সুতোয় বাঁধা সংসার পর্ব-৪২

0
699

#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া
৪২
নীলার এভাবে পালিয়ে যাওয়া দেখে উল্লাস চিন্তায় পরে গেলো। রাস্তার পাশে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
ড্রাইভার এসে উল্লাসকে বললো স্যার বাসায় ফিরবেন না।
আমি আবার ওই বাসা থেকে ঘুরে আসি।তুমি একটু ওয়েট করো।উল্লাস ছুটে গেলো তরীর বাসায়।ফুলের তোড়া দরজার কাছে রেখে আসলো।একটা ইটের টুকরো দিয়ে দেয়ালে রেখে গেলো।আমি তো ফিরে এসেছি ১বছর পর।তুমি তো আমার জন্য অপেক্ষায় থাকলে না।

কক্সবাজার রিসোর্টে একটা রুমে বসে আছে তরী।কিছুক্ষণ আগে হাঁটতে বেড়িয়েছেন স্বপ্না,তরী সাথে যায়নি।
একটা রুমে তরী নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করালো।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো।
-মেয়ে হলে কি সংসার সামলানো প্রধান কাজ?মেয়েদের নিজের জীবন বলতে কি?
আয়নার প্রতিচ্ছবি একটু হাসলো। আবার তরী প্রশ্ন করলো।
দুনিয়ার সব পুরুষ তো বেঈমান।আমার সাথে বাবার বেঈমানী, অরুনা আন্টির সাথে হাসান সাহেবের স্বার্থপরতা,অহনার সাথে রাসেলের অভিনয়।সবগুলো পুরুষ এক ধাতুতে তৈরি।
জীবনে কোনো পুরুষের দাসী হয়ে থাকবো না।বিয়ে ও করবো না।নিজের পায়ে দাঁড়াবো নিজের একটা পরিচয় তৈরি করবো।অমুকের মেয়ে,তমুকের স্ত্রী,কিংবা কারো মায়ের পরিচয় না আমার নিজস্ব একটা পরিচয় থাকবে।
তরী মনে মনে জেদ করলো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

স্বপ্না হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের কাছাকাছি যায়।একটু দূরে বালির মধ্যে বসে থাকে।এক জীবনে সালমানের সাথে স্বপ্ন দেখতো বৃদ্ধ বয়সে দুজন ট্যুরে যাবে।
ছেলে মেয়েরা তখন সমস্ত দায়িত্ব নিবে নিজেরা নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াবে।
আজ এসেছে তবে একা সাথের সঙ্গী আকাশের তারা।স্বপ্নার চোখ আটকে গেলো দুজন মানুষের দিকে।দূর দেখে মনে হচ্ছে মা আর মেয়ে জল খেলা করছে।
উচ্ছসিত দুজন হুট করে পিঞ্জর ছাড়া পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।
স্বপ্না একটু একটু করে এগিয়ে যেতে চেনা মুখ ভেসে উঠলো।
অরুনা চৌধুরী দেখে তো মনে হচ্ছে তিনিই। স্বপ্না ওদের কাছাকাছি যেতেই পুরো ক্লিয়ার তিনিই অরুনা।

-অরুনা আপা।
নিজের নাম শুনে থমকে যান অরুনা।পরিচিত কেউ নিশ্চিত কিন্তু তিনি তো পরিচিতদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সাহস করে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন স্বপ্না।দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো স্বপ্নাকে।তোহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উনাকে চিনতে পারছেনা।কিন্তু ওর মায়ের এমন আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে প্রিয় কেউ হবে।

-তোহা এদিকে আয়,এই যে উনি তোর স্বপ্না আন্টি।ওই যে তরীর কথা বলেছিলাম উনার মা।
-আন্টি আপনার কথা অনেক শুনেছি।
-তাই বুঝি তোমার মা অনেক গল্প করেন আমাদের।
-মা তো সারাক্ষণ আপনাদের কথা বলেন।
আচ্ছা আন্টি তরী এসেছে ওকে দেখার খুব ইচ্ছে করছে।
-তরী তো এসেছে ও রিসোর্টে আছে।
-তাহলে রাতে আমরা সবাই একসাথে ডিনার করবো।
-আচ্ছা অরুনা আপা, তোহা তো বিদেশে ছিলো।
-অনেক গল্প স্বপ্না আপা,আসো বসে কথা বলি।

দুজনেই দুজনের গল্প জুড়ে বসলো।অনেক গল্পের মধ্যে অরু শুনলো সালমানের করুণ পরিনতির কথা।স্বপ্না শুনলো অরুনা সব ছেড়ে আসার গল্প।

মাগরিবের আযান দিবে তরী আশেপাশে চোখ বোলাচ্ছে মাকে দেখতে পারছেনা।ভয় লাগছে খুব এদিকে রিদ্ধ,রিহান ও ফিরছেনা।
স্বপ্নাকে ফোন দিতে গিয়ে দেখলো ফোন রুমে ফেলে গেছে।
কি করবো ভাবতে ভাবতে রিদ্ধ,রিহান চলে আসলো।
-আপু তুই রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
-সেই বিকেলে মা বাইরে গেলেন এখনো আসছেন না।আমার ভয় লাগছে অচেনা জায়গা যদি মা পথ ভুলে যান।
-তুই রিহানকে নিয়ে রুমা যা,আমি আশেপাশে দেখে আসি।
তরী, রিহানকে রুমে নিয়ে গেলো। রিদ্ধ একটু এগিয়ে যেতেই মাকে পেয়ে গেলো।
-মা,এভাবে একা কোথায় গিয়েছিলে?
-হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম।
-আপু তো ভয় পেয়ে গেছে।
-চল রুমে যাই।

রুমে যেতেই তরী এসে মাকে জড়িয়ে ধরে।
-পাগলি মেয়ে একটা। তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে।
-কি?
-সেটা ডিনারে দেখবি।
রাতে সবাই মিলে বাইরে খেতে গেলো।অরুনা আর তোহা আগে থেকেই ওদের অপেক্ষা করছে।
তরী ওর অরুনা আন্টিকে দেখেই ছুটে যায়।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।অরুনা অনেক আদর করলো তরীকে।
কিন্তু রিদ্ধের এগুলো মোটেই ভালো লাগছেনা।হিমেলদের পরিবারের সাথে নতুন করে কোনো সম্পর্ক হোক সেটা রিদ্ধ চায় না।
খেতে খেতে গল্প করছে সবাই গল্পের ফাঁকে তরী বলে উঠলো হিমেলের সেদিনের ব্যবহারের কথা। তারপর হিমেলের ফোনে কল এসেছিলো হাসান সাহেবের অসুস্থতার।
অরুনা অস্থির হয়ে গেলো হাসান অসুস্থ শুনে।তোহা অল্প করে হেসে উঠলো।
-আচ্ছা মা আমরা মেয়েরা এমন কেনো।সারাজীবন তুমি যে লোকটার কাছ থেকে অবহেলা ছাড়া কিচ্চু পাও নি তার অসুস্থতা শুনেই এতো উতলা।
-একটা পাখি পুষলে তার জন্য মায়া জন্মে।তার প্রতি ভালোবাসা বাড়ে পাখি তো বিনিময় বুঝে না তবুও আমরা বোবা প্রাণীর যত্ন নেই,ভালোবাসি।
আর তোর বাবা তো মানুষ আমার কাছে থেকেছে কত রাত একসাথে কাটিয়েছি। জীবনের মূল্যবান ৩৫বছর একসাথে পার করেছি।ও বিনিময়ে কি দিয়েছে তোয়াক্কা করিনা আমি যে ওকে ভালোবাসি।তাই ওর কিছু শুনলে হৃদয় কেঁপে উঠে।
স্বপ্না একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, সবাই নিশ্চুপ।
-তুমি কি আবার ওই পরিবারে ফিরে যাবে আন্টি।
-না রে মা,ওইখানে আমার প্রয়োজন নেই।হাসান সাহেবের ভালোবাসার রুবি আছেন দেখভালের ত্রুটি হবে না।

**তরীর ফোনে মেসেজ আসলো কলেজ হোস্টেলে থাকার জন্য এপ্লাই করেছিলো।রুম পাওয়া গেছে মেসেজ এসেছে।দু দিনের মধ্যে রুমে উঠতে হবে।
খেতে খেতে স্বপ্নাকে জানালো।
-আমরা তো আরো দু দিন থাকবো।
-এখান থেকে যাবার দিন তোমরা বাসায় যাবে,আমি হোস্টেলেই উঠবো।
-এতো জার্নির পর শরীর মানবে না।
-কিচ্ছু হবে না।টেনশন করো না আমি বড় হয়ে গেছি।
-তোকে চোখের আড়াল করতে ভয় হয়।
-এতো টেনশন করবে না।আমাকে আমার মতো করে সব সামলাতে দাও।
রিদ্ধ মাকে কথা বলতে মানা করলো।রিদ্ধ চায় তরী নিজের দূর্বলতা কাটিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো থাকুক।

দু দিন অনেক সুন্দরভাবে কাটিয়ে ওরা বাসায় ফিরতে রওনা হলো।তরীকে ওর কলেজ হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে ওরা বাসায় যায়।
দরজা খুলতে গিয়ে রিদ্ধ দেখলো শুকিয়ে যাওয়া ফুলের তোড়া।
-রিদ্ধ ফুল রাখলো কে?
-বুঝতে পারছিনা মা।
দেয়ালে কিছু একটা লেখা দেখতে পায় স্বপ্না।
-ইশ কয়দিন বাসায় ছিলাম না।লোকজন বাসাকে বস্তি বানিয়ে দিয়েছে।ইট দিয়ে দেয়ালে লিখে দিয়েছে।রিদ্ধ জল নিয়ে আয় দরজা খুলে পরিস্কার করতে হবে।
স্বপ্না একটু এগিয়ে গিয়ে লেখা পড়লো,সাথে সাথে রিদ্ধকে ডাকলো।
-কিসব লেখা তুই পড়ে দেখ কিছু বুঝতে পারিস কি না।
রিদ্ধ পড়লো কিন্তু কিছুই তো বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ খেয়াল হলো উল্লাসের কথা।
-মা,নিশ্চয়ই উল্লাস ভাইয়া এসব লিখছে আর ফুল রেখেছে।
-ধ্যাত এসব কোন পাগলের কান্ড কে জানে।
স্বপ্না গুরুত্ব না দিয়ে ভিতরে চলে গেলো।

স্বপন কেইস নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করেছে।শেষমেশ সমস্ত সাক্ষ্য নিয়ে আদালতে যায়।স্বপ্না আর রিদ্ধ এসেছে মৃত মানুষটার উপর থেকে মিথ্যা অপবাদ তুলে নিতে।

*সেদিন রাতে সালমান বাইরে কাজে গিয়েছিলো ফিরতে পারেনি।রুমাকে ফোন করে জানায় যাতে ওরা ঘুমিয়ে যায়।
রুমা ঘুমিয়ে যায়,কিন্তু দরজায় কেউ ডাকছে ভেবেছিলো সকাল হয়ে গেছে সালমান এসেছে।চোখে দেখে না তাই রাত কি দিন বুঝার উপায় নেই।
উঠে দরজা খুলে দিতেই দুজন লোক ওকে চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে ফাঁসি লাগিয়ে চলে যায়।

স্বপনের কথাগুলো বানানো গল্প বলছে রুমার পক্ষের উকিল।স্বপন এবার সামনে নিয়ে আসল অপরাধীকে।
অহনার ভাই একমাত্র বোনকে চোখের সামনে আত্মহত্যা করছে দেখে সহ্য করতে পারেননি তিনি।সেদিন প্রতিজ্ঞা করেন রুমাকে শাস্তি দিবেন।রুমার বাসার কাছাকাছি থাকতে শুরু করেন।ঘটনার দিন সালমান বাড়িতে নেই শুনে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে কাজ করান।
লোকটা নিজের মুখে সব স্বীকার করলো।ঘটনা এতেই শেষ না সবকিছু আগে থেকেই জানতেন উকিল নাজমা বেগম।কারণ অহনার ভাইয়ের সাথে উনার প্রেমের সম্পর্ক। তাই সেদিন ভোরে তিনি নাটক সাজালেন রেপ কেইসের নাটক।
আর রুমার মাকে দিয়ে মামলা করালেন।রুমার মায়ের হাতে কিছু টাকা গুজে দিতেই একটার পর একটা মিথ্যা অপবাদ দেয়া শুরু করেন তিনি।

সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হয় সালমান নির্দোষ। অহনার ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ,উকিলের ১০বছরের জেল এবং রুমার মায়ের ৫বছরের সাজা হলো।
তিয়াসকে স্বপ্নার কাছে দেয়া হয়েছে।সবকিছু সামলে স্বপ্না তিয়াসকে নিয়ে বাসায় ফিরে। পুরোনো সব ভাড়াটিয়া কে নোটিশ পাঠালো তিন দিনের মাথায় বাড়ি ছেড়ে দিতে।
রিদ্ধ-মা ভাড়াটিয়া বাসা ছাড়বে কেনো?
-তিয়াসের জীবনে যাতে রুমার চিহ্ন না থাকে।
-মানে কি মা?যার ছেলে তার চিহ্ন থাকবে না।
-এমন মায়ের চিহ্ন থাকলে সন্তানের ভালো হবে না।কেউ যাতে কখনোই তিয়াসকে সত্যিটা না বলে তাই এই ব্যবস্থা করলাম।তিয়াসের মা আমি সবাই সেটাই জানবে তিয়াস ও তাই জানবে।

চলবে
(দুঃখিত আজ শেষ করতে পারিনি আগামীকাল শেষপর্ব পাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here