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পাওয়া যায়। কান খাঁড়া করে বুঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। সে কি হয়েছে দেখতে যাবে তার আগেই কেউ রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। সেই কেউটা জয়। ঐশী জয়ের এমন কান্ডে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওপাশ থেকে অনবরত দরজায় ধাক্কাধাক্কি করা হচ্ছে।
জয় ঐশীর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“ দরজা আটকে ২০ হাজার টাকা চাচ্ছিলো। খামখেয়ালি আলাপ নাকি! ফাঁকি দিয়ে এসে পড়েছি।”
জয়ের কথায় ঐশী হেসে উঠে। জয় ঐশীর পাশের সোফায় বসে কিছুক্ষণ ঐশীকে দেখে বলে,
“ তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। দাঁড়াও আমি ফ্রেশ হয়ে অযুটা করে আসছি। নামাজ পড়ে রেস্ট নাও তুমি। খেয়েছো?”
“ হ্যা। মা খাইয়ে দিয়েছে।”
জয় হেসে ওয়াল কেবিনেট আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। জয় ফ্রেশ হয়ে আসতেই ঐশী ঢুকে অযু করার জন্য। ঐশী অযু করে আসতেই দেখে জয় ইতিমধ্যে বেডটা পরিষ্কার করে ফেলেছে। ফ্লোরে দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি গায়ে মাথায় টুপি পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটাকে দেখে ঐশী মনে মনেই মাশাল্লাহ বলে উঠে। বিষয়টা ঐশীর কাছে দারুণ ভালো লাগে। স্বামী স্ত্রীর সাথে নামাজ আদায় করার জন্য অপেক্ষা করছে বিষয়টা ভেবেই কেমন জানি শান্তি শান্তি লাগছে।
“ কই এসো..”
জয়ের ডাকে ঐশী হিজাবটা ঠিক করে জয়ের পিছনে জায়নামাজে গিয়ে দাঁড়ায়। দুজনে নফল নামাজগুলোসহ বাকি নামাজগুলোও আদায় করে নেয়।
১৪১.
নামাজ আদায় শেষে ঐশী গিয়ে বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। জয় জায়নামাজ ঠিক করে রেখে সেও ঐশীর সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। ঐশী জয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়, ঐশীর সাথে সেও তাল মেলায়।
জয় ঐশীর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে। হালকা আকাশি রঙের সুতির শাড়িতে মেয়েটাকে আস্ত একটা আকাশ মনে হচ্ছে। মুখে কোনো কৃত্রিমতা নেই। কিন্তু মুখে ক্লান্তির ছাপ। হাত, কান, গলায় কোনো অলংকার নেই। সে হঠাৎ ঐশীকে বলে উঠে,
“ আমি তোমাকে একটু ছুয়ে দেখি?” – জয়ের কথায় ঐশী হেসে উঠে।
“ কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?” – জয় বাচ্চাদের মতো মাথা নেড়ে না বোঝায়। ঐশী এবার জয়ের সামনে তার ডান হাত তুলে ধরে। জয় হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে, জয়ের কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। ঐশী জয়ের দ্বিধা দেখে মুচকি হেসে জয়ের নাক টেনে দেয়।
“ কি এবার বিশ্বাস হয়েছে?”
জয় কিছু না বলে, মাথা নিচু করে শুধু হাসে। ঐশী জয়কে চুপ করে থাকতে দেখে বলে,
“ ডাক্তার সাহেব যদি কিছু মনে না করেন আমি শুয়ে পড়ি? আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।”
“ হ্যা হ্যা অবশ্যই। দেখেছো কত্তটা কেয়ারলেস আমি! মনেই নেই আমার। তুমি শুয়ে পড়ো, আমি তোমার মাথা টিপে দিচ্ছি।”
“ না না ওসব করার দরকার নেই। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে। আমার মাঝে মাঝেই মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠে। কোনো ব্যাপার না। আপনি দয়া করে লাইটটা অফ করে দিন। ঘর একদম অন্ধকার না হলে আমি ঘুমাতে পারি না। আপনি কি এখনই ঘুমাবেন?”
“ হ্যা ঘুমাবো। তার আগে আসো আমি তোমার মাথায় একটু তেল দিয়ে দেই। তাহলে আরাম পাবে।”
“ আপনি!! আপনি তেল দিয়ে দিবেন! পারেন?” – ঐশী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। জয় কিছু না বলে হেসে বের হয়ে যায় রুম থেকে। একটুপরই আবার ফিরে আসে। ঐশীকে নিচে বসতে বলে জয় বিছানায় বসে। নবরত্ন তেল কিছুটা মাথার মাঝখানে ঢেলে দেয়। তারপর সেটা ঘষে ঘষে সারাটা মাথায় মাসাজ করে দেয়। বেশ আরাম লাগছে ঐশীর। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার।
“ বাহ আপনি তো দারুণ মাসাজ করতে পারেন।”
“ মা আর স্মৃতিকে করে দিতে দিতে শিখে গেছি।” – জয় হেসে উত্তর দেয়। ঐশী নিঃশব্দে হাসে। মাথায় তেল দেওয়া শেষে জয় ঐশীর চুলটাও আঁচড়িয়ে দেয়। ঐশীর চুলগুলো খুব একটা বড় না। পাতলা তবে খুব সিল্কি। ধরতে খুব ভালো লাগে।
ঐশী শুয়ে পড়েছে। ঐশীর শত মানা করা সত্যেও জয় ঐশীর মাথা টিপে দিয়েছে। এতো আরামে ঐশী সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু জয়ের চোখে ঘুম নেই। অন্ধকারের জন্য ঐশীকেও দেখতে পারছে না। কিন্তু ঐশী তার পাশেই শুয়ে আছে এটা ভেবেই তার খুশি খুশি লাগছে। অন্ধকার রুমে সে একা একাই হাসছে। কিছু একটা মনে হতেই জয় আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। এরপর কেবিনেট থেকে কিছু একটা বের করে আবার ঐশীর পাশে এসে বসে।
কিছু সিম্পল গয়না গড়িয়ে রেখেছিল ঐশীর জন্য। বিয়ে ঠিক হওয়ার মাস খানেক পরেই। সে জানে ঐশী গয়না পড়ে না, তার নাকি এসব পড়লে শরীর ভার ভার লাগে। কিন্তু জয়ের শখ হয়েছে। তাই স্পেশালই তার প্রেয়সীর জন্য একদমই পাতলা আর সিম্পল কিছু বানিয়েছে। জয় সতর্কতার সহিত প্রথমে কানে ছোট্ট একজোড়া ইয়ার রিং পড়িয়ে দেয়। এরপর গলায় একটা চেইন। চেইনটা ঐশীর গলার সাথে একদম মিশে গেছে। ঐশীর নাক ফুঁড়ানো নেই তাই নাকফুল বানায় নি। হাতে পাতলা চিকন দুইটা চুড়ি পড়িয়ে দেয়। ডিম লাইটের হালকা আলোতেও ঐশীকে দেখতে এখন অপূর্ব লাগছে। জয় ফটাফট ঐশীর গালে কয়েকটা চুমু খেয়ে নেয়। ঐশীর কোনো নড়চড় নেই দেখে আরও কয়েকটা দিয়ে নেয়। এরপর ঐশীর পায়ের কাছে গিয়ে নিচে বসে পড়ে।
জয়ের নুপুর খুব পছন্দ। তাই পাতলা একজোড় সোনার নুপুরও বানিয়ে নিয়ে এসেছে। সে নিয়ত করে রেখেছিল তার বউকে সে তার মনের মতো করে সাজাবে। তার পুতুলের মতো বউটাকে সে তার মনের আশ মিটিয়ে সাজাবে। ঐশীর পায়ে নুপুরগুলো পড়িয়ে নুপুর দুটোতে চুমু খায়। পায়ে জয়ের গালের ঘষা পেয়ে ঐশী পা সরিয়ে নেয়। তা দেখে জয় জিহবায় কামড় দেয়। এরপর ডিম-লাইট অফ করে এসে শুয়ে পড়ে। কিন্তু শান্তি পাচ্ছে না। কার বাসর রাত এমন হয়? ভেবেছিল আজকে সারারাত ছাঁদে বসে গল্প করে কাটিয়ে দিবে। কিন্তু বউটা তার মাথা ব্যাথায় কাত হয়ে গেছে। জয় ঐশীর দিকে ফিরে আস্তে আস্তে ঐশীর কাছে ঘেঁষে। এরপর ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে ঐশীকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে আবার লাইটটা অফ করে দেয়। মাথায় কয়েকটা চুমু একে জয় চোখ বন্ধ করে নেয়। এবার ঠিক আছে।
#ক্রমশ…
( কপি করা নিষেধ।)
[ কেমন লাগলো জানাবেন। ]