সূর্যোদয় পর্ব ৪০

0
102

#সূর্যোদয়
#পর্ব_৪০
#কারিমা_দিলশাদ

১২৩.

সার্কিট হাউসের মাঠের পাশে বসে আছে জয় আর ঐশী। এই মাঠটা বিশাল বড়। সারাক্ষণ মাঠে খেলাধুলা চলে, মাঠের ওপাশে বিভিন্ন ক্লাব আর এপাশে বসার জায়গা আছে। সেখানেই বসে আছে তারা। দু’জনের হাতেই চা। ঐশী আশপাশটা এনজয় করলেও লক্ষ্য করেছে জয় আসার পর থেকেই কেমন মুষড়ে আছে।

ঐশী এক হাঁটুতে ভর করে গালে হাত দিয়ে জয়কে দেখছে। ঐশীর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। প্রথম সাক্ষাতে ঐশী বুঝতে পেরেছিল জয়ের মাঝে অতো রাখঢাক নেই। আর লোকটা খুব কনফিউজড। ঐশীর একটা ভাবনা সঠিক অপরটা নয়। জয়ের মাঝে সত্যিই কোনো রাখঢাক নেই। তবে জয় অতোটাও কনফিউজড না, অন্তত ঐশীর থেকে তো কমই। আসলে মানুষ একটা বিষয় নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করলে, সেই বিষয়টা বিশ্বাস করলে এবং নিজের মাঝে ধারণ করলে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।

জয় যে মানুষটা ছোট থেকেই একজনকে মনেপ্রাণে চায়, যাকে নিয়ে অবুঝ মনেই স্বপ্ন সাজিয়েছে। সেই মানুষটা যখন জানতে পারে তার স্বপ্ন পূরণ হবে না, তার এতদিনের গড়া দুনিয়াটা কেবল তার নিজস্ব খেয়াল খুশি হয়েই রয়ে যাবে তার মাঝে এতটুকু কনফিউশান থাকা স্বাভাবিক। যখন মানুষ চারদেয়ালের মাঝে ফেঁসে যায়। দমবন্ধ হয়ে যখন মরার অবস্থা হয় তখন মানুষ একফোঁটা আশার আলোর জন্য কতটা ছটফট করে তা ঐশীর ভালো জানা আছে। সে নিজেই এটার ভোগ করেছে।

জয়ের থেকে ঐশী তো আরও বেশি কনফিউজড। এই যেমন ঐশী বিশ্বাস করে পুরুষ মানুষ খারাপ, বিয়ে করে কেউ সুখী হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐশী এখনও তা বিশ্বাস করে। তবে জয়ের ক্ষেত্রে সেই জিনিসটা এখন আর তার ভাবনায় আসে না। না চাইতেও একটা বিশ্বাস কাজ করে। এই বিশ্বাসটা জয় নিজে আদায় করে নিয়েছে, ইলোরা ইয়াসমিনও এটার ভাগীদার। তবে ঐশীর কোনো এক্সপেকটেশন নেই। সে নিজের ভাগ্যকে একবার যাচাই করে দেখতে চায়।

ঐশীর বরাবরই কম কথা বলা মানুষ পছন্দ। সে নিজেও কম কথা বলতে পছন্দ করে। তাই বলে আল্ট্রা মুখচোরা মানুষ পছন্দ না। যেখানে কথা বলা উচিত বা প্রয়োজনে যার সাথে কথোপকথন চালানো যাবে এমন মানুষ পছন্দ। জয় কিছুটা সেরকমই। সবার সামনে বা সবার সাথে জয় বেশি কথা বলে না। কেবল ঐশীর সাথে। জয় প্রতিটা মানুষের সাথে আলাদা আলাদা বিহেভ করে। ফ্যামিলির সাথে একরকম, ফ্রেন্ড’দের সাথে একরকম, কাজের জায়গায় একরকম, আবার ঐশীর সাথে আরেকরকম। যার সাথে যেরকম ব্যবহার করাটা উচিত জয় সেটাই করে।

সবগুলো সম্পর্ক সুন্দরভাবে ব্যালেন্স করে চলে। লোকটার এই সাইডটা ঐশীর ভীষণ পছন্দ। বিয়ের পর কি হবে জানা নেই। কেবল ঐশীর কাছে জয় নিজেকে একদম ভে’ঙেচুরে দেয়। কোনো লিমিটেশন নেই, কোনো ফর্মালিটি নেই। মাঝে মাঝে খুবই ম্যাচিউর, ঐশীর পার্ফেক্ট গার্ডিয়ানের ন্যায় আবার মাঝে মাঝে খুবই চাইল্ডিশ ব্যবহার করে।

এই তো সেদিন ছুটির সময় একজন স্টুডেন্টের ভাই এসেছিল তাকে নিতে, তখন ঐশীর সাথেও কথা বলে। ঐশীও সৌজন্যেরক্ষার্থে কথা বলছিল তারসাথে। তখনই জয় আসে। এসে দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর আবার কি হলো কে জানে। তার পাশে এসে মুখ ফুলিয়ে উড়নাটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। বাচ্চারা যখন কাউকে যেতে দিতে না চাই বা কোনো জিনিস বা কাউকে নিজের আয়ত্তে রাখতে যেভাবে কাপড় ধরে থাকে সেভাবে। ঐশী আর ওই ভদ্রলোক দু’জনেই জয়ের এমন ব্যবহারে অবাক হয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল, তবে জয় ওসব আদোও কেয়ার করে? অচেনা একজনের সামনে জয়ের এমন ব্যবহারে ঐশী ভীষণ বিব্রতবোধ করে। সেদিন আর জয় তারসাথে কথা বলে নি। পরে অবশ্য ঐশী বুঝতে পারে লোকটা খুব জেলাস।

ঐশী জানে জয় তার পরিবারের মানুষদের পছন্দ করে না। অবশ্য পছন্দ না করাটাই স্বাভাবিক। এতে তারকোনো আক্ষেপ নেই। তারপরও জয় কখনো তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার তো দূরের কথা তেমন কোনো অসংলগ্ন ব্যবহারই করে না যাতে তারা বুঝতে পারে জয় ওনাদের পছন্দ করে না। সবসময় হাসিমুখে, ভদ্রভাবে এবং আন্তরিকতার সহিত ব্যবহার করে। ঐশীর মনে হতো জয় দায়িত্বশীল না। তবে সে ভুল, জয় ভীষণ দায়িত্বশীল এবং ভীষণ কেয়ারিং একজন মানুষ। আর দেখতে শুনতে তো মাশাল্লাহ।

এতক্ষণ ধরে ঐশী জয়ের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছে কিন্তু জয়ের কোনো নড়চড় নেই। সে নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। চা টাও ঠান্ডা হয়ে গেছে তার।

ঐশী তার কাঁধ দিয়ে জয়ের কাঁধে ধাক্কা দেয়। ইশারায় কি হয়েছে জানতে চায়। জয় মুচকি হেসে না সূচক মাথা নাড়ায়। ঐশী এবার নড়েচড়ে বসে জয়কে বলে,

“ আপনি বললেই হলো নাকি। এভাবে মুষড়ে আছেন কেন? কি সমস্যা বলুন তো। এভাবে হুট করে এখানে নিয়ে আসলেন আর এখন কিছুই বলছেন না। কি হয়েছে বলুন না?”

জয় কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে যা বলে তা শুনে ঐশীর মনে মিশ্র এক অনুভূতি হয়। উচ্চতর ডিগ্রির জন্য জয় স্কলারশিপ পেয়েছে। দুই বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হবে তাকে। এটা শুনে ঐশী জয়ের জন্য খুশিও হয়েছে আবার তার মনে ভয়ও দানা বাঁধছে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা জয় স্কলারশিপটা নিতে চাচ্ছে না।

জয়ের মনেও ভয় হচ্ছে ঐশী যদি এবার বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেয়? দুইটা বছর। একেতো ঐশী এই সম্পর্ক নিয়ে এমনিতেই দ্বিধান্বিত। তারউপর ঐশীর ট্রমা। জয় চায় না ঐশী কোনো ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। কিন্তু ডাক্তারি তার ভীষণ শখের পেশা, বড় ডাক্তার হওয়া তার স্বপ্ন। আর তাই এই স্কলারশিপটা তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবুও সে ঐশীর জন্য এমন হাজারটা স্বপ্ন-শখ কোরবানি করতে প্রস্তুত। কিন্তু সে বিষয়টা ঐশীর সাথে শেয়ার না করেও পারছিল না।

১২৪.

দুঘন্টা ধরে দুজন মানুষ পাশাপাশি চুপচাপ বসে আছে। জয়ের জন্য দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে জয় নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ঐশী তার জীবন, ঐশীকে ছাড়া সে তার লাইফ কল্পনাও করতে পারে না। আর এটা তার স্বপ্নের একটা অংশ। ডিগ্রীটা পরেও নেওয়া যাবে। আর না করা গেলে নাই করলো। যেভাবে আছে সেভাবেও খারাপ না। বেশ ভালো আছে। এজন্য প্রেয়সীকে কোনোরকম ইনসিকিরিটিতে ফেলতে পারে না সে। যেখানে সে ঐশীর বিষয় সব জানে।

জয় দুহাতে দিয়ে সারাটা মুখ ঘষে নেই। এরপর ঐশীর দিকে ফিরে স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ ঐশী….ডোন্ট ওয়ারি। আমি কোত্থাও যাচ্ছি না। তুমি কোনোরকম টেনশন করো না। আসলে বিষয়টা আমি তোমাকে জানাতে চাইছিলাম, আর বুঝোই তো বিষয়টা কতটা খুশির। তাই আরকি। তুমি মন খারাপ করো না। আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাচ্ছি না।”

“এতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন? দেখুন আমি জানি ডাক্তারি পেশাটা আপনার খুব শখের পেশা। অনেক বড় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আপনার। তারজন্য এই ডিগ্রীটা অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। এটা ছাড়া মানেই বোকামি। আপনি যাবেন ডাক্তার সাহেব।”

জয় ঐশীর কথায় খুব অবাক হয়। ঐশী এইকথা বলছে! জয় কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মেকি হেসে বলে,

“ আরে ধুর ব্যাপার না। এটা পড়েও করা যাবে। তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। আর মাত্র একমাস পরে আমাদের বিয়ে তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো। আমার জন্য তুমি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।”

ঐশী জয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

“ স্বপ্ন ভাঙা মন ভাঙার থেকেও বেশি যন্ত্রণার ডাক্তার সাহেব। স্বপ্ন ভাঙার সাথে সাথে মানুষের মনটাও ভেঙে যায়। আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়। আর মন ভাঙার সময় কেবল মন ভাঙে। মন ভাঙলে আপনি অপর মানুষকে দোষ দিতে পারবেন, এতে সাময়িক হলেও কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু যখন স্বপ্ন ভেঙে যায়, তখন কাউকে দোষারোপ করেও স্বস্তি মেলে না। বারবার মনে হবে যদি কারো কথা না শুনতাম, যদি এটা করতাম, যদি ওটা করতাম। আর যদি কারো জন্য স্বপ্ন ভাঙে, তাকে আপনি না কখনো বলতে পারবেন আর না সেই ব্যাথা সহ্য করতে পারবেন। আমি কারো স্বপ্ন ভাঙার কারণ হতে চাই না ডাক্তার সাহেব, ব্যাথার কারণ হতে চাই না। আপনি যাবেন ডাক্তার সাহেব।”

“ ঐশী এমন সুযোগ আরও আসবে। এটা তেমন কোনো ফ্যাক্ট না….”

“ বাট এই সময় আর আসবে না।”

“ হয়তো। কিন্তু আমি তোমাকে হারাতে পারবো না ঐশী। এমন হাজার স্বপ্ন তোমার পায়ে রাখতে রাজি আমি। তবুও তোমাকে হারাতে চাই না আমি।”

“ ডাক্তার সাহেব এসব ফিল্মি ডায়লগে জীবন চলে না। নিজের স্বপ্নের কদর করতে শিখুন। আগলে রাখতে শিখুন, নিজের ভালোটা বুঝুন।”

“ হ্যা হ্যা তাই করছি। নিজের ভালোটাই বুঝছি। আর আমার সেই ভালোটা তুমি। কোনোকিছুর জন্য আমি তোমাকে হারাতে পারবো না। তুমি তোমার বুকে হাত রেখে বলোতো তুমি সত্যিই আমাকে মন থেকে যেতে বলছো। তোমার মাঝে কোনো দ্বিধা নেই? তুমি ইনসিকিউর ফিল করছো না? বলো।”

জয় উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে। কিন্তু ঐশী নিশ্চুপ থাকে। জয় নিজেকে শান্ত করে বলে,

“ লিসেন ঐশী। আমাদের সম্পর্কটা এখনো মজবুত হয় নি৷ সম্পর্কের পরিণয় পায় নি। আমি তোমাকে ভালোবাসলেও তুমি আমাকে এখনো অবধি বিশ্বাসটাই করে উঠতে পারো নি। আর আমি বিদেশ চলে গেলে তোমার বিশ্বাসটাই আমার সবচেয়ে বেশি দরকার। আমি এই রিস্ক নিতে পারবো না ঐশী, কক্ষনো না।”

১২৫.

ঐশী বিগত তিনদিন ধরে জয়ের বিষয় নিয়ে ভাবছে। এই তিনদিনে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও ঐশী স্বাভাবিক নেই। কোথাও যেন তাল কেঁটে গেছে। জয় রোজ ফোন করছে, স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে।

জয় ইলোরা ইয়াসমিনকেও কিছু বলে নি। এমনকি স্কলারশিপটা যে সে পেয়েছে সেটাও জানায় নি। সে ভেবেছে যতোই হোক এমন একটা অফার ঐশীর জন্য রিজেক্ট করছে শুনলে ঐশীর জন্য মায়ের মনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আসলে সে তো ঐশীর জন্য না নিজের জন্যই রিজেক্ট করছে, কারণ তার কাছে ঐশীই সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।

কিন্তু জয় না বললেও ইলোরা ইয়াসমিন জানে জয়ের স্কলারশিপের কথা। ইভেন সবই জানেন। তিনি মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছেন। জয় স্কলারশিপটা ঐশীর জন্য করতে চাইছে না এসব ভেবে না। তিনি এটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন যে তার ছেলে তার জীবনের এতোবড় একটা অর্জনের কথা তারসাথে শেয়ার করে নি এটা ভেবে। তার ছেলের এতবড় সুযোগের খবরটা অন্য একজনের কাছ থেকে তার শুনতে হয়েছে। ঐশীর জন্য তারমনে কোনো কষ্ট নেই, আক্রোশ নেই। জয় যদি তাকে বলতো, তো তিনি নিজেই না করতেন এখন এই ডিগ্রীটার জন্য। কারণ এখন সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট দুজনের সম্পর্কটা মজবুত করা। ডিগ্রি তো পরেও নেওয়া যাবে।
কিন্তু তার ছেলে নিজের মুখে তাকে খবরটা না দেওয়ায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন। ছেলে হয়তো ভেবেছে মা বিষয়টা বুঝবে না, তাই বলে নি। ছেলে তাকে বিশ্বাস করতে পারে নি এটা ভেবে তিনি কষ্ট পেয়েছেন।

১২৬.

বিছানায় আধশোয়া হয়ে ভাবছে ঐশী। হঠাৎ করেই ঐশী উঠে বসে। ফোন হাতে নিয়ে পায়চারী করতে থাকে। আবার অস্থির পায়ে বারান্দায় চলে যায়। কিছুক্ষণ পর হাতে থাকা ফোনটার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে কিছু ভাবতে থাকে। বেশ সময় নিয়ে ভেবে মুখ ফুলিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ে। এরপর ঝটপট ফোনো কিছু টাইপ করে, বারান্দায় রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে বসে থাকে।

ওদিকে,

জয় এই তিনদিন কাজের জন্য ঢাকায় ছিল। কেবল মাত্র বাসায় ফিরলো। সবে গোসল করে বের হয়েছে। টাইম দেখার জন্য ফোনটা নিতেই ঐশীর নাম্বার থেকে মেসেজ নোটিফিকেশন দেখে। মেসেজ ওপেন করে পড়ে খানিক ভ্রু কুঁচকায়। কিন্তু মেসেজটা বুঝার পর কিছুক্ষণের জন্য সে থমকে যায়। সে আবার ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলায়৷ সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা বাক্য,

“I trust you.”

জয় তাড়াতাড়ি ঐশীকে কল দেয়। ঐশী জানতো এই কলটা আসবে তাই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই জয় বলে,

“ ঐশী আর ইউ সিরিয়াস?”

“ ইয়েস।”

জয়ের খুশিতে জয়ী হওয়ার ভঙ্গিতে আস্তে করে ইয়েস বলে উঠে। ঐশী ফোনের ওপাশ থেকেও যেন জয়ের খুশিটা অনুভব করতে পারছে। জয় বলে,

“ তোমার মাঝে সত্যি কোনো দ্বিধা নেই তো?”

ওপাশ থেকে নিরুত্তর। জয় একটুপর আবার ‘ঐশী’ বলে ডেকে উঠে।

“ নো। এবার আপনি বিদেশে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।” – জয়ের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। ঐশী বলে উঠে,

“ রাখছি আল্লাহ হাফেজ।”

ঐশী কল কেটে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আর ভাবে,

“ জীবন নিয়ে জুয়া খেলায় নেমেছি আমি। যে যাওয়ার সে আজ হোক কাল হোক এমনিতেই যাবে। যা হওয়ার হবে। কপালে যা লিখা আছে তাই তো হবে। শত ভাবনা চিন্তা করেও তা আটকাতে পারবো না। আর কোনো চিন্তা ভাবনা করবো না আমি। আজ থেকে সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম। এবার কেবল স্রোতে গা ভাসিয়ে যাব।”

১২৭.

পরেরদিন জয় জুম্মা’র নামাজ পড়ে মায়ের রুমে যায়। ইলোরা ইয়াসমিন প্রতি শুক্রবার যোহরের নামাজ পড়ে কোরআন শরিফ পাঠ করে। জয় গিয়ে মায়ের পাশে বসে। ইলোরা ইয়াসমিন কোরআন শরিফ পাঠ শেষে কোরআন শরিফ বন্ধ করে রাখতেই জয় মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। ইলোরা ইয়াসমিন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কিছু সূরা পাঠ করে ফু দেয়।

“ আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই মা। যদিও খবরটা পাওয়ার সাথে সাথে বলা উচিত ছিল। কিন্তু একটা কারণে তখন বলি নি।”

ইলোরা ইয়াসমিন বিচক্ষণ মানুষ । তিনি বুঝে গেলেন ছেলে কি বলতে চায়। তবুও তিনি কিচ্ছু না জানার ভান করে বলে,

“ কি বলবি বাবা?”

জয় মায়ের কোল থেকে উঠে হাসিমুখে বলে,

“ অস্ট্রেলিয়ায় আমার স্কলারশিপ হয়েছে মা।”

ইলোরা ইয়াসমিনের চোখে পানি চিকচিক করছে। তিনি ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খায়। আর ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে,

“ অনেক বড় হ বাবা। তোর সব স্বপ্ন পূরণ হোক। সব মনো কামনা আল্লাহ পূরণ করুক বাবা।”

জয় মাথা নিচু করে বলে,

“ খবরটা আমি চারদিন আগেই পেয়েছিলাম মা। কিন্তু বলি নি। আসলে আমি স্কলারশিপটা নিতে চাচ্ছিলাম না।
এর কারণটা আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছ। আমি চায় নি ঐশী কোনো ইনসিকিরিটিতে ভুগুক। এখনও আমাদের মাঝে সম্পর্কটা পাকাপোক্ত হয় নি, আন্ডারস্ট্যান্ডিং নেই আর ওর ট্রাস্ট ইস্যু আছে তা তো তুমি জানোই। তাই ভাবলাম তোমাকে না বলি। ভেবেছিলাম এটা বললে তুমি হয়তো ঐশীর প্রতি মনে বিরুপ ধারণা পোষে রাখবে। কিন্তু পরে মনে হলো আমার মা সবার থেকে আলাদা, অসাধারণ একজন নারী। সে এমন কিছুই করবে না বরং তোমাকে বললে তুমিই আমাকে এখন যেতে মানা করবে। কিন্তু ওইদিনই জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হলো। ফোনে বলতে পারতাম বাট আমি চেয়েছিলাম সামনাসামনি বলতে। সরি মা, আমাকে মাফ করে দাও।”

ইলোরা ইয়াসমিনের মনে যেই কষ্টটা ছিল তা এখন আর নেই। তিনি অশ্রুসজল চোখে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়।

পুরুষ মানুষেরও সবদিক ব্যালেন্স করে চলতে হয়। মা স্ত্রী দুজনের মাঝেই সমতা বজায় রাখা উচিত। মা-বউয়ের অন্যায়কে অদেখা করলে চলে না। আবার কেবল মায়ের অন্যায় অদেখা করে বউকে সব মেনে নিতে বলাও কোনো পুরুষের কাজ না। তবে এটা জয় নিজের সরলতা থেকেই করেছে। সে সত্যি অনুতপ্ত।

ইলোরা ইয়াসমিন এবার ছেলেকে আদর করতে করতে বলে,

“ আমার সোনা ছেলে। আমার লক্ষী ছেলে।”

জয় মায়ের ঘাড়ে মাথা রেখেই বলে,

“ তবে জানো ঐশী আমাকে বিদেশ যেতে বলছে।”

তিনি জয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। জয় তখন সেদিনের সবকথা এবং রাতের মেসেজের কথা সব খুলে বলে।

“ তবে আমি জানি। ও কথাটা মন থেকে বলে নি। কেবল সব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।”

ইলোরা ইয়াসমিন জয়কে জিজ্ঞেস করে,

“ তোকে যেতে হবে কবে?”

“ ছয় মাসের মধ্যে। দুবছর থাকতে হবে ওখানে।”

ইলোরা ইয়াসমিনের বুক ধক করে উঠে। এতগুলো বছর হয়েছে তিনি কোনদিন জয়কে ছাড়া থাকে নি। হ্যা জয় যখন ঢাকা মেডিকেলে পড়তো তখন আলাদা ছিল। তবে সুযোগ পেলে হয় তিনি ঢাকা চলে যেত, না হয় জয় চলে আসতো। কিন্তু এতো ঘন্টা দু’একের রাস্তা না৷ সাত সাগর তেরো নদীর পারি দিয়ে যেতে হয়। ছেলেকে না দেখে কিভাবে থাকবে এই দুইটা বছর? ভিডিও কলে দেখে কি আর মন ভরবে। তিনি মাতৃ মনের হাহাকার নিজের মাঝেই দাবিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে জয়কে বলে,

“ মানিয়ে নিতে চাইছে এটাই বা কম কি বল। একদিন ঠিক মেনে নিবে। আর ঐশী যথেষ্ট বোঝদার সে সব সামলে নিবে। তুই চিন্তা করিস না। তোর কাছে এখনো তো সময় আছে। একটু সবর কর আর ওকেও সময় দে। তুই ওর আছিস, ওরই থাকবি এই ভরসাটুকু দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।” — জয় হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে।

১২৮.

মানুষের জীবনে কখন কি হয়ে যায় তা কে বলতে পারে। যেখানে নিঃশ্বাসেরই কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সেখানে মানুষের সিদ্ধান্ত আর তেমন কি। যেই বিয়ে আরও একমাস পড়ে হওয়ার কথা ছিল তা এখন পনেরদিন পরে ঠিক করা হয়েছে। গত পরশুদিন জয়ের পরিবার এসে সব ঠিক করে গেছে। জয়ের বিদেশ যাওয়াকে কেন্দ্র করে এই পরিবর্তন।

আসলে বর মহাশয় আর সময় নষ্ট করতে চায় না। যতদিন দেশে আছে সে তার সুহাসিনী’র সাথে সময় কাটাতে চায়৷ এতে অবশ্য কেউ আপত্তি করে নি। এমনকি আশ্চর্যের বিষয় হলো ঐশী নিজেও কোনো কারণে অমত করে নি। তবে স্মৃতি একটু গাইগুই করেছে। কেননা তার পরীক্ষা সামনে। কিন্তু পরে সেও মেনে নিয়েছে।

কেউ অমত না করলেও সবার মাঝে কেমন একটা হায়হায় ভাব দেখা যাচ্ছে। এতো অল্প সময়ে এতকিছু ম্যানেজ করা মুখের কথা না।

১২৯.

ঐশী কাপড় আয়রন করছে। আজকে জয়দের বাসায় যাবে। কারন আজকে ওদের বাসায় একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার রাখা হয়েছে। যেহেতু জয়ের হবু বউকে কেউ দেখেনি আর সবাই দেখতে চাইছে। তাই ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীকে ডেকেছেন। এক সাথে দুইকাজ হয়ে যাবে ভেবে। বাসাটায় বেশকিছু পরিবর্তন করা দরকার৷ বাসাটা রি-ডেকোর করানো হবে। তো ঐশী এসে ওদের রুমটা ওর মতো করে কি কি যোগ করতে হবে বাদ দিতে হবে সেটাও দেখিয়ে দিল, আর বাকিদের সাথেও চেনা পরিচিত হয়ে নিল।

ঐশীর পরিবারের সবাইকেই ইনভাইট করা হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের আগে ওদের ফ্যামিলি গেট টুগেদারে সবাই মিলে যাওয়াটা ভালো দেখাবে না। এটা অবশ্য ঐশীই তার ছোট খালার মাধ্যমে বলিয়েছে। ওর মা তো ওনার বোন-ভাই, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্নে-ভাগ্নি সবাইকে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলেন। মারুফের পরিবারের মতো। ওদেরটা অভদ্রতা এটা তার বাবা মা স্বীকার করে অথচ সেম কাজটা তারা আরেকজনের সাথে করতে যাচ্ছে সেটা নাকি আন্তরিকতা। হাহ্।

ইলোরা ইয়াসমিন ভদ্রতাসূচক সবাইকে ইনভাইট করেছে অথচ তার মা তার পুরো খানদান নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। এটা অবশ্য তার মায়ের স্বভাব। কোনো সামাজিকতা নেই। তাই ঐশী তার ছোট খালাকে বলে যেন সে তার মাকে বোঝায়। প্রথমতো বিয়ে না হতেই এতোগুলা মানুষ নিয়ে যাওয়াটা ছোটলোকি পর্যায়ে পড়ে। তাও যদি কেবল ওরা চারজন যেত তাও সেটা শোভনীয় ছিল। দ্বিতীয়ত ওখানে যারা উপস্থিত থাকবে তাদের মন মানসিকতা সম্পর্কে ঐশী জানে না। একেকজনে একেক কথা বলতে পারে। আর ওদের ফ্যামিলির মানুষের ম্যান্টালিটির সাথে তাদের ম্যান্টালিটির মাঝে বিস্তর ফারাক।

কাপড় আয়রন করতে করতে আরেকটা জিনিস ভাবছিল ঐশী৷ জয়ের সাথে তার একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। সে ফোনেই বলতে পারতো তবে সামনাসামনি বলাটাই বেটার মনে করেছে সে। আরও আগেই বলা উচিত ছিল, তবে বলা হয়ে উঠে নি।

এরমধ্যেই মায়ের রুম থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনতে পায় ঐশী। দৌড়ে সে তার মায়ের রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় কি হয়েছে জানতে। গিয়ে দেখে তার জন্মদাত্রী মা আর তাদের আদর্শ সন্তান বংশের প্রদীপ ধস্তাধস্তি করছে। তার ভাই তার মায়ের এক হাত মুচড়ে ধরেছে। আরেক হাত দিয়ে হয়তো তার মা আবার ছেলেকে আঘাত করতে নিয়েছিল তাই সেটাও তার ছেলে ধরে রেখেছে। আর মুখ দিয়ে অনর্গল বিশ্রী থেকেও বিশ্রী গালাগা’লি করছে। তার মা ব্যাথায় আস্তে আস্তে কাতরাচ্ছে। পাছে আবার বাইরের মানুষ শুনে না ফেলে।

ঐশী কিছুই করলো না। সে চুপচাপ অপেক্ষা করে জানার চেষ্টা করলো কিসের জন্য এই মারামারি। আর ঘটনা হলো। ঐশীর বাবা মায়ের বংশের প্রদীপ জানে তার বাবার হাতে এখন বেশকিছু টাকা আছে। যা তারা মেয়ের বিয়ের জন্য কাল ব্যাংক থেকে তুলে এনেছে। আর সেটা দেখেই তাদের ছেলে বেশ বড় অংকের টাকা চাইছে। তবে তারা এখন এইটুকু ছেলের হাতে এতগুলো টাকা দিবে না, আর ছেলে মানবে না। তাই এই অবস্থা। ঐশী সেখানে যেমন চুপচাপ গিয়েছিল সেভাবেই চুপচাপ আবার রুমে ফেরত আসে।

দরজা লাগিয়ে সে কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে যায়। সাওয়ার ছেড়ে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। তার এই কাজটা দেখলে মানুষ ছিঃ ছিঃ করবে আর বলবে কেমন মেয়ে ভাই মাকে মারছে দেখেও কোনো হেলদোল নেই। ওইটুকু ছেলে যে মাকে মা’রছে সেটাও ছাপিয়ে যাবে তার কিছু না করায়। অথচ কেউ জানবে না প্রথম প্রথম ঐশী গিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতো। তখন তার ভাই তার উপর চড়াও হতো। না পেরে ঐশীও মা’র শুরু করতো। এতটুকু পর্যন্ত সবঠিক। এরপর সব শান্ত হয়ে গেলে ঐশীর মা এসে আবার ওকে মা’রতো। ঐশী তার ছেলেকে মে’রেছে কোন সাহসে, এটাই তার দোষ। কখনো কখনো আবার ছেলের সামনেই মা’রতো। একদিন বলে,

“ ওই মা** তুই আমার পোলারে মা’রস কোন সাহসে। এই পোনাই (ছেলে) কি তুই পয়দা করছিলি? পয়দা তুই করস নাই, পয়দা আমি করছি। পয়দা করতে কষ্ট লাগে। নিজে ক্ষমতা কইরি পয়দা কর গা। পরে ওইগুলারে মা’ইরা মজা নিস।” – ব্যাস ওইদিনই লাস্ট। সব সম্মান শ্রদ্ধা সেদিন থেকে এক্কেবারেই শেষ। এরপর থেকে ঐশী আর কোনদিন ওদের মাঝে যায় নি। যেদিন শওকত মে’রে হাত ওর মায়ের ভেঙে দিয়েছিল সেদিনও যায় নি। মে’রে যখন শওকত বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, পরে তার মা তার কাছে এসে কাতরাচ্ছিল। মানবতা থেকে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।

#ক্রমশ…

কপি করা নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here