সূর্যশিশির
৩৩.
রুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার কোমল দেহ মানুষরুপী এক পশুর থাবায় ছিন্নভিন্ন। রুমির নিদারুণ যন্ত্রণা দেখে বাকরুদ্ধ পুরো পরিবার।
সারারাত বিলাপ করে এখন মৃতের মতো হাত-পা সোজা করে ঘুমাচ্ছে। রূপা পুলিশকে ব্যাপারটা জানানোর সিদ্ধান্ত নিলে, সুমনা প্রতিবাদ করলেন। আশ্চর্যজনকভাবে, বারেকও তাতে সম্মতি দিলেন।
তাদের ভাষ্যমতে, পুলিশের কাছে গেলেই ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়বে। এতে রুমির তো কখনো বিয়ে হবে না সেইসঙ্গে বাকি ছেলেমেয়েদেরও সমাজে বেঁচে থাকাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। কেউ মূল্য দিবে না।
রুমি যতক্ষণ না জাগে পুরো ঘটনা জানা যাবে না। রূপা নিজের রুমে বসে অপেক্ষা করছে, কখন রুমি জাগ্রত হবে। দুপুর দুটো থেকে ইফতারের আয়োজন শুরু করতে হবে। এখন বাজে সকাল এগারোটা। ফোনকলে রূপার ধ্যান কাটল।
অরুনিকা কল করেছে।
রূপা ফোন কানে তুলেই বলল, “আংকেল চলে গেছে?”
অরুনিকা বলল, “হু, চলে গেছে। আজ বিকেলে আসতে পারব না। মা অনেক রেগে আছে।”
“আসতে হবে না। ভিডিও কলে কথা বলব। তুই মন দিয়ে পড়ছিস? আগামী মাসে এডমিশন মনে আছে?”
“আছে বাবা। এখন শোন, লেকে তোর জন্য হিরণ অপেক্ষা করছে। তুই গিয়ে দেখা করে আয়।”
রূপার টনক নড়ল। বিয়ের ঘটনা আর রুমির আগমনে হিরণের সঙ্গে দেখা করার কথা মনেই ছিল না৷
রূপা দ্রুত কল কেটে সাইকেল নিয়ে লেকের দিকে যায়। আজ লেকে মানুষজন খুব কম। যে কয়জন আছে নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। চারপাশে সুনসান নীরবতা। সারারাত জাগার পর সবাই ঘুমাচ্ছে। রূপা হিরণের নাম্বারে কল করল।
ওপাশ থেকে হিরণ বলল, “বলুন রূপা।”
আজ কণ্ঠস্বরটা অন্যরকম লাগছে! নাকি ঠিকই আছে?
রূপা বলল, “আমি লেকের পাড়ে। আপনাকে তো চিনি না। পরনে শার্ট, গেঞ্জি নাকি পাঞ্জাবি?”
“গ্রে রঙের শার্ট। আমি বোধহয় আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।”
রূপা ডানে-বামে তাকাল। তারপর পিছনে তাকাল। ধূসর রঙের শার্ট পরা এক সুদর্শন যুবক কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রূপা ধীরকণ্ঠে বলল, “আপনি কি আমার পিছনে?”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ফোন প্যান্টের পকেটে পুরে রূপার দিকে এগিয়ে এসে হাস্যমুখে বলল, “এখন সামনে।”
প্রথম সাক্ষাতেই অরুনিকার জন্য হিরণকে পছন্দ হয়ে গেল রূপার।
সে প্রত্যুত্তরে বলল, “আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?”
হিরণ দুই হাতে চুল ঠিক করতে করতে বলল, “অরুনিকা গতকাল বলেছিল, রূপা এটা পরে, ওটা পরে — রূপা দেখতে এরকম, ওরকম। বেশ কিছুদিন হলো ওর সঙ্গে আমার কথা হয়৷ সারাক্ষণ আপনার কথাই বলে। তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি।”
ছেলেটার কথাবার্তা চঞ্চল!
রূপা বলল, “চলুন, ওদিকে গিয়ে বসি।”
দুজন গিয়ে লেকের পাড়ের বেঞ্চে বসল। এক কোণে হিরণ, অন্য কোণে রূপা।
হিরণ সোজা প্রসঙ্গে এসে বলল, “কী কী প্রশ্ন করবেন করুন।”
রূপা অবাক হয়ে বলল, “প্রশ্ন?”
হিরণ হেসে বলল, “অরুনিকা বলেছে, সে কার সাথে মিশছে সেটা নাকি রূপা খুব যাচাই-বাছাই করে দেখে৷”
“তা ঠিক বলেছে। কিন্তু যাচাই-বাছাই তো আড়াল থেকে করব, সরাসরি না।” বলেই হাসল রূপা।
“আপনি কোথায় যেন থাকেন?”
“সুজাত বাজারের নয় নম্বর গলিতে। আপনার ফাইনাল কবে?”
“কিছুদিনের মধ্যে। কিছু খাবেন?” পরক্ষণে জিভ কামড়ে বলল, “সরি, আজ রোজা মনে ছিল না।”
“আপনি কি রোজা রাখেননি?”
“রেখেছি। আসলে হয় কী, রোজার প্রথম ছয়-সাতদিন মনে থাকে না যে রোজা রেখেছি। যখন বয়স কম ছিল, ভুলে খেয়েই ফেলতাম।”
“অরুনিকা তো এখনো ভুলে খেয়ে ফেলে।”
“তাই নাকি? ও এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছে।”
রূপা পরখ করে হিরণকে দেখছে৷ সুদর্শনের যে সংজ্ঞা তার সবটাই হিরণের মধ্যে আছে। কথাবার্তা শুনে ভালো মনে হচ্ছে। মিশুকও বটে।
রূপা বলল, “আপনার গ্রামের বাড়ি?”
“যশোরে। এখানে পড়াশোনার সুবাদে থাকা হয়।”
“সুজাত বাজারে অরুনিকা আপনাকে দেখেছিল — ”
“বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারাম খেলতে গিয়েছিলাম।”
রূপা গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, “ওখানে বদমাশ ছেলেদের আনাগোনা বেশি। জায়গাটা এড়িয়ে চলবেন।”
“সেদিনই শুধু গিয়েছিলাম৷ আমি ভালো করে জায়গাটা চিনিও না।”
“খারাপ জায়গা না চেনাই ভালো। আপনারা ভাইবোন কয়জন?”
“চার ভাই, দুই বোন।”
“যৌথ ফ্যামিলি?”
“হ্যাঁ, যৌথ।”
“আপনি কত নাম্বার?”
“আমি পাঁচ নাম্বার। আমার ছোট একটা বোন আছে।”
বেশ কিছুক্ষণ তাদের আলাপ-আলোচনা চলল।
রূপার প্রাথমিক দেখা শেষ। ছেলেটা খালি চোখে দারুণ। এবার পিছনের খোঁজখবর নিতে হবে।
বলল, “এখন আসি তাহলে, অনেক কাজ বাকি। অরুনিকা ছাদে গেলে, এটা দিবেন।”
একটা কিটক্যাট এগিয়ে দিল; অরুনিকার খুব পছন্দের চকলেট।
হিরণ ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল, “অবশ্যই।”
রূপা কিছুদূর এসে অরুনিকার ফোনে বার্তা পাঠাল — তোর হিরণকে আমার পছন্দ হয়েছে।
তারপর সাইকেলে চড়ে চলে আসল হোটেলে। বারেক গুমোট মুখে বসে আছেন।
রূপা গিয়ে প্রশ্ন করল, “রুমি জেগেছে?”
বারেক বললেন, “জ্বর অনেক। ওর জ্বরটা মাপা দরকার, ডাক্তার দেখানো দরকার।”
“চলেন নিয়ে যাই। এভাবে তো মরে যাবে।”
“এখন বের করলে মানুষজন দেখবে না?”
রূপা বিরক্ত হয়ে বলল, “এতো মানুষজনের কথা ভাবেন কেন আব্বা? ওরা আমাদের খাওয়ায়?”
“সমাজ ছাড়া কি বাঁচা যায়?”
“অন্তত বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে যেতে দেন।”
“রুমির চোখেমুখের দাগ দেখে প্রশ্ন করবে।”
“দূরের ডাক্তার নিয়ে আসলেই তো হয়। তারা তো আর আমাদের চিনে না৷ আমি যাচ্ছি।”
রূপা আর বারেকের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করল না। সাইকেলে উঠতে গিয়ে পিছনে দেখল, ফাইয়াজ আসছে। সে দাঁড়াল না, চলে গেল।
ত্রিশ মিনিটের মাথায় একজন ডাক্তার নিয়ে বাড়িতে আসল৷ ধরা পড়ল, রুমির একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর৷ এরইমধ্যে জেসমিন এলো বাড়িতে।
তার থেকে লুকোনোর কিছু নেই বলে লুকাল না সুমনা।
জেসমিনও পরামর্শ দিল, পুলিশকে জানাতে, সেই ছেলেকে খুঁজে বের করতে৷ রূপা বলল, “রুমি সব বলুক, তারপর আমি যা করার করব।”
ইফতারের পূর্ব মুহূর্ত। রূপা সবেমাত্র অবসর পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আযান পড়বে৷
তখন সুজন রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল, “ওস্তাদ, দুলাভাই আইছে।”
রূপার বুঝতে কিছুটা সময় লাগল, সুজন সম্বোধন স্যার থেকে দুলাভাইয়ে স্থানান্তর করেছে! সে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল৷ ফাইয়াজ সবসময় দরজার বাহির থেকে কথা বলে। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখুনি, একটা মুখ উঁকি দিবে৷ কিন্তু না, উঁকি দিল না। সোজা
রান্নাঘরে ঢুকে গেল। রূপা প্রথমে ভড়কে গেল৷ পরক্ষণেই মনে হলো, লোকটা আর তার স্যার নয়।
ফাইয়াজ দুটো ম্যাংগো জুস একটা চেয়ারের উপর রেখে অন্য চেয়ারে বসে বলল, “তোমাদের
ইফতার নাকি সুস্বাদু। অনেক প্রশংসা শুনেছি।”
রূপা বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল, “আপনাদের বাসায় তো পাঠানো হয়েছে।”
ফাইয়াজ থতমত খেয়ে গেল এই কথায়। ভেতরকার প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দিল না৷
বলল, “আমি দেখিনি।”
রূপা অ্যাপ্রোন খুলে তাড়া দিয়ে বলল, “দ্রুত যান, আযান পড়ে যাবে।”
“দ্রুত কেন যাব?”
“ওমা, ইফতার করবেন না?”
“আমার জানামতে তো রেস্টুরেন্টে খাবার-দাবার থাকে!”
রূপা কিছু বলার আগে বারেক বিশাল বড় প্লেটে ইফতার সাজিয়ে নিয়ে এলেন। ফাইয়াজের সামনে রেখে বললেন, “অসময়ে এলে, বেশিকিছু করতে পারিনি।”
এলাহি আয়োজন দেখে ফাইয়াজ এবার অপ্রতিভ হয়ে ওঠল। সে রূপার সঙ্গে প্রথম রোজার প্রথম ইফতার করতে চেয়েছিল মাত্র। এজন্যই আসা৷ নয়তো আসত না৷
ইতস্তত করে বলল, “এতকিছুর প্রয়োজন ছিল না আংকেল।”
বারেক বিগলিত হেসে বললেন, “এ আবার তেমন কী? রূপা, বাবাজির যা যা লাগে হাতের কাছে এগিয়ে দে। কিছুর কমতি যেন না পড়ে।”
রূপা মাথা ঝাঁকাল। বারেক চলে যেতেই ফাইয়াজ বলল, “এতকিছু কী করে খাব?”
“এইটুকু খাওয়া অসম্ভব কিছু না।”
ফাইয়াজ হাসল। বলল, “আমার সামনে চেয়ার নিয়ে বসো। এতকিছু আমি খেতে পারব না।”
রূপা বলল, “আমার ইফতার আছে। আপনি খান।”
আযান পড়ছে। ফাইয়াজ তাড়া দিল, “দ্রুত বসো।”
রূপা বসতে না চাইলে ফাইয়াজ হাতে ধরে টেনে বসাল। এক প্লেটে দুজন চুপচাপ ইফতার করল। খাওয়ার মাঝে দুজনের মধ্যে কোনো কথা হলো না৷
খাওয়া শেষে ফাইয়াজ বলল, “এতো কম তো পিঁপড়াও খায় না। সারাদিন রাঁধো, খেতে পারো না?”
“আমার খেতে ভালো লাগে না।”
“কী ভালো লাগে? টইটই করে ঘুরে বেড়াতে?”
লোকটার এই একটা খোঁটা দেয়া ছাড়া কী আর কিছু বলার নেই? রূপা কিছু বলল না। ফাইয়াজ বলল, “রুমি নাকি ফিরেছে? কী অবস্থা ওর?”
“ভালো না, অনেক জ্বর।”
“কী হয়েছিল জানিও। ছেলেটার নাম-ঠিকানা নিও।”
বলতে বলতে সে প্যান্টের পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় পরল।
বলল, “নামায পড়তে মনে চায় না? এভাবে চলবে?”
রূপা মাথা নত করে ফেলল। রোজা রাখলেও সে নামায আদায় করে না৷ এজন্য মাঝেমধ্যে নিজেকে অভিশপ্ত মনে হয়৷ ফাইয়াজ জবাবের আশা না করে বেরিয়ে গেল।
রূপা অবশিষ্ট খাবার ডাস্টবিনে ফেলে, প্লেট ধুয়ে নিল।
রিংটোনের শব্দ হচ্ছে! রূপা এদিকওদিক তাকিয়ে নিজের ফোন খুঁজল। তার ফোনের রিংটোন তো এরকম না! খুঁজে পেল ফাইয়াজের ফোন! ফোনটি হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে লেখা — তানি।
চলবে…