#সূর্যোদয়
#পর্ব_৩৭
#কারিমা_দিলশাদ
১০৯.
জয় নৃত্যশৈলিতে এসে পড়েছে। এটা তার রেগুলার রুটিন। মেয়েটাকে একনজর না দেখলে তার শান্তি হয় না। এই যে ঐশীকে বাসায় পৌঁছে দেয়। এই সময়টুকুই তার কাছে অনেক। যদিও এই অল্প সময় দেখে আর এই এতো অল্প সময় ঐশীর সাথে থেকে তার মন ভরে না। তবে নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো।
প্রতিদিন দরজায় পর্দা ঝোলানো থাকলেও আজকে পর্দা দুটো দুই সাইড থেকে ভাজ করে বেঁধে রাখা। আর ভিতর থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আসছে। যদিও এমন আওয়াজ আসা স্বাভাবিক তবে কি মনে করে আজ জয় ভিতরে প্রবেশ করে। গিয়ে দেখে ঐশীর ফ্রেন্ডরা হল রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফ্লোরে বসে হৈ-হুল্লোড় করছে। তাকে দেখে হৈ-হুল্লোড় যেন আরও বেড়ে গেল। অনিক আর সৌরভ তাকে সাদরে ভিতরে নিয়ে যায়। বিজয় চেয়ার এনে দেয় বসার জন্য। কিন্তু জয় চেয়ারে না বসে সবার সাথে ফ্লোরেই বসে। কোশল বিনিময় আর দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির মাঝে জয় ঐশীকে খুঁজতে ব্যস্ত। বিষয়টা বিজয় খেয়াল করে বলে,
“ ভাই আপনার ডাক্তারণি চা বানাইতে গেছে। আইতাছে। সবুর করেন সবুরে মেওয়া ফলে।” -বিজয়ের কথায় সবাই হেসে উঠে। আর জয় লজ্জায় পড়ে যায়। এরমধ্যে কবিতা গিয়ে ঐশীকে জয় আসার কথা জানিয়ে আবার বাকিদের সাথে জয়েন করে।
ওরা কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। জয় ওদের জিজ্ঞেস করলে জানায় ওরা একটা এতিমখানায় একটা দিন কাটানোর পরিকল্পনা করছে। সাথে নিজেদের সাধ্যমতো এতিম বাচ্চাদের জন্য কিছু আয়োজন করবে, ওদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাবে। জয় সব শুনে বলে,
“ বাহ!! এটা তো বেশ ভালো পরিকল্পনা। খুবই ভালো। সত্যিই তোমরা তোমাদের বয়সী বাকিদের থেকে অনেক আলাদা।”
“ সবই আপনার বউয়ের ক্রেডিট ভাই। আপনার বউ এসবের মূল হোতা। ঔ সবসময় এইগুলা প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে। আমরা খালি ওরে একটু সঙ্গ দেই। ওর সাথে থাইকা আমরাও কিছু সওয়াবের ভাগিদার হই।” — অনিকের কথায় জয় বেশ পুলকিত হয়। ঐশীর এই দিকটা জয়ের অগোচরে ছিল। আর আজ সেটা জানতে পেরে ঐশীর প্রতি জয়ের ভালোবাসা আর সম্মান দুটোই আরও অনেক গুণে বেড়ে গেল। এরমধ্যেই ঐশী সবার জন্য চা নাস্তা নিয়ে আসে। বিজয় সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ ওইতো পদার্পণ করছেন আমাদের করুণাময়ী রাণী রাসমনি।”
ঐশী বিজয়ের কথায় পা দিয়ে তাকে লাথি দেখায়। আর বিজয়ও পাল্টা জবাব দেয়। বন্ধুদের মাঝে এতো ফর্মালিটি, ঠিক-বেঠিক, উচিত-অনুচিত কাজ করে না। ঐশী ট্রে টা নামাতে নামাতে বলে,
“ নেন মহারাজেরা গরম গরম চা আর কলিজা সিঙ্গারা হাজিররররররররর..”
ঐশীর ট্রে টা রাখতে দেরি কিন্তু সবার হামলে পড়তে দেরি নেই। খাবলা-খাবলি টানাটানি করে সবাই কোনোরকমে চা আর সিঙ্গারা নিয়ে বসে যায়। ঐশী সব বাঁচিয়ে নিজের আর জয়ের চা নাস্তা নিয়ে নেয়। জয়েরটা জয়ের হাতে দিয়ে জয়ের থেকে একটু দূরে বসে পড়ে। ঐশীর ফ্রেন্ড’দের সঙ্গ জয়ের বরাবরই খুব ভালো লাগে। ছেলেমেয়েগুলোর মাঝে ভান নেই, ছলচাতুরী, অশ্লীলতা, বা অন্যান্য বাজে দিক নেই। ওরাও জয়ের সাথে খুব ফ্রেন্ডলি। ওদের পরিকল্পনার মাঝে ওরাও জয়ের পরামর্শ নিচ্ছে। আর সেও খুবই সাচ্ছন্দ্যে কোনটা করলে ভালো হবে, কিভাবে করলে ভালো হবে সেসবে তার মতামত রাখছে।
কথা বলতে বলতে জয় চায়ের কাপে চুমুক দেয়। চুমুক দিতেই তৃপ্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। খুবই দারুণ হয়েছে চা টা। জয় চোখ মেলে ঐশীর দিকে তাকায়। যে এখন মুখে পেন্সিল রেখে চুলগুলো আঁটোসাঁটো করে বাঁধনে বাঁধতে ব্যস্ত। কি অপরুপ সুন্দর দৃশ্য। চা টাও বেশ ভালো বানায়। ভালো বললে কম বলা হবে দুর্দান্ত বানায়। জয় চায়ের প্রতি চুমুকেই আবেশে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছে। আর ঐশীকে দেখছে। মেয়েটা কথা বললে আর হাসলে বাম ঠোঁটের কোণায় একটা ভাঁজ পড়ে। জয়ের খুব ইচ্ছা ভাঁজটায় হাত ছোঁয়ানোর, ঠোঁট ছোঁয়ানোর।
১১০.
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। থামাথামির কোনো নামই নেই। বৃষ্টি নামার আগেই আশা আর কবিতা বাদে ঐশীর বাকি ফ্রেন্ডরা চলে গেছে। ওরা বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেছে। আটকা পড়েছে জয়ও।
এই মূহুর্তে জয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছে। তার হাতে খালি চায়ের কাপ। ঐশী ট্রে তে করে বাকি চায়ের কাপগুলো নিয়ে জয়ের চায়ের কাপটা নিতে আসে। জয় কাপটা দিতে দিতে বলে,
“ চা টা দারুণ ছিল।”
“ তাই?”
“ আমি সাধারণত চা খুব একটা খাই না। কফিই খাওয়া হয় বেশি। তবে এই চা টা জাস্ট ওয়াও। অসাধারণ। ”
“ আরে বাহ্ এতো ভালো লেগেছে!” – বলেই মৃদু হাসে ঐশী। জয়ও হালকা হেসে সম্মতি দেয়। ঐশী জয়কে ওয়েট করতে বলে কিচেনে যেতে নেয়। তখনই পিছন থেকে জয়ের ডাকে থেমে যায়। জয়ের দিকে তাকিয়ে কি হয়েছে ইশারা করতেই জয় তার কাছে এসে ইতস্তত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“ ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। আমি কি আর এক কাপ চা পেতে পারি?”
ঐশী মিষ্টি হেসে সম্মতি জানিয়ে কিচেনে চলে যায়। জয় লজ্জায় পড়ে যায় কিন্তু চা টা তার সত্যিই খুব ভালো লেগেছে। জয়ও ঐশীর পিছনে যেতে যেতে আশপাশটা অবলোকন করে। বাসাটা অনেক বড়, অনেকটা জায়গা জুড়ে। বারান্দাটাও লম্বা চওড়াই অনেক বড়। হল রুমের পরে আরও তিনটা রুম। এরপর একটা কমন বাথরুম, এরপর ডাইনিং এরপর বেশ বড়সড় কিচেন। পুরনো আমলের বাড়ি হওয়ায় সবকিছু এতো বড় বড় করে তৈরি করা। বারান্দার সামনে বেশ বড়সড় একটা উঠান। যা বেশ কিছু ফল-ফলাদির গাছগাছালি দিয়ে ভরা। সবমিলিয়ে বাসাটা সুন্দর।
জয় আস্তে আস্তে সব দেখতে দেখতে কিচেনের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিচেনে ঐশী কাজ করায় ব্যস্ত। আর জয় তাকে দেখতে ব্যস্ত। উড়না এক সাইড দিয়ে এনে অপর সাইডে কোমরে বাঁধা, চুলগুলো অগোছালো ভাবে কোনোরকমে খোঁপা করা। কিছু খুচরো চুল কানের পাশ দিয়ে আর মুখের সামনে পড়ে আছে। কি সুন্দর ব্যস্ত হাতে একবার কাপগুলো ধুচ্ছে আবার চুলায়ও কাজ করছে। পাক্কা গৃহিণী মনে হচ্ছে।
জয় দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। তার বুকটা আনচান আনচান করছে। এই মূহুর্তে তার ইচ্ছে করছে পিছন থেকে ঐশীকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু লাইসেন্স নেই। বিয়েটা হয়ে গেলেতো আর তার এতো সব মন কেমন কেমন করা গুলো নিজের মাঝে বন্দী রাখতে হতো না। কিন্তু মেয়েটা তো বুঝতেই চায় না।
জয় এবার নজর সরিয়ে বাইরে তাকায়। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণই নেই। সারা বারান্দার গ্রিল জুড়ে বিভিন্ন হ্যাঙ্গিং প্ল্যান্ট ঝুলানো। গাছগুলো বৃষ্টির পানিতে আরও চকচক করছে। প্রতিটা রুম বারান্দার প্রতিটা জায়গায় কোনো না কোনো গাছ অবশ্যই আছে। যা বাসার সৌন্দর্যটা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মেয়েটার রুচির প্রশংসা করতে হয় বটে।
তার পর্যবেক্ষনের মধ্যেই এক কাপ চা তার সামনে চলে আসে। সে হাত অনুসরণ করে দেখে ঐশী দু কাপ চা নিয়ে এসছে। জয় হেসে চা টা হাতে নেয়। বিনিময়ে ঐশীও হালকা হাসে।
জয় চায়ে প্রথমে দুটো ফু দেয়, এরপর চুমুক দিয়ে চোখটা বন্ধ করে নেয়। তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে চা টা তার কাছে কতটা ভালো লেগেছে। ঐশী গ্রিলে মাথা দিয়ে জয়কে দেখে যাচ্ছে। জয়ের চা পান করার ঢং-টা তার বেশ ভালো লাগছে। এই যে ফু দিয়ে চুমুক দিচ্ছে এটাও তার ভালো লাগছে। চুমুক দেওয়ার পর আবেশে চুখ বন্ধ করে নিচ্ছে বারবার এটাও তার ভালো লাগছে। কি সুন্দর তৃপ্তি নিয়ে লোকটা চা খাচ্ছে।
জয় বলে,
“ কফি কফির জায়গায়। কিন্তু স্পেশাল কিছু সময়ে চায়ের মজাই আলাদা। এই যেমন বৃষ্টি হচ্ছে এসময় চা টা আলাদা একটা ব্যাপার, আলাদা একটা আবেগ। আর পাশে যদি প্রিয়জন থাকে তাহলে তো কথায় নেই।”
জয়ের কথায় ঐশী ভ্রু উঁচিয়ে একটা মুখভঙ্গি করে। যা দেখে জয় হেসে ফেলে ঐশীও মুখে হাসি নিয়ে বাইরে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এবার জয় ঐশীকে দেখছে। মেয়েটা যখন চায়ে চুমুক দিয়ে চা টা গিলে তখন তার ঠোঁটের কোণে আবার ওই ভাজটা পড়ে। জয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঐশীকে দেখছে। গ্রীলে মুখ লাগিয়ে রাখায় বৃষ্টির ছাঁটা ঐশীর মুখে পড়ে মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। পানির ফোঁটা গুলোকেও এখন জয়ের হিংসে হচ্ছে। তার বুকটা হু হু করে উঠে। কবে বিয়েটা হবে।
আস্তে আস্তে জয়ের নজর তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। এই নজরে কেবল ঘোর। জয়ের মাথা ঝিমঝিম করা শুরু করে দিয়েছে। শ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে এখানে থাকাটা আর ঠিক হবে না। এবার তার যাওয়া উচিত। না হলে আবার কোনো উল্টাপাল্টা কাজ করে ফেলবে। বিয়ের আগে এসব কিছু সে মোটেই করতে চায় না। কিন্তু এই মেয়ের সামনে এলে তার সব নীতিবাক্য হাওয়া হয়ে যায়।
ঐশী হুট করে জয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে জয় চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। ঐশী জয়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। জয় প্রায় প্রায়ই এমন করে, এরপর শুরু হয় তার অদ্ভুত ব্যবহার। ঐশী ভাবে আজকে জয়ের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলবে। সে হুট করে জয়কে ডেকে উঠে।
“ ডাক্তার সাহেব? ”
জয় চমকে উঠে। চোখ খুলে ঐশীর দিকে তাকিয়ে কোনোরকমে গলা দিয়ে বের করে,
“ হুম.. হুমম।”
“ আর ইউ ওকে?”
“ ইয়াহ। আমি একদম ঠিক আছি। কি হবে আমার?” -জয় আমতা আমতা করে বলে।
“ আমি প্রায় সময় খেয়াল করেছি আপনি খুব অদ্ভুত ব্যবহার করেন। আপনার কি কোনো সমস্যা আছে? ”
“ সম..সমস্যা মানে? কেমন সমস্যা?”
“ সেটা তো আপনিই ভালো জানেন। আপনার কি শ্বাস নিতে সমস্যা হয়?”
জয় একটা জোর নিশ্বাঃস ফেলে। চায়ের কাপটা পাশের ছোট্ট টেবিলে রেখে ঐশীর দিকে ঝুঁকে বলে,
“ আগে এই সমস্যা ছিল না জানো। কিন্তু তোমার কাছে আসার পর থেকে এমন হয়। এই সমস্যার কারণও তুমি আর ওষুধও তুমি।”
১১১.
ঐশী কাজে ব্যস্ত। আজকে তারা সবাই একটা এতিমখানায় এসেছে। অনিক আর বিজয় বাচ্চাদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। ঐশী সেদিকে তদারকি করছে। যদিও অনেক লোক তবে যেহেতু উদ্যোগটা সে নিয়েছিল তাই সবকিছু তাকে চেক করতে হচ্ছে।
ক’টাদিন তার খুব ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সে চেয়েছিল ছোটো কোনো এতিমখানা যেটার অবস্থা তুলনামূলক বেশি খারাপ। কোনোরকম চলছে এমন একটা এতিমখানায় কিছু সাহায্য করতে।
এই এতিমখানার অবস্থা অনেক খারাপ। পর্যাপ্ত টাকার অভাবে এখানের বাচ্চারা ভালো মতো খেতেও পারে না। এই এতিমখানা রফিকউল্লাহ সাহেব তৈরি করেছেন। তিনি একজন রিটায়ার্ড সরকারি কর্মকর্তা সাথে বিপত্নীক ও নিঃসন্তান। নিজের সারাজীবনের পুঁজি ও পেনশনের টাকা দিয়ে কোনোরকমে এই এতিমখানাটা চালায়। এতিমখানাটায় মোট আটজন বাচ্চা।
তারা বাচ্চাদের জন্য কিছু কাপড়, প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবহার সামগ্রী, আর কিছু খেলনা নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি খাবারের আয়োজন করেছে যেন বাচ্চারা আজকে পেটভরে ভালো মন্দ কিছু খেতে পারে। আর বেশ ভালো একটা এমাউন্ট ডোনেশনেও দিয়েছে।
অল্পসল্প আয়োজনটা বেশ বড়সড় আয়োজন হয়ে গেছে। এসব ঐশীর একার পক্ষে কোনদিনই সম্ভব ছিল না। প্ল্যানটা করার পর ডিপার্টমেন্টের কাছের কয়েকজনকেও বলা হয়। তাদের দেখাদেখি ডিপার্টমেন্টের সবাই এগিয়ে আসে আর যে যেভাবে পারে এতে যোগদান করে। আর সবচেয়ে বেশি হেল্প যে করেছে সে হচ্ছে জয়। এই আয়োজনে জয় এবং তার বন্ধুরাও অনেক বড় একটা অবদান রাখছে। বেশ বড় একটা এমাউন্ট তারাই দিয়েছে।
ঐশীদের আটজনের সাথে ডিপার্টমেন্টের আরও কিছু ফ্রেন্ড এসেছে। বন্ধের দিন হওয়ায় সিয়াম, ফয়সাল, নিতু, রুপা ওরাও এসেছে। জয় সৌরভকে সাথে নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে গেছে।
প্রচুর গরম আবহাওয়া। সূর্য যেন তার সবটা তেজ আজ পৃথিবীতে ঢেলে দিচ্ছে। যদিও হালকা হালকা বাতাস বইছে। তবে তা যথেষ্ট না। জয় সবে জিনিসপত্র নিয়ে ফিরেছে। ঘামে ভিজে তার টিশার্ট একদম জবজবে হয়ে গেছে। শরীর থেকে এমনভাবে ঘাম ঝরছে যেন সবে পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসেছে।
ঐশী রান্না বান্নার তদারকি করতে করতেও বিষয়টা খেয়াল করে। সে তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পানি দিয়ে দুই গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে অনিককে দিয়ে জয় আর সৌরভের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তা দেখে নিতু রুপাকে বলে,
“ বাপ বাহ আমাদের ভাবীর এখনই কতো দরদ দেখ। বরের কষ্ট আর সহ্য হলো না।”
“ এতকিছু সামলিয়েও ম্যাডামের নজর তার দিকে ঠিকই আছে ।” -রুপা আর নিতুর কথায় সবাই হেসে উঠে। ঐশী লজ্জা পেলেও নিজেকে সামলে বলে উঠে,
“ আপু কি যে শুরু করেছেন আপনারা। একটু আগে আমরাও তো খেলাম। আর ওরা মাত্র বাইরে থেকো এলো। তাই আরকি…..”
“ হ্যা গো বুঝছি তো।” – বলেই হেসে উঠে নিতু। তার সাথে বাকিরাও তাল মেলায়।
আসার পর থেকেই নিতু,রুপা, সিয়াম আর ফয়সালের সাথে ঐশীর বেশ ভালো বন্ডিং তৈরি হয়ে গেছে। বিশেষ করে নিতু আর রুপা দুজনেই খুব মিশুক। ঐশীর বিষয় শুনে প্রথমে মনে মনে তারা মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। তবে ঐশীকে দেখে এবং তার সাথে মেশার পর এখন দুজনেরই ঐশীকে বেশ পছন্দ হয়েছে। তাদের মতে ঐশীই জয়ের জন্য পার্ফেক্ট। মেয়েটার মাঝে সত্যিই আলাদা কিছু আছে।
সব আয়োজন একদম খুব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সারাটাদিন সবাই পরিশ্রমের সাথে সাথে অনেক আনন্দও করেছে। প্রতিটা ভালো কাজের পর মানুষের মন এমনেতেই ফুরফুরে হয়ে যায়৷ তেমনি আজকে উপস্থিত সবাই ভিতর থেকে বেশ ফুরফুরে অনুভব করছে।
সিয়াম তো বলেই দেয়,
“ যাক ঐশীর উছিলায় আজ একটা ভালো কাজ করলাম। ভিতরটা শান্তি শান্তি লাগছে। থ্যাংকস ঐশী।”
ঐশী কিছু না বলে কেবল একটা মিষ্টি হাসি দেয়। রুপা বলে,
“ সত্যি রে। খুব শান্তি লাগছে। একদম নির্ভার। প্রতিদিন ওই একঘেয়ে রুটিন আর একঘেয়ে জীবন নিয়ে বেশ হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। আজকে অন্যরকম একটা দিন কাটলো। এইটাই এখন ফুয়েলের মতো কাজ করবে।” -রুপার কথায় সবাই হালকা হেসে দেয়।
সূর্যের তাপ কমে গেছে। সূর্যের এবার যাবার পালা। সব গোছগাছ করে বাচ্চাদের খায়িয়ে, নিজেরা খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই এতিমখানার সামনের ঘাসের উপর গোল হয়ে কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে বসে পড়েছে। জয় এক হাত পিছনে রেখে তাতে ভর দিয়ে একটু একটু করে কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছে আর ঐশীকে দেখছে।
কালো থ্রি পিছে শ্যামরাঙা মেয়েটাকে স্নিগ্ধ ফুটন্ত একটা কালো গোলাপ মনে হচ্ছে। আর মেয়েটার হাসি? সে তো ঘায়েল করা। মেয়েটার কালো রং পড়া একদমই উচিত নয়, একদমই না। জয়ের চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ঘুরিয়ে নেয়।
১১২.
এবার সবার যাবার পালা। সবাই রফিকউল্লাহ সাহেব আর বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়। রফিকউল্লাহ সাহেব সবাইকে দোয়া করে দেয়।
সবার তো আর একসাথে যাওয়া সম্ভব না তাই যে যারমতো করে চলে যাচ্ছে। সিয়ামরা গাড়ি করে চলে যাবে। ঐশীর বাকি ফ্রেন্ডরা একটা অটো ঠিক করে। ঐশী ওদের সাথে যেই যেতে নিবে ওমনি জয় তাকে আটকে দেয়।
“ ঐশী আমার সাথে চলো, আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
ঐশী কিছু বলবে তার আগেই তার ফ্রেন্ডরা এবং নিতু রুপাও জয়ের সাথে যেতে জোর করে। ঐশী আর অমত করার সুযোগ পায় না। ওরা চলে গেলে জয় আর ঐশী দাঁড়িয়ে থাকে। ঐশীর অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুটা ভয় ভয়ও করছে। অচেনা জায়গা তার উপর আবার একা একটা ছেলের সাথে। যতই উড বি হোক, ঐশী এখনও ওকে সেভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারে নি।
ঐশীর ভাবনার মাঝেই জয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“ এবার যাওয়া যাক?”
“ আপনার বাইক কোথায়?”
জয় মাথা চুলকিয়ে বলে,
“ উমম……. বাইক তো আজকে নিয়ে আসি নি।”
ঐশী চোখ বড় বড় করে তাকায়। বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ তাহলে কি দিয়ে যাব এখন? আপনি সিয়াম ভাইয়াদের সাথে চলে যেতেন আর আমি আশাদের সাথে। কেন আটকালেন শুধু শুধু? কি যে করেন না আপনি বোকার মতো। আম্মু বকবে আজকে।”
“ আরে বকছো কেন? আমি তো তোমার সাথে একটু সময় কাটাবো বলে ওদের যেতে বললাম। আমাদের এখন একটু স্পেস দরকার না।”
“ স্পেস না? স্পেস নিয়ে কি এমন করবেন শুনি? সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এখন এমন একটা নির্জন অচেনা জায়গায় আপনি স্পেস দেখাচ্ছেন?”
জয় মুখ ফুলিয়ে বলল,
“ এতো রাগ করছো কেন? স্পেস দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু তুমি আনরোমান্টিক মানুষ ওসব বুঝবে না। দেখ রোদ পড়ে গেছে। রাস্তাটা দেখো কি সুন্দর। এখানে হাটতে ভালো লাগবে, চলো না। মোড় থেকে রিকশা নিয়ে নিব।”
ঐশী এবার চুপ করে রইল। আসার সময় তারও ইচ্ছে করছিল রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে। গ্রামের দিকে হওয়ায় বেশ খোলামেলা আর গাছ-গাছালিতে ভরা। তাই সে আর দ্বিমত করে না। কিন্তু জয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে জয় মুড অফ করে ফেলেছে। হয়তো ঐশীর ওভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয় নি।
তাই ঐশী হাসিমুখে জয়কে বলে,
“ তা ঠিক বলেছেন। আসুন তাহলে। তবে মোড় পর্যন্ত কিন্তু অনেকটা পথ।”
জয় এবার উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
“ আরে গল্প করতে করতে পৌঁছে যাব।” – ঐশী হেসে দেয় জয়ের উচ্ছলতা দেখে। দুজনে পা বাড়ায় পথের দিকে।
১১৩.
জায়গাটা আসলেই সুন্দর। দুপাশে বিস্তৃত ধানক্ষেত। মাঝখানে পিচঢালা পাকা রাস্তা। রাস্তার পাশে সারি সারি রেইনট্রি আর ইউক্যালিপটাস গাছ। খোলামেলা জায়গা হওয়ায় হু হু করে বাতাস বইছে। সেই পথ দিয়ে হেঁটে চলছে দুজন যুবক-যুবতী। যাদের একজনের মনে ভালোলাগা আর ভালোবাসার বসন্ত বাতাস বইছে। আর আরেকজনের মনে ভালোলাগা আর দ্বিধার দোলাচল।
জয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“ ঐশী খারাপ লাগছে?”
“ না না। বেশ ভালো লাগছে। যখন এসেছিলাম তখন খুব ইচ্ছে করছিল এখানে নামার। কিন্তু কাজের জন্য হয়ে উঠে নি।”
“ তাহলে তখন মানা করছিলে কেন?”
“ মানা কোথায় করলাম? কিভাবে যাব সেটা নিয়ে একটু টেনশন করছিলাম। আর সত্যি বলতে আজকে অনেক লেইট হয়ে যাবে । বাসায় এটার কথা জানে না। বাসায় জানে আমি ডান্স ক্লাসে। আম্মু খুব বকবে।” – বলেই মন খারাপ করে ফেলে ঐশী।
জয় বলে,
“ তুমি খুব লক্ষী জানো? তুমি যতই বলো তুমি এখন আর কারো কথার কেয়ার করো না, তোমার আব্বু আম্মু এখন তোমার কাছে ম্যাটার করে না। সত্যি তো এটাই তুমি আজও তাদের ভয় পাও, তাদের কথা তোমার কাছে আজও ম্যাটার করে।” – জয়ের কথায় ঐশী দাঁড়িয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকায় সে জয়ের দিকে। জয় হেসে তাকে হাঁটার ইশারা করে আর বলে,
“ অবশ্য এটা একদিক দিয়ে ভালো। এই ভয় আছে বলেই তুমি এখনও লক্ষী মেয়ে হয়ে আছো।”
“ আর লক্ষী! পুরা চৌদ্দ গোষ্ঠীতে আমার থেকে খারাপ বেয়াদব মেয়ে আর একটা নেই।”
“ লোকের কথায় কি আসে যায়। তুমি নিজে তো জানো তুমি কেমন। তোমাকে যারা বুঝে যারা কাছ থেকে চেনে তারা তো জানে তুমি কি, কতোটা অসাধারণ। আই মাস্ট স্যা ঐশী ইউ আর সাচ এ ডিফারেন্ট গার্ল। তুমি অসাধারণ। খুবই স্ট্রং একটা মেয়ে তুমি। যার বাইরেটা শক্ত ভিতরটা নরম। আর আজকের পর থেকে তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসা আরও বহুগুণে বেড়ে গেছে। আই ফিল প্রাউড অফ ইউ।”
শেষের কথাগুলো জয় ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলে। ঐশীর হাঁটা আবার থেমে যায়। লজ্জা লাগছে তার। গালদুটো লাল হয়ে গেছে, দৃষ্টি স্থির রাখতে পারছে না সে। বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জয় তা দেখে এবার জোরে জোরে হেসে দেয়।
“ ওয়াও! তুমি লজ্জা পেলে তো আরও দারুণ লাগে তোমাকে। ইশশশ ক্রাশ….” – বুকে হাত দেয় জয়। ঐশী তা দেখে জয়ের পেটে হালকা করে একটা ঘুষি দেয়। আর হনহন করে সামনে এগোয়।
এভাবেই খুনসুটি আর বাক্যলাপ করতে করতে মোড়ে চলে আসে তারা৷ সেখান থেকে রিকশা নেয় তারা। ঐশীকে আগে রিকশায় উঠতে বলে। ঐশী রিকশায় উঠে বসে কিন্তু তার উড়নার কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে থাকে। জয় সেটা ঐশীর কোলে তুলে দিয়ে নিজেও রিকশায় চড়ে বসে।
রিকশায় উঠে ঐশী বকবক করতে থাকে। এই প্রথম ঐশী জয়ের সাথে এতো কথা বলছে। আজকে অনেক কিছুই প্রথমবার হলো। আজকে প্রথমবার দুজন এক সাথে সারাটাদিন কাটালো,আজকে প্রথম দুজন এক সাথে এতটা পথ হাঁটলো, আজকে প্রথমবার তারা দুজন এক রিকশায় এতটা কাছাকাছি বসলো। জয়ের ভিষণ ভালো লাগছে। ঐশী হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে, কথার সাথে তাল মিলিয়ে চোখ একবার বড় করছে আবার ছোট করছে। আর জয় হা করে ঐশীর কথা বলা গিলছে। জয়ের মনে হচ্ছে এইসময় কখনো না থামুক। তার মনে মনে বাজছে,
এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
লাল লা লা লা …..
ভেবেই জয় হেসে ফেলে। ঐশীও তখন একটা মজার কথা বলছিল ঐশী ভাবলো জয় হয়তো তার কথা শুনেই হাসছে। তাই সেও জয়ের সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠে। সন্ধ্যালগ্নে দু’জন যুবক-যুবতীর এই সুন্দর মূহুর্তের সাক্ষী হয়ে রইল রাস্তাঘাটের অচেনা ক’জন মানুষ আর প্রকৃতি।
#ক্রমশ…
( কপি করা নিষেধ। কেমন লাগলো জানাবেন। 🥹🥹)