সূর্যশিশির
৩২.
অরুনিকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে, কলিংবেল চাপবে নাকি। রাত বাজে নয়টা৷ বিকেল থেকে এতো রাত অবধি সে হিরণের সঙ্গে ঘুরেছে। কীভাবে যে এতোটা সময় পার হয়ে গেল টেরই পেল না সে। প্রতিটি ঘন্টা যেন মিনিটে রূপ নিয়েছিল! দুজন রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল খেতে৷ ফেরার পথে ফোন কেনার কথা মনে পড়ে। হিরণ ফোন কিনে দিতে চেয়েছিল, অরুনিকা জোরাজুরি করে নিজেই ক্রয় করেছে৷ তবে সিম হিরণের ভোটার কার্ড দিয়েই তুলতে হয়েছে। হিরণের উপস্থিতির রেশ এখনো তাকে ঘোরে রেখেছে৷ এই স্বর্গীয় সুখ এতদিন কোথায় ছিল?
হাট করে দরজা খোলার শব্দ শুনে অরুনিকা হকচকিয়ে গেল৷ আজিজুর চৌধুরী কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি বললেন, “ভেতরে আসো।”
ঝড়ের পূর্বাভাস! অরুনিকা ধীর পায়ে আজিজুরের পাশ কেটে এক ছুটে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
আজিজুর পিছন পিছন গিয়ে দরজায় শব্দ করে চিৎকার করলেন, “বেয়াদব মেয়ে, দরজা খুলো। এতো অবাধ্যতা তুমি কার থেকে শিখেছো? অরুনিকা…আমাকে রাগিও না৷ দরজা খুলো।”
অরুনিকার বুক ধড়ফড় করছে। পাপার চিৎকারকে সে খুব ভয় পায়। কিন্তু আজ কিছুতেই সে বের হবে না৷ বুকে এক হাত রেখে ভাবল, “পাপা, রাত দুটোর ফ্লাইটে চলে গেলেই, বেঁচে যাব৷ তখনই রুম থেকে বের হব, তার আগে না।”
সে দ্রুত শাড়ি পরিবর্তন করে৷ আজিজুর দরজার ওপাশে পাগলা ষাড়ের মতো চিৎকার করছেন।
সহসা অরুনিকার মনে হলো, আজ তারাবির নামাজ ছিল৷ পথে অনেক মুসল্লিদের মসজিদে যেতে দেখেছে তবুও হিরণের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেছে! দ্রুত ফোন নিয়ে রূপার ফোনে বার্তা পাঠাল — রমজান মোবারক দোস্ত।
তারপর অযু করতে গেল৷ ততক্ষণে আজিজুরের চিৎকার, চেঁচামেচি থেমে গেছে। ভাগ্যিস, সেহরির সময় তার মুখোমুখি হতে হবে না।
রূপা বাড়ি ফিরতেই সুমনা পিছু পিছু গিয়ে প্রশ্ন করলেন, “কোথায় গিয়েছিলি বরের সাথে?”
বেশ শান্ত সুরেই প্রশ্ন করেছেন৷
রূপা ফোন রেখে বলল, “সাহানি নদীর পাড়ে।”
“খেয়ে নে এসে। সেহরির রান্নাবান্না —”
রূপা থামিয়ে দিয়ে বলল, “চিন্তা করো না৷ আমি জামাকাপড় পরিবর্তন করে দোকানে যাব। ভোরের আগে ফিরব না।”
“তোর বর যদি মানা করে?”
রূপা সুমনার দিকে তাকাল। তার দুই চোখে আতঙ্ক। রূপা রান্নাবান্নার দায়িত্ব ত্যাগ করলে কী হবে? তা ভেবে অস্থির হয়ে আছেন তিনি।
রূপা আশ্বস্ত করে বলল, ” আমি শুনব না৷ তুমি এখন যাও, আমি শাড়ি পাল্টাব।”
“দোকানে যাবার আগে খেয়ে যাস।”
সুমনা চলে গেলেন। রূপা শাড়ি পরিবর্তন করতে গিয়ে, শাড়িতে ফাইয়াজের গায়ের পারফিউমের ঘ্রাণ পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার স্নায়ুগুলো নতুন উদ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে শাড়িটি নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিল। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে থতমত খেয়ে শাড়ি একপাশে রেখে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।
গেইটের বাইরে এসে বোরকা-নিকাব পরা একটা মেয়েকে দেখতে পায়, ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ বোরকা দেখে মনে হচ্ছে, মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে এসেছে। বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর, মেয়েটি নিকাব তুলল। মানুষটিকে চিনতে পেরে রূপা দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরে বলল, “রুমি!”
রুমি রূপাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল।
রূপা উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, “কোথায় ছিলি? তোর এই অবস্থা কেন?”
রূপা রুমিকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। রুমি ছাড়ছে না, জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
রূপা ডাকল, “এই রুমি? বল আমাকে…”
রূপা এখনো খেতে আসছে না কেন, দেখার জন্য সুমনা বাহিরে এসে দেখলেন রূপা গেইটের বাইরে কাকে যেন জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি উৎসুক হয়ে এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন, “রূপা?”
তাৎক্ষণিক রূপা, রুমি একসঙ্গে তাকাল। রুমিকে দেখে সুমনার চোখ দুটি জ্বলে ওঠে। তিনি অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলেন, “রুমি!”
রূপা কিছু বুঝে উঠার পূর্বে তিনি তড়িৎ বেগে গিয়ে রুমির হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন৷ তার চোখেমুখে প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ।
রুমি কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আম্মা, আম্মা…আমার কথা শুনো।”
রূপা দ্রুত বারেককে কল করল। বারেক রিসিভ করতেই দ্রুত বলল, “আব্বা, রুমি আসছে৷ দ্রুত আসেন।”
সুমনা রান্নাঘর থেকে ভাতের চামচ নিয়ে রুমির চোখেমুখে আঘাত করে বসলেন। রুমি আর্তনাদ করে পড়ে যায়। রূপা দৌড়ে গিয়ে রুমিকে আগলে দাঁড়াল। তার পিঠে চামচের বারি পড়ে।
সে চিৎকার করল, “আম্মা, কী করছো? পাগল হয়ে গেছো?”
রাগে সুমনার শরীর কাঁপছে। এই কুলাঙ্গার মেয়েকে তিনি সহ্য করতে পারছেন না৷ মনে মনে কবর দিয়ে ফেলেছিলেন, এখন কেন আসল? তিনি রাগে কিড়মিড় করতে করতে বললেন, “নিমক হা’রামের বাচ্চা, আমার বাড়িতে আসছে কেন? এই তুই বেরিয়ে যা৷ কালসাপ… তুই বেরিয়ে যা।”
তিনি রূপাকে সহ রুমিকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকেন।
এক পর্যায়ে রূপা অতিষ্ঠ হয়ে ধমকে উঠল, “আম্মা, থামো। আল্লাহর দোহাই থামো।”
রুমি জবুথবু হয়ে কাঁদছে৷ আচমকা সুমনার মারের আঘাতে নাক, মুখ দিয়ে রক্ত নির্গত হচ্ছে। রূপার দেখে ভীষণ মায়া হয়, কষ্ট হয়৷ সে রুমিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “কাঁদিস না। চুপ।”
“তুই ওরে ছাড় রূপা। আমি ওরে আজ জীবন্ত কবর দেব। কোন কলঙ্ক নিয়ে আসছে আমাদের জন্য?”
“এমন নিষ্ঠুরতা করোনা আম্মা। রুমির অবস্থা দেখছো না তুমি!”
সুমনা পাষাণের মতো উচ্চারণ করলেন, “ওর অবস্থাতে আমার যায় আসে না৷ ওর লা’শ বাড়িতে এলে আমি খুশি হতাম৷”
এ কথা শুনে রুমির কান্নার বেগ বাড়ল। রূপা তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “আম্মা রেগে গেলে কেমন হয়ে যায় জানিসই তো। শুনিস না আম্মার কথা। তুই আমার সঙ্গে রুমে চল।”
সুমনা হুশিয়ার করলেন, “খবরদার, তুই ওরে রুমে নিবি না৷ এখুনি বাড়ি থেকে চলে যেতে বল।”
রূপা ঘাড় ঘুরিয়ে প্রতাপ নিয়ে বলল, “তুমি চুপ থাকো আম্মা।”
তারপর রুমিকে তোলার চেষ্টা করে বলল, “উঠ। রুমে গিয়ে বোরকা খুলে জামাকাপড় পরিবর্তন করে খেয়ে নিবি আগে৷ তারপর সব শুনব।”
রুমির হাত-পা কাঁপছে ক্রমাগত। চোখ থেকে জল বেরোচ্ছে৷ সে রূপার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন ছেড়েই দিলেই অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে৷
রূপা জানতে চাইল, “ছেলেটার নাম কী?”
রুমি তার মনোহর দুটি ভেজা চোখ মেলে রূপার দিকে তাকাল। বলল, “পারভেজ। খুব মেরেছে আপা, খুব…” রুমির গলা বুজে আসল।
রূপার অন্তরে একটা আগ্নেয়গিরি লাভা ছুটতে শুরু করে। তার ফুলের মতো সুন্দর বোনকে দুমড়েমুচড়ে ছিঁড়ে ফেলা পারভেজ কে? কেন সে এরকম করল?
রূপা দ্বিতীয় প্রশ্ন করার পূর্বে রুমি বমি করতে শুরু করে।
ঠিক তখনই সুমনার টনক নড়ে। কিছু সময়ের ব্যবধানে রুমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে রূপার বাহুতে।
চলবে…