সূর্যশিশির
১৮.
বাতাসের সঙ্গে সাঁ সাঁ ধ্বনি তুলে ছুটছে রূপার সাইকেল। তার সাইকেল থেকে মোটর সাইকেলটির দূরত্ব অনেক। সে বুদ্ধি করে রোড ছেড়ে গলি ধরে এগোতে থাকে সামনে। রঙ-বেরঙের দালান পাহারা দেয়া রাত জাগা প্রহরীরা মধ্যরাতে একটি মেয়েকে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালাতে দেখে অবাক হয়ে গেল। উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল। রূপার মাথায় ক্যাপ না থাকায় তার লম্বা চুলের ঝুঁটি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে একজন নারী; শুধুমাত্র বেশভূষা পুরুষ মানুষের।
মিনিট দশেক পর গলি ছেড়ে রোডে আসতেই তার পাশ কেটে মোটরসাইকেলটি চলে যাচ্ছিল, রূপা দ্রত জুতা খুলে ছুঁড়ে মারল। বলল, “রাজন মিয়ার পোলা তোরে আমি চিনে ফেলছি।”
জুতাটি সোজা গিয়ে রুমির পিঠে বারি খেল।
মোটর সাইকেলটি নিমিষে রোডের শেষ প্রান্তে চলে যায়। রূপা পিছু নেয়ার মতো আর শক্তি পেল না। পিছু নিয়েও কোনো উপকার হবে না। সে ছেলেটিকে চিনতে পারেনি! আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে মাত্র! যদি সত্যি রাজন মিয়ার ছেলে হয় চিনে ফেলার ভয়ে অবশ্যই রুমিকে নিয়ে ফিরে আসবে। তবে যদি অন্য কেউ হয়? মোটর সাইকেলটিও যেন খুব দামী মনে হলো! এলোমেলো চিন্তায় বিভোর হয়ে রূপা পাড়ায় ফিরে আসে।
পাড়ার মোড়ে বারেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বারেক তাকে দেখে হনহনিয়ে হেঁটে এসে ব্যস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, “ধরতে পারিসনি?”
রূপা নিরাশ ভঙ্গিতে বলল, “না।”
রাতের শেষ প্রহরে রূপা ও বারেক বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসে।
সুমনা বিধ্বস্ত অবস্থায় দুই ছেলে ও ছোট মেয়েকে নিয়ে গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আঁচল মুখে চেপে ধরে রেখেছেন। বাপ-মেয়েকে শূন্য হাতে ফেরত আসতে দেখে তিনি বাড়ির ভেতর গিয়ে প্রবেশ করলেন।
বারেক ও রূপা বাড়ির অভ্যন্তরে এলে, সুমনার গলা থেকে ছিটকে আসে চাপা আর্তনাদ, “রুমি এটা কী করল? আমাদের সম্মানের কথা একটাবার ভাবল না!”
বিপর্যস্ত সুমনাকে স্বান্তনা দেয়ার মতো ভাষা নেই রূপার।
বারেক দূর্বল পায়ে চেয়ার টেনে বসলেন। তার চেহারা অন্ধকারচ্ছন্ন। ঘরের মেয়ে কোনো ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া মানে সমাজে সম্মান হারানো, মাথা হেঁট হওয়া। আগামীকাল এই খবর রটে গেলে তাদের জীবন দূর্বিষহ হয়ে ওঠবে। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন। ভীষণ অসুস্থবোধ করছেন। বুকে চাপ অনুভব হচ্ছে।
সুমনা রূপার দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললেন, “তোর বোন কই গেল রে রূপা?”
রূপা বলল, “শান্ত হও আম্মা। কেঁদো না।”
সুমনা মাথা চাপড়ে বললেন, “কী করে শান্ত হব হ্যাঁ? কী করে শান্ত হব আমি? আগামীকাল যখন সবাই জানবে আমার মেয়ে পালিয়েছে, আমার এই বাচ্চাগুলোর কী হবে? তোর বাপ দোকানে বসলে প্রতি মুহূর্তে মানুষ কথা শুনাবে। সমাজ আমাদের, আমার নিষ্পাপ ছোট ছেলেমেয়েদের উচ্ছিষ্ট বানিয়ে রাখবে। আমি কী করব? রুমিকে এতো আদর করলাম, সবচেয়ে বেশি দিলাম তবুও এমন করল৷ বাবা-মায়ের কথা ভাবল না! এতোটা নিমকহারাম, এতোটা!”
রূপা মুখ ফসকে বলে ফেলল, “তুমিও তো ওর কথা ভাবোনি। জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছো।”
সঙ্গে সঙ্গে সুমনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। কিছু বুঝে উঠার পূর্বে বসা থেকে উঠে রূপার চুলের মুঠি ধরে বললেন, “খুশি হয়েছিস না? খুশি তো হবিই। তোর ভাগের সব রুমিকে দিয়েছি। আজ তো তোর খুশির দিন। তোর উৎসবের দিন। তুই খুশি হবি না তো কে হবে?”
রূপা ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠল। কোনোরকমে বলল, “আমি তোমাদের কথা সবসময় ভেবেছি আম্মা। কখনো ক্ষতি চাইনি। ছাড়ো আমার চুল।”
সুমনা ছাড়লেন না। রাগে-দুঃখে তার শরীর কাঁপছে, শরীর কিড়মিড় করছে। চোখ দুটি অস্বাভাবিক লাল। তিনি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে মানুষ খু’ন করা তার বাঁ হাতের কাজ।
বারেক সুমনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। তীব্র প্রতাপ নিয়ে বললেন, “কিছু হলেই তুমি রূপার গায়ে হাত তুলো কেন? তোমার আদরের মেয়ে তোমার ভুলের জন্য তোমার মুখে চুনকালি দিয়ে পালিয়েছে। এখন সেই চুনকালি মাখা মুখ নিয়ে জীবন কাটাও।”
সুমনা দপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন। বাঁধ ভাঙা ঝর্ণার মতো হুহু করে কেঁদে ওঠলেন। রূপার মাথা ভনভন করছে ব্যথায়। সে অন্যদিকে গিয়ে বসল।
বারেক সুমনার পাশে বসে মৃদু স্বরে বললেন, “তুমি কাঁদলে কী করে হবে? আমি কতটা দূর্বল মনের তুমিতো জানো। কত সহজে ভেঙে পড়ি। এই পরিস্থিতি তো তোমাকেই সামাল দিতে হবে।”
বারেক কথা বলছেন থেমে থেমে। তার বুকের ব্যথাটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাদের পাপের শাস্তি এটা তাই না?”
বারেক কিচ্ছুটি বললেন না। একসময় আবেগের তাড়নায় তিনিও সুমনাকে নিয়ে পালিয়ে এই শহরে এসেছিলেন। যদি এখনের বোধটা যৌবনে হতো, পালিয়ে বিয়ে করার মতো ভুল করতেন না। শেষ অবধি চেষ্টা করতেন পরিবারকে মানানোর।
তিনি চুপচাপ একপাশে বসে রইলেন। আশিক-আরমান সোফায় শুয়ে পড়ে।
হঠাৎ সুমনা কান্না থামিয়ে দৌড়ে দুই তলায় উঠে গেলেন। আকস্মিকতায় উপস্থিত সবাই চমকাল। পিছু নিলো সুমনার। সুমনা তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করলেন রূপার ব্যাগ। ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় ঢুকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখেন, বাকিরাও চলে এসেছে। তিনি সতর্কতার সঙ্গে চারপাশে চোখ বুলিয়ে ব্যাগ রূপার হাতে দিয়ে বললেন, “তুই এখুনি রিনিকে নিয়ে কোথাও চলে যাবি। রুমি যখন ফিরবে তখন তোরা ফিরবি।”
বারেক চিৎকার করলেন, “কী বলছো?”
সুমনা বললেন, “আমি ফাইয়াজের বাসায় বলব, ওদের নানি গুরুতর অসুস্থ তাই ওরা তিন বোন গ্রামে গেছে। আমি চাই না কেউ জানুক, রুমি পালিয়েছে।”
“কিন্তু আমাদের তো নানা-নানি কেউ নেই।” বলল রূপা।
সুমনা খরখরে গলায় বললেন, “নানি থাকতেই হবে কেন? আমি টাকা দিচ্ছি। তুইতো কত জায়গা চিনিস। যেকোনো কোথাও গিয়ে পড়ে থাক। রুমিকে পেলে আমি কল করব, তখন তোরা চলে আসবি। তিন বোন একসঙ্গে পাড়ায় ঢুকবি।”
রূপার ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। সে বলল, “পাগলামি করছো আম্মা। ওরা তো প্রশ্ন করবে, তিন বোনই কেন গেল? তোমরা কেন যাওনি?”
সুমনা এই কথায় থমকালেন। একটু ভেবে বললেন, “তাহলে আমরা সবাই যাব। আমি আর তোর বাপ, আরমান- আশিককে নিয়ে একদিন পর ফিরে আসব। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলব, তোদের নানি অসুস্থ, উনি তিন নাতনিকে ছাড়তে চায়নি। তাই রেখে আসছি। এটাই ভালো হবে।”
সুমনা কারো মতামত না শুনে উন্মাদের মতো নিজের রুমের দিকে ছুটে গেলেন। বারেক ও রূপা বাকহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সুমনা সম্মানের ভয়ে পাগলের মতো আচরণ করছেন। তিনি নিজের মধ্যে নেই। রুমি কার সাথে গেল? কার পাল্লায় পড়ল? সেই চিন্তা সুমনার নেই। তার শুধু চিন্তা সম্মান হারানোর।
কিছুক্ষণ পর তিনি বোরকা পরে আরেকটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। ততক্ষণে বাকিরা নিচ তলায় নেমে এসেছে। সুমনা বারেককে একটা শার্ট দিয়ে তাড়া দিলেন, “এটা তাড়াতাড়ি পরো। ”
রূপা বিরক্ত হয়ে বলল, “আম্মা তুমি পাগলামি করছো। সমাজের ভয়ে চোরের মতো পালাব কেন?”
সুমনা সশব্দে রূপার গালে থাপ্পড় বসালেন। রূপা থাপ্পড় খেয়েও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আরো মারো, যত ইচ্ছে মারো। কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক না। তুমি অতিরিক্ত করছো, পাগলামি করছো।”
“হারামির বাচ্চা, তুই বুঝতেছিস না কেন? মানুষ যদি জানে ঘরের মেয়ে নাগর নিয়ে ভাগছে, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব? পথেঘাটে সব জায়গায় মানুষ কথা শুনাবে।”
সুমনা ভুল বলেননি। এই খবর একবার ছড়িয়ে গেলে তাদের পুরো পরিবারের মানসিক শান্তি সমাজের মানুষ নষ্ট করে দিবে। কিন্তু সুমনার বিপর্যস্ত অবস্থায় করা পরিকল্পনা কতটুকু কাজে দিবে?
রূপা বলল, “আচ্ছা, আমরা চলে গেলাম। এরপর যদি কখনোই রুমিকে না পাই? তখন কী এই পাড়ায় ফিরতে হবে না? কতদিন রিনিকে নিয়ে বাইরে থাকব?”
“তখন বলব, রুমি মরে গেছে৷ গ্রামে কবর দিয়ে আসছি।”
রূপা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল। সুমনা রাগে-দুঃখে এতোটাই বিমূঢ় হয়ে আছেন যে তাকে চেনা যাচ্ছে না। তিনি কীসব বলছেন?
বারেক এই পরিকল্পনার প্রতিবাদ করলেন। তিনি এভাবে পালাতে পারবেন না। আগামীকাল ফাইয়াজ, তার পরিবার ও পাড়ার গণ্যমান্য দুজন ব্যক্তিকে নিয়ে আংটি পরাতে আসবে। এসে যদি শুনে, রুমি বাড়ি নেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ঠিক; কিন্তু তাই বলে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই লুকোচুরি খেলা খেলবেন? কক্ষনো না। তিনি সাফ করে জানিয়ে দিলেন, “আমি তোমার এই ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে নাই।”
উত্তেজিত সুমনা মুহূর্তে বারান্দায় রাখা ব’টি নিজের গলায় ধরে বললেন, “তাহলে সকাল হওয়ার আগে আমার ম’রে যাওয়া ভালো।”
বারেক আঁতকে ওঠলেন। রূপা চিৎকার করল, “কী করছো আম্মা!”
আশিক, আরমান ও রিনি ভয়ে কাঁদতে শুরু করে।
বারেক সাবধান করে বললেন, “সুমনা, ব’টি নামাও। গলায় লেগে যাবে।”
“আমি যা বলি শুনো, নয়তো আমি…”
“যা বলবে তাই হবে৷ তুমি ব’টি নামাও।”
অগত্যা বাধ্য হয়ে তারা সুমনার পরিকল্পনা মেনে নিলো।
ভোর হতে হতে পুরো পরিবার ত্যাগ করে রসন ভিলা।
এই পুরো দৃশ্যটি চিলেকোঠার রুম থেকে অবলোকন করল ফাইয়াজ।
চলবে…
(কপি করা নিষেধ।)