#সূর্যোদয়
#পর্ব_১৭
#কারিমা_দিলশাদ
৪২.
জীবন চলছে জীবনের গতিতে। দিন বদলায়, সময় বদলায়, মানুষ বদলায়। বদলে যাই ভালোবাসা, বদলে যায় সম্পর্ক। মধুর সম্পর্কগুলো তিক্ততায় রুপ নেয়, তিক্ততার সম্পর্ক মধুর সম্পর্কে রুপ নেয়।
ঐশী আগের থেকে এখন আরও ব্যস্ত দিন পার করছে। পড়াশোনা কাজ নিয়ে ব্যস্ত এবং খুশিও। কেবল ওর বাবা মা’র সাথে ওর সম্পর্কটা কেমন জানি স্থির। তবে এতে সে মোটেও চিন্তিত না। এসব তাকে এখন আর ভাবায় না। সবাই জাহান্নামে চলে যাক কোনো সমস্যা নেই। সে তার মতো করে চলবে। অন্যের কথায় কান দিয়ে নিজের শান্তি ন’ষ্ট করার কোনো মানেই নেই।
ঐশী আর জয়ের সম্পর্কেও বদল এসেছে। তবে আদোও এটা কোনো সম্পর্ক কি না জানা নেই। বিষয়টাকে একেবারে সম্পর্কও বলা যায় না৷ যোগাযোগ বা বন্ধুত্ব বলা যায়। স্মৃতি ডান্স ক্লাসে জয়েন হওয়ার পর ঐশী এবং জয়ের মাঝে যোগাযোগ বেড়েছে। বেশ কয়েকবার বসে আড্ডা দিয়েছে, একসাথে চা কফি পান করেছে। এবং অবশ্যই সেটা ঐশীর বাকি ফ্রেন্ড এবং স্মৃতির উপস্থিতিতে। ঐশীর বাকি ফ্রেন্ডদের সাথে জয়ের এখন খুব ভাব। এক অসম বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে এখন সবার মাঝে।
জয়ের মাঝেও বদল এসেছে, তার অনুভূতিতে বদল এসেছে। সবকিছু একদম স্বাভাবিক থেকেও কোথাও যেন একটা কিছু ঠিক নেই। তার মনের হালচাল ঠিক নেই। আজকাল তার দিন রাত কেটে যায় একজনের কথা ভাবতে ভাবতেই। একজনকে নিয়ে চিন্তা করতেই তার ভালো লাগে। তার সাথে কথা বলতেই তার ভালো লাগে। একজনের সাথে কথা বলার বাহানা দেখা করার বাহানায় উন্মুখ হয়ে থাকে। ‘ ঐশী’ -এই নামটা তার জীবনের সাথে কখন কিভাবে যেন জড়িয়ে গেছে। তা তার নিজেরও জানা নেই।
বিগত ৬ মাস ধরে স্মৃতি ঐশীর কাছে নাচ শিখছে। এই ছয় মাসে হাজার ব্যস্ততার মাঝেও প্রায় প্রতিদিন স্মৃতির কলেজ ছুটি হলে ওকে নিয়ে ডান্স ক্লাসে দিয়ে আসে জয়। যার কোনো দরকার নেই, কোনো মানে নেই। স্মৃতি হাজারবার বারণ করে তবে তার জবাবে জয় যুক্তি দেখায় বোনের কষ্ট তার সহ্য হয় না। তাই প্রতিদিন আসে বোনকে ড্রপ করতে। কিন্তু এর আসল কারণ কি তা স্মৃতি বেশ আন্দাজ করতে পারে।
তবে বিষয়টা স্মৃতির এখন আর ভালো লাগছে না। তার ভাইয়ের মনের কথা তার বেশ জানা আছে। যেই ছেলে পুতুল ব্যতিত অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকানো তো দূর অন্য মেয়ের কথা মাথাতেও আনতো না। পুতুলই ছিল যার ধ্যান-জ্ঞান। সে এখন নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে কথা বলার হাজার বাহানা খোঁজে। একটা মেয়েকে দেখার জন্য রোজ রোজ ভরদুপুরের রোদ,বৃষ্টি, জ্যাম উপেক্ষা করে তাকে দেখার জন্য বাহানা খোঁজে। যেই বিষয়টা জয়ের ব্যক্তিত্ব এবং তার বয়স কোনটার সাথেই যায় না। যার কথা বলা, চালচলনে কঠোর আত্মবিশ্বাস এবং স্মার্টনেস ঠিকরে পড়ে সে একটা মেয়ের সামনে গিয়ে বোকাসোকা, নাদান হয়ে পড়ে। এসব কিছুই তার নজরে পড়ে। তবে তার কথা হচ্ছে তার ভাই যদি তার ঐশী আপুকে পছন্দই করে তাহলে এতো দোনোমোনো কেন? ভাই ঐশী আপুকে তার মনের কথা কেন বলে না। এতো দ্বিধা-দ্বন্দের কারণটাই বা কি? এতদিন এই সবকিছু দেখেও সে চুপ ছিল। এবার অনেক হয়েছে, তাই আজ সে ঠিক করেছে জয় ফিরলে তার সাথে এই বিষয়টা নিয়ে সরাসরি কথা বলবে।
যদিও বড় ভাইয়ের সাথে এসব কথা বলা সংগত না। তবে তার আর জয়ের সম্পর্কটা আর পাঁচটা ভাইবোনের মতো দ্বিধা-দ্বন্দের না। যথেষ্ট খোলামেলা, তবে অশালীন নয়। তারা অনায়াসে একজন আরেকজনকে তার মনের সব কথা শেয়ার করতে পারে।
৪৩.
রাতের বেলা,
জয় হাসপাতাল থেকে আজ একটু দেরিতে ফিরেছে। এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু কাজ করতে বসেছে। এরমধ্যেই স্মৃতি এসে নক করে। জয় দরজায় তাকিয়ে স্মৃতিকে রুমে আসতে বলে।
স্মৃতি বিনাবাক্য রুমে এসে বিছানায় জয়ের সামনে বসে তারদিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে। একটু পর জয় বিষয়টা নোটিশ করে। ল্যাপটপ থেকে চোখ উঠিয়ে স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ কি? কিছু বলবি?”
স্মৃতি কেবল মাথা নাড়ায়।
“বল।”
“ তুই ঐশী আপুকে বলে দিচ্ছিস না কেন?”
স্মৃতির প্রশ্নে জয় অবাক হয়ে তারদিকে তাকায়। আর বোকার মতো বলে,
“ কি বলব আমি ওনাকে?”
“ এই যে তুই আপুকে পছন্দ করিস।”
স্মৃতির কথায় জয় যেন আকাশ থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়লো। সে কিছুক্ষণ স্মৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
“ এসব কি বলছিস পাগলের মতো। আমি কেন ওনাকে পছন্দ করতে যাব?”
“ তুই আপুকে পছন্দ করিস না বলছিস?”
“ পছন্দ করি অবশ্যই করি৷ কিন্তু এই পছন্দ ওই পছন্দ না যেটা তুই বলছিস। ওনি খুব অসাধারণ একজন মানুষ ওনাকে অপছন্দ করার তো কোনো কারণ নেই।”
“ দেখ ভাই তুই আপুকে ঠিক কোন পছন্দ করিস তা তুইও জানিস আমিও জানি। তোর কি মনে হয় ঐশী আপুকে দেখলে তোর যেই আচরণ, তোর যেই পরিবর্তন তা কারো চোখে পড়ে না?
এই যে এই বাহানায় ওই বাহানায় তুই যে বারবার ওনার সাথে কথা বলতে চাস দেখা করতে চাস তা কি আমি বুঝি না? ”
“ দেখ স্মৃতি তুই কিন্তু অনেক বাজে কথা বলছিস। এমন কিছুই না৷ এসবই তোর ভুল ধারণা। আর তুই কি বুঝিস পছন্দ অপছন্দের বলতো? এসব মাথা থেকে ঝেড়ে পড়তে বস গিয়ে নাহলে ঘুমিয়ে পড়।”
“ ওহহহ আমার ভুল ধারণা, আমি কিছু বুঝি না! আমি এখন আর এতটাও ছোট নই ভাইয়া, যে এসব বুঝবো না। ঐশী আপুকে দেখার জন্য, তার সাথে কথা বলার জন্য তোর উতলা হওয়া। তার সামনে গেলে তোর নার্ভাসনেস, তোর মুগ্ধতা সবকিছু খুব ভালোভাবে নজরে পড়ে। তার সামনে গেলে তোর মুখ দিয়ে কথাই বের হয় না। কিন্তু তুই তো এমন না? এসবের মানে কি তাহলে? ভাই তুই এতো দ্বিধায় কেন আছিস? কি সমস্যা?”
স্মৃতির কথায় জয় ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আর বলে,
“ স্মৃতি তুই তোর রুমে যা। আমি তোর সাথে এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। মনে রাখিস আমি তোর বড় ভাই। সেটা মাথায় রেখে কথা বলবি।”
স্মৃতিও উঠে দাঁড়ায়। বলে,
“ সিরিয়াসলি ভাই! তুই একথা বলছিস অথচ তুই তো বলতি তোকে বন্ধুর মতো ভাবতে। সব তোর সাথে শেয়ার করতে। আর আজকে তুই একথা বলছিস।”
“ কারণ আমি তোর বড় ভাই। তুই এসব বুঝবি না।”
“ কেন বুঝবো না? তুই আমার বড় বলেই যে কেবল তুই আমার ভালো খারাপ সবসময়ে সাথে থাকতে পারবি আর আমি ছোট বলে তোর খারাপ সময়ে সাথে থাকতে পারব না এটা কোথায় বলা আছে? তুই আপুকে বলে কেন দিচ্ছিস না সেটা বল। ”
“ স্মৃতি তুই বুঝতে পারছিস না। এটা হয় না। সম্ভব না এটা আর।”
“ কেন সম্ভব না? তুই কোনদিক দিয়ে খারাপ? আর এমনও তো নয় যে আপু তোর মতো কোয়ালিফাইড না বলে তুই এমন করছিস। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
“ কারণ আমি তার যোগ্য না। সে আরও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে স্মৃতি। সে সাধারণের মধ্যে থেকেও অসাধারণ। সে সব বিষয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আর আমি নিজেকেই চিনতে পারছি না। আমি সবকিছুতেই আজকাল হীনমন্যতায় ভোগী, সবকিছুতে কনফিউজড। নিজের অনুভূতি, ভালো লাগা, খারাপ লাগা, উচিত অনুচিত কোনো কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছি না। সে এমন কাউকে ডিজার্ভ করে যে তাকে সবটা দিয়ে ভালোবাসতে পারবে। আর আমার দ্বারা সম্ভব না তাকে সেই ভালোবাসাটা দেওয়ার। আমি তো এটাও জানি না তার প্রতি আমার এই অনুভূতিগুলোকে কি নাম দেওয়া যায়।”
একদমে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ দম নেয় জয়। এরপর বলে,
“ প্লিজ স্মৃতি তুই এসব নিয়ে আর কথা বলিস না। মাথা ঘামাস না এসব নিয়ে। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দে। আমার আরও সময় দরকার। ”
স্মৃতি কিছুক্ষণ মাথা ঝাকায়। তারপর বলে,
“ ঠিক আছে নে। সময় নে। কিন্তু সময় নিতে নিতে যেন আবার আগেরবারের মতো দেরি না হয়ে যায়। আমিও আর এগুলো নিয়ে কখনো কোনো কথা বলবো না। মাথাও ঘামাবো না।” — বলেই স্মৃতি হনহন করে বেরিয়ে যায়।
পিছনে রেখে যায় স্তব্ধ জয়কে। স্মৃতির প্রথম কথাগুলো বারবার তার কানে বাজছে। “ আগেরবারের মতো দেরি না হয়ে যায় ” “ আগেরবারের মতো দেরি না হয়ে যায়”…….. জয় নিজের মাথার চুলগুলো খামছে ধরে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। কি করবে কি করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার কাছে।
#চলবে………….
( কপি করা নিষেধ। তবে শেয়ার করতে পারেন।)
[ বি:দ্র: যারা আমার পেজে আছেন তারা প্লিজ গল্প পড়ে রিয়েক্টের পাশাপাশি আপনাদের ভালো লাগা খারাপ লাগাগুলো প্রকাশ করবেন। এবং অন্যদেরকেও পড়তে আগ্রহী করুন। ধন্যবাদ। 😊😊]